-আই ক্যান হেল্প !!
আমি ঐশীর দিকে একটু ভাল করে তাকালাম । এতো সময় মেয়েটার দিকে ঠিক মত তাকাই নি । কেবল হু হা করে যাচ্ছিলাম ! প্রতিবারই মেয়ে দেখতে এসে আমি এমন করেই থাকি । যাকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই তার কথা এতো মনযোগ দিয়ে শোনার কোন কারন নেই ।
কিন্তু যখন সে ঐ কথাটা বলল তখন আমার মনযোগ দিতেই হল । ঐশী আবার বলল
-আমি জানি আপনি বিয়ে করতে চান না । এর আগেও অনেক কজনকে রিজেক্ট করে দিয়েছেন । ব্যাপারটা এরকম না যে আপনার তাদের পছন্দ না । আপনি কেবল বিয়ে করতে চান না । তাই তো !
আমি মেয়েটার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম । বোঝার চেষ্টা করলাম আসলে মেয়েটা কি বলতে চায় ।
বললাম
-কিভাবে হেল্প করবেন শুনি ?
-আপনাকে বিয়ে করে ?
-মানে ?
আমি সরু চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম । মেয়েটা খুব ভাল করেই জানে আমি ঠিক বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী না ! তারপর সে বলছে আমাকে সাহায্য করতে পারবে । কিভাবে করবে ? আমাকে বিয়ে করে ! হাস্যকর লাগছে না ব্যাপার ?
আমি কিছু বলার আগেই ঐশী বলল
-আগে শুনুন আমার কথা ! আপনার মত একই সমস্যা আমারও ! আমারও আসলে বিয়ের ব্যাপারে এলার্জি আছে । এমন না যে আমি ছেলেদের পছন্দ করি না কিন্তু বিয়ে করা মানেই হচ্ছে নিজের স্বাধীনতা খর্ব করা । এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না । ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছিলো কিছু দিনের জন্য । কি বলবো আপনাকে এতোটা ডোমিনেটিং ছিল সে । শেষে ছেড়ে দিলাম । তারপর অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম যে আশে পাশে সব পুরুষই এমন !
-আপনারাও কম যান । একটা ছেলের জীবনে এসে তার জীবনের সব কিছুতে ভাগ বসান । ছেলেটার নিজের লাইফ বলে কিছু থাকে না । সারাটা জীবন যায় আপনাদের চাহিদা পূরন করতে করতে । আর যদি সন্দেহের বাতিক তাকে তাহলে কথাই নাই । স্বামীর লাইফ হেল !
আমি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললাম । ঐশী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল । তারপর বলল
-অভিজ্ঞতা আছে নাকি ?
-এক বার না দুবার !
-তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়ালো ? আমরা কেউ ই বিয়ে করতে চাই না । কিন্তু আমাদের পরিবার এটা ঠিক মেনে নিচ্ছে না ! তাই না ?
-হ্যা ! আমাকে তো ওয়ার্নিং দিয়েছে । বাড়ি থেকে বের করে দিবে !
ঐশী মুখ খানিকটা করুন করে বলল
-আপনার তো ভাল অপশান । আমাকে বলেছে আগামী ছয় মাসের ভেতরে যদি বিয়ে না করি তাহলে সাত নম্বর মাসে যাকে প্রথমে তার সাথে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে । কোন কথা শুনবে না !
আমি বুঝতে পারলাম ঐশীরও ঠিক আমার মতই সমস্যা । এতোদিন ধরে আমি যেমন বিয়ের জন্য না করে এসেছি মেয়েটাও ঠিক একই ভাবে না করে এসেছে । আর আমার থেকে মেয়েটার সমস্যা মনে হচ্ছে বেশি । কারন আমাদের দেশে আমরা ছেলেরা যত সহজে বিয়ের জন্য না করতে পারি মেয়েরা অতটা সহজে পারে না । ভাগ্য গুনে আজকে আমরা দুজন দুজন কে দেখতে এসেছি । আগে তো পুরা পরিবার শুদ্ধ মেয়ে দেখতে যেতাম । আমার রিজেক্টের জ্বালায় এখন কেবল আগে আমাকে একা আগে আগে পাঠাচ্ছে । আমি ওকে বলার পরেই পারিবারিক ভাবে এগোনো হবে ! আমার জন্য অবশ্য সুবিধাই হয়েছে ।
আমি ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলল
-প্লান কি ?
ঐশী খানিকটা দম নিল । যেন কথা গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে । তারপর বলল
-দেখুন আমরা বিয়ে করতে চাই না সেটার কজ আমাদের কাছে আছে । কিন্তু সেটা আমাদের পরিবার মানবে না । তাই না ?
