দিশার দিকে তাকিয়ে মনে হল অনেকটা পথ ও হেটে এসেছে । একেবারে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা । আমাকে দেখে জলদি জলদি মুখটা মুছলো হাতের রুমাল দিয়ে । অন্য হাতে ছাতাটা ধরা ।
আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । তারপর বললাম
-তুমি আবারও হেটে এসেছো ?
অপরাধ ধরা পরে গেছে এমন একটা ভাব করে দিশা হাসলো । আমি খানিকটা রাগের মুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে । ও আমার কাছে এসে বলল
-প্রতিদিন তো আর আসি না । মাঝে মাঝে যখন রিক্সা পাই না তখন আসি !
-রিক্সা পাও নি সিএনজি নিয়া আসবা ? এতো কষ্ট করার মানে কি ?
দিশা যেন আমার কথা শুনে খুব মজা পেল । আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-আশিক সাহেব, ১০ হাজার বেতনের চাকরিতে রিক্সা চড়াটাই অনেক বিলাসিতা । তার উপর আবার সিএনজি !
আগে এই কথাটা দিশা প্রায়ই বলতো । রিক্সাতে চড়তে চাইতো না । আমার জোর করার কারনে এখন রিক্সাতে উঠে । বলেছি যে যদি রিক্সা করে না আসা যাওয়া কর তাহলে চাকরি করতে দিবো না । এতো কষ্ট হবে না । তারপর গিয়ে রিক্সা করে যাওয়া আসা করে ।
আমার আর দিশার সংসারে টাকার অভাব ছিল । তবে ভালবাসার কোন অভাব নেই । দুজনের চাকরি করি ছোট খাটো । দুজনের চাকরি মিলে কোন মতে সংসারের খরচ চলে যায় । কিন্তু এতে আমার কিংবা ওর কারো কোন অভিযোগ নেই । অফিস থেকে ফিরে এসে ওর সাথে সময় কাটাই । মাঝে মাঝে সময় থাকলে বিকেলে হাটতে বের হই । ছুটির দিন গুলোতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই ওকে নিয়ে । রাতে ওকে জড়িয়ে ঘুমাই । সকালে দুজন মিলেই রান্না করে তারপর অফিসে যাই । ওর স্কুল বিধায় ও একটু আগে চলে আসে ।
আজকে অবশ্য অফিস থেকে আমি একটু জলদি জলদি চলে এসেছি । এসে দেখি ও বাসার গেটের কাছে এসে দম নিচ্ছে । দিশা বলল
-আজকে এতো জলদি চলে এলে যে ?
-আবার যেতে হবে । একটা কাজে এসেছি । ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই । কিছু খেয়ে যাই ।
-ও তাহলে চল জলদি । খাবার গরম করে দেই ।
-আরে আগে বিশ্রাম নাও । এই অবস্থায় সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হবে না ।
সিড়ি ঘরেই চুপ করে ওকে নিয়ে বসি কিছুটা সময় । মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় এতো অভাবের মাঝেও মেয়েটা কি হাসি মুখে দিন পার করছে । একটা অভিযোগ নেই একটা বারতি আবদার নেই । আল্লাহ সবার কপালে এমন বউ লিখে রাখে না । আমি বললাম
-চল তোমাকে কোলে করে নিয়ে উঠে উপরে ।
-মোটেই না ।
-আরে আমার শক্তির উপর তোমার ভরশা নেই ?
-সেটা আছে কিন্তু এতো কষ্ট করতে হবে না ।
-আরে চল না । না পারলে তখন নামিয়ে দেব !
-বলেছি না দরকার নেই ।
দিশা অবশ্য আরও মানা করতে চাইলো তবে কাজ হল না । আমি ঠিক ঠিক ওকে কোলে নিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে উঠতে লাগলাম । আমার মাঝে মাঝে এমন পাগলামো করতে খারাপ লাগে না ।
প্রতিদিনই এমন কোন কোন আনন্দে আমাদের দিন কাটে । ওকে পেয়ে একটা দিন এমন কি একটা মুহুর্ত মনে হয় না এই মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়ে আমি জীবনে ভুল করেছি । আমি কোন কোন কোন দিন সারপ্রাইজ দেই মাঝে মাঝেও আমাকে অবাক করে ওর কাজ দিয়ে । ঠিক দুইদিন পরেই ও আমাকে তেমন ভাবেই অবাক করে দিল । ঠিক রাত বারোটায় আমাকে জন্মদিনের উইস করলো । করবে সেটা আমি জানতাম । ও ওর নিজের জন্মদিন ভুলে যেতে পারে তবে আমার টা কোন দিন ভুলবে না । একটা ছোট কেকেরও ব্যবস্থা করেছে দেখলাম । কিন্তু কেক কাটার পরেই আসল অবাক হওয়াটা । আমার জন্য ও একটা উপহার কিনেছিলো । প্যাকেট খুলতে দেখি একটা ফাস্ট ট্র্যাকের সানগ্লাস । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম রেপ্লিকা । কারন আসলটা কেনার মত টাকা জোগার করা ওর পক্ষে একটু কষ্টের আর এতোটা বিলাসিতা আবার আমাদের মানায় না ! কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে সানগ্লাস টা আসল । রেপ্লিকা না ! আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-এতো দাম দিয়ে কিভাবে কিনলে ?
-সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না । তোমার না খুব শখ ছিল এই সানগ্লাসের । তোমার জন্য কিনেছি এটাই বড় কথা !
-দিশা ! সত্যি করে বল .....
তখনই আমার মনে কিছু একটা বাড়ি মারলো । কিছু একটা যেন মনে পড়ে গেল । ব্যাপারটা মনে হতেই আমার চোখ খানিকটা সিক্ত হয়ে উঠলো । পাগল মেয়েটা পুরো মাস জুড়ে একটা দিনই স্কুলে রিক্সা করে যায় নি । তার বদলে হেটে হেটে এই রোদের ভেতরে যাওয়া আসা করেছে । সেই টাকা বাঁচিয়ে ও এই সানগ্লাস কিনেছে ।
আমি ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলাম ! যেন আমার বুকের স্পন্দনটা ও শুনতে পারে । ওকে মুখের কথা দিয়ে নয় হৃদয় দিয়ে অনুভব করাতে ইচ্ছে যে আমি ওকে খুব বেশি ভালবাসি । খুব বেশি ভালবাসি !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:৩০