সুপ্তির সাথে পরিচয় হওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে এখনও কেমন যেন লাগে । এখনও মনে হয় ঐদিন যদি আমি ওকে বাসের সিট ছেড়ে না দিতাম তাহলে হয়তো আমাদের জীবনের গল্পটা আজকে অন্য রকম হত । কিন্তু অন্য রকম কিভাবে হবে ! আমাদের গল্প যে এভাবেই লেখা হয়েছে !
বড় মগবাজারে আমি টিউশনী থেকে বাসায় ফেরার জন্য যেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম সেখানেই সুপ্তির সাথে আমাদের প্রতিদিন দেখা হত ! আমি যখন পড়ানো শেষ করে বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম সেও অপেক্ষা করতো । দেখতাম একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে । কিন্তু কোন দিন কথা হয় নি । একদিন বাসে খুব বেশি ভীড় ছিল । কোন মতে আগে উঠে পড়লাম । ভাগ্য ভাল হওয়ার মগবাজার মোড়ে না আসতেই একটা সিটও ফাকা হয়ে গেল আমি যে সিট টার কাছে দাড়িয়ে ছিলাম । বসে পড়তেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা ঝাকিতে এদিক ওদিক ঝুকে যাচ্ছে ।
আমি উঠে গিয়ে মেয়েটাকে বসতে দিলাম । ব্যস আমার মনে আর কিছু ছিল না । ফার্মগেট আসতেই বাসের অনেকেই নেমে গেল । মেয়েটার পাশের সিট টাও ফাকা হয়ে গেল । মেয়েটা আমাকে রীতিমত ডেকে সেই ফাকা সিটে বসালো । বসে মেয়েরা স্বাধারনত এমনটা করে না । সিট ছেড়ে দিলে সেই উপকারের কথা তারা মনে রাখে না বরং এমন একটা ভাব করে যেন সেই সিটে আসলে তারই বসার অধিকার ছিল আমি অবৈধ ভাবে সেখানে বসেছি । যাক এই মেয়েটা সেরকম নয় জেনে ভাল লাগলো !
বাস যখন আড়ং এর মোড়ে আটকে আছে তখন মেয়েটার সাথে টুকটাক কথা বললাম । নাম কি করে এই সব । মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে বলল এবং আমারটাও শুনলো ! ব্যস ওখান থেকেই শুরু ! তারপর প্রতিদিনই আমাদের দেখা হত । মেয়েটার একটা প্রাইভেট কোম্পানীর রিসিপ্টশনিষ্ট ছিল । তবুও সব কাজ শেষ করে বের হতে হতে রাত নয়টা বেজে যেত । অফিসের সবাই বের হলে তার বের হওয়ার উপায় ছিল না । ঠিক যখন আমি বের হতাম টিউশনী থেকে ।
আমরা একসাথে ওয়্যারলেস মোড়ে দাড়ানো থেকে বাসে মোহাম্মাদপুর আসা পর্যন্ত গল্প করতাম । নিজের কথা বলতাম ! বিশেষ করে যেদিন থেকে আমি আমার জীবনের গল্প করলাম ওর কাছে সেদিন থেকেই ও যেন আমার সাথে আরও বেশি বেশি কথা বলতে শুরু করলো ।
আমারও খারাপ লাগতো না । আমার প্রেমিকার তখন সবে মাত্র বিয়ে হয়ে গেছে । আমারও কারো সাথে কথা বলতে পেরে খারাপ লাগতো না ! দিনা মানে আমার প্রাক্তন প্রেমিকা যার সাথে আমি বাসার অমতেই পালাতে চেয়েছিলাম । বাসা থেকে বেরও হয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম । বাবা আমাকে হুমকি দিয়েছিল যে আমি যদি ঐ মেয়ের সাথে যাই তাহলে আমার জন্য তার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে । আমি তবুও বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলাম । মেট্রিকের পর কোন দিন বাবার উপর নির্ভরশীল ছিলাম বলেই হয়তো সাহসটা আমার ছিল । কিন্তু ঐদিন দিনা এল না । আমি একা একাই ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এলাম । পরে জানতে পারলাম আমার বাবাই না দিনার বাবাকে ফোন কে দিনাকে আটকানোর কথা বলেছিল । দিনা আর বের হতে পারে নি বাসা থেকে । বাবার উপর রাগ করে আর কোন দিন বাসায় যায় নি । তারও বছর খানেক পরে দিনার বিয়ে হয়ে যায় ! আমি একা একা ঘুরতে থাকি ।
তারপর সুপ্তির সাথে আমার দিনের পর দিন কথা হতে থাকে । মেয়েটা যে একেবারে বিশ্ব সুন্দরী ছিল সেটা আমি বলবো না । তবে মেয়েটার ভেতরে কিছু একটা ছিল যেটা আমার ভাল লাগলো । আর দুজনের যেহেতু মোহাম্মাদপুরেই থাকতাম শুক্রবারে দুজন এলাকার দোকানে ফুসকা চটপটি খেতাম !
