শীতের সকালে বেলা করে ঘুমানো আমার অনেক দিনের অভ্যাস । সব কিছু থেকে এই ঘুমটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ন মনে হয় । আর নাজিয়া জীবনে আসার পর থেকে এটা যেন আরও কয়েকগুন বেড়ে গেছে । এখন কেবল ঘুম হলেই চলে না নাজিয়ার সাথে ঘুমানিটা জরুরি কাজের ভেতরে পরে গেছে ।
সকালে নাজিয়া ঘুম থেকে উঠতে চাইলেও ওকে উঠতে দিতাম না । জোর করে বিছানা ধরে রাখতাম । আমার কারনে বেচারিকে নিজের ডিউটি টাইম পর্যন্ত বদলাতে হয়েছে । আগে সকাল হলেও ওঠার জন্য নড়া চড়া করতো কিন্তু আস্তে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে । আজকেও সকালে ঘুম ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে ছিলাম ।
কিন্তু একটা সময়ে উঠতেই হল । ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকে উঠতেই হবে ?
-কেন ?
-ভুলে গেছো ?
-আজকে আবার কি ! আজকে না শুক্রবার, ছুটির দিন ?
- তোমার তো প্রতিদিনই ছুটির দিন । আর আমার তো শুক্র শনি নাই জানো না ? আজকে বাবার বাসায় অনুষ্ঠান আছে, মনে নেই ?
আমি ওকে আরেকটু জড়িয়ে ধরলাম । তারপর ওর চোখ বন্ধ অবস্থায় ওর কপালে একটু ছোট চুমু খেয়ে বললাম
-তোমার বাবা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না ।
নাজিয়ার মুখ থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে শুনলাম । তারপর ও বলল
-জানি । কিন্তু কি করবো বল ? বাবা তো ! ফেলে তো আর দিতে পারি না !
-হুম ! যেতেই হবে ?
-হুম । যেতেই হবে ! আমি দিউটি থেকে সোজা চলে যাবো ওখানে । তুমিও চলে এসো ।
-আচ্ছা !
আরও আধা ঘন্টা ওকে জড়িয়েই শুয়ে রইলাম । তারপর নাজিয়া আমাকে রেখেই উঠে গেল । ওর হাসপাতালে ডিউটির সময় হয়ে যাচ্ছে । আমার অবশ্য সেই সমস্যা নেই । আমি চাইলেই বেলা করে ঘুমাতে পারি । আমার কাজ সন্ধ্যা থেকে ।
অনেকের কাছে ব্যাপারটা এখনও ঠিক বিশ্বাস যোগ্য হয় না যে নাজিয়ার মত মেয়ে আমাকে কেবল পছন্দই করে নি, আমাকে সবার অমতে বিয়েও করেছে । আমরা গত চার মাস ধরে চমৎকার সংসার করে চলেছি ।
নাজিয়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ওর চেম্বারে । ও তখন ডা. আজম খানের এসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করে । আমি আমার ভাতিজাকে নিয়ে গেছি সেখানে । সেখানেই ওকে প্রথম দেখি ওকে । টুকটাক কথা হয় । তারপরে নাজিয়ার সাথে দেখা হয় একটা সেচ্ছা সেবিকদের অনুষ্ঠানের ! আমার যেহেতু কোন কাজ কর্ম নেই আমি মাঝে মাঝে অনেক জায়গাতে যাই । একটা ক্যাম্পেইনে নাজিয়াকে দেখতে পাই । আমি ওকে ঠিক মত চিনতে পারি নি ওকে । ও নিজেই আমাকে চিনে ফেলল । সারা দিন ছিলাম ক্যাম্পে । সন্ধ্যায় যাওয়ার সময় ও কারো কাউকে খুজে পাচ্ছিলো না । আমি ওকে সঙ্গ দিলাম ঢাকা পর্যন্ত ! ঐদিন আসার পথে ওর সাথে অনেক কথা হল । ও অনেক কথা বলল । কেন বলল কে জানে ? তবে আমার শুনতে খারাপ লাগছিলো না ।
নাজিয়ার বিয়ে হয় ও যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ে । ওর বাবার একান্ত ইচ্ছায় । ছেলে তখন ফুল ডাক্তার । তবে বিয়েটা টিকলো না । ছেলেটা বাইরে দিকে যতটা ব্রাইট ভেতরে ভেতরে ততটা ব্রাইট ছিল না । নাজিয়ার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতো । ওর ডাক্তারী পাশের আগেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায় । প্রথমে বেশ কিছু দিন নাজিয়া ফ্রাস্টেড ছিল । তারপর নিজেকে বিভন্ন কাজে যুক্ত করা শুরু করে । সেখানে থেকে এই স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে টুকটাক কাজ শুরু !
বাস থেকে যখন নামলাম আমরা গুলিস্তানে দেখি ওকে নেওয়ার জন্য একটা সাদা কালো রংয়ের প্রাডো গাড়ি দাড়িয়ে আছে । ও আমাকে লিফট দিতে চাইলো কিন্তু আমার অন্য দিকে যাওয়ার ছিল । ভেবেছিলাম ঐটাই সম্ভবত আমাদের শেষ দেখা হবে । কিন্তু বাসায় যেতে না যেতেই নাজিয়ার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে হাজির । এরপর থেকেই ওর সাথে আমার কথা বার্তা শুরু হয় । প্রথমে ইনবক্সে টুকটাক হাই হ্যালো । তারপর ফোন শেষে সেখান থেকে দেখা সাক্ষাত শুরু । আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না নাজিয়ার সাথে আমার হঠাৎ এতো কথা কেন শুরু হয়ে গেল !
আসলে কেউ কেউ এমন থাকে যার সাথে কথা শুরু হলে কথা বলতেই ইচ্ছে করে । নাজিয়া ছিল তেমনই একজন । হয়তো ওরও আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগতো । মিমির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমার আর কোন মেয়ের সাথে এতো কথা কোন দিন হয় নি । মিমির কথাও আমি নাজিয়াকে বলেছিলাম সব । ও নিজের বৈবাহিক জীবনের দুঃখ স্মৃতির কথা আমার সাথে শেয়ার করতো । আমার কেন জানি মনে হত ও কথা গুলো বলে শান্তি পেত ।
মাঝে মাঝেই আমাদের দেখা হত । আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম । নিজেও ঠিক বুঝতাম না আমার মাঝে এতো কথা কোথায় ছিল । মাঝে মাঝে যখন ওর নাইট ডিউটি থাকতো আমি ওর হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হতাম । রাত ভয় ওর অফিসে বসে চা খাওয়া হত আর কথা চলতো । একটা কথা আমি বুঝতে পারতাম যে আমার সাথে ও প্রান খুলে হাসতো । আমিও হাসতাম ।
এমন একদিনের কথা । আমি আর ও বসুন্ধরাতে বসে বসে গল্প করছি । একটা মুভি দেখার প্লান করেই গেছি । এমন সময়ই ও একটু ওয়াশ রুমে গেল । ফিরে এসে দেখি ওর মুখের ভাবটা একদম মুছে গেছে । জানতে চাইলাম
-কি হয়েছে ?
-কিছু না ! চল এখন থেকে । আমার কেন জানি ভাল লাগছে না ।
এমন ভাবে কিছু না বলল আমি মোটামুটি শিওর হয়ে গেলাম যে কিছু একটা হয়েছে । কার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে । কার সাথে দেখা হয়ে হলে ওর মুড অফ হতে পারে ! চিন্তা করতে লাগলাম । প্রথম যে নামটা মাথায় এল সেটা হচ্ছে ওর এক্স হাসব্যান্ড !
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-কোথায় দেখা হয়েছে ?
নাজিয়া প্রথমে কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতের ইশারায় দেখালো কোন দিকে দেখেছে । আমি ওর হাত ধরলাম । এরপর ওকে নিয়ে এমন ভাবে ওদিকে হাটতে লাগলাম যেন বাইরে থেকে যে কেউ আমাদের দেখলে মনে করে আমরা কাপল । একটু যে অস্বস্তি লাগছিল না তা না তবে নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখের হাসিটা আবার আস্তে আস্তে ফিরে আসছে । হাজব্যান্ডের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম ওর হাজব্যান্ড আমাদের দেখতে পেয়েছে । এবং আমাদের চলার ভঙ্গি দেখে ওনার বুঝতে কষ্ট হল না যে আমাদের ভেতরে কি সম্পর্ক । হেসে সামনে বসা একজনের সাথে কথা বলছিলো । সেই হাসিটা মিলিয়ে যেতে দেখলাম । আমি ঠিক এটাই চাচ্ছিলাম !
ঐ দিন নাজিয়ার সাথে মুভি দেখছিলাম নাজিয়া আমার হাতটা ধরেই রেখেছিলো সবটা সময় । আমি কেন জানি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে আমাদের ভেতরে । তারপর থেকে নাজিয়া আমার সাথে দেখা সাক্ষাক কমিয়ে দিল । এমন কি কথা বলা পর্যন্ত । ঠিক এক মাসের পর ও আমাকে বিয়ের জন্য প্রোপোজ করে বসলো । আমি সেদিন এতো অবাক হয়ে এর আগে হয়েছিলাম কি না আমি জানি না !
আমি কেবল বললাম
-আমার মত বেকার একটা ছেলেকে বিয়ে করলে মানুষ কি বলবে ?
