-তুই সব সময় আমার সাথে এমন করিস ! যা তোর আসা লাগবে না ।
সায়েম ফোনটা রেখে পার্কের বেঞ্চের উপর বসলো । ওর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে । কিন্তু রাগটা ও প্রকাশ করতে পারছে না । এই সকাল বেলা ও এখানে এসেছে কেবল মিথিলার সাথে দেখা করার জন্য কিন্তু মহারানী এখনও ঘুমাচ্ছে ।
-কি হয়েছে ? এই সুন্দর সকালে এমন মুখ গোমড়া করে কেন রেখেছো ?
সায়েম তাকিয়ে দেখে তার পাশে এক বৃদ্ধ বসে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাসি মুখে । ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে ? গার্লফ্রেন্ড প্রবলেম ?
সায়েম প্রথমে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । এতো বয়স্ক মানুষের মুখে এমন কথা শুনে কেমন যেন একটু অবাক হল
-না মানে ....
-আরে বলে ফেল । কি সমস্যা ?
-আর বলবেন না দাদু ! একজনের অপেক্ষা করছি এই সকাল বেলা ঘুমে ভেঙ্গে উঠেছি কিন্তু মহারানীর খবর নেই । মেয়ে গুলা সব সময় এমন করে । সম্পর্কের জন্য কিছু করতে রাজি নয় ! পটানো থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত এমন কি বিয়ের পরেও সব কিছু আমাদের কে করতে হয় !
বৃদ্ধলোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-এটা ঠিক বললে না । মেয়েরা এমন কিছু অনেক কিছু করতে পারে যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না !
-যেমন ?
-গল্প শুনবে ? গল্প শুনে বুঝতে পারবে যে তারা কি করতে পারে !
মিথিলার এখনও আসার কোন নাম গন্ধ নেই । কখন আসবে ঠিক নেই । সায়েম বলল
-বলেন । সময় কাটুক !
বৃদ্ধ একটু যেন হাসলো । সায়েমের বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন বৃদ্ধ এই গল্প আরও অনেকের কাছেই বলেছে । এটা তার খুব পছন্দের গল্প ।
-আমার খুব কাছের এক বন্ধু ছিল । বুঝলে, নাম ছিল নিশি !! কলেজ আর ইউনিভার্সিটি জীবনে এক সাথেি কাটিয়েছি । আমার সব কিছুর উপর তার অন্য রকম অধিকার ছিল । আমাকে জ্বালিয়ে মারার জন্য এই একটা মেয়েই যথেষ্ঠ ছিল । যাই হোক, আমি কোন দিন ওকে সেই চোখে দেখি নি । ওর আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল ব্যাস !
এমন ভাবেই দিন যাচ্ছিলো । এমন একদিন শুনতে পেলাম নিশির নাকি কোথা থেকে এক বয়ফ্রেন্ড জুটেছে । সারা দিন ওর বয়ফ্রেন্ডের গল্প করতো । আগে তো এমনিতেই আমার মাথা খেয়ে ফেলতো নানান গল্প করে এখন যুক্ত হল বয়ফ্রেন্ডের গল্প । নাম যেন কি ছিল তারুন না বারুন । সে এমন ও তেমন । আজকে এই করেছে কাল সেই করেছে । একদিন বিরক্ত হয়ে বললাম তোর বয়ফ্রেন্ডের খবর রাখ তোর কাছে । আমি শুনতে চাই না ।
আরও এক ঝামেলা সহ্য করতে হত যে শপিং । ওর বয়ফ্রেন্ডের গায়ের গড়ন নামি আমার মতই । তার জন্য গিফট কিনতে যাবে সেই জন্য আমাকে যেতে হবে । আমার গায়ের মাপ দিয়ে ওর কেনা কাটা করতে হবে । মাঝে মাঝে ওদের এক সাথে ছবি দেখতাম । ও আমাকে ইনবক্সে পাঠাতো । তখনও আমার তেমন কিছু মনে হয় নি । আসলে ও সব সময় চোখের সামনে থাকতো তাই কিছু মনে হত না ।
একদিন আমার সামনে এসে নিশি বলল যে আগামীকাল নাকি ওরা বিয়ে করতে যাচ্ছে । আমাকে বিয়ের সাক্ষী হতে হবে । স্বানন্দে রাজি হয়ে গেলাম । জানতে চাইলাম
-এতো তাড়াহুড়া কেন ? কদিন হল তোদের সম্পর্ক ? এতো জলদি বিয়ে করবি
নিশি বলল
-কোন উপায় নেই । বাবা আমার বিয়ের কথা বার্তা বলছে । সামনের সপ্তাহে আমাকে দেখতে আসবে ।
আমি আর কথা বাড়ালাম না ! পরদিন যথা সময়ে হাজির হয়ে গেলাম মগবাজার কাজী অফিসের সামনে ! নিশি আগে থেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো তবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ও একটু চিন্তা করছে । বিয়ে তো আর চাট্টিখানি কথা না । বিরাট মানষিক চাপের বিষয় । একটু চিন্তিত হতে পারে । কিন্তু আরও একটু পরে চিন্তার কারন জানতে পারলাম । তার বয়ফ্রেন্ডের ফোন বন্ধ !
আমি জানতে চাইলাম
-সকাল থেকে কথা হয়েছে ।
-হয়েছে একবার ।
-তারপর ?
-আর হয় নি ।
-চিন্তা করিস না । চলে আসবে ।
কিন্তু যখন নির্ধারিত সময়ের পার হয়ে যাওয়ার পরেও আর ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে গেল তখন বুঝতে আর বাকি রইলো না যে ঐ বেটা আর আসবে না । নিশির মুখের দিকে আমি তাকাতে চাইছিলাম না । দোকান থেকে একটা পেপসি কিনে নিয়ে এলাম ।
-তুই আমাকে বিয়ে করবি ?
আমি সবে মাত্র পেপসির বোতলের মুখ খুলে মুখে দিয়েছি । সব টুকু মুখে দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম । নিশির দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি বললি তুই ?
নিশি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
-তারুন মনে হয় আসবে না । ওর ফোন বন্ধ ! তুই বিয়ে করবি আমাকে ?
-এটা আন্ডারওয়্যার কিনছিস নাকি ? একজন আসে নি বলে অন্যজনকে দিয়ে দিবি ?
-তো কি করবো আমি এখন ?
-কি করবি ? বাসায় যাবি ।
-সেখানে যাওয়া যাবে না ।
-কেন ? সমস্যা কি !
-বাসায় চিঠি লিখে এসেছি । বাসায় গেলে বাবা আমাকে একেবারে মেরে ফেলবে । আমি বাসায় যেতে পারবো না ।
-চিঠি লিখে আসার দরকার ছিল না । মোবাইলের যুগে কেউ চিঠি লিখে ?
-শোন এতো কিছু বলতে পারবো না । তুই আমাকে বিয়ে করবি কি না বল !
-মাথা খারাপ তোর ! আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না আর কেনই বা করবো ! তোর প্রেমিক আসে নাই বিয়ে করতে এই জন্য আমি কুরবানী হব কেন ?
নিশি আমার দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে তারপর বলল
-ওকে ঠিক আছে । যা তুই !
-তুই কোথায় যাবি !
-সেটা তোকে চিন্তা করতে হবে না । যা !
-চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি !
-বলেছি না তোকে চিন্তা করতে হবে না । তুই বাসায় যা ! বাসায় তো যেতে পারবো না, একেবারে উপরে চলে যাবো ...।
-মানে কি এসবের !
-তোকে এতো চিন্তা করতে হবে না । তুই যা !
তারপর আমাকে পারলে একেবারে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় ! আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকি ! এই মেয়ের সমস্যা কি ! এই মেয়ে আসলেই আমাকে কোন দিন শান্তি দিবে না । আমি ওকে ছেড়েও যেতে পারছি না যদি কিছু করে বসে !
-তারপর তারপরপ কি করলেন ?
সায়েমের যেন আর তর সইছে না ! বৃদ্ধ হাসলেন । তারপর বললেন
-কি আর করা । বন্ধু তো । এতো দিনের বন্ধুত্ব । ওকে তো এভাবে ফেলে আসতে পারি না । শেষে বিয়ে কর ফেললাম । ওকে নিয়ে যখন আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম তখন আমাদের বাসায় যেন বোমা পড়লো । নিশিকে আমাদের বাসায় সবাই চিনতো খুব ভাল করেই । বাবা তো পারলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করেই দেয় । নিশির বাসায় খবর দেওয়া হল । তারা তো আকাশ থেকে পড়লো । কারন নিশি যেমন আমাদের বাসায় পরিচিত মুখ তেমনি আমিও ওদের বাসার পরিচিত খুব । প্রায়