-অরিন ঠিক আছো তুমি ?
নিজের চিন্তাতেই ডুবে ছিল । অফিসের সোমা আপার ডাকে ফিরে এল বাস্তবে । খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই থাকতে পারছে না । আজকে ওর পক্ষে কোন ভাবেই স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হচ্ছে না । কোন মতে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে অরিন বলল
-না ঠিক আছি ।
-কিন্তু তোমার চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না । কি হয়েছে ? স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়েছে সকালে ?
-নাহ ! সুমন আমার সাথে ঝগড়া করে না !
-তাহলে ?
-কিছু হয় নি আপু ! কাল রাতে ঘুমাতে একটু দেরি হয়েছিল তাই এমন মনে হচ্ছে ।
সোমা আপা আর বেশি কিছু জানতে চাইলো না । নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেল । অরিন আবারও নিজের কাজে মন দিল । তবে কেবল মনিটরের দিকে তাকিয়েই রইলো । কাজের কাজ কিছু হল না । ও কিছুতেই নিজের কাজে মন বসাতে পারছে না । ঘুরে ফিরে তার মনটা তার বাসার দিকে চলে যাচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে এখন ওরা কি করছে !
কি করবে এখন ?
সুমনের বাহুতে অন্য কোন মেয়ে রয়েছে তারা পৃথিবীর সব থেকে আদিম খেলায় মত্ত এই জিনিসটা মেনে নিতে পারছে না ও কিছুতেই । সুমনের উপর রাগ করতে চাইছে কিন্তু পারছে না । কারন ও খুব ভাল করেই জানে এই সব কিছুর জন্য ও নিজেই দায়ী ! ও নিজে এমন কাজটা না করলে হয়তো সুমন আজকে এইকাজটা করতো না !
আর সুমনকে ও দোষ দেবে কিভাবে ?
ও তো গোপন অথবা লুকিয়ে কিছু করে নি । ওকে সরাসরিই বলেছে । বলেছে ও কি করতে যাচ্ছে এবং কেন করতে যাচ্ছে ।
সুমনের সাথে অরিনের বিয়েটা প্রায় সাত মাস পার হয়ে গেছে । সব দিক দিয়েই ওদের বিয়েটা ভাল ছিল । দুজনেই চাকরি করতো তারপরেও ওদের কারো অভিযোগ ছিল না । কিন্তু একটা খুব বড় অস্বাভাবিকত্ব ছিল ওদের বিবাহিত জীবনে । এই সাত মাসে অরিন একটা বারের জন্যও সুমনকে শারীরিক ভাবে নিজের কাছে আসতে দেয় নি ।
প্রথম যেদিন সুমন অরিনের কাছে আসতে চেয়েছিলো অরিন মুখ ফুটে কিছু বা বললেো আচরনে বলেছিলো যে সে আগ্রহী না । সুমন ধরে নিয়েছিলো হয়তো ওর শরীর খারাপ লাগছে । তাই কিছু বলে নি । কিন্তু সপ্তাহ খানেক পরেও যখন একই কান্ড করলো তখন সুমন কারনটা জানতে চাইলো । অরিন কিছু না বলে কেবল চুপ করে রইলো । এর পরে সুমন আরেকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু অরিনের শীতল আচরন দেখে আবার দমে গেল ।
অরিন ভেবেছিলো এবার সুমন আর চুপ থাকবে না । থাকার কথাও না । তবে আশ্চর্য ভাবে লক্ষ্য করলে তারপর থেকে সুমন আর ঐদিকে আগোই নি কোন দিন । ওদের সব কিছু স্বাভাবিক ছিল কেবল মাত্র ঐ একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে । অরিনের মনের ভেতরে ব্যাপারটা খারাপ লাগতো কিন্তু ও নিজেকে কিছুতেই বুঝাতে পারতো না !
কিছুতেই সেই ঘটনা মন থেকে বের করতে পারতো না । যখনই কেউ ওর কাছে এমন ভাবে আসার চেষ্টা করছে তখনই ব হুদিন আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা মনে পড়ে যেত ।
ঘটনাটা ঘটে যখন ও ক্লাস নাইনে পড়ে । প্রাইভেট থেকে ও একা একাই বাসায় আসতো । ঐদিন একটু রাত হয়ে গেছিলো । রাস্তা দিয়ে আসার সময় হঠাৎ করেই তিনটা ছেলে ওকে জাপতে ধরে পাশে গলির দিকে নিয়ে যায় । অরিন এতোটাই ভয় পেয়েছিল যে চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছিলো কিন্তু কপাল ভাল যে দুজন লোক ঐ গলি দিয়ে তখনই যাচ্ছিলো । ওরা এগিয়ে এলেই ছেলে গুলো দৌড়ে পালিয়ে যায় । তবে অরিন যে শকের ভেতরে চলে গিয়েছিলো সেটা কাটতে বেশ কিছু দিন লেগে যায় এবং ওর মনে একটা দাগ রয়েই যায় ।
এর পরে আর কোন ভাবেই ও এই ঘটনাটা মন থেকে বের করতে পারে না । কলেজেের শেষ দিকে একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক হয়েছিল । কিছুদিন সম্পর্ক চলার পরে ছেলেটা ওকে যখন চুম খেতে যাচ্ছিলো তখনই ওর সেই আগের দিনের কথাটা ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে এবং চিৎকারে ওকে ধাক্কা ফেলে দেয় । এরপর আর ওদের সম্পর্ক ঠিক হয়নি । এর পরে অরিন নতুন কোন সম্পর্কের দিকে এগোই নি ।
তারপর পারিবারিক ভাবে অরিনের বিয়ে হয় । ভেবেছিলো বিয়ের পর হয়তো অরিনের এই সমস্যা টা থাকবে না কিন্তু সেই সমস্যা রয়েই গেল । সুমন অবশ্য খুব বেশি উচ্চ-বাচ্চ করে নি । ওদের মাঝে এই জিনিসটা নিয়ে আর কোন কথা হয় নি আর । অবস্য এটা নিয়ে ওদের মাঝের সম্পর্কের কোন সমস্যা হয় নি । খুব স্বাভাবিক ভাবেই সুমন ওর সাথে মিশতো কথা বলতো ওকে হাসাতো । দুজন মাঝে ঘুরতেও যেত ! সুমন যে ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছে সেটা অরিন খুব ভাল করেই বুঝতে পারতো । ও নিজেও সুমন কে ভালবাসতে শুরু করেছিলো । কিন্তু ঐ সমস্যাটা কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছিলো না ।
কিন্তু গতকালকে সুমন ওকে ওকে যা বলল সেটার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিল না । কিন্তু সুমনের প্রতিটি কথাতেই যুক্তি ছিল । ও সেই কথার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারেও নি । কেবল অবাক হয়ে শুনেছে । এবং সেটা মেনেও নিয়েছে !
গতকাল রাতেই খাওয়ার পরে সুমন কথাটা তুলল । ওকে ডেকে নিয়ে গেল বসার ঘরে ! তারপর খুব স্বাভাবি ভাবে বলল
-কালকে তুমি বাসায় আসবে কখন ?
-যখন আসি !
-আচ্ছা তাহলেই হবে ।
-মানে !
সুমন কিছুটা মসয় চুপ করে থেকে বলল
-আসলে আমাদের বিয়েতে কিছু যে একটা স্বাভাবিক নেই সেটা তো তুমি জানো তাই না ?
অরিন কোন কথা না বলে চুপ করেই রইলো ।
-কিন্তু আমি তো একজন মানুষ তাই না ? দেখো শুনতে তোমার কাছে কেমন লাগবে তবে আমার নিজের জৈবিক কিছু চাহিদা আমার আছে । থাকা স্বাভাবিক নাকি !
অরিন কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলো ।
-আমি আসলে সেটাই করতে চাচ্ছি ! হয়তো তোমার কাছ থেকে আড়াল করতেই পারতাম কিন্তু সেটা ঠিক হত না । তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম ! কাল আমার এক বন্ধু আসবে । ওর ম্যারেড লাইফও নাকি ঠিক যাচ্ছে না !
অরিন কেবল অবাক হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে ছিল । কি বলবে খুজে পেল না ! সুমন বলল
-এভাবে তাকিয়ে থেকো না প্লিজ ! আমার যা চাহিদা ছিল আমি কিন্তু প্রথমে তোমার কাছ থেকেই আশা করেছি সেটা আমার প্রাপ্য ছিল । অপেক্ষা করেছি যে তুমিও নিশ্চঐ সেটা অনুভব করবে । এক মাস দুই মাস গুনো সাত মাস পার হয়ে গেল । তোমার দিক থেকে কোন সাড়া আসে নি ।
অরিন আবারও মাথা নিচু করে শুনে গেল ।
-দেখো মানুষের সমস্যা থাকেই । তোমারও আছে । ঠিক আছে আমি মেনে নিলাম । কিন্তু আমার দিকটাও তো তোমার দেখতে হবে না ! আশা করি তুমি বুঝতে পারছো ?
অরিন কোন ভাবে বলল
-বুঝতে পারছি !
-থেঙ্কিউ ! কালকে কেবল সন্ধ্যার আগে বাসায় এসো না । তাহলেই হবে । কেমন !
