সাইকেল কেনার পর থেকে বাসায় ফেরা নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয় না । টিউশনী থেকে একটু দেরি করে বের হলেও কোন সমস্যা হয় না । তাই মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করেই দেরি করে যাই । তবে আজকে মনে হল একটু যেন বেশিই দেরি হয়ে গেছে । রাস্তায় একদম মানুষ নেই । এরকম ফাঁকা রাস্তা আমি এর আগে কোন দিন দেখি নি । তবে রাস্তা এতোটা ফাঁকা হওয়ার আরেকটা কারন অবশ্য রয়েছে । আজকে ছুটির দিন তার উপর আকাশে বেশ ভাল মেঘ করেছে । বিকালে একবার বেশ ভাল বৃষ্টি হয়ে গেছে । এখন আবার শুরু হবে যে কোন সময় !
অবশ্য সেটা নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা নেই । যদি বৃষ্টি নেমেও যায় আমি ভিজতে ভিজতেই যাবো । এরকমই একটা ইচ্ছা আছে আজকে । যখন স্কুলে পড়তাম তখন তো বৃষ্টি হলেই আমি সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যেতাম । সাইকেল চালাতে চালাতে বৃষ্টিতে ভিজতে আমার বেশ লাগতো । তাও তো ১০/১১ বছর হয়ে গেল । আজকে এই সুযোগ কোন ভাবেই মিস করা যাবে না । আমি মোবাইলটা পলিথিনের ব্যাগের ভেতরে ভরে আপন মনে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম ।
কিন্তু যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনটা হল না । বৃষ্টিতে এলো ঠিকই তবে যে বৃষ্টিতে শরীর ভিজবে না এমন বৃষ্টি । কিন্তু সেই সাথে শুরু হল ঝড় । একটু ভয় হল কারন ঢাকা শহরে গাছ পালা খুব একটা না থাকলেও কারেন্টের তার রয়েছে । কোন তার কোন দিক ছিড়ে পড়বে সেটা বোঝা মুশকিল । আর সেই সাথে এতো জোড়ে বাতাস শুরু হল যে আমি ঠিক মত সাইকেল চালাতে পারছিলাম না ।
অনেক চেষ্টা করার পর মনে হল এই ঝড় না থামা পর্যন্ত কোথায়ও সাইকেল থামিয়ে অপেক্ষা করা উচিৎ ! নয়তো বিপদে পড়তে পারি । কিন্তু কোথায় থামবো ?
জায়গা খুজতে খুজতেই কাটাবন চৌরাস্তার কাছে চলে এলাম । কাটাবনের সিগনালের কাছেই কয়েকটা ব্যাংকের এটিএম আছে । সেখাবে বেশ ভাল ছাউনি আছে । সিদ্ধান্ত নিলাম যে ঐখানেই থামবো কিছু সময়ের জন্য । কিন্তু যখনই কাটাবোন চৌরাস্তা পার হতে যাবে তখনই বাতাসের বেগ যেন বহুগুনে বেড়ে গেল । একটু আগেও বাতাস বইছিলো । তবে এতোটা জোড়ে না । হঠাৎ কোথা থেকে এতো জোড়ে বাসাত আসা শুরু করলো সেটা বুঝতে পারলাম না
আমি কেবল অবাক হয়ে দেখলাম আমি আমার সাইকেলটা সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারছি না । খুব চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন কাজই হল না । যেন আমি একটা ঘুর্নিঝড়ের ভেতরে পড়েছি । নিজের ইচ্ছেতে কিছুতেই সাইকেল নড়াতে পারছি না । কয়েকবার চেষ্টা করে যখন হাল ছেড়ে দিলাম তখনই আমি নিজেকে খানিকটা ভার শূন্য অনুভাব করলাম । তাকিয়ে দেখি আমি সহ আমার সাইকেলটা পিচের রাস্তা থেকে উপরে উঠে পড়েছি । এবং আমি সাইকেল সহ ঘুরতেছি । এতোদিন মুভিতে দেখেছি কিভাবে গাড়ি বাড়ি প্রবল বাতাসে উড়ে যায় কিন্তু আজকে নিজে সেটা অনুভাব করতে পারছি । আমার মনে হল আমি এবাই শেষ হয়ে যাবে । তীব্র একটা ভয় কাজ করতে শুরু করলো নিজের মাঝে ।
হঠাৎ করে এরকম ভাবে বাতাস শুরু হওয়ার মানে বুঝতে পারলাম না । যখন মনে হল আর হয়তো জীবিত থাকবো না তখনই নিজেকে আবিস্কার করলাম যে আমি পিচের উপর বসে আছি । সাইকেলটা একটু দুরে পড়ে আছে । এবং আশে পাশে একটা অতি শান্ত ভাব রয়েছে । সব থেকে অবাক করা বিষয় যে একটু আগে যে তীব্র ঝড় হচ্ছিলো সেটার নাম গন্ধ নেই । এমন কি রাস্তাটা একেবারে শুকনা । এখানে কয়েক সেকেন্ড আগেও যে বৃষ্টি হয়েছে সেটার কোন প্রমান নেই । তবে আমার শরীর কিন্তু খানিকটা ভেজা ভেজাই । আমি মাথা মন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না ।
এতো কিছুর পরেও আমার চোখ থেকে চশমাটা উড়ে যায় নি দেখে অবাক লাগছিলো । আমি চশমাটা খুলে নিজের শার্ট দিয়ে ভাল করে মুছে আবারও চোখে দিলাম । চারিপাশে তাকিয়ে দেখি সেখানে কিছুই নেই । আশে পাশে কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। আমি যখন বের হয়েছিলাম তখন রাত এগারো কি সাড়ে এগারোটা বেজে থাকবে কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে রাত তিন কি চারটা বাজে । এতো গভীর রাত কিভাবে হল ?
আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না । আমি পরে থাকা সাইকেলটা তুলে নিলাম । আরেকবার চারিপাশে তাকিয়ে দেখলাম । এতো নির্জনতা ঢাকা শহরের জন্য খানিকটা বেমানান । মোবাইল বের করে সময় দেখলাম সাড়ে এগারোটা বাজে । সময়ের তুলনাতে জায়গাটা যেন একটু বেশিই নির্জন হয়ে গেছে । এমন তো হওয়ার কথা না । কোন ভাবেই না ।
আমি সাইকেল চালাতে বাটা সিগলানের দিকে রওনা দিলাম । আমার এখন বাসায় যাওয়া দরকার । রাস্তা ঘাট একেবারে ফাঁকা । আমি যদিও আমি কখনই খুব দ্রুত সাইকেল চালাই না, তবে আজকে মনে হল আমার দ্রুই সাইকেল চালানো দরকার । আমি গিয়ার বাড়িয়ে যখনই সাইকেলর গতি বাড়িয়েছি তখনই আমার পাশ দিয়ে সাই করে একটা কার গাড়ি চলে গেল । মনে একটু সাহস এল এই ভেবে যে আমি এই জগতে আসলেই একা নই । একটু আগে আমার তাই মনে হচ্ছিলো যে এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই ।
আমি আপন মনে সাইকেল চালাচ্ছিলাম । কিন্তি কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই একটু বিকৎ শব্দ পেলাম । কোন কিছু সাথে কোন কিছুর ধাক্কার আওয়াজ ! একটু আগে যে গাড়িটা গিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই এক্সিডেন্ট করেছে । কোন সন্দেহ নেই ।
আমি দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাটা সিগনালে আসতেই দেখতে পেলাম গাড়িটা । আইল্যান্ডের সাথে ধাক্কা খেছে । সেখানেই পড়ে আছে । গাড়ি থেকে ধোয়া উড়ছে । গাড়িটা পার করার সময় সেটার নম্বর প্লেটটার দিকে আমার চোখ গেল । চোখে আটকে গেল বলা চলে । নাম্বরটা একেবারেই সহজ !
ঢাকা গ ******* ।
আমি সামনে যেতেই একটা বিভৎস দৃশ্য দেখতে পেলাম । ধাক্কার ফলে যে ড্রাইরের সিটে বসে ছিল সে গ্লাস ভেঙ্গে সামনে চলে এসেছে । একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো । মেয়েটাট চুল ছড়িয়ে ছিটিতে আছে । মাথাটা খুবই মারাত্বক ভাবে আহত হয়েছে । রাস্তার সোডিয়াম আলোতে মাথার রক্ত কেমন কালো দেখাচ্ছে ।
আমার এক মন বলছে জলদিই এখান থেকে কেটে পড়তে । কোন ঝামেলার দরকার নেই কিন্তু অন্য মন সেটা করতে বাঁধা দিল । মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে কি না দেখতে মন চাইলো । আমি সাইকেল থামিয়ে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাড়াতেই মেয়েটা মাথা তুলে দাড়ালো । পুরো মুখে রক্ত লেগে একাকার হয়ে আছে । আমার দিকে খানিকটা সময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মৃত্যু স্বরে বলল
-ব্রেক !
আমি ঠিক মত কিছু না বুঝতে পেরে মেয়েটার আরও কাছে গিয়ে বললাম
-কি বলছেন ?
-ব্রেক ! শাহরিয়ার ব্রেক কেটে দিয়েছে !
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না মেয়েটা । এলিয়ে পড়লো ।
আমি যখন কথাটা বুঝতে পারলাম তখন আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । মেয়েটা বলছে কি ! আমি এখন কি করবো ? কি করা উচিৎ ? আমি দ্রুত মোবাইল বের করে যখন সাহায্যের জন্য ফোন করতে যাবো তখনই আরেকটা দৃশ্য দেখতে পেলাম । ঘটনা স্থল থেকে একটু দুরে একটা বাইক দাড়িয়ে আছে । মাথায় হেলমেট পরা থাকার কারনে আমি ঠিক মত চেহারাটা দেখতে পেলাম না । কিছুটা সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বাইক ঘুরিয়ে বাইকটা শাহবাগের দিকে চলে গেল ।
আমার মনে হল এখনই সাহায্য আনা জরুরী । মেয়েটাকে হয়তো এখনও বাঁচানো যাবে । কোথায় যাবো ? কোন দিকে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । ঠিক তখনই আমার মনে পড়লো যে সায়েন্সল্যাবে পুলিশ বক্স আছে । সেখানে কেউ না কেউ থাকবেই । আর চিন্তা না করে আমি আবারও সাইকেলে উঠে বসলাম । দ্রুত যেতে হবে ।
কিন্তু যখন সায়েন্সল্যাবের তিন রাস্তার কাছে এসেছি তখনই আবার কোথা থেকে এক ঝাক বাতাস আমাকে পেয়ে বসলো । সেই কাটাবনের মত প্রবল বাতাসে আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যবে । আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । একটু আগেও এখানে কোন বাতাস ছিল না তাহলে এখন কোথা থেকে এল ? এবং এই ঘুর্ণি বাতাসও আমাকে মাটি থেকে উপড়ে উঠিয়ে ফেলল কয়েক হাত ।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । মাথার ভেতরে কেবল মেয়েটার কথাই ঘুরছিলো । মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে । তারপর হঠাৎ করে আবারও সব থেমে গেল । তবে আবার আমি সব থেকে বেশি অবাক হলাম । আমি ঠিক আগের জায়গাতে পৌছে গেছি ।
কাটাবন !
সেই সিগনাল । টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে ।
আমি সাইকেলে চেপেই বসে আছে । আমি বোকার মত কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলাম । কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না । কি হচ্ছে আমার সাথে ? আর আসে পাশে তাকিয়ে আমার একটু আগের মত মনে হল না । মনে হল এখন সেই এগারোটাই বাজে । ঐতো দেখা যাচ্ছে এটিএম বুথের কাছে একজন গার্ড বসে বসে ঢুলছে । আমি কিছুটা সময় আসলেই বোকার মত বসে রইলাম কিছুটা সময় ।
মেয়েটার কথা মনে হতেই আমি সাইকেল চালিয়ে বাটা সিগনালের কাছে এলাম ।
কোন গাড়ি দেখতে পেলাম না । যেন কিছুই হয় নি ।
আমি আসলেই কিছু বুঝতে পারছিলাম না । আমার সাথে কি হচ্ছে ?
আমি তাহলে এতো সময় স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি ? এসবের মানে কি ?
দুই
-আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছেন ? তাই না ?
