মিতুর লিফটের সুইচটা কয়েকবার চাপ দিলো । লিফট টা আটকে আছে নয় তলায় ! বিরক্ত লাগছে ওর । মনে হচ্ছে যেন সব কিছু আজকে থেমে গেছে । লিফট টাও আসছে না । মনে মনে রাগ হল না । যখন তাড়াহুড়া করে তখনই যেন সব কিছু আটকে থাকে !
সিএনজি করে আসার সময়ই মনে হচ্ছিলো সিএনজিটা যেন চলছে না । তার উপর রাস্তায় প্রচুর জ্যাম । ঢাকা শহরের এই এক সমস্যা । এমনিতেই সারাটা সময় এখানে জ্যাম গেলেই থাকে । আর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে এই জ্যাম যেন আর ছাড়তেই চায় না । আজকে সারাটা দিন বৃষ্টি হচ্ছে । সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে । এখনও থামার নাম নেই ।
অনেক জায়গাতে পানি জমে গেছে । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে জ্যাম ।
আজকে মিতুর অফিসে একটু কাজের চাপ ছিল । অফিস থেকে বের হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেছে । তার উপর রাস্তায় জ্যামে আটকে ছিল প্রায় তিন ঘন্টা । সিএনজির ভেতরে বসে থাকতে কয়েকবার মনে হয়েছে বের হয়ে হাটা দেয় । বৃষ্টি না হলে তাই করতো ।
মিতুর বারবার সুমনের কথা মনে হচ্ছে । বিয়ের পর এতো রাত এর আগে কোন দিন হয় নি । এমনিতেও সুমন কথা বলে অনেক কম । আজকে নিশ্চয়ই আরও গম্ভীর হয়ে থাকবে । বাড়ির বউ যদি রাত দশটা পর্যন্ত বাইরে থাকে তাহলে তাহলে সেটা কোন ভাবেই সুখের কোন কথা না । কিন্তু ও কি করবে ! ওর তো দোষ দেওয়া চলে না ।
মাঝে মাঝে মিতুর মনে হয় চাকরি বাকরি ছেড়ে দেয় । ওর প্রায় সব কটা বান্ধবীই তাই করেছে । বিয়ের পর সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে পুরো দমে গৃহিণী হয়ে গেছে । ফেসবুক চেক করতে গিয়ে দেখে আজকে ওর এক বান্ধবী বাসায় ভুনা খিচুড়ী রান্না করছে স্বামীর জন্য । দুজন মিলে এই বৃষ্টি সেলিব্রেট করবে । সেই ছবিও ফেসবুকে দিয়েছে । আর মিতুকে আবার সেই ছবি ট্যাগও দিয়েছে । মিতুর একটু হিংসাই হল । আজকে বাসায় থাকলে ও নিজেও এই কাজ গুলো করতে পারতো । কিন্তু ও এই কাঁদা মাটি মারিয়ে বাসায় যাচ্ছে । সেখানে বাসায় গিয়ে আবার রান্না করতে হবে ।
জানে সুমন কিছু বলবে না । তবুও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে । ফেরার পথে একবার ভাবলো ও বাইরে থেকে খিচুরী কিনে নেয় দুজনের জন্য । কিন্তু সেটা বাতিল করে দিল । সুমন ঠিক বাইরের খাবার পছন্দ করে না । বাইরের মোরগ পোলাও থেকে ওর ঘরের আলু ভর্তাতেই আগ্রহ বেশি !
যখন গলিং বেল চাপ দিল তখন দশটা বেজে দুই মিনিট । আজকে সত্যিই সুমন বিরক্ত হয়ে যাবে । দরজা খুলতেই সুমনের চেহারা দেখতে পেল । বিরক্ত কিনা ঠিক বোঝা গেল না তবে মুখ বরাবরের মতই গম্ভীর ।
মিতু ঘরে ঢুকেই বলল
-সরি ! অনেক দেরি হয়ে গেল তাই না ? রাস্তায় এতো জ্যাম ছিল । আসলে ...
সুমন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে । বুঝতে পারছি আমি । বাধরুমে গিয়ে আগে ফ্রেস হয়ে নাও ।
কন্ঠ স্বাভাবিক দেখে মিতুর মনটা ভাল হয়ে গেল চট করেই । সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি ফ্রেশ হয়ে তারপর খেতে বসি । তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে !
-আচ্ছা সমস্যা নেই । তুমি ধীরে সুস্থে আসো ! এতো তাড়াহুড়া করতে হবে না ।
মিতুর ইচ্ছে সুমনের গালে একটা চুমু খেতে । কিন্তু সংকোচের কারনে সেটা ঠিক পারলো না । ওদের বিয়ে হয়েছে কয়েক মাসই কেবল হয়েছে । এখনও ঠিক সংকোচ জিনিসটা কাটে নি পুরোপুরি । তার উপর সুমন মানুষ হিসেবে খুব চুপচাপ । দরকার ছাড়া বেশি কথা বলে না । তাই ওদের সম্পর্কে এখনও খানিকটা শীতলতা রয়েই গেছে ।
মিতু আরেকবার সুমনের দিকে তাকিয়ে হাসি দিল । তারপর ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেল ।
কিন্তু আজকে মিতুর জন্য অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো । ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হওয়ার সময়ই ভাবছিলো যে এখনই চট করে হালকা কিছু বানিয়ে দিবে সুমনকে । ঘরে আলুর চিপস আছে । সেটা খানিকটা ভেজে দিক । তারপর একটু ভুনা খিচুরী রান্না করবে । এখনও বাইরে বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে । একটু হয়তো রাত হবে খেতে তবে সেটা মন্দ হবে না । তাই ঠিক করে নিল ।
গোসল সেরে আজকে কেন জানি মিতুর শাড়ি পরতে ইচ্ছে হল । চট করে শাড়ি পরে যখন ডাইনিং রুমে এল একটু ছোট খাটো ধাক্কার মত খেল । ওদের ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার ! মিতু তাকিয়ে দেখে খাবারের আইটেমের ভেতরে রয়েছে ভুনা খিচুরী । গরুর মাংসের ভুনা আলাদা ভাবে । রংটা দেখেই মনে হচ্ছে জিনিসটা খেতে স্বাধ হয়েছে । আরও আছে ইলিশ মাস ভাজা গত দিনের মুরগীর মাংসটা বেশ কড়া করে ভাজা হয়েছে, ঝোল শুকিয়ে ফেলা হয়েছে । একটা ভর্তার আইটেমও রয়েছে ! কিসের ভর্তা এটা কে জানে ! আর সালাদ কেটে সেটা চমৎকার ভাবে সাজানো রয়েছে ।
মিতু আর যাই হোক এই টেবিল ভর্তি খাবার আশা করে নি কোন ভাবেই । কিন্তু এসব সব সুমন রান্না করেছে ভাবতেই পারছে না । রান্না ঘর থেকে সুমনকে বের হতে দেখলো । ওর হাতে কোকাকোলার বোতল । ওটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল
-বস । খাওয়া শুরু করা যাক !
মিতুর অবাক হওয়ার ভাবটা তখনও কাটে নি । সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-এসব তুমি রান্না করেছো ?
সুমন কোন কথা না বলে কেবল হাসলো । মিতু বললাম
-আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । তুমি এতো কিছু রান্না করতে পারো ?
জবাবে আবারও সুমন হাসলো । তারপর বলল
-আগে আমি নিজেই রান্না করতাম মাঝে মাঝে । আজকে তোমার আসতে দেরি হচ্ছিলো আর তোমার ঐ বদ বান্ধবী এক আইটেম রান্না করে তার ছবি তুলে এমন ভাব করছে যেন কি না কি রান্না করে ফেলেছে । তাই মনে হল আমরাও একটু রান্না করি ।
মিতু কি বলবে বুঝতেই পারলো না । কেবল অনুভব করলো যে ওর অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে । একটু সংকোচ হলে একটা কাজ করেই ফেলল । সুমনের কাছে কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই বলল
-আমার তো আসার মনে হচ্ছিলো আজকে তুমি রাগ করবে দেরি দেখে !
-কেন রাগ করবো ? মানুষের দেরি হতে পারে না ? আর ঠিক রাগ করি না । তবে তুমি দেরি হলে টেনশন হয় !
আরেকটু শক্ত করেই যেন জড়িয়ে ধরলো সুমনকে । তারপর বলল
-নিজেকে আজকে অনেক বেশি লাকি মনে হচ্ছে !
তারপর মিতু চট করে নিজের মোবাইলটা নিয়ে এল । মিতুর অবশ্য এমন ভাবে ছবি আপলোড দেওয়ার খুব অভ্যাস নেই । তবে আজকে ওর খুবই ইচ্ছে করছে খাবারের ছবি গুলো মানুষকে দেখাতে । মনে হতে লাগলো যে এই ছবি আপলোড না দিলে ওর শান্তিই লাগবে না !
সব গুলো আইটেমের ছবি তুলল একে একে । এরপর সেগুলো ফেসবুকে আপলোড দিয়ে লিখলো "সবাই তো বাড়ির বউয়ের রান্না খায় কিন্তু কজন বউয়ের এমন বৃষ্টির দিনে স্বামী হাতের রান্না খাওয়ার কপাল থাকে" ।
সারা দিনের কাজের ব্যস্ততা আর জ্যামের ভেতরে বসে থাকতে থাকতে মিতুর মনে হয়েছিলো আজকে দিনটা বাজে আর বিরক্তি ভাব নিয়ে শেষ হবে । এমন চমৎকার ভাবে দিনটা শেষ হবে মিতুর ভাবতেও পারে নি । জীবন মাঝে মাঝেই ওদের কে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু দেয় !
মানুষের জীবন গুলো এমনই কিছু ছোট ছোট টুকরো ঘটনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় । কোন কোন ঘটনা তাদের অনেক বেশি আনন্দ দেয় আবার কোন ঘটনা দুঃখ দেয় । এরকম ছোট ছোট দুঃখ আনন্দের দুকরো জীবন দৃশ্য নিয়েই মানুষের বেঁচে থাকা !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪০