-আমরা বিয়ে করছি !
তৃষা খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বলল । চোখটা তখনও মোবাইলের দিকেই । মোবাইল টা ছাড়া ও একটা মুহুর্তও কাটে না । কেউ যে মোবাইল টিপতে টিপতে বিয়ের কথা বলতে পারে আমার জানা ছিল না ।
আমি সবে মাত্র কোকাকোলার গ্লাসে একটা চুমুক দিয়েছি সেই সময় তৃষা কথাটা বলল । আরেকটু হলেই আমার মুখ থেকে কোকাকোলা বের হয়ে যেত । অনেক কষ্টে সেটা গিলে ফেললাম । তারপর বললাম
-মানে ? কি বললে ?
-অন্য ভাষায় তো বলি নি । পরিস্কার বাংলাতে বলেছি। বলেছি যে আমরা বিয়ে করছি !
নিজেকে খানিকটা সামলে নিলাম । তারপর বললাম
-তা হঠাৎ আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হল কেন ? তুমি তো জানো আমাদের বিয়ে হলে বাসর রাতেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে । আমি যেমন তেমন তার ধারে কাছেও না ।
-ওসব জানি না । বিয়ে করছি মানে বিয়ে করছি । আর কথা শুনতে চাই না ।
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । কদিন থেকেই তৃষার বাসাতে ছেলে দেখা শুরু হয়েছে । এবার ওকে বিয়ে করতেই হবে এমন কিছু । ওর দাদী নাকি কি স্বপ্ন দেখেছে । তারপরই থেকেই তিনি তার নাতনীকে বিয়ে দিয়ে চান । মায়ের কথা মত তৃষার বাবাও মেয়েকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে ।
আমি বললাম
-তা তোমার বাবার আনা পাত্রে কি সমস্যা !
তৃষা মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকালো । মুখটা খানিকটা সময়ের জন্য বিরক্তিতে ভরে গেল । তারপর বলল
-আর বলো না, ড্যাডের আনা পাত্রদের দের আমি একদম সহ্য হচ্ছে না । তিনজনকে দেখেছি । একেকটার একেক চিজ ! তার ভেতরে দুইজনের ইয়া বড় মোঁচ আছে । তুমি তো জানো আমি মোঁচ কি পরিমান অপছন্দ করি ।
-মোঁচে সমস্যা ? আরে ওরা কেটে ফেলবে । সমস্যা নেই তো ।
-রাখো তোমার কেটে ফেলবে । এমন এমন সব কথা বলেছে । আমাকে নাকি চাকরি করতে দিবে না আমাকে ঘরে থাকতে হবে সংসার সামলাতে হবে । এই... সেই... । আরে বেটা আমি কেবল ঘরের থাকার জন্য এতো কষ্ট করে ডাক্তার হচ্ছি ! আমার পিএইচডির কি হবে !! থাপড়িয়ে সব কটার দাঁত ফেলে দিতে পারলে ভাল লাগতো !
আমি বললাম
-তা আমার দিক থেকেও সসম্যা আছে । তুমি তো জানো আমার কোন কোন জায়গাতে সমস্যা । সেগুলো তো তুমি মানবে না !
তৃষা কিছু টা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো । তারপর বলল
-তোমাকে ঠিক সাইজ করে ফেলবো । সমস্যা হবে না । তোমাকে তো আমি চিনি বেশ ভাল করেই । সুতরাং ....
-কিন্তু আমারও তো রাজি হতে হবে !
-ইস ! ঢং করবা না তো ! আমি জানি তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ । ওরকম মেয়ে তুমি এই দুনিয়াতে কোথাও পাবে না । তৈরিই হয় নি । আর নিজের দিকে লক্ষ্য আছে । দিন শেষে কিন্তু বিয়েই হবে না । শেষে পাড়া প্রতিবেশি কিন্তু ঐ কথা বলবে !
তৃষা ঐ বলবে কি কথা বুঝালো সেটা আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম । বললাম
- কিন্তু তোমার বাবা রাজি হবে ?
-হ্যা হবে না কেন ? ইনফ্যাক্ট সেই কিন্তু আমাকে তোমার কথা বলেছে । বলে অন্য কোন ছেলে নাকি আমাকে ঠিক সামলাতে পারবে না । আমার যা জেদ । তুমি নাকি পারবে ! এমন টা বাবার বিশ্বাস !
আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললাম
-তা তোমার কি বিশ্বাস ?
-উহু । তুমিও পারবে না । তবে ....।
-তবে ?
-তবে অন্য সবার থেকে তুমি মোটামুটি সামলাতে পারবে ! এটাই অনেক !