নাজিয়া হেসে বলল
-লোকের মন মত চলতে গিয়ে একবার তো খুব স্বকার ছেলেকে বিয়ে করেছিলাম । ফলাফল তো দেখতে পেয়েছি ।
নাজিয়াকে মানা করার কোন উপায় ছিল না । তবে ওর বাবার দিক থেকে প্রবল আপত্তি এল । সে কিছুতেই আমাদের বিয়ে হতে দিবে না । এমন কি আমাদের বাসায় পর্যন্ত চলে গেল আমাদের বিয়ে ঠেকাতে । তিনি কোন ভাবেই তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে প্রস্তুত নন । শেষে মা আমাকে ফোন করে বলল নাজিয়ার ব্যাপারে আরেকবার ভেবে দেখতে বলল । যদিও সরাসরি আমাকে কিছু বলে নি । বাবা মা কোন দিনই আমার উপর তাদের সিদ্ধান্তা চাপিয়ে দেয় নি । এমন কি আমি কি করবো কিংবা করছি সেটা নিয়েও তাদের কোন মাথা ব্যাথা খুব একটা ছিল না । তাদের আদর্শ বড় ছেলে মানে আমার বড় ভাইকে নিয়েই তারা সুখে ছিল ।
নাজিয়ার বাবা এমন কি নাজিয়াকে হুমকি দিল যে যদি আমার সাথে সে বিয়ে করে তাহলে তার দরজা চিরো দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে তার জন্য । এই কথা শোনার পরদিনই নাজিয়া বাসা ছেড়ে চলে আসলো । আমরা দুজন মিলে সারাদিন বাসা খুজে একটা বাসা ভাড়া করলাম । আমি চাকরি বাকরি কিছু না করলেও টিউশনী করে বেশ ভাল টাকা আয় করি । কিছু জমানো টাকাও আমার ছিল । বড় ভাইয়ার কাছ থেকে আরও লাখ খানেক টাকা ধার নিলাম । ভাইয়া অবশ্য মানা করলো না। বরং বলল যে বিয়ে শাদী করলে যদি আমার কিছুটা সুমতি হয় !
দুজন মিলে সারাদিন কেনা কাটা করে ঘর দোর ভরিয়ে ফেললাম । তার এক সপ্তাহে মাঝেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল । একা একাই হল বিয়ে টা । বাসায় বললাম আগে চাকরি বাকরি পাই তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান হবে । যদিও নাজিয়ার বাবা বলেছিলো যে তার বাড়ির দরজা বন্ধ কিন্তু বিয়ের দুদিনের মাথায় সেই দরজা খুলে গেল । আমাদের দাওয়াত দিল ও বাসায় !
দরজা বন্ধ না হলেও একটা কথা আমি বুঝতে পারতাম যে নাজিয়ার বাবা আমাকে ঠিক পছন্দ করতেন না । মাঝে মাঝে খোচা দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতেন । আমিও কম যেতাম না । হাসতে হাসতেই তার খোচার জবাব দিতাম । এতে তিনি আরও রেগে যেতেন । তবে নাজিয়ার জন্য রাগারাগি করতে পারতেন না ! এভাবেই চমৎকার ভাবেই চলে যাচ্ছিলো জীবন ।
সন্ধ্যা বেলা একটু আগে আগেই বের হলার টিউশনী থেকে । আমার টিউশনীর কাছেই একটা কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান টা হচ্ছিলো । ওর বাবার অফিসের কোন প্রোগ্রাম ! আমি গেটের কাছে এসে দেখি নাজিয়া সেখানে দাড়িয়ে আছে । আমার জন্য অপেক্ষা করছে । আমাকে দেখতে পেয়ে হাসলো । আমি রিক্সা থেকে নামার আগেই রিক্সার সামনে এসে থামলো । বলল
-নেমো না ।
-সে কি কেন ?
-ভেতরে ঢুকেছিলাম ।
-আমি ঢুকবো না ?
-আমি জানি তুমি এখানে আসতে চাও না । সুতরাং জোর করে আসতে হবে না । আমি বাবাকে মুখে দেখিয়ে এসেছি । চল !
-সত্যি যেতে হবে না ?
-না ।
আমি একটু হাসলাম । আসলেই আমার এই টাইপের অনুষ্ঠানে যেতে ভাল লাগে না । আর যেখানে ওর বাবা আছে সেখানে তো আরও যেতে ইচ্ছে করে না । নাজিয়া বলল
-চল । আজকে আমরা ক্যান্ডেল লাইট দিনার করবো । আমার ট্রিট !
আমি রিক্সা ঘুরাতে বললাম । বিয়ের ব্যাপারে আগে আমার একটা ভীতি ছিল বিয়ে ব্যাপারে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা আসলেই খারাপ কিছু নয়, বিশেষ করে নাজিয়ার মত একজন বউ থাকলে তো কথাই নেই । life is beautiful.
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:০৩