ভার্সিটির শেষ দিন ছিল । সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলো । নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে এমন কথাও অনেকে দিচ্ছিলো । কিন্তু এখান থেকে বের হলেই সবাই নিজ নিজ যুদ্ধে নেমে পড়বে । নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন অ্ন্য সবার কথা চিন্তা করার সময় কোথায় কারও ।
আমাকে ঘিরে সবার ভীড় ছিল বেশ । ঠিক এক সপ্তাহ পরেই আমার ফ্ল্যাইট । কানাডাতে মামার কাছে চলে যাবো । সামনে আরও কিছু পড়ার ইচ্ছা আছে । সেখানে গিয়ে হবে । এর মধ্যে সব ব্যবস্থাও হয়ে গেছে । তাই সবার সাথে বলতে গেলে আজকেই আমার শেষ দেখা । সবার সাথে দেখা হলেও একজনের সাথে দেখা হল না । জানতাম ও আমার কাছে কোন দিন আসবে না । তাই শেষ বারের মত ইচ্ছে হল একবার দেখা হোক । কিন্তু কোথাও দেখা পেলাম না তার।
আর কোন দিন হয়তো আসা হবে না এখানে, এই ভেবে ক্যাম্পাস টা আরেকবার দেখতে মন চাইলো । সবাইকে রেখেই একা একা হাটতে লাগলাম পুকুর পাড়ের দিকে । ক্যাম্পাসের অবসর সময় গুলো এই পুকুর পাড়েই খুব কাটতো আমাদের । এখানে বসেই আড্ডা চলতো । আমি আরেকটু এগিয়ে যেতেই অপুকে দেখতে পেলাম । বাঁধানো পুকুর পাড়ের রেলিং এর উপর বসে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে ।
আমার জন্য কি ওর মন খারাপ ?
সঠিক উত্তরটা আমার জানা নেই তবে এটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে ।
আমি নিজের চেহারা বেশ ভাল ধারনা রাখি । ক্লাসের অনেকেই আমার বেশ পছন্দ করে এটা আমার কাছে অজানা নয় । ঠিক তেমনি অপুও যে আমার পছন্দ করে এই তথ্যটা আমি খুব ভাল করে জানি । মেয়েরা বুঝতে পারে এসব বিষয় । কিন্তু অন্য সবার থেকে অপুর পার্থক্য হচ্ছে অপু কখন আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টা করে না । আরও ভাল করে বলতে গেলে আমার কাছ থেকে ও যেন একটু দুরে দুরেই থাকতে পছন্দ করে ।
এই পাঁচ বছর আমরা এক সাথে ক্লাস করি । আজ পর্যন্ত ওর সাথে আমার একটা কথাও হয় নি । ফেসবুকে আমাকে অনেকেই নক দিলেও আজ পর্যন্ত ও আমাকে একটা হাই পর্যন্ত বলে নি । আমিও বলি নি কোন দিন । ক্লাসের ৯১ জন স্টুডেন্টের মধ্যে কেবল অপুর সাথেই মনে হয় আমার কথা হয় নি কোন দিন ।
আমি পায়ে পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম । ও যে রেলিং য়ের উপর বসে ছিল সেখানে গিয়ে বসলাম ঠিক ওর পাশেই ও তখনও ঠিক বুঝতে পারে নি যে আমি ওর পাশে এসে বসেছি । আকাশের দিকে তখনও তাকিয়ে কি যেন ভাবছে । আমি কিছু না বলে একটু কাসলাম
ও চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো । খানিকটা অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । এর আগে আমি ওর এতোটা কাছে কোন দিন বসেছি কি না আমার মনে নেই ।
দুজনেই কি বলবো কিছু সময় বুঝতে পারলমা না । কিছু নিরব থাকার পরে অপু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল
-চলে যাচ্ছো তাহলে ?
নিজের বিশ্মিত ভাবটা লুকিয়ে রেখে বললাম
-হু !
-আর আসবা না ?
-ঠিক নেই ।
আমি অপুর চোখের তাকিয়ে খানিকটা অবাক হলাম । ভেবেছিলাম সেখানে আমি বিষণ্ণতা দেখতে পাব অথচ সেখানে তেমন কিছুই নেই । আমি চলে যাচ্ছি জেনেও ছেলেটা কি দুঃখ পাচ্ছে না ? নাকি আমি এতো যেটা ভেবে এসেছিলাম সেটা ভুল । অপু আমাকে ওভাবে দেখেই না হয়তো ! কিংবা ওর হয়তো অন্য কেউ আছে !
আমি বললাম
-যাই ? কেমন ! ভাল থেকো !