-বুঝলাম ।
আমাদের কথা চলতেই থাকে । আমি সব সময় একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছি যে যে মানুষটার সাথে আমার মনের মিল থাকে তার সাথে আমার কথা বলতে গেলে কথার কোন অভাব হয় না । তৃষার সাথেও ব্যাপারটা এরকম । ওর সাথে কথা বলতে গেলে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায় বুঝতে পারি না । আমাদের যদিও প্রায় কোন দিক দিয়েই মিল নেই । আমি উত্তরে গেলে তৃষার অবস্থান দক্ষিনে তবুও কোথায় যেন একটা মিল আছে । এই শত দিক থেকে অমিল হওয়াই সম্ভবত একটা বড় মিল ।
আমার সেদিনের কথা এখনও মনে আছে । আমার সাথে কি একটা কথা কাটাকাটি নিয়ে কথা বন্ধ করে দিল ও । আমিও আর ফোন দিলাম না । দেবও না ঠিক করে ফেললাম । তৃষা যেমন জেদী আমিও তেমনই । ও রাগ করেছে আমিও করলাম । একদিন কোন যোগাযোগ হল না । দুইদিনের মাথায় আমার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির । ফোন রিসিভ করে আকাশ থেকে পড়লাম । তৃষার বাবার ফোন । ভদ্রলোক আমার নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছে কে জানে ! সেটা চিন্তা করার সময় পেলাম না । উনি যা শোনালো তা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । তৃষা নাকি আমার সাথে ঝগড়ার পর থেকে সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে সেই সাথে খাওয়া দাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে ।
এটা কোন কথা হল ! আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে সেটা না বোঝা গেল খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতে হবে কেন ? তৃষার বাবা বেশ চিন্তায় আছেন । মেয়ের একগুয়েমী স্বভাবটা তিনি খুব ভাল করেই চেনেন ।
কি আর করা ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । দরজা ভেবেছিলাম বন্ধ থাকবে কিন্তু সেটা খোলা ছিল । আমাকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেও তৃষার মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হল না যেন ও জানতোই আমি আসবো । মোবাইল থেকে খানিকটা চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো তাররপ আবারও মোবাইলের দিকে ফিরে গেল । ওর দিকে তাকিয়ে আমি হেসে ফেললাম ।
-হাসো কেন ? একদম দাঁত ভেঙ্গে ফেলবো হাসলে !
-সেকি দাঁত ভাঙ্গা তো তোমার কাজ না । তুমি এই কাজ কবে থেকে নিলে !
-বাজে কথা বলবা না ।
-তুমি বাজে কাজ করতে করতে পারবে আমি বলতেও পারবে না !
-আবার ?
-আরে আবার কই পাইলা । প্রথমবারই তো । আচ্ছা তুমি বল দেখি আজকালের যুগে কে কারো সাথে রাগ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় ! এমন বেকুবও আছে ?
-এই খবোরদার বললাম ! আমাকে বেকুব বলবা না !
-প্রমান কর ।
-মানে ? কি প্রমান করবো ?
ততক্ষনে তৃষার জন্য খাবার চলে এসেছে । আমি ওর ঘরে প্রবেশের আগেই বলেছিলাম যে কিছু সময় পরেই যেন খাবার যেন পাঠানো হয় । আমি প্লেট থেকে একটা মাংশের টুকরো মুখে তুলতে তুলতে বললাম
-এখান থেকে একটু খাও !
-ইস ! ফ্যাট ! মোটা হয়ে যাবো !
আমি আবারও জোরে হেসে উঠলাম । হাসিয়ে থামিয়ে বললাম
-ডিয়ার, চিন্তা কর না । তুমি একটু মোটা হলেও আমি তোমাকে বিয়ে করলো । একটু মোটা হলেও সমস্যা হবে না ।
-তোমাকে আমি বিয়ে করলে তো !
-তাহলে আমার উপর রাগ কেন করছো ? রাগ করে খাওয়া বন্ধ করেছো কেন ? এ থেকে কি প্রমান হয় !
-কিছু প্রমান হয় না । এই দেখ খাচ্ছি !