আমি নুসাইবার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । আমি যে ইয়ার্কি মারছি না সেটা বোঝানোর ক্ষীন চেষ্টা । তবে তাতে খুব একটা কাজ হল বলে মনে হল না । নুসাইবা বলল
-আচ্ছা আপনি আমাকে যা বলছেন আপনি নিজে হলে সেটা কি বিশ্বাস করতেন ?
-জি না !
-তাহলে আমাকে কেন বিশ্বাস করতে বলছেন ?
-আমি জানি না । আমার কাছে এর কোন ব্যাখ্যা নেই । কোন কিছু জানিও না ।
নুসাইবা আমার দিকে বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল
-দেখুন আপনার কি মনে হয়েছে আমি জানি না তবে আপনার এই কথা বার্তা আমার বিশ্বাস করার কোন কারন নেই । আমি যাচ্ছি !
আমি কিছু বলতে পারলাম না আর । আর কিছু বলারও নেই । মেয়েটাকে আমি সাবধান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু মেয়েটা সেটা কানেই নিল না । নুসাইবা উঠতে যাওয়ার সময় আমি বলল
-আমি কোন খারাপ ইনটেশন নিয়ে আপনাকে এসব কথা বলি নি ।
নুসাইবা বলল
-আমিও বলছি না আপনি কোন খারাপ ইনটেশন নিয়ে বলেছেন ! আমার সাথে শাহরিয়ার বেশ কিছু দিন ধরেই ঝামেলা হচ্ছে । এই জন্যই আমি আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছি কিন্তু যা বলেছেন সেটা বিশ্বাস করার মত নয় !
-আচ্ছা সাবধানে থাকবেন । আর একটা কথা ?
-বলুন ।
-দয়া করে নিজে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকবেন কয়েকটা দিন । আর শাহবাগ বাটা সিগনাল এরিয়াটা এড়িয়ে চলবেন প্লিজ !
নুসাইবা আর কিছু না বলে মাথা কাত করে চলে গেল । আমি চুপ করে বসেই রইলাম । সেদিনের ঘটনার পরে আমি শান্তি মত ঘুমাতেই পারি নি দুইটা দিন । কিন্তু আমার কিছু করারও ছিল না । যখন মনে হল যে আমার আসলে কিছুই করার নেই । এটা নেহতই একটা হ্যালুশিনেসন ছাড়া আর কিছু নয় তখনই আমার চোখের সামনে গাড়িটার নাম্বার ভেসে উঠলো । একদম ইজি একটা নাম্বার । গাড়ির নাম্বার থেকে গাড়িটার ঠিকানা বের করা সম্ভব !
আমার বড় মামা বিআরটিসিতে চাকরি করে । তাকে নাম্বারটা দিয়ে খোজ লাগাতে বললাম । মামা প্রথমে দিতে না চাইলেও শেষে আমার জেদ দেখে রাজি হয়ে গেল । বলল যে কাজটা গোপন এভাবে কাউকে ডিটেইলস দেওয়ার নিয়ম নেই ।
মামা কিছু সময় পরেই আমাকে ডিটেইল পাঠালো । নাম টা দেখেই আমার বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো । গাড়িটা শাহরিয়ার হাসানের নামে নিবন্ধন করা রয়েছে । মোবাইল নাম্বার বাসার ঠিকানা সব কিছু দেওয়া আছে । আমি নাম্বারটা ফেসবুকে সার্চ দিতেই শাহরিয়ারের হাসানের প্রোফাইল খুজে পেলাম ! এবং সেখান থেকেই নুসাইবার খোজ পেলাম । ওদের প্রোফাইলেই লেখা ছিল যে তারা বিবাহিত ! তার পরেই প্রোফাইলে আরও রিসার্চ করে দেখা গেল শাহরিয়ার সাহেব বাইক চালায় ! এবং সেদিন রাতে আমি যে বাইকটা দেখেছিলাম এটাই যে সেই বাইক সেটা বুঝতেও আমার কষ্ট হল না।
ব্যাস ! আমার আর কোন সন্দেহ রইলো না যে আমি যা দেখেছি সেটা সত্যি । এতো কাকতালীয় এক সাথে ঘটতে পারে না । হয়তো ঘটনা টা ঘটে গেছে অথবা ঘটবে সামনে । এর পরেই আমি নুসাইবাকে নক দিলাম । যদি ঘটনা ঘটে গিয়ে থাকে তাহলে রিপ্লাই আসার কথা না । তবে রিপ্লাই এলো । আমার সাথে বেশ কিছু কথাও বলল । বেশ ফ্রেন্ডলিই মনে হল আমার কাছে ।
প্রথমে সে আমার কথায় কান না দিলেও একটা সময়ে আমার সাথে কথা বলতে রাজি হল । কিন্তু কথা বলে খুব একটা কাজ হল না ।
আমি নিজেকে এই বলে সান্তনা দিলাম যে আমি আমার তরফ থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি করি নি । এখন যদি মেয়েটির কপালে ঐ ভাগ্যই লেখা থাকে তাহলে আমার কি করার থাকতে পারে !