একদিন আমি কিছু আচ করতে পারলাম । সেদিন আমার পড়ানোর সময় সূচিতে একটু পরিবর্তন আসার কারনে ঘন্টা দেড়েক পড়ে বের হলাম পড়ানো থেকে । তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে ! আমি অবশ্য আগে থেকেই ওকে মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আজকে যেন ও আমার জন্য অপেক্ষা না করে । আমার বের হতে দেরি হবে । কিন্তু যখন ওয়্যারলেস মোড়ে এলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম সুপ্তি মুখ শুনকো করে দাড়িয়ে আছে । আমাকে দেখে একটু মুখটা উজ্জল হয়ে এল !
আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম
-এখনও অপেক্ষা করছো কেন ?
-তোমার সাথে যাবো !
-তোমার কি মাথা খারাপ নাকি ! এতো সময় দাড়িয়ে থাকার দরকার ছিল কোন । বললাম না যে আমার দেরি হবে !
সুপ্তির মুখটা আবার কালো হয়ে গেল । অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো । আমার কেন যেন মনে হল ও কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে । আমি একটু বেশিই জোড়ে কথা বলে ফেলেছি ! আমি প্রবল বিশ্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । আমরা যে বাসে করে যাওয়া আসা করতাম ততক্ষনে সেই বাস বন্ধ হয়ে গেছে । ওকে নিয়ে রিক্সায় চড়লাম । রাস্তা ঘাট প্রায় ফাকা হয়ে গেছে । পুরো রাস্তা ধরে ও কোন কথা বলল না । কেবল আমার হাত ধরে বসে ছিল । বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে !
তারপর এক শুক্রবারে সব কিছু আরও একটু বেশি ওলট পালট হয়ে গেল । আমাকে সুপ্তি আমাদের এলাকার ঘোরোয়া মিনি চাইনিজে নিয়ে গল । আমি খানিকটা অবাক হয়েছিলাম তবে কিছু বললাম না । তারপর ও যখন বলল যে ওর ইচ্ছে যে আমাদের জীবনটা এরপর থেকে এক সাথে চলুক তখনও আমি আকাশ থেকে পড়লাম আরেকবার । দিনার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি এই ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে রেখে ছিলাম ।
-আমি কিভাবে বিয়ে করবো ?
-আমাকে পছন্দ না তোমার ?
-আরে পছন্দ হবে না কেন ? কিন্তু বললেই তো আর বিয়ে করা যায় না । তোমার তো একটা চাকরি আছে । আমার তো তাও নেই । টিউশনি করে দিন চলে !
-টাকা তো কম আয় কর না আমার থেকে !
-তা করি না কিন্তু সেটার তো স্থায়ীত্ব নেই । আজ আছে কাল নেই । তখন কি হবে !
-সেটা তখন দেখা যাবে ! দুজন মিলে আমার অনেক টাকা আয় কি ! চল্লিশের কাছাকাছি ! দুজনের জন্য এনাফ ! এটা কোন অযুহাত না ! তবে আমাকে যদি পছন্দ না হয় তাহলে অবশ্য আমি কিছু বলবো না !
আমি কি করবো বুঝলাম না । আমার পরিচিত অনেকেই বিয়ে শাদী করে ফেলেছে । আমার এসবের চিন্তা নেই দেখে ওসবের দিকে যায় নি । কিন্তু আজকে !
আর কিছু না ভেবে সুপ্তিকে বিয়ে করেই ফেললাম । আর কেউ না কেবল আমরা দুজন বিয়েতে হাজির হলাম । একবার মনে হল বাসায় জানাই তারপর মনে হল জানিয়ে কি হবে ! কোন দরকার নেই ।
বিয়ের পর দুজন আলাদা আলাদা থাকলেও পরের মাসেই মগবাজারেই একটা ছোট্র দুই রুমের বাসা ঠিক করে ফেললাম । আরও ভাল করে বললে সুপ্তিই বাসাটার খোজ বের নিয়ে এল । কবুতরের খোপের মত দুটো ঘর, একটা বাধরুম, একটা ছোট্ট রান্না ঘর সাথে ছোট একটা বারান্দা ! ব্যাস আর কিছু না । কিন্তু আমাদের জন্য অনেক কিছু । কিছু টাকা আমার হাতে ছিল, সেটা দিয়ে ঘরের জন্য আসবার পত্র কিনে ফেললাম । ছোট একটা ফ্রিজ একটা আলনা ! জুতার র্যাক !
কি বলবো জীবন কেমন চলছিল তবে যেমন চলতে শুরু করলো সেটা আমি কোন স্বপ্নেও ভাবিই । ছোট বাসার ভেতরে সুখের কোন অবাব ছিল না । টাকা পয়সারও অভাব ছিল । সুপ্তি ঠিকই বলেছিলো দুজনের যা খচর হতো তার থেকে আমরা দুজন একটু বেশিই আয় করতাম !
সকাল বেলা সুপ্তি অফিস চলে যেত । তবে যাওয়ার আগে আমার জন্য রুটি বানিয়ে তারপর যেত । আমি একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতাম । দুপুরে ও অফিস থেকে চলে আসতো এক সাথে খাওয়ার জন্য । তারপর বিকেলে আমি বের হতাম টিউশনীর জন্য । এসে দেখতাম ও রান্না করছে । ছুটির দিন গুলোতে আমরা বেলা করে এক সাথে শুয়ে থাকতাম । এক সাথে রান্না তারপর বিকেলে ঘোরাঘুরি । সত্যি বলতে কি জীবনটা এতো চমৎকার হবে কোন দিন ভাবতেও পারি নি ।
ওর মত মেয়ের সাথে এভাবে পরিচয় তারপর জীবনটা এভাবে এগিয়ে চলা !
আমি যতই সুপ্তির সাথে দিন কাটাতে শুরু করলাম ওকে যেন আস্তে আস্তে চিনতে শুরু করলাম । চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে হলেও একটা ব্যাপার আমি ঠিকই পরিস্কার বুঝতে পারতাম যে ও ভেতরে ভেতরে খুব জেদি । এবং ও জেদটা আমার সাথেই দেখাতো । সুপ্ত আগ্নেওগিরির মত ছিল ওর জেদটা । সব সময় দেখাতো তবে একবার শুরু হয়ে গেলে সেটা আর থামানো মুশকিল হয়ে যেত ।
সেটা আমি বিয়ের চার মাসের মাথায় টের পেলাম । টিউশনী সেদিন ছিল না । আমার অন্য এক জায়গায় একটু কাজ ছিল । আরও ভাল করে বললে কয়েক জনের সাথে দেখা করার কথা ছিল । এর মাঝে এমন একজন ছিল যাকে আমি এক সময় পছন্দ করতাম যদিও আমাদের মাঝে কোন দিনই কিছু হয় নি । অনেক আগের ঘটনা । আমি সব কিছুই সুপ্তিকে বলতাম এটাও ও জানতো । ও যখন শুনলো অন্য সবার মাঝে ঐ মেয়েটাও আছে তখন ওকে আমাকে বলল আমি যেন না যাই । এমন না আমাকে যেতেই হবে । তবে আমি সেদিকে কান দিলাম না ।
যাওয়ার আগে আরও বেশ কয়েকবারই বলল আমি যেন না যাই । কিন্তু আমি না শুনেই চলে গেলাম । রাতে বাসায় ফিরে দেখি মহারানী মুখ অন্ধকার করে আছে । আমার সাথে ঠিক মত কথা বলল না । রাতের খাবারের সময় দেখলাম ও কিছুই খেল না । আমার মনে হল হয়তো আগেই খেয়েছে তাই এখন খাবে না । কিন্তু পরদিন দুপুরেও ও খেতে এল না তখন একটু চিন্তায় পড়লাম । এমনতো করে না ও । ফোন করলেও ও রিসিভ করলো না । সন্ধ্যায় আমি টিউশনীতে গেলাম না । ও যখন বাসায় আসলো তখন দেখি ওর মুখটা শুকিয়ে এতো টুকু হয়ে গেছে । চেহারা দেখেই মনে হল ও সকাল থেকে কিছু খায় নি ।
আমি জোর করে খাওয়াতে গেলাম কিছুইতেই খেল না । আরও ভাল ভাবে জিজ্ঞেস করতেই বেরিয়ে এল যে আসলে সকাল থেকেই না গতকাল দুপুর থেকে না খেয়ে আছে আমার উপর রাগ করে । কত করে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়েও ওকে খাওয়াতে পারলাম না তো কিছুতেই । আমি কেন ওর কথা না শুনে চলে গেলাম ! এটাই ছিল ওর জেদের কারন !
শেষে আর না পেরে আমি নিজেও বললাম যে আজ থেকে আমারও খাওয়া দাওয়া বন্ধ । এখন থেকে ঠিক যত ঘন্টা না খেয়ে থাকবে তত দিন আমিও না খেয়ে থাকবো ! তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম !
ঘন্টা খানেক না পাড় হতেই দেখলাম ওর রাগ কমে এল । ও নিজে খেতে বসলো । সেই সাথে আমি নিজে আরও ভাল করে বুঝলাম সুপ্তি আসলে কেমন মেয়ে । নিজে জেদ ধরে নিজের উপর কষ্ট দিবে !
তারপরেও ছোট খাটো ভাবে ও আমার উপর রাগ করতো তবে সেটা সামলে নিতাম । সবার উপর মেয়েটা আমাকে যে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হত না । আর আমাকে ভালবাসে বলেই তো আমার উপর জেদ ধরে আমার সাথে রাগ করে ! এই মেয়েটার জন্য আমার কেন জানি অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে । বিয়ে করলে যে মানুষের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আসে সেটাও আমার মাঝে দেখা দিল । আমি চাকরীর জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করলাম । ওর সাথে জলদি জলদি রাতে ঘুমিয়ে পড়তাম । রাতে জলদি ঘুমানোর ফলে সকালে তাড়াতাড়ি উঠেও পড়তাম । তারপর চাকরির পড়া শুনা চালাতাম এক টানা ! এভাবেই দিন যাচ্ছিলো । আস্তে আস্তে সুফল পাওয়াও শুরু করলাম । আরও মাস ছয়েক যেতে না যেতেই আমি চাকরি পাওয়া শুরু করলাম । সব ধরনের চাকরিতে এপ্লাই করতাম । চাকরি পেলেও আসলে আমরা দুজনেই অপেক্ষা করছিলাম একটা ভাল চাকরি পাওয়ার অপেক্ষাতে ।
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো তখনই একদিন অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটলো । ও সকাল বেলা অফিসে চলে গেছে । আমি বসে বসে পড়ছি । এমন সময় আমাদের বাসার দরজায় কড়া নড়ার শব্দ পেলাম । একটু অবাক হলাম । আমাদের বাসায় কেউ ই আসে না । তাহলে এখন আবার কে এল ? দারোয়ান কি কোন কাজে এসেছে ?
কিন্তু দরজা খুলে বেশ অবাক হয়ে গেলাম । একজন স্যুট পরা মাঝ বয়সী মানুষ আমার সামনে দাড়িয়ে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে । হাতে কিছু একটার প্যাকেট ! আমি বললাম
-বলুন কাকে চাই ?