এই বলে প্লেট থেকে ফলের একটা টুকরো মুখে তুলে নিল । ওর অন্বেষন সমাপ্ত হল ।
আমাদের মধ্যে সব থেকে চমৎকার ব্যাপারটা ছিল যে আমরা কেউ কাউকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করতাম না । আর আমি ঠিক যেমনটা ওর সামনে তেমন ভাবেই চলতাম ও ঠিক তাই । এই জন্যই হয়তো আমরা একে অন্যের সাথে সব কিছু বলতে পারতাম ! নিজেদের এমন কিছু কথা যা অন্য কাউকে বলা যেত না । জানি না ঠিক কিভাবে ওর সামনে একের পর এক কথা বেরই হয়েই যেত ।
দেখতে দেখতে সব কিছু ঠিক হয়ে গেল । সত্যি সত্যি ওর সাথে বিয়ে হয়েই গেল । আমার কাছে খানিকটা স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিলো । ওর সাথে আমার প্রায়ই কথা হত এই বলে যে যদি ওর সাথে আমার বিয়ে হয় কোন দিন তাহলে নিশ্চিত ভাবেই বাসর রাতেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে ।
তবে মনের ভেতরে খানিকটা অপরাধ বোধ কাজ করছিলো । কারন এই বিয়েতে যে তৃষা রাজি হয়েছে সেটা এমনি এমনি হয় নি । ওকে খানিকটা চাপের ভেতরে রেখে রাজি করানো হয়েছে । নয়তো আমার সাথে বিয়ে বসতে রাজি হত না ।
আসলে ঐদিনের ওভাবে রাগ ভাঙ্গাতে দেখে তৃষার বাবার মনে হয়েছে তার মেয়েকে আমি ছাড়া আর কেউ সামলাতে পারবে না । তাই উনি নিজেই চাচ্ছিলেন যে বিয়েটা যেন আমার সাথেই হোক । তিনি নিজ থেকেই আমাকে ডেকে কথাটা বললেন । উনি উনার মেয়েকে তো ভাল ভাবেই চেনেন ।
কিন্তু এভাবে সোজা সুজি বললে হয়তো কোন দিন তৃষা রাজি হবে না । আমি তখন বুদ্ধি দিলাম কিভাবে এগোলে । তৃষা ঠিক যে যে ব্যাপার গুলো তীব্র ভাবে অপছন্দ করে সেই গুনের ছেলেকে তৃষার সামনে হাজির করতে বললাম । বলাই বাহুল্য ওকে দেখতে আসা সব ছেলে গুলোই আমার আর ওর বাবার ঠিক করা ছেলে ছিল । এবং কি কি বলতে হবে কি কি বললে তৃষা রেগে যাবে সব আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম ! জানতাম যে বিরক্ত হয়ে ওর মনে হবে বিয়ের জন্য আমিই হচ্ছে সব থেকে বেটার অপসন ।
আজকে ফল স্বরূপ আমার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে । কিন্তু মনের ভেতরে খানিটকা অস্বস্থি লাগছিলই । ঠিক করলাম যে এখনই ওকে সকল সত্য কথাটা বলে দিব । জানি হয়তো ফলটা খুব বেশি ভাল নাও হতে পারে । বিয়ের রাতেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতে পারে । তবুও সত্যটা ওকে বলে দিব ভাবছি !
বাসর ঘরের ঢুকে দেখি ও আপন মনে মোবাইল টিপছে । ওর যা সাস্বভাব । আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল
-কি ব্যাপার মুখ গোমড়া করে রেখেছো কেন ?
-না মানে ....
কি বলব খুজে পেলাম না ।
-আমাকে বিয়ে করেছো বলে মন খারাপ ?
-আরে কি বল ?
-নাকি আমাকে ট্রিক্স করে বিয়ে করেছো এই জন্য মন খারাপ ?
আমার মনে হল আমি হয়তো ভুল শুনলাম । কি বলল ও ! তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-তুমি কি ভেবেছো আমি এসব বুঝবো না ? আমাকে এতো বোকা ভেব না । আর তোমার সাজানো দুই নম্বর পাত্রটা যে তোমার বন্ধু সেটা আমি সেদিনই চিনতে পেরেছিলাম । মোচ লাগালেই তো চেহারা বদলে যায় না !
আমি কেবল চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি ! তৃষা বলেই চলেছে ।
-প্রথমে তোমার উপর রাগ হয়েছিল । কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে আব্বুও এর ভেতরে আছে । তারপর মনে হল যে তোমাকে জ্বালানোর ভেতরে মজা । এতো দিন তো তোমার উপর জোর খাটানোর কোন বৈধ উপায় ছিল না কিন্তু এখন আছে ।
আমি আস্তে আস্তে খাটের উপর বসলাম । এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে তৃষা কি বলছে । তৃষা বলল
-এবার তোমাকে পেয়েছি হাতের কাছে । এবার থেকে আমার সব কিছু তোমাকে সহ্য করতে হবে । এবার আর তোমার কোন ছাড়াছাড়ি নাই ।
তৃষার কথায় আমার চিন্তিত হওয়ার কথা কিন্তু কেন জানি আমার চিন্তা লাগছে না । ওকে আমি যতদুর চিনি বলতে পারি যে সামনে জীবনে আমার আসলেই খবর আছে । কিন্তু কেন জানি সত্যি সত্যি চিন্তা লাগছে না । বরং এটা জেনে ভাল লাগছে যে তৃষা ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতো ! এটাই সব থেকে আনন্দের ব্যাপার । তৃষা বলল
-কই ? বসে আসো কেন ? এদিকে এসো আগে একটা সেলফি তুলে নি । বিয়ের প্রথম সেলফি ! আর এখন ফেসবুক আর টুইটার থেকে নিজের রিলেশোন সিপ স্টাটাস বদলায় ! আজ থেকে যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে চ্যাটিং করেছো তো মরেছো । সকাল বলে উঠতে হবে নিয়মিত । নো ওয়েলি ফুড ! ......
তৃষা কি বলে যাচ্ছে আমি আর খেয়াল করলাম । আমি চোখ কেবল ওর দিকে ! সামনের নতুন জীবনের দিকে !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:২৮