তারপর কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন । ঠিক দুই সপ্তাহ পরে নুসাইবা আমাকে নক দিল । ওর নক পেয়ে আমি বেশ খানিকটা অবাক হলাম । আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে আসার জন্য বলল । আমি ঠিক কারন টা বুঝতে না পারলেও দেখা করতে রাজি হলাম । ঠিকানায় গিয়ে দেখি সেটা বেইলি রোডের একটা বিশাল বাসার ঠিকানা । গেটের কাছে গিয়ে আমার নাম বলতেই দারোয়ান আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল । বুঝতে পারলাম আমার কথা আগে থেকেই বলা ছিল । আমাকে ঠিক বসার ঘরেও বসতে বলা হল না । বরং একেবারে ঘরের ভেতরে দিকে নিয়ে যাওয়া হল । একটা শোবার ঘরে গিয়ে যখন থামলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম বিছানায় নুসাইবা শুয়ে আছে আধশোয়া ভাবে । মেয়েটার মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা । হাতেও ব্যান্ডেজ বাধা ! মেয়েটা এক্সিডেন্ড করেছিলো সেটা কোন সন্দেহ নেই ।
আমাকে দেখে হাসলো ! আমি অবাক হয়ে বললাম
-কিভাবে হল ?
-আপনার ভবিষ্যৎ বানী সতি হয়ে গেছে ।
-মানে ?
-মানে হল শাহরিয়ার সত্যি সত্যিই আমাকে মারার চেষ্টা করেছিলো ।
-তাই নাকি ?
আমাকে বিছানার পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসতে ইশারা করলো । তারপর বলল
-আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি যেন গাড়ি না চালাই । তবে গত পরশু রাতে শাহরিয়ার হঠাৎ করেই আমার সাথে অদ্ভুদ আচরন শুরু করে । আমাদের বিয়ের আগে আমরা প্রায়ই মাঝে মাঝে মধ্য রাতে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতাম, মাঝে মাঝে আমরা রেসও দিতাম । ও বলল যে ও এরকম একটা ড্রাইভে যেতে চায় । আমি যে অবাক হয় নি বলবো না । কদিন থেকে আমাদের ভেতরের সম্পর্ক খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো । আমার কাছে মনে হল ও সম্ভবত সেটা উন্নতি করতে চায় এই জন্যই এমন করছে । কিন্তু যখন ও বলল যে ও যাবে বাইকে আর আমি যাবো গাড়িতে । ও নাকি রেস দিবে !
আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম । নুসাইবা বলল
-তখনই আমার আপনার কথা মনে হল । কোন কারন নেই তবুও আমার মনে হল আপনার কথাটা সত্যি হতে চলেছে । আমি চাইলেই মানা করে দিতে পারতাম । কিন্তু আমি দেখতে চাইলাম যে ও আসলে কত নিচে নামতে পারে ! আমি সব সময়ই গাড়ি খুব দ্রুত চালাই । গাড়ি নিয়ে আগে বের হয়ে গেলাম । গাড়ি যখন মৎস ভবন পার হল তখনই শাহরিয়ারের ফোন এল আমার মোবাইলে । ফোন রিসিভ করতেই ও আমাকে বলল যে ও আমার গাড়ির ব্রেক কেটে দিয়েছে । আর ইঞ্জিনের সাথে এমন কিছু করেছে যে আমি চাইলেও গতি কমাতে পারবো না । ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার । ও এসব ভাল বুঝবে ! সে নাকি আমার কাছ থেকে মুক্তি চায় !
-তারপর ?
-আমি ফোন রেখে দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম । কিন্তু তারপরই আপনার কথা আবারও মনে পড়লো । আপনি শাহবাগ বাটা সিগনাল এলাকা এড়িয়ে চলতে বলেছিলাম । শাহবাগে আসতেই গায়ের শক্তি দিয়ে হুইল বাংলামোটরের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম । এতো স্পিড থাকার কারনে সেটা খুব বেশি ভাল কাজ হল না । গাড়ি উল্টে গেল তবে ......
-তবে আপনি মারা গেলেন না । তাই না ?
-দেখতেই পাচ্ছেন । তবে আপনার সাথে যদি দেখা না হল আমি ঐ বাটা সিগনালের দিকেই যেতাম । আর হয়তো ....।
লাইণটা শেষ করলো না । আমিও বুঝতে পারলাম ও কি বলতে চাইলো । আমি বলল
-শাহরিয়ার কোথায় ?
-ওকে পুলিশে দিয়েছি ! সে আসলে এতো বড় কিছু হ্যান্ডেল করতে পারে নি । সব স্বীকার করে নিয়েছে ।
-যাক ভাল ।
আরও বেশ কিছু সময় কথা হল । নুসাইবার বাবা মায়ের সাথেও কথা হল । আমার দেখা হবে বলেই ওদের বাসা থেকে চলে এলাম ।
পরিশিষ্টঃ
-আপনার কি মনে হয় ? ঐদিন আসলে কি ঘটেছিলো ? আপনি কিভাবে দেখলেন অমন একটা ঘটনা !
-জানি না । এটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । আমি অনেকের কাছেই এই ঘটনা বলেছি । কেউ কোন উত্তর দিতে পারে নি । কেউ বলেছে আমি স্বপ্নে দেখেছি কেউ বলেছে হ্যালুসিনেশ ।
সাব্বির সাহেব আমার দিকে বেশ কিছু তাকিয়ে থেকে বলল
-আমার কি মনে হয় জানেন ?
-কি মনে হয় ?
-আসলে আমার মনে হয় আপনি ঐদিন খানিক সময়ের জন্য চলে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে । ঐ যে ঘুর্ণিঝড়টা ওটা আপনাকে ছিটকে ফেলেছিলো ভবিষ্যয়তে ! প্রকৃতি কখনও কোন অস্বাভাবিক ঘটনা স হ্য করে না । তাই পরক্ষনেই আপনাকে আবার আগের জায়গাতে নিয়ে এসেছে । কিন্তু এর মাঝে যা হবার হয়ে গেছে । আর আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল । যেমন মনে করুন আজকে আপনি সাইকেল নিয়ে বের হলেন তাহলে ভবিষ্যতে আপনার সাথে একরম ঘটনা ঘটবে আবার যদি হেটে বের হন তাহলে ঘটনা ঘটবে অন্য রকম! বর্তমানের একটা কাজ তারপর পরের ঘটনা কে এফেক্ট করে সেটা আবার অন্য ঘটনা কে এফেক্ট করে এভাবে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয় সামনের ঘটনা ! নুসাইবার বেলাতেও এই ঘটনা ঘটেছে । সে যদি বাটা সিগনাল দিয়ে আসতো তাহলে কাচ ভেঙ্গে সামনে আসতো মাথায় আঘাত পেত । বাংলামোটরের দিকে গেছে বসে মাথায় আর হাতে আঘাত পেয়েছে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেত তাহলে অন্যভাবে আঘাত পেতে পারতো !
আমিও অনেক ভেবেছি এই ঘটনা নিয়ে । তবে এটার থেকে ভাল ব্যাখ্যা আমার কাছে জানা নেই । যাক জীবনে অনেল ঘটনাই ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই, যে ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি না । এই ঘটনাটাও না হয় অব্যাখ্যায়িত হয়ে থাকুক !
তবে নুসাইবা যে বেঁচে আছে এটাই সব থেকে বড় কথা !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:৩৮