ঘড়িতে নটার ছুই ছুই করছে । মীরু কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । আগেই জানতো আজকে দেরি হবে তবে এতো দেরি হয়ে যাবে ভাবতেও পারে নি । এখনও হাতের কাজ শেষ হওয়ার নাম নেই । আজকে ব্যাংক ক্লোজিং । রায়হানকে আসার সময় বলে এসেছিলো যে একটু দেরি হতে পারে । কিন্তু এতো দেরি হবে সেটা বুঝতে পারে নি ।
সমস্যা যদিও রায়হান না । সমস্যা হচ্ছে তার শ্বশুর মশাই । মীরু আর রায়হানের বিয়ে হয়েছে ছয় মাসও হয় নি । রায়হানদের বাসায় মীরুকে সবাই পছন্দ করে কেবল ওর চাকরি করার ব্যাপার টা বাদ দিয়ে । মীরুর শ্বশুর মশাই পছন্দ না যে তার বাড়ির বউয়েরা বাইরে চাকরি করুক । রায়হানের বড় দুই ভাইয়ের বৌয়েরা কেউ ই চাকরি করে না । কিন্তু মীরু করে । সরাসরি কিছু না বললেও মীরুর বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না যে তারা ঠিক কেউ ই ব্যাপারটা পছন্দ করছে না ।
মীরু একবার ভেবেছিলো চাকরিটা ছেড়ে দিবে । কিন্তু রায়হানই নিজেও ওকে চাকরি ছাড়তে মানা করলো । বলল যে মীরু যদি নিজ ইচ্ছা থেকে চাকরি ছাড়তে চায় তাহলে ওর কিছু বলার নেই কিন্তু অন্য কে পছন্দ করলো না এই জন্য যেন মোটেই চাকরি না ছাড়ে । তখনই মীরু একটু বুকে সাহস পেল । ততদিনে মীরু বুঝে গেছে তার ঠান্ডা স্বভাবের স্বামীকে পরিবারের অন্য সবাই কেমন একটু ভয় করে । সমীহ করে চলে । এমন কি শ্বশুর মশাই রায়হানের সামনে কিছু বলে না ।
কিন্তু আজকে আর সম্ভবত আর শেষ রক্ষা হল না । এতো দিন মীরু চেষ্টা করেছে যাতে করে কোন কাজের জন্য কারো কাছে কথা শুনতে না হয় । কিন্তু এতো রাত করে আজকে বাসায় গেলে নিশ্চিত কথা শুনতে হবে । একটু মনটা খারাপই হল । আজকে নিশ্চয়ই রায়হানের কোন কথা বলার থাকবে না । আর আজকের দিনে কাজ শেষ না করে ওঠাও যাবে না ।
নাহ ! মীরু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল । এই চাকরিটা আর করবে না । ব্যাংকের চাকরি ঝামেলা এর থেকে অন্য চাকরি খুজে দেখবে !
যখন হাতের সব কাজ শেষ হল তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে দশটা বাজে । আজকে সত্যিই বাসায় গেলে কত কথা শুনতে হবে কে জানে ! সব ফাইল পত্র এক সাথে করে পিসি অফ করে দিল । একবার মনে হল রায়হানকে ফোন দেয় । তারপর মনে হল থাক । ওকে ফোন দিয়ে আর লাভ নেই । ও একটু আরাম প্রিয় । অফিস থেকে বাসায় এসে শুয়ে শুয়ে বই পড়তে পছন্দ করে খুব । আজও মনে হয় তাই করছে । সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখনই ও গেট দিয়ে বের হয়ে এল তখন যেন একটু মেঘ ডাকা শুরু করেছে । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তেমন একটা মেঘ করে নি । বৃষ্টি হতে দেরি আছে । তবে রাতে বৃষ্টি হবে সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায় । কালকে ছুটি । সকালে আরাম করে ঘুমানো যাবে ।
সকালের ঘুমের কথা মনে হতেই আবারও বাসার কথা মনে পড়লো । রাতে কি হবে সেটার ঠিক নেই ও পড়ে আছে সকালের ঘুম নিয়ে । গেট দিয়ে যখনই বের হতে যাবে তখনই মীরু অবাক হয়ে দেখলো ওদের অফিসের সামনে যে চায়ের দোকানটা আছে সেখানে রায়হান বসে আছে । হাতে একটা চায়ের কাপ আর চোখটা মোবাইলের দিকে । মীরু কিছুটা সময় চুপ করে গেটের কাছে দাড়িয়েই রইলো । এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । রায়হানের চোখ তখনও মোবাইলের দিকেই নিবদ্ধ । ওকে এখনও দেখে নি । মীরু অনুভব করলো ওর চোখটা খানিকটা যেন সিক্ত হয়ে উঠেছে । তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে হাটতে হাটতে ঠিক রায়হানের সামনে গিয়ে দাড়ালো । দেখলো রায়হানের পাশে কয়েকটা শপিং ব্যাগ ! খানিকটা অবাক না হয়ে পারলো না । রায়হান কখনও মার্কেটে যায় না । কেনা কাটা একদম করতে চায় না । আজকে কি এমন দরকার পড়লো যে নিজে নিজেই মার্কেটে কি এমন কি নে আনলো ?
মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মীরু ওর দিকে তাকিয়ে আছে ! এক চুমুকে বাকি চা টুকু শেষ করে দিয়ে বলল
-কাজ শেষ ?
মীরু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল
-কত সময় ধরে বসে আছো ? কখন এসেছো ?
