প্রথমবার আমি দরজার টোকাটা আমি ঠিক মত শুনতে পাই নি তবে পরের টোকাটা ঠিকই শুনতে পেলাম । কেউ আমার দরজায় টোকা দিচ্ছে । ঘড়িতে খুব বেশি রাত হয় নি তবে এই জায়গাটার জন্যটার এই সময়টা অনেক রাত ।
সেন্ট-মার্টিনে এগারো টার সময় সকল লাইট অফ হয়ে যায় । সব দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় । আর এখানে আমাকে চেনার কথা না । কেউ এসে আমাকে ডাকও দেবে না । কেবল একজন ছাড়া !
আমি দরজা খুলতে যাকে আশা করেছিলাম সেই দাড়িয়ে আছে । লাইটের আলো নেই তবে আকাশে চাঁদ আছে । সেই আলোতে মেয়েটাকে দেখতে কেমন যেন মনে হচ্ছে ।
আমার দিকে তাকিয়ে ফাইজা বলল
-আমার ভয় লাগছে !
-কিসের ভয় ?
-কিসের যেন আওয়াজ আসছে ।
-ও ।
-ঘুম আসছে না ।
-তাহলে ? কি করবে ?
-চল না, একটু সমুদ্রের পাড় থেকে হেটে আসি !
আমি চারিদিকে তাকালাম । চারিদিকে নিরবতা বিরাজ করছে । তবে এখন বের হওয়াটা খুব বেশি অস্বাভাবিক হবে না । আমি দরজা দুটো লক করে ওকে নিয়ে হাটতে বের হলাম । আমাদের হোটেলটা সমুদ্র পাড়ের একদম পাশেই । ওখানে যেতে খুব বেশি সময় লাগলো না । চাঁদের আলোতে ফাইজার সাথে হাটতে আমার একটু অন্য রকম লাগছিলো । আমরা আপন মনে হাটছিলাম । এমন সময় হঠাৎ করেই ফাইজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি খুব অবাক হয়েছিলে যখন আমি তোমার সাথে এখানে আসতে চাইলাম, তাই না?
আমি ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম
-একটু অবাক যে হই নি বলবো না । তবে তোমাকে যেমন ভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে তুমি সব কিছু করতে পারো ।
-আমি এখানে কেন এসেছি জানো ?
-কেন ? ট্যুর !
-সুইসাইট করতে !
আমার প্রথমে মনে হল আমি ঠিকমত শুনতে পারি নি । আমি দাড়িয়ে পড়লাম হাটতে হাটতে । বললাম
-কি বললে ?
-সুইসাইড । আত্মহত্যা !
-মানে কি !
আমার মনে হল ফাইজা আমার সাথে ঠোট্টা করছে । আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-আসো হাটি !
তারপর আবারও হাটতে লাগলো সামনের দিকে । আমিও ওর সাথে সাথে হাটতে লাগলাম । আর ওর সাথে এখানে আসার কথা ভাবতে লাগলাম । আমি কোন দিন ভাবতেও পারি নাই যে কোন দিন এরকম ভাবে ওর সাথে আমার এই সমুদ্রে পাড়ে হাটা হতে পারে । এমন কোন সম্ভাবনাও আমার মনে কোন দিন দেখা দেয় নি । কিন্তু আজকে আমি ওর সাথে হাটতেছি । এখানে আসার দুদিন আগেও আমি ঠিক জানতাম না যে ফাইজা আমার সাথে আসবে ।
আমি প্রায়ই এদিক ওদিক ট্যুর করে বেড়াই । একা একাই এদিক ওদিক চলে যাই । কদিন থেকেই ভাবছিলাম যে সেন্ট মার্টিনে আসবো । অফ সিজেনে এখানে আসাটার কথা অনেক দিন থেকেই মাথায় ছিল । কিন্তু ক্লাস টিউশনী আর পরীক্ষার ফাঁকে সময় করতে পারছিলাম না । সেই সময়ে একটা এক সপ্তাহের ছুটি চলে এলো । এক সপ্তাহ বলতে আমাদের ক্লাশ সপ্তাহ তিন হয় । আর সেই তিন দিনের দুইদিনেই আমাদের ক্লাস স্যারেরা অফ ঘোষনা করে করে আর বাদি দিন টা পাবলিক হলিডে পড়ে যায় । এই সুযোগ কোন ভাবেই মিস করা যায় না । আমি প্লান করে ফেললাম । আমি যেদিন টিকিট করতে যাবো ঠিক সেই দিনই ফাইজা আমার কাছে এসে বলল
-তুমি কি সেন্টমার্টিন যাবে ?
-হ্যা ।
-আমার জন্য একটা টিকিট কাটবা প্লিজ ।
-তুমিও যাবা নাকি ? একা ?
-ভয় নেই আমি তোমাকে জ্বালাবো না । কেবল সেন্ট মার্টিন যাওয়া পর্যন্ত ! কাটবা প্লিজ !
-আচ্ছা সমস্যা নেই !
একটু অবাক লাগছিলো । কারন ফাইজা ঠিক আমার বন্ধু না । কেবলই ক্লাস মেইট । এর বেশি কিছু না । এর আগে ও আমার সাথে ঠিক মত কথা বলেছে কি না আমার মনেও নেই । তবে মেয়েটা এক সময় খুব হইচই করতো ক্লাসের ভেতরে । সব সময় হই হুল্লর চিৎকার চেঁচামিচির মধ্যেই থাকতো । কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে দেখি মেয়েটা কেমন যে নিশ্চুপ হয়ে গেছে । ক্লাসে আসাও কমিয়ে দিয়েছে । অন্য সবার সাথে কথা বার্তাও কমিয়ে দিয়ে অনেক !
ওর সাথেই আমি টিকিক কাটি । একসাথে টেকনাফ তারপর ট্রলারে করে এখানে এসে হাজির হই । আমি অবশ্য ভাবতে পারি নি ফাইজা এই ট্রলারে করে এখানে আসার সাহস করবে কিন্তু ট্রলারে উঠার পরে ও এমন একটা মনভাব করে বসে থাকলো যেন ও নিয়মিতই এই ট্রলারে করে এইখান দিয়ে যাওয়া আসা করে । কিন্তু একটু আগে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার বলে কি না ওর ঘুমাতে ভয় লাগছে !
আমি ফাইজার পাশাপাশি হাটতে থাকি । ঢাকার জন্য হয়তো কোন রাতই না কিন্তু এখানের জন্য অনেক রাত যদিও কয়েকজন মাছুড়েদের দেখা যাচ্ছে । আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও নিজেদের কাজে মন দিল । একটু পরেই নৌকা নিয়ে বের হয়ে যাবে ওরা ! আমরা হাটতে থাকি । ফাইজা কোন কথা না বলেই হেটে চলেছে । আমারও অবশ্য হাটতে খারাপ লাগছে না ।
হঠাৎই ফাইজা বালির উপর বসে পড়লো । আমাকেও থামতে হল । ওর দেখাদেখি আমিও বসে পড়লাম ওর পাশে । ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-বলবে কিছু ? নাকি বলার ইচ্ছে নেই ।
-জানি না !
-তুমি এখানে সুইসাইড করতে এসেছো ?
-হুম !
-এখন ?
-জানি না । এখন মনে হচ্ছে আসা উচিৎ হয় নি ।
-আমাকে বলা যাবে কারন টা ?
ফাইজা অনেকটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর হঠাৎ করেই বলল
-আমার মেয়েটা মরে গেছে !
আমি বেশ খানিকটা অবাক কন্ঠে বললাম
-মেয়ে মানে ? তোমার বিয়ে হল কবে ?
-মেয়ে হওয়ার জন্য বিয়ে হতেই হয় ?
আমি চুপ করেই গেলাম । ফাইজা আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে আমি বুঝে গেলাম । আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না । কিছু কিছু ব্যাপারে মেয়েরা খুব বেশি সেন্সসেটিভ হয় । এটা কেবল তারাই বুঝতে পারে । সেগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হয়তো তেমন ঠিকঠাক মত প্রকাশ করতেও পারবো না । তাই চুপ থাকাই শ্রেয় !
ফাইজা আকাশের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । তারপর হঠাৎ করেই আবার বলল
-জানো আমি ওকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতেই চেয়েছিলাম । রাফি চায় নি তবুও নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম । আমার নিজের মেয়ে, নিজের শরীরের একটা অংশ কিন্তু আমি পারি নি । আমি ....
ফাইজার কন্ঠে এমন কিছু ছিল যেটা ওর মনের আকুলতা ওর মনের কষ্টটা পরিস্কার বের করে দিচ্ছিলো । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । কিছু বলা ঠিকও হবে না কি না বুঝতে পারছিলাম না । আমি কেবল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । কেমন একটা শূন্য চোখে মেয়েটা তাকিয়ে আছে ।
আমি বললাম
-একটু কাঁদো চিৎকার করে । এই দেখছো না সমুদ্র এ সব কিছু গিলে নেয় । তোমার কষ্ট গুলোও গিলে নেবে !
ফাইজা আমার দিকে তাকালো । তারপর উঠে দাড়িয়ে বলল
-চল নামি !
-এখন ?
-হ্যা । আসো প্লিজ ।
আমি কথা বাড়ালাম না । অবাক হলেও মেয়েটার কাজ কর্ম দেখতে ইচ্ছে করছে । ফাইজা স্যান্ডেলটা খুলে সমুদ্রের দিকে হাটতে লাগলো । আমি ওর সাথে সাথে হাটতে লাগলাম । যখন কোমর পর্যন্ত পানি তখন আমি ওর হাত চেপে ধরলাম । বললাম
-আর এগিও না । সমুদ্র এখন বেশ উত্তাল দেখছো না ।
ফাইজা আমার দিকে তাকিয়ে আবার সমুদ্রের দিকে তাকালো । আমি ওর পাশে এসে দাড়ালাম । অদ্ভুদ এক অনুভূতি হচ্ছিলো । সমুদ্রের ঢেউয়ের কারনে আমরা দুজন একটু নড়ছিলাম । ফাইজা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল
-আসলেই কি আমার কষ্ট গুলো এই সমু্দ্র নিতে পারবে ?
-পারবে । অবশ্যই পারবে !! তুমি এক কাজ কর নিজের মত যত দুঃখ আছে সেটা একটা চিৎকার দিয়ে বের করে দাও ।
ফাইজা আরও কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে থাকলো । আবছায়া আলোতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখান থেকে পানি পরতে শুরু করেছে । তারপর ও সত্যি সত্যি খুব জোরে একটা চিৎকার দিল । তারপর আরেকবার !
তৃতীয় চিৎকারটা কান্নাতে রূপান্তর হতে সময় লাগলো না । আমার কেন জানি মনে হল এই সময়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরা উচিৎ । ওকে এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ।
তারপর আবারও পাড়ের দিকে হাটা দিলাম । ফাইজা তখনও কেঁদেই চলেছে । যখন ওকে যখন রুমে এলাম তখন ফাইজা খানিকটা সামলে নিয়েছে । একা একাই নিজের রুমে গেল । বাধরুমে গিয়ে পোষাক বদলে এসে দেখি ওর ঘরের দরজা খোলা । টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি ভেতরে তাকিয়ে দেখি ফাইজা বিছানার উপর বসে আছে ।
আমি ভেতরে ঢুকে ওর পাশে বসলাম । তারপর বললাম
-ভাল লাগছে এখন ?
-ফাইজা কোন কথা না বলে কেবল মাথা নাড়লো ?
-আমি এখানে ঘুমাই ?
প্রত্যেকটা রুমেই দুটো করে বেড রাখা ঘুমানোর জন্য । ফাইজা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো । আমি তাড়াতাড়ি বললাম
-তুমি না বললে তোমার ভয় লাগছে !
ফাইজা হেসে ফেলল । তারপর বলল
-তোমার ভয় লাগছে আমি যদি আবার কিছু করে না ফেলি !
আমি মাথা চুলকে বললাম
-আসলে একটু ভয় যে করছে না তা আমি বলব না ।
-ভয় নেই আমি করবো না সুইসাইড !
-সত্যিই তো ?
-হুম । তবে তুমি চাইলে এখানে ঘুমাতে পারো । আই হ্যাভ নো প্রব্লেম !
মোমের আলোতে অনেকটা সময় ফাইজার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটা কেমন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । আমি অন্য খাট থেকে মেয়েটার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রইলাম । মোমের আলোতে অদ্ভুদ সুন্দর লাগলো সেই চেহারা !
সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গলো তাকিয়ে দেখি ও বিছানাতে নেই । বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো । জলদি উঠে বাধরুমের দরজাতে কান পাতলাম । ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে না । আমি যখন ঘুরতে যাবো তখন দেখি ও দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে । হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওর পোশাক দেখে মনে হল ও বাইরে গেছিলো হাটতে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ভাবছিলে ?
-না মানে কিছু না !
-ভয় পেও না । গত কালকের মত আমার মাথা ঠিক হয়েছে । সামলে নিয়েছি অনেকটাই । আর সব থেকে বড় কথা অনেক দিন পর শন্তিতে ঘুমিয়েছি রাতে ।
-সমুদ্র তাহলে সত্যি সত্যিই তোমার কষ্ট গুলো নিয়ে গেছে ।
-হয়তো ! চল হাত মুখ ধুয়ে নাও । সকালের নাস্তা করে আসি । তারপর ছেড়া দ্বীপে যাবো ।
কেমন করে বাকি চারটা দিন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না । আমরা সারাদিন সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতাম । ওর মনের যত কথা আছে আমাকে বলতে লাগলো ঠিক আমার পেটের সব কথা খুচিয়ে খুচিয়ে বের করতে লাগলো। সময়টা যতটা ভাল ভেবেছিলাম তার থেকেও ভাল গেল ফাইজার সাথে । ফেরার পথে আরেক কান্ড ।
ফেরার পথে ট্রলারে ফাইজা পুরো সময়টা আমাকে চেপে ধরে বসে রইলো । ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম ও ভয় পাচ্ছে । কিন্তু আসার পথে ওর মুখ বিকার ছিলো । কারনটা ধরতে অবশ্য খুব একটা কষ্ট হল না ।
যাই হোক আবারও ঢাকায় এসে স্বাভাবিক জীবন শুরু হয়ে গেল । এবং ফাইজা সেই স্বাভাবিক জীবনের একটা অন্যতম অংশে
পরিনত হল ।
তারপর ..... নাহ সেটা অন্য কোন গল্প । এই গল্পটা কেবলই ফাইজার । সামনের গল্পটা হয়তো আমাদের দুজনের হবে !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:০৯