-আচ্ছা । তুমিও ভাল থেকো ।
আমি হাটা দিলাম নিজের পথ ধরে । কিন্তু কেন জানি মনের ভেতরে খারাপ লাগা শুরু করলো । কোন কারন নেই তবুও ।
দুই
অবশ্য বাসায় আসার পর থেকে আর খারাপ লাগা ভাবটা থাকলো না খুব একটা । দেখতে দেখতে ফ্লাইটের দিন চলে এল । সব কিছু নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে অন্য কিছু ভাবার সময় ছিল না । কিন্তু যখন বোর্ডিং পাস নিয়ে প্লেনের ভেতরে গিয়ে বসলাম তখন আবারও কেেন জানি সব কিছু মনে হতে লাগলো । বাড়ির কথা, মা বাবার কথা আর ক্যাম্পাসের কথা । অপুর কথাও মনে পড়লো । ছেলেটার চোখের ঐ স্বাভাবিক দৃষ্টিটা আমার কেন জানি মন খারাপ করিয়ে দিল । এমন তো হওয়ার কথা ছিল না । ছেলেটার তো মন খারাপ হওয়ার কথা ছিল । আমি নিজের ভাবনা দেখে নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম ।
আমি চলে যাচ্ছি দেখে অপুর মন খারাপ হয় নি এটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । ছেলেটার মন খারাপ হলে আমার ভাল লাগতো ? আমি নিজের কাছে এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা চাইতে লাগলাম । এসবই ভাবতে ভাবতে প্লেন টেক অফ করার নির্দেশনা চলে এল । আমি সিট বেল্ট বেধে অপেক্ষা করতে লাগলাম । আমার পাশের সিটের টাক মাথার ভদ্রলোককে দেখলাম নির্বিকার ভাবে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে । আমিও কিছু পড়ায় মন দিলাম ।
আরও ঘন্টা খানেক পরে এয়ার হোস্টেস এসে আমাকে অনুরোধ করলো যে আমি যেন এই সিট টা একটু এক্সচেঞ্জেইজ করি । একজন এখানে আসতে চাচ্ছে । তার নাকি এই সিওয়ান সিট টা বেশ পছন্দ । সব সময় এই সিটেই যাওয়া আশা করেন । এবার সিট টা পান নি । যদি আমার কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে আমি যেন বদল করি !
আমার কোন সমস্যা ছিল না । আমি উঠে গিয়ে আরও চার সিট পরে গিয়ে বসলাম । দেখলাম আমাকে ক্রস করে এক মহিলা সেই সিটে গিয়ে বসলো । আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল । তবে সেই হাসিতে কোন কৃতজ্ঞতা সুলভ কিছু ছিল না ছিল খানিকটা দুষ্টামী ভরা দৃষ্টি । আমার কাছে ব্যাপারটা ঠিক কেমন যেন লাগলো ।
আমি নতুন সিটে বসে আবারও হাতের ম্যাগাজিনে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম । নতুন সিটে আমার পাশে কোন যাত্রীকে দেখতে পেলাম না । তবে একটা কালো রংয়ের জ্যাকেট পড়ে রয়েছে সিটের উপর । যাত্রী নিশ্চয়ই ওয়াশ রুমে গেছে । যাক আগের জনের মত টাক মাথা না হলেই হল !
-কি খবর ?
আমি চমকে উঠলাম ! চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি অপু দাড়িয়ে রয়েছে আমার সিটের পাশে । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার পাশে সিটেই বসে পড়লো । বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো যে এই সিট টা আসলে ওর !
আমি অবাক বিশ্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম ! কোন মতে বললাম
-তুমি ?
-হ্যা আমি !
-কোথায় যাচ্ছো ?
-তুমি যেখানে যাচ্ছো ! তুমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে এবং যে সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে যাচ্ছো, যে ক্লাসে ক্লাস করবে সেখানেও তুমি আমাকেই দেখতে পাবে ।
আমি আরও কিছু কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ! অপু আবারও বলল
-তুমি তোমার মামার কাছে থাকবে । যদি ডার্মেটরিতে থাকতে তাহলে দেখতে আমি ঠিক তোমার পাশের রুমে থাকছি ! এমন কিছু তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে যদি কোন দিন বিয়ে করার কথা ভাবও দেখবে তোমার সেই বরের বোন কিংবা কাজিনকে আমি বিয়ে করে তোমার পাশেই হাজির আছি !
একবারে কথা গুলো বলে অপু আবারও হাসলো । আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না । এই জন্য শেষ দিন অপুর মন খারাপ ছিল না । কারন ও আমার সাথেই আসছিলো । আমি কেবল তাকিয়ে রইলাম অপুর দিকে । অপু বলল
-বুঝেছেন ম্যাডাম ! আমার হাত থেকে তোমার কোন মুক্তি নেই ! তোমার পিছু আমি এই জীবনে ছাড়বো না ! তুমি যেখানে
আমি বললাম
-মুক্তি কে চাচ্ছে শুনি ?
আমার হঠাৎ করেই মন অনেক বেশি ভাল হয়ে গেল । অপু নামে এই পাগল ছেলেটা আমার জন্য যদি এতো দুর আসতে পারে আমার কাছাকাছি থাকার জন্য এতো কিছু করতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না ওর সাথে থাকতে। আমার কেন জানি মনে লাগলো দেশের বাইরের জীবনটা আমার চমৎকার কাটতে যাচ্ছে, অপুর সাথে !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ সকাল ৯:৫২