সেই সন্ধ্যা থেকে মিতু জানলার পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও নির্দিষ্ট করে কিছুই দেখছে না। আজকে ওর মন খারাপ। অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে। রাতের আগে কান্না কাটি করা যাবে না। মিতুর আম্মু টের পেলে নানান প্রশ্ন করবে। এখন মিতুর কোন জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না।
পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই পিছন ফিরে তাকালো। মিতু মা এসে বসেছে। নরম স্বরে মেয়েকে বলল
-ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস কেন?
-এমনি মা।
-মন খারাপ?
মিতু কিছু না বলে আবারও জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। মিতুর মা বলল
-সুমন বিসিএসে টিকে গেছে এই জন্য মন খারাপ?
কথাটা শুনার সাথে সাথে মিতু মায়ের দিকে ফিরে চাইলো। মাকে ও যতটা বোকা মনে করতো ততটা বোকা সে নয়। মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মিতুর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল। কিছু না বলে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আসলেই সুমন ভাইয়ার বিসিএসে টিকে যাওয়াতে মিতুর মন খারাপ। কারন এর পর কি হবে মিতু খুব ভাল করে জানে। সুমন ভাইয়া অনেক দিন থেকেই উপর তলার রমিজ আঙ্কেলের মেয়ে নিথিকে পছন্দ করে। নিথি এতোদিন তাকে পাত্তা দেয় নি কিন্তু এবার দিবে। বিসিএস ক্যাডারকে পাত্তা দেবে না এমন মেয়ে খুব কমই আছে এদেশে। পারিবারিক ভাবে হয়তো বিয়েও ঠিক হয়ে যাবে। রমিজ আঙ্কেলও বিয়ের জন্য অমত করবে না।
মিতুর মা মেয়েকে আদর করতে করতে বলল
-আমি কি সুমনের বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো?
মিতু ফোঁফাতে ফোঁফাতেই বলল
-না।
-কেন না?
-আমি তো নিথির মত দেখতে এতো সুন্দর না। আমি তো দেখতে কালো।
-কে বলেছে তুই কালো? এটাকে কালো বলে? আর সুমন তো তোকে পছন্দ করে। করে না?
-ঐভাবে করে না।
তুই তো করিস? ভালবাসিস না ওকে? তাহলে কেন বলিস নি এতোদিন? যখন ওর সাথে কথা বলেছিস এতোদিন তখন কেন বলিস নি?
মিতু কোন জবাব না দিয়ে মাকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ওর কান্না আসতে লাগলো খুব বেশি।
দুই
এদিকে সুমনদের বাসাতে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে। সবার মন ভাল। উপর তলার নিথিরাও এসেছে। তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। রাতের খাবার তারা একসাথে খাবে।
কিন্তু সুমনের মনে চলছে অন্য কিছু। আজকেই নিথিদের এভাবে ডেকে আনার পেছনে মায়ের একটা আলাদা উদ্দেশ্য আছে সুমন সেটা জানে।
খাবার টেবিলেই কথা উঠলো। ছেলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়েছে, এখন একটা বউ দরকার। ঠিক তখনই সুমনের মা বলল
-ঠিক মনের কথা বলেছেন ভাবি। এখন একটা ছেলের বউ দরকার।
সুমন তাকিয়ে দেখলো নিথির মুখটা কেমন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। সুমনের মা বলল
-ভাবি আমি চাই......
কথাটা শেষ হল না তার আগেই সুমন বলল
-মা। এখন এসব থাক!
-কেন থাকবে কেন?
-মা প্লিজ।
হঠাৎ করেই ঘরের আবহাওয়া বদলে গেল। সুমনের মা বলল
-কি হল এমন? তুই তো একদিন আমাকে বলেছিলি যে তুই নিথিকে পছন্দ করিস! তাহলে?
-তখন বলেছিলাম। তখন করতাম পছন্দ।
-এখন কি সমস্যা?
-এখন কোন সমস্যা নেই। এখন আর সেই অনুভূতি নেই।
কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না। বেশ কিছু সময় পরে নিথির বাবা বলল
-নিথি কি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কোন দিন?
সুমন বলল
-না আঙ্কেল। এমন কিছু না। আসলে ও আমাকে কোন দিন পছন্দই করে নি। এখন যে পছন্দ করা শুরু করেছে সেটা আমার জন্য না, আমার চাকরির জন্য।
সুমন আর কোন কথা না বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল। কথা গুলো বলতে পেরে অনেক শান্তি লাগছে ওর।
তিন
-মন খারাপ তোমার?
মিতু তাকিয়ে দেখলো সুমন পেছনে এসে দাড়িয়েছে। ভেবেছিল আজকে সে ছাদে আসবে না। প্রতিদিন রাতে সুমন ছাদে আসতো। মিতুও আসতো একই সময়। এই সময়টাতে অনেক কথা হত দুজনার। মিতু বলল
-আজকে ভাবলাম আপনি হয়তো আসবেন না?
-কেন? প্রতিদিনই তো আসি।
-না আজকে একটা বিশেষ দিন আপনার জন্য। আর শুনলাম নিথিরা নাকি আপনাদের বাসায় গিয়েছিল। ভাবলাম গল্প গুজব করবেন ওর সাথে।
সুমন প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল
-আমার রেজাল্ট নিয়ে তুমি খুশি না?
-কেন খুশি হব না? অনেক খুশি!
-তাহলে ফোন করে যখন তোমাকে বললাম তুমি কথা বললে না কেন?
-আসলে তখন মোবাইলে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আমি কথা বলেছিলাম আপনি শুনতে পাননি।
সুমন কোন কথা না বলে কিছুটা সময় মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে কান্নাকাটি করেছে। সুমন বলল
-আমি নিথিকে আর পছন্দ করি না।
কথা টা শুনে মিতু চুপ করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলতে পারলো না। সুমন বলল
-আজকে কথাটা সবার সামনেই বলে দিয়েছি। যা কনফিউশন ছিল দূর হয়ে গেছে।
মিতু ক্ষীণ কন্ঠে বলল
-কাকে পছন্দ করেন এখন?
-তুমি জানো না?
-না। বলেন।
মিতুর কেবল মনে হল ও হয়তো এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। সুমন বলল
-আমি তাকেই পছন্দ করি যে এতোটা দিন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালবেসে এসেছে, আমি হাতে মেয়েদী পছন্দ করি বলে একটা দিন তার হাত খালি রাখে নি মেহেদী ছাড়া, যে আমাকে আমার চাকরির জন্য না বরং আমাকে আমার জন্য ভালবাসে, অনিশ্চিত জেনেও যে আমার হাত ধরতে চাইতো আমি তাকে ভালবাসি।
মিতু লক্ষ্য করলো ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। কোন মতে বলল
-কিন্তু আমি তো নিথির মত দেখতে সুন্দর না।
-দরকারও নেই অমন সৌন্দর্য্যের।
তারপর সুমন মিতুর সামনে হাটু ভাজ করে বসে বলল
-মিতু তুমি হয়তো আমার জীবনে প্রথমে আসো নি, তবে আমি চাই আমার জীবনের শেষ নারী তুমিই হও। এখন থেকে একদম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। হবে?
মিতু কেবল অশ্রু চোখে সুমনের দিকে তাকিয়ে রইলো । ওর কিছু বলা উচিৎ কিন্তু কান্নার জন্য কিছু বলতে পারলো না !
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১০:২৭