আমি এই ভদ্রলোকে যে আগে কোন দিন দেখি নি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ! সুপ্তির পরিচিত কেউ ? লোকটা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি সুপ্তির হাজব্যান্ড ?
আমি বললাম
-হ্যা ! আপনি ?
লোকটা একটু ইতস্তত করলো । তারপর বলল
-আমি ওর বাবা !
আমি একটু ধাক্কার মত খেলাম । প্রায় এক বছর হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের । তবে এর মাঝে কোন দিন ও ওর বাবা মায়ের ব্যাপারে একটা কথাও আমাকে বলে নি । প্রথমে আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তবে ও জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলো । তারপর থেকে আমি আর দ্বিতীয়বার জানতে চাই নি !
আমার শ্বশুর মশাইয়ের দিকে আমি আরেকবার ভাল করে তাকালাম । সে যে বেশ অবস্থা সম্পন্ন মানুষ সেটা আমি বুঝতেই পারছিলাম । আমি ওনাকে ভেতরে আসতে বললাম । উনি ভেতরে এল । আমাদের বসার ঘরে ছোট শোফার উপর ওনাকে বসতে দিলাম । বসতে বসতে উনি বললেন
-তুমি খুব অবাক হয়েছে আমাকে দেখে ?
-আসলে ও কোন দিন আপনাদের কথা আমাকে বলেই নি ! আমি জানতামই না ওর কেউ আছে কি না !
সুপ্তির বাবাকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখলাম । তারপর বললেন
-সুপ্তি আসবে কখন ?
-দেরী আছে । ও দেড়টার আগে আসবে না ।
-আমি যে এসেছি ও যেন না জানে !
-কেন ?
-আসলে ও আমার সাথে রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে । আমার মেয়ে তো আমার মতই জেদী । প্রচন্ড জেদ ! প্রথমে ভেবেছিলাম কোথায় আর যাবে ফিরে আসবে ! কিন্তু ও ফিরে আসে নি আর !
-ও !
-তারপর যখন বুঝতে পারলাম ও আর ফিরে আসবে না তখন পাগলের মত ওকে খুজতে শুরু করলাম । গত তিন বছরের ওকে দুইবার খুজেও পেয়েছিলাম দুই বারই ও আবার পালিয়ে গেছে । এইবার আর তাই ওর কাছে যায় । খবর পেলাম ও তোমাকে বিয়ে করেছে !
আমি কি জানতে চাইবো বুঝতে পারলাম না । তারপর একটা কথা মনে হতেই বললাম
-ও কিসের জন্য পালিয়েছিলো বাসা থেকে !
-আসলে দোষ যে আমার ছিল না বলবো না । এখন মনে হয় আমারই দোষ ছিল । ছোট বেলা থেকেই ওকে আমি আমার মত করে মানুষ করতে চেয়েছি । নিজের ইচ্ছে গুলো ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছি । তখন ভুলে গেছিলাম যে ও আমার মেয়ে ওর ভেতরে জেদ থাকবে । ও চুপ করে থাকলেও আসলে আমার উপর আস্তে আস্তে ওর প্রচন্ড অভিমান জন্মেছিলো । তারপর যখন ও পড়ালেখা শেষের আগেই আমি ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলাম তখন সেই জেদটা বের হয়ে এল । ও বাসা ছেড়ে চলে এল ! আর ফিরে যায় নি !
আমার সুপ্তির বাবার জন্য খারাপই লাগলো । তিনি আরও বেশ কিছু সময় থাকলেন । আমার সাথে অনেক কথা বললেন । সুপ্তির অনেক ছবি দেখলেন ! তারপর যাওয়ার সময় সেই প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে বললেন ও চকলেট খুব পছন্দ করে । ওকে যেন আমি এগুলো দেই আস্তে আস্তে । আর কোন ভাবেই যেন ওকে না জানাই যে উনি আমার কাছে এসেছিলেন ! আমি কথা দিলাম যে বলব না !
তারপর থেকে সুপ্তির বাবা আমাকে নিয়মিত ফোন দিতেন । আমিও কথা বলতাম । কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো ওর বাবার কথা সুপ্তির কাছে বলা উচিৎ । ভদ্রলোক যথেষ্ট সময় কষ্ট পেয়েছেন নিজের এক মাত্র মেয়ের কাছ থেকে দুরে থেকে । আমি কেবল সুযোগের অপেক্ষাতে ছিলাম । তেমন সুযোগ একটা চলেও এল । যে ভাল চাকরিটার অপেক্ষা করছিলাম সেটার কল চলে এল ।
রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওকে জড়িয়ে যখন শুয়ে পড়লাম তখনও ওকে বললাম
-একটা কথা বলব । রাগ করবা নাতো ?
সুপ্তি আমার দিকে মুখ করে শুয়ে বলল
-রাগ করবো কেন ? তবে ঐ বদ মেয়ের কথা বলবা না !
আমি হাসলাম । তারপর বললাম
-আজকে সকালে আমার একটা চাকরি কল এসেছে !
কোম্পানীর নাম আর স্যালারীর কথা বলতেই সুপ্তি চিৎকার করে উঠলো । তারপর আমার বুকে একটা ছোট করে কিল মেরে বলল
-এটা এতো সময় আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছো ! তুমি খুব খারাপ ! আজকে আমরা রাতে বাইরে খেতাম !
-এক সাথে সেলিব্রেট করার আরও অনেক সময় আছে ! বুঝলে ।
-হুম ! আমি জানতাম তুমি এক দিন ঠিকই পারবে !
-এটা তোমার জন্যই ম্যাডাম ! তোমাকে বিয়ে না করলে হয়তো এমন কথা আমার মনেও আসতো না ।
সুপ্তি আমাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল
-হুম হয়েছে । বুঝলাম ! কালকে আমরা তোমার জন্য কেনাকাটার জন্য বের হব ! ঠিক আছে !
-নাহ ! কালকে আমরা অন্য কোথাও যাবো ?
-কোথায় ?
-তোমার বাবার বাসায় ।
আমি ভেবেছিলাম সুপ্তি চমকে উঠবে । তবে সে চমকালো না ! আমি অবাক হলাম ! তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলালম
-তুমি জানতে আমার সাথে দেখা হয়েছে ?
সুপ্তি কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল
-কবে থেকে দেখা হয়েছে জানি না । তবে যেদিন থেকে ওয়্যারডোরফের ভেতরে লুকানো চকলেট গুলো দেখেছি সেদিন থেকে জানি । বাবা আমার জন্য প্রতিদিন চকলেন নিয়ে আসতো !
সুপ্তি তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে আছে । ওর চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি না । তবে আমার মনে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । আমি বললাম
-তোমার বাবাকে যথেষ্ঠ শাস্তি দেওয়া হয়েছে । আমার মনে হয় এখন তাকে তোমার মাফ করে দেওয়া উচিৎ !
সুপ্তি অনেকটা সময় কোন কথা বলল না । তারপর বলল
-ঠিক আছে ! এখন আমি চাইলেও তো আগের মত গায়েব হয়ে যেতে পারবো না । তুমি আমার সাথে আছো । তবে তুমি নিজেও তোমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক ঠিক করবে বল !
একটু হেসে বললাম
-করবো !
সেদিন রাতে আমরা প্রায় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম । এতো দিন যে সুপ্তি আমাকে ওর ফ্যামিলির ব্যাপারে একটা কথাও বলে নি সেই সুপ্তিও আমাকে কত কথাটা যে বলল ! আমাদের সামনের জীবনটা যে আরও চমৎকার হতে যাচ্ছে সেটা আমার কিংবা সুপ্তির কারো বুঝতেই অসুবিধা হল না !
জীবনটা আসলেই এভাবে এক জনের সাথে জড়িয়ে যায় । এভাবেই এগিয়ে চলে । সুপ্তির সাথে আমার ভাগ্যই লেখা ছিল নয়তো এভাবে ওর সাথে পরিচয় হত না । না হলে সুপ্তির জেদও হয়তো কোন দিন কমতো না ! সব কিছুর জন্যই উপর ওয়ালা কিছু না কিছু ঠিক করে রেখেছেন । কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষা !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ২:২৯