-হ্যা ! আমি বলেছিলাম । কিন্তু কাজ হয় নি ।
-তাহলে তাদেরকে সেটা দেখিয়ে দেই । আমরা আগে বিয়ে করবো । তারপর বিয়ের এক সপ্তাহ পর থেকে দুজন মিলে ঝগড়া শুরু করবো ! বিয়ের ফলে যে যে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো আমরা আমাদের পরিবারের লোকজনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেব । আমার ইস্যুর হবে আপনার সব বিষয়ে নাক গলানো আর আপনার ইস্যু হবে আমার স্বাধীনতায় ব্যাপারে নাক গলানো । এমন ভাবে ঝগড়া শুরু হবে যে পুরো বাড়ি সেটার জানবে ! তারপর যখন আমার আমাদের ডিভোর্স হবে তখন কিন্তু আমাদের হাতে একটা বড় কজ থাকবে দেখানোর মত । কারন সব কিছু তাদের সামনেই হয়েছে । আমরাও বলতে পারবো যে বিয়ে করলে কি অশান্তি হবে !
আমার কেন জানি মনের ভেতরে একটু কেমন কেমন করতে লাগলো তবে বলতে বাধ্য হলাম যে ঐশীর প্লানটা আসলে বেশ ভাল । এতে কাজ হতে পারে । অন্তত বেশ কিছু দিন বাবা মাকে শান্ত রাখা যাবে । আমি আর কিছু না বলে রাজি হয়ে গেলাম ।
বাসায় এসে যখন মাকে বললাম যে মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে তখন মা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল । সব কিছু খুব দ্রুত হতে লাগলো । আমি মনে মনে ঠিক করতে লাগলাম যে কিভাবে কিভাবে ঐশীর সাথে ঝগড়া করবো । ওকেও বলে দিয়েছি ও যেন কিছু কিছু ভেবে রাখে । দুজন মিলেই ঝগড়া করতে হবে এবং সেটা সবার সামনে ।
বেশি সময় লাগলো না । দুই মাসের ভেতরেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল । যদিও মনের ভেতর থেকে সেই অস্বস্থি বোধটা কিছুতেই যাচ্ছিলো না । মনে হচ্ছিলো কোন ঝামেলা হবে না । যতই বলি না কেন বিয়ে অনেক বড় একটা ব্যাপার । অবশ্য তখন আর আমার কিংবা ঐশীর কিছুই করার ছিল না । আমরা যে প্লান বাস্তবায়নের জন্য এগোচ্ছিলাম সেটার থেকে ফিরে আসার আর কোন পথ ছিল না !
বাসর রাতে আমার কাছে কেমন অদ্ভুদ লাগছিলো । সত্যি বলতে কি যতই প্লান করে বিয়ে করি না কেন কনে বেশে ঐশীকে অদ্ভুদ সুন্দর লাগছিলো । আমি খানিকটা সময় মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে রইলাম । তবে রাতে খুব বেশি কথা বার্তা হল না । দুজনের বিয়ের ঝাক্কিতে বেশ ক্লান্ত ছিলাম ! আমি বালিশ নিয়ে সোফাতে শুতে যাচ্ছি দেখে ঐশী বলল
-শোফাতে যেতে হবে না । তুমি এখানেই ঘুমাও !
-না মানে !
-সমস্যা তো নেই ! বিয়ে তো হয়েছেই আমাদের ! তাই না ? পরে যা হবার হবে । আর বেশি অস্বস্থি লাগবে মাঝখানে কোল বালিশ দিয়ে দিচ্ছি !
কথা অবশ্য সত্যি ! ওর সাথে যে সঠিক ভাবে বিয়ে হয়েছে সেটা তো সঠিক । আমি বিছাতেই শুয়ে পড়লাম । এই জন্যই আমি ঠিক বিয়ে করতে চাই নি । কোথাকার কোন মেয়ে আসবে, তারপর এতোদিন যে সব জিনিসের উপর আমার পূর্ন অধিকার ছিল সেটার উপর কব্জা করতে শুরু হবে । নিজের খাটে নিজে শান্তি মত ঘুমাতে পারবো না । নিজের সব কিছুর উপর সেই মেয়ে অধিকার ফলাবে ! এটা হয় কোন দিন !
ভাগ্য ভাল ঐশীর দেখা পেয়েছিলাম । মেয়েটারও আমার মত একই সমস্যা ছিল বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম ! এই সব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুম চলে এল টের পেলাম না ।
সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঐশী পাশে নেই । আগেই উঠে গেছে । আমি ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখি ঐশী সবার সাথে হাসি মুখে নাস্তার টেবিলে নাস্তা খাচ্ছে । ওর মুখের ভাব দেখেই কেমন যেন সেই অস্বস্থিটা আবারও বেড়ে গেল । ওকে দেখেই মনে হচ্ছে অনেক দিন থেকেই ও এই বাড়ির সদস্য ! আমাকে দেখে ঐশী হাসলো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
-ডিয়ার হাসব্যন্ড, আসুন আপনার নাস্তা রেডি !
লাইনটার ভেতরে কি ছিল কে জানে দেখলাম নিলু ভাবী মা হেসে উঠলো । ভাইয়া এমন কি বাবাও হেসে উঠলো ! আমি আসলেই কিছু বুঝতে পারছিলাম না । তবে কিছু যে একটা সমস্যা হয়েছে সেটা বুঝতে পারছিলাম ! ঐশীর পাশের চেয়ারটাই কেবল ফাঁকা ছিল আমি সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম ! সবাই কেমন আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে । এমন একটা ভাব যেন আমি সার্কাসের ক্লাউন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে !
আমি পরোটা মুখে দিয়েছি ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তা কি কি টপিকে ঝগড়া করবে বলে ঠিক করেছো ?
আমার মনে হল আমি যেন দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম ! ভাবী কি বলল কথাটা ! এটা তো তার জানার কথা না ! কথাটা বলেই ভাবী আবারও হাসতে লাগলো । নিলু আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-ভাইয়া তুই বরাবরই গাধাই রয়ে গেলি রে ! এতো সহজে ধরা খেয়ে যাবি ভাবি নাই !
আমার মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বের হয়ে গেল
-মানে ?
-মানে বুঝলি না ? তুই বুঝবিও না ! যাই হোক তোর হয়তো মনে নেই তাই বলছি । ঐশী ভাবী হচ্ছে সাবিহার কাজিন ! সাবিহাকে চিনিস ! আমার ফ্রেন্ড !
আমি কেবল অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । আমার একটুও বুঝতে কষ্ট হল না যে আমার পরিবারের সবাই আসলে সব কিছু জানে । আমি ভেবেছিলাম আমি নিজে পরিকল্পনা করছিলাম কিন্তু আমাকে নিয়ে এরা সবাই এতো বড় প্লান করে আমার বুঝতেই পারি নি ।
ভাবী বলল
-ঐশী তোমাকে প্রথমে দেখে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে । ওদের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাবটা প্রথমে আসে । তোমাকে না জানিয়েই কথা বার্তা হয় । মা বাবা দুজনেরই ঐশীকে খুব পছন্দ হয় ! কিন্তু আমরা ঠিক জানতাম তুমি ঠিক ঠিক ঝামেলা পাকাবে । সেটা আমরা ঐশীর পরিবারের সাথেও বলি ! তারপর ঐশীই বলে সে ম্যানেজ করে নিবে ! তোমাকে রাজি করাবে ! সে তাই করিয়ে দেখেছে দেবস মশাই । তুমি আটকে গেছো !
আমি নাস্তা না খেয়ে উঠে গেলাম । নিজের ঘরে এসে খাটের উপর বসে রইলাম । রাগ হতে লাগলো নিজের উপরেই । আসলেই আমার মনের ভেততে তখনই খানিকটা কু ডেকে উঠেছিলো । তখন যদি শুনতাম ! তাহলে এই ফাঁদে পরতে হত না ! ঠিক করলাম এই বাড়িতেই আর থাকবো না !
যখন উঠতে যাবো তখন দেখি ঐশী ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । সেটা আমার সামনেই খাটের উপর রাখলো ! তাকিয়ে দেখি ফেলে রেখে আসা নাস্তা । আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল
-নাস্তা খেয়ে নাও !
-খাবো না ।
ঐশী শান্ত কন্ঠে বলল
-দেখো তোমাকে আমার শুরু থেকেই পছন্দ ছিল । তাই তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি এসব কিছু করেছি । তোমার বাবা মা পুরো পরিবার আমাকে পছন্দ করে আমি তাদেরকে খুব পছন্দ করি খুব । সো তুমি চাও বা না চাও আমি তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছি । আর আমি বেঁচে থাকতে আমি তোমাকে ছেড়ে কোন দিন যাবো । তোমার সামনে দুটো পথ খোলা আছে এটা মেনে নিয়ে এগিয়ে চল কিংবা না মেনে নিয়ে । তবে আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না এটা শিওর ! আর তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও কিংবা আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও তাহলে .....
এই টুকু বলে ঐশী নিজের ব্যাগের কাছে গেল । আমি দেখলাম সেখানে ও একটা বোতল বের করলো । আমার দিকে তাকিয়ে বললল
-এটা কি জানো ?
-কি ?
-পটাশিয়াম সায়ানাইট !
আমার মুখ হা হয়ে গেল । ঐশী বলেই চলল
-তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও এটা খেয়ে আমি মরে । এমন কি যদি কোন দিন মুখেও আনো তবুও ! যদি বিশ্বাস না হয় এখনই বলে দেখো ।
লাইনটা বলার সময় ঐশীর চোখের পর্দাটা একবারও কাপলো না । আমার একটুও বুঝতে কষ্ট হল না যে বিন্দু মাত্র মিথ্যা বলছে না ।
কি আশ্চর্যের বিষয় !
আমি ঐশীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি ! আমি কোন কথা বলতে পারলাম না । অবশ্য ঐশী আর কিছু জানতে চাইলো না । আবার সেই পরোটা আর মাংশ তুলে দিল আমার মুখে । আমি এবার না করলাম না । করতে পারলাম না । যে ভয়টা পাচ্ছিলা সেটাই হল । সামনের জীবনে এই মেয়ে আমার জীবন ছাপা ছাপা করে দিবে সেই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই ! আর আমি কিছু বলতেও পারবো না !
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৯:৪৪