এতো জোরে মিমিকে ধমক দিয়েছি যে আমি নিজেও চমকে গেছি । মিমিতো চমকে গেছেই । কিছুটা সময় আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ! এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যেন আমি ওকে এতো জোরে ধমক দিতে পারি ।
কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মিমি বলল
-তুই আমাকে ধমক দিলি কেন ?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
-নাহ ! তোমাকে ধমক দেব কেন, কোলে নিয়ে নাচবো ? তোকে কতবার বলেছি সাবধানে চলতে ! এই সময়ে এতো লাফালাফির দরকার কি ! যদি পড়ে যেতিস !
মিমি আমার দিকে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! আমি ওর হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে একটু নরম কন্ঠে বললাম
-এমন কেন করিস ! তুই তো একা না এখন ? বুঝবি না ?
মিমি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! মেয়েটা এই কদিনেই কেমন বদলে গেছে । আগের সেই রাফ টাফ ভাবটা নেই ওর ভেতরে । সব মেয়েরাই মা হওয়ার সময় সম্ভবত এমন হয়ে যায় ! ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম
-কিছু খাবি ? খেতে ইচ্ছে করছে ?
-নাহ ! সারাদিন খাওয়ার উপরেই আছি । তোর মা আমাকে খাইয়ে খাইয়ে একেবারে ফুলিয়ে ফেলছে ।
-তার আর কি দোষ । তার ছেলের ঘরের ....
কথাটা বলতে গিয়েই মনে হল ভুল করে ফেলেছি । কথাটা বলা ঠিক হয় নি । আমার অসমাপ্ত বাক্যটা শুনেই মিমির চেহারা বদলে গেল । আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ কন্ঠে বলল
-কি বললি তুই ?
-আরে কিছু বলি নি !
-এই বাচ্চা শুধুই আমার ! শুধুই আমার !
-আচ্ছা বাবা শুধু তোর ! আমি জানি ! মেনে নিচ্ছি !
-তাহলে তুই তোর মাকে কেন বলেছিস ?
-আমি কিছু বলি নি । মা এমনিতেই বুঝে গেছে । তুই চিন্তা নিস ! তোর বাচ্চা তোরই থাকবে !
মিমি তবুও আমার দিকে গোমড়া মুখে তাকিয়ে রইলো । আমি ওকে বললাম
-আচ্ছা বাবা বুঝলাম ! এভাবে তাকিয়ে থাকিস না । বাচ্চার চেহারা অন্য রকম হয়ে যাবে !
-এই জন্যই আমি তোকে আসছে মানা করেছি । আমি আমার দেখা শুনা করতে পারি ।
-হ্যা তা তো পারিসই । আমি তো দেখতেই পারছি !
আমি নিজ হাতে ওর পা দুটো টি টেবিলের উপর তুলে দিলাম । ও এভাবে আরাম করে বসতে পারে । পেতের উপর ঠিক মত চাপ পড়ে না । টিভিটা ছেড়ে দিয়ে ফ্রিজ থেকে জুসের গ্লাসটা ওর সামনে রেখে বললাম
-আমি গোসল শেষ করতে করতে এই গ্লাস শেষ করবি । মনে থাকে যেন !
-করবো না ! আমার উপর কর্তৃত্ব করবি না বলছি খবর !
-থাপ্পড় খাবি ! যা বলছি কর !
মিমি আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় তবে একটু আগের যে গোমড়া মুখ ছিল সেটা আর নেই । আমি একটু হেসে বাধরুমের দিকে রওনা দিলাম !