তারপর থেকে অরিন আর একটা মিনিটের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারে নি । বারবার কেবল ঐ একই কথা মনে হচ্ছে ! গুহরে ফিরে ঐ একটা কথাই । সকাল বেলা অরিনের অফিসে যাওয়ার সময়ও সব কিছু স্বাভাবিক ছিল । সুমন এমন ভাবে আচরন করতে লাগলো যেন কোন ঘটনাই ঘটবে না । কিছুই হবে না । কিন্তু অরিনের মনের মাঝে কি চলছে সেটা কেবল অরিনই বুঝতে পারছে ।
অফিস থেকে যখন বাসায় এসে হাজির হল তখন বিকাল পাঁচটা । এসে ভেবেছিলো সুমনকে বাসাতেই পাবে । কিন্তু পেল না । নিজের পরিচিত ঘরটা কেমন যেন অপরিচিত লাগলো ওর কাছে । অন্য দিন এই সময় বাসায় এসে রান্না করে সে । সুমন আগে আসলে সুমন নিজেও রান্না ঘরে অনেক কাজ এগিয়ে রাখে । তারপর দুজন মিলে রান্না করতে থাকে । আসলে সব দিক দিয়ে ওরা একদম সুখী একটা কাপল হতে পারতো । কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি ।
অরিন নিজের শোবার ঘরের বিছানার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রইলো । বিছানাটা এখন একদম গোছানো লাগছে । কিন্তু ও জানে এখানে কি হয়েছে আজকে ! অরিনের চোখ দিয়ে কখন পানি পড়তে শুরু করেছে ও নিজেই জানে না । সোজা বাধরুমে চলে গেল । দরজাটা বন্ধ না করেই ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে ওটার নিচে দারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ।
সুমনের উপর নাকি নিজের উপর কি এক অভিমানের ও কাঁদছে ও নিজেই জানে না । অথচ ও চাইলে আজকের দিনটা কোন আসতো না ! এমন কোন ঘটনা ঘটতোই না ।
হঠাৎ কেউ অরিনে শরীর স্পর্শ করলো । অরিন নড়লো না । খুব ভাল করেই জানে এসেছে । সুমনের কাছেও এক সেট চাবি আছে । সুমন আরেকটু কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে পেছন থেকে । অরিন তো আগে থেকেই ভিজে গিয়েছিল সুমনও আস্তে আস্তে ভিজে যেতে লাগলো । অরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে সুমন বলল
-আমার উপর রাগ লাগছে ?
-উহু !
-তাহলে কাঁদছো কেন ?
-জানি না ।
-আমি জানি ।
-তাহলে কেন করলে এমন একটা কাজ ?
তখন অরিন অবাক হয়ে আবিস্কার করলো যে সুমন যে ওকে জড়িয়ে ধরেছে এতে ওর কিছু মনে হয় নি । অন্য সময় হয়ে হয়তো চিৎকার করে উঠতো। সেই তিন জনের চেহারা ভেসে উঠতো কিন্তু আজকে তেমন কিছুই হয় নি । ওকে ওকে এবার ওর মুখোমুখি দাড় করালো । দুজনে ঝর্নার নিচে দাড়িয়ে রইলো কেবল ।
অরিন তাকিয়ে দেখে সুমনের মুখটা কেমন হাসি হাসি । এমন একটা ভাব যেন আজকে কোন ঘটনাই ঘটে নি । অরিন ভিজতে ভিজতে বলল
-হাসছো কেন ?
-তোমার অবস্থা দেখে !
-মানে ?
-আরে গাধা তোমার কি আসলেই মনে হয়েছে আমি ওমন কিছু করবো ?
পিটপিট করে অরিন তাকিয়ে রইলো সুমনের দিকে । বুকের মাঝে কেমন একটা স্পন্ডন শুনতে পাচ্ছে । সুমন বলল
-তুমি আসলেই এমন কিছু কর নি ?
-বিশ্বাস না হলে আমার অফিসে ফোন দিয়ে দেখো । আজকে সারাদিন আমি ওখানেই ছিলাম !
অরিননের কান্নার বেগ যেন হঠাৎ করেই আরও বেড়ে গেল । তারপর সুমনের শরীরে একটা ধাক্কা মেরে বলল
-তাহলে আমার এমন কেন করলে ? আমাকে কষ্ট দিতে ভাল লাগে খুব ?
-কেন করেছি ?
এই বলেই সুমন চোখের নিমিষেই অরিনের ঠোটে চট করে একটা চুম খেয়ে ফেলল ও কিছু বুঝে ওঠার আগে ! অরিনের কান্না থেমে গেল মুহুর্তেই । সুমন বলল
-আমি ঠিক শিওর ছিলাম না যে কাজ হবে কি না ! তবে অনেক দিন আগে তুমি যে শকটা পেয়েছিলে সেটা দুর করার জন্য একটা ধাক্কা দেওয়ার দরকার ছিল ।
-তুমি জানতে সব ?
-হুম । তোমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি ! প্রথমে তোমাকে সময় দিয়েছি তোমার সাথে মিশেছি আমার সম্পর্কটা ভাল করেচি । ভেবেছি আমাকে ভালবাসতে শুরু করলে হয়তো সব কাটিয়ে উঠবে !
অরিন চুপ করে রইলো ! সুমন বলেই চলেছে
-তুমি নিজেও যে আমাকে ভালবাসো সেটা আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু ঐ শক থেকে হওয়া দেওয়ালের জন্য আমার কাছে আসতে পারছিলে না তোমার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও । দেখো আজকে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি তাতেও তোমার কিছু মনে হয় নি কারন একটা শক আরেকটা শককে দুরে সরিয়ে দিয়েছে ।
-তোমাকে আমি একদম .....
এই বলে অরিন ওর দিকে আসতেই সুমন ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । এতো দিন পর হঠাৎ করে সুমনকে জড়িয়ে ধরাতে একটা শিরশিরে অনুভুতি অরিনের মনে উদয় হল । তবে সেটা তার ভাললাগার অনুভুতির কাছে কিছু নয় ...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:১১