চেহারাতে একটু বোকাবোকা ভাব এনে রায়হান বলল
-এই বেশি না । ঘন্টা খানেক !
-একবার আমাকে ফোন দেওয়া যায় নি ? বলা যায় নি আমি অপেক্ষা করছি !
রায়হান আবারও হাসলো । বলল
-তুমি কাজে ব্যস্ত ছিলে তাই ভাবলাম কি দরকার ! এখানে সময় ভালই কাটছিলো !
-বুঝতে পারছি কেমন ভাল সময় কেটেছে ! তা মার্কেটিং এ গেছিলে মনে হচ্ছে !
রায়হান ততক্ষনে উঠে উরেছে । এদিক ওদিক তাকিয়ে সিএনজি কিংবা রিক্সা খুজতে লাগলো । মীরু মনে মনে বলল সিএনজি যেন না পায় । রিক্সাই ভাল । আজকে রায়হানের সাথে খুব রিক্সাতে চড়তে ইচ্ছে করছে । রিক্সাই পাওয়া গেল ।
একটু একটু বাতাস দেওয়া শুরু করেছে । মীরুর সত্যিই খুব ভাল লাগছিলো । হয়তো বাসায় গিয়ে ওকে কথা শুনতে হবে । তা শুনতে হোক । কিন্তু এখন এই রিক্সা ভ্রমনটা ওর কাছে অন্য রকম ভাল লাগছে । একটু পরেই যেন বৃষ্টি নামবে । প্রিয় মানুষটার হাত ধরে ওর রিক্সায় বসে আছে । মনে হয় এই ভ্রমন যে আর শেষ না হয় । সারা জীবন ধরেই যেন চলে ।
কিন্তু তখনও অবাক হওয়ার খানিকটা বাকি ছিল । মীরু ভেবে ছিলো সরাসরি বোধহয় বাসাতেই যাবে কিন্তু রায়হান যখন ২৭ নম্বরের আলফ্রেস্কোর সামনে রিক্সা থামাতে বলল তখন মীরু অবাক হয়ে বলল
-এখানে থামাতে বললে কেন ?
-ডিনারটা সেরে যাই ।
-কি দরকার ? বাসায় গিয়ে করি । চলে এসেছি তো !
রায়হান বলল
-দরকার আছে !
মীরু অবশ্য আর আপত্তি করলো না । আজকে ওর কেন জানি সব কিছুই ভাল লাগছে । রাতের খাবার শেষ করে যখন ওরা আবারও রিক্সায় উঠলো তখন আসলেই একটু রাত হয়ে গেছে । তবে খুব একটা চিন্তার কোন কারন নেই ।
বাসায় ঢুকার সাথে সাথেই মীরুর শ্বাশুড়ি প্রশ্ন করলো
-এতো দেরি কেন ?
মীরু কি বলবে সেটা প্রথমে ভেবে পেল না । সোফার উপর বসে শশুর মশাই টিভি দেখছে । চোখ টিভির দিকে হলেও তার খেয়াল যে এদিকে সেটা বুঝতে মীরু মোটেই কষ্ট হল না । কেন দেরি হয়েছে সেটা তো ওর জানা আছে । কিছু না বলে রায়হানের দিকে তাকালো ! রায়হান তখন জুতার ফিতে খুলতে শুরু করেছে । মায়ের দিকে না তাকিয়েই রায়হান নির্বিকার কন্ঠে বলল
-মা মার্কেটে গেছিলাম একটু । ওখানে দেরি হয়েছে । আর রাতের খাবার খেয়ে এসেছি । তোমরা খেয়ে নাও ।
মীরুর অফিসে যে দেরি হয়েছে সেটা একবারও মুখেও আনলো না । ব্যাপারটা এমন দাড়ালো যে রায়হান মিতুকে ওর অফিস থেকে নিয়ে গিয়েছে মার্কেটে । সেখান থেকে রাতের খাবার খেতে গিয়ে দেরি হয়েছে । মীরু বুঝতে পারলো কেন তখন রায়হানের কাছে শপিং ব্যাগ দেখেছিলো ! কারো কিছু বলার রইলো না । ছেলের বউকে নিয়ে ছেলে শপিং এ গেছে বাইরে খেয়ে এসেছে । এখানে কেউ কিছু বলতেও পারবে না । মীরু যা ভেবেছিলো তার কিছুই হল না সব কিছু রায়হান আগে থেকে ভেবে রেখেছিলো ।
নিজেকেদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মীরু কিছু না ভেবে রায়হানে জড়িয়ে ধরলো !
-আরে কি হল ?
-থ্যাঙ্কিউ ফর ডু দিস ফর মি !
-আরে তুমি কি অন্য কেউ নাকি !
-আজকে তুমি না থাকলে কি যে হত !
মীরু জানে তাকে অনেক গুলো কথা শুনতে হত । সেটা মীরু মোটেই ভাল লাগতো না । বিয়ের সময়ই মীরুর মনে হয়েছিলো যেমন ছেলে ওর পছন্দ তার কোন কিছুই রায়হানের ভেতরে নেই । কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই মীরুর মনে হচ্ছে ওর ধারনা মোটেই ঠিক ছিল না । বরং মীরু যেমনটা চেয়েছিলো রায়হান যে তার থেকেও আরও অনেক বেশি কিছু ! এমন স্বামীর সবার কপালে জোটে না ! যতই দিন যাচ্ছে রায়হানকে যেন আরও নিজের মত করে ও পেতে শুরু করেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:০৬