মিমির সাথে আমার পরিচয় সেই ক্যাম্পাসের দিন গুলো থেকে । ও অন্য সবার মত ছিল না । এই জন্যই সম্ভবত ওর সাথে আমার ভাব হয়েছিলো সব থেকে বেশি । আমরা ঝগড়া করতাম মাঝে মাঝে মারমারিও করতাম । তবে একে অন্যের সুখ দুঃখে ছেড়ে যাই নি কোন দিন । যখন আমার প্রথম নীলার বিয়ে হয়ে গেল তখনই মিনি অনেকটাই আমাকে সামলে ছিল । ও না থাকলে হয়তো দিন গুলো আরও খারাপ যেত ।
মিমির আরেকটা অস্বাভাবিক দিক ছিল ও বিয়ে শাদী ভালবাসার সম্পর্কে একদম বিশ্বাসী ছিল না । এটার জন্য অবশ্য ওকে ঠিক দোষও দেওয়া যায় না । ওর বাবা মা প্রেম করেই বিয়ে করেছিলো কিন্তু ওনাদের বিয়েটা ঠিক সুখকর হয় নি । তীব্র সাংসারি অশান্তির ভেতরে মিমি বড় হয়েছে । সেটা থেকেই ওর এই মনভাব !
আমি ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম । মেয়েটা সারা জীবন একা একা থাকবে কিভাবে ! অবশ্য ভার্সিটিতে ওঠার কদিন পর থেকেই ও একা একাই থাকতো । মা বাবার সাথে থাকতো না । আমাদের ভেতরে বন্ধুত্ব ঠিকঠাকই চলছি । ভার্সিটি শেষ করে দুজনেই চাকরিতে ঢুকে পড়তাম । নিয়মিত আমাদের দেখা হত । ফোনে তো যোগাযোগ হতই ।
কিন্তু একদিন হিসাবে সব অলট পালট হয়ে গেল । মিমি আমাকে একটা অদ্ভুদ কথা বলল । যা শোনার জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না !
। মিমি প্রেম ভালবাসা বিয়েতে ঠিক বিশ্বাস না করলেও বাচ্চাদের খুব ভালবাসতো । ওর ইচ্ছে হল ও সিঙ্গেল মাদার হবে ! ঐ বাচ্চা নিয়েই সে থাকবে তার বাকি জীবন । এবং আমাকে বলতে ওর বাবার বায়োলজিক্যাল বাবা হতে । আমি প্রথমে ঠিক বিশ্বাস পারছিলাম না । আমার ইতস্তত ভাব দেখে মিমি খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-তুই যদি রাজি না থাকিস তাহলে ওকে ! আমি অন্য কারো কাছে যাবো !
-আচ্ছা আমি একটু ভাবি ! তারপর বলি ?
-আচ্ছা !
কেন জানি আমি রাজি হয়ে গেলাম ! প্রথমে আমি খুবই অস্বস্থিতে ছিলাম । ওর সাথে এমন কিছু করতে হবে যা আমি কোন দিন আমার মনেও আনি নি ! কিন্তু সেই তুলনাতে মিমি বেশ স্বাভাবিক ছিল । ঠিক তিন মাস পরে ও আমাকে জানালো যে ও কনসিভ করেছে । ওর মুখে এমন একটা উজ্জল ভাব দেখলাম আমার নিজের মনটা ভাল হয়ে গেল । সেই সাথে সকল অস্বস্থি দুর হয়ে গেল । কিন্তু আরেকটা অদ্ভুদ অনুভুতি আমার নিজের মাঝেই কাজ করতে লাগলো ।
আমি নিজেও তো বাবা হতে চলেছি ।
আশ্চর্য একটা অনুভুতি !
আমি যেন ওর প্রতি আরো বেশি যত্নবান হয়ে উঠলাম । আগের থেকেও বেশি বেশি খোজ খবর নিতে শুরু করলাম । ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরে আমাকে সরাসরিই জানতে চাইলো । আমি নিজের অনুভুতি গোপন করে বললাম
-তুই আমার বন্ধু না ?
-তো ?
-তো মানে কি ? এই সময়ে মেয়েদের একটা এক্সট্রা কেয়ার দরকার ! আমি তোকে সেই কেয়ার দিতে যাচ্ছি ! আর কিছু না । আর আমি সাথে থাকলে তোকে অনেক অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে না । জানিসই তো এটা বাংলাদেশ ! এখানে এখনও এটা ঠিক স্বাভাবিক না !
মিমি কিছু বলল না । তারপর থেকেই আমার আসা যাওয়াটা নিয়মিত হয়ে গেল । একটা সময় আমি ওর ফ্ল্যাটেই থাকা শুরু করলাম । অফিস শেষ করে আমি বাসা আসছি না দেখে মা আমাকে নানান প্রশ্ন করতে শুরু করলো । শেষে আমি না পেরে মাকে সব কিছু বলে দিলাম । মা সব শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তবে আমাকে আর কিছু বলল না ।
কদিন পরে মিমির অবস্থা আরও একটু নাজুক হয়ে গেল । আর মাস খানেকও নেই ডেলিভারির । ও ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে কিন্তু আমি নিতে পারছি না । সারাটা সময় ওর সাথে থাকলেও অফিসের সময় ওকে একা একা রাখতে মন চাইতো না । অস্থির লাগতো । তাই মাকে বললাম এই সময় টুকু যেন মিমির কাছে এসে থাকে । মিমি তীব্র আপত্তি করলেও আমি শুনলাম না !
একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করতে শুরু করলাম । আগে মিমি যেটা না বলতো সেটা কখনই হ্যা বলা যেত না । খুব জেদি মেয়ে ও । আমি কোন ভাবেই জোর খাটাতে পারতাম না ওর উপর । কিন্তু এখন কেমন যেন বদলে গেছে । আমি একটু ধকম কিংবা জোর করলে সেটা ও মেনে নেয় । শুনেছি মেয়েরা মা হওয়ার সময় এরকম অনেক মানষিক পরিবর্তন হয় !
গোসল শেষ করে এসেই দেখি মিমি গ্লাস শেষ করেছে । আমি টেবিলের দিকে রওনা দিবো এমন সময় মিমি বলল
-দাড়া আমি উঠছি ! আন্টি তোর জন্য চিংড়ি রান্না করেছে ।
-তোর উঠতে হবে না । আমি নিয়ে নিচ্ছি !
-তুই আমার জন্য এতো করছিস । এই টুকু আমি করি !
-বেশি ফরমাল হতে হবে না । বুঝেছিস ।
আমি ভাত খাওয়া শুরু করেছি এমন সময় মিমির ডাক শুনতে পেলাম । ডাকের ভেতরেই এমন কিছু ছিল মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই । দৌড়ে গিয়ে দেখি মিমি ঘামতে শুরু করেছে ।
-কি হয়েছে !
মিমি কোন মতে বলল
-মনে হয় ...।
আমি সাথে সাথেই এম্বুল্যান্সে ফোন দিলাম । সেটা সাথে মাকেও । বললাম যে উনি যেন সোজাসুজি হাসপাতালে গিয়ে হাজির হয় । পরিচিত কয়েজন ডোনারকেও ফোন দিলাম যদি কোন সমস্যা হয় এই ভেবে ।
যখন হাসপাতালে পৌছেছি তখন মিমির অবস্থা বেশ খারাপ হতে শুরু করেছে । ওটি তে ঢুকার শেষ মুহর্তে মিমি আমার হাত চেপে ধরলো । বলল
-আমি মরে যাই আমার বাচ্চাটাকে তুই দেখবি । দেখবি !
আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বললাম
-মরে গেলে তোর খবর আছে !
এতো টেনশন আমি এর আগে কোন দিন করেছি কি না আমি বলতে পারবো না । কত সময় পার হয়েছে আমি নিজেও জানি না একটা সময় ডাক্তার বলল যে সব কিছু ঠিক । মিমির একটা মেয়ে হয়েছে । আর সবাই সুস্থ আছে । আমি সামনে ডাক্তার সাহেবকে জড়িয়ে ধরলাম । কখন যেন চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে আমি খেয়ালই করি নি ।
যখন ওদের দেখার সুযোগ পেলাম মিমি আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বল ভাবে হাসলো । আমি ওর পাশে রাখা ছোট্ট পুতুলেট মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম এক ভাবে । কি যে ভাল লাগার একটা অনুভুতি হচ্ছিলো সেটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না । নার্স খুব সাবধানে বাচ্চাটাকে আমার কোলে তুলে দিল । আমার তখনই মনে হল এই শিশুকে মেয়েকে ছাড়া আমার পক্ষে একটা দিনই থাকা সম্ভব না ! বাবা হওয়ার আনন্দ যে সেটা আমার বুঝতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হল না ।
তখনই একটা অদ্ভুদ কান্ড হল । আমার মা বাবা কেবিনে ঢুকলো । তাকিয়ে দেখি মিমির বাবা মাও পেছনেই আছে । সব থেকে অবাক হলাম পেছনে একজন হুজুর মত লোক কে দেখে ! আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে । আমার মা কারো দিকে না তাকয়ে একটা চেয়ারের দিকে হুজুর মত লোকটাকে বসতে নির্দেশ করে বললেন
-আপনি কাজ শুরু করেন !
আমি বললাম
-কি হচ্ছে মা এসব ?
মা কঠিন কন্ঠে বলল
-চুপ ! তোদের বিয়ে দেব !
মিমি বলল
-কি বলছেন এসব ?
মা মিমিকে আমার থেকেও জোরে ধকম দিয়ে বলল
-এই মেয়ে একদম চুপ ! যা বলছি শুনবা ! কোন কথা না ! কাজী সাহেব আমি শুরু করেন !
মিমির দিকে তাকিয়ে দেখি মিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । আমার মায়ের কাছ থেকে ধকম সে আশা করে নি । আমিও করি নি । আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে আমিও এসবের কিছু জানি না !
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
-মা ! প্লিজ !
-কোন কথা শুনতে চাই না !
-আচ্ছা ঠিক আছে । আমাকে মিমির সাথে কয়েকটা মিনিট একা কথা বলতে দাও ! প্লিজ । তোমরা একটু বাইরে যাও !
মা কিছু না বললেও সবাইকে নিয়ে বাইরে চলে গেল । আমি মিমিকে কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না । আমাদের মেয়ে তখনও আমার কোলেই । আমি মেয়েকে ওর পাশে শুইয়ে দিয়ে বললাম
-আমি আসলে .....।
মিমি চুপ করে রইলো !
আমি বললাম
-আমি তোর স্বামী হয়ে থাকতে চাই না । তুই আমার বন্ধুই হয়ে থাকবি ! কোন দিন তোর উপর স্বামীত্ব ফলাবো না কথা দিলাম । কিন্তু আমাকে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করিস না প্লিজ ! আমি যখন আমাদের মেয়েকে কোলে নিলাম আমার সব কিছু উল্টে পাল্টে গেছে । আমার কেবল মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটাকে ছেড়ে ..... তোকে ছেড়ে আমি একটা মুহুর্তও থাকবে পারবো না ।
মিমির দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে সিক্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে । চোখে পানি টলটল করছে । বললাম
-বিয়ে করবি আমাকে ? প্লিজ !
তখনই ওর চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোকে কিন্তু তুমি বলতে পারবো না । তুই ই বলবো ! সারা জীবনই তুই বলে ডাকবো !
-আচ্ছা ডাকিস !
তারপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো। আমাদের বিয়ে হল হাসপাতালেই । হাসপাতাহলের বেডে মিমি শুয়ে ছিল আর আমি ওর পাশে ওর হাত ধরে । মিমির ভেতরে অন্য রকম কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম । মা হওয়ার পর ওর ভেতড়ে পরিবর্তন চলে এসেছে । আমি নিজেও তো বদলেছি ! একদিনও হয় নি অথচ মেয়ের জন্য কি পরিমান মায়া অনুভব করছি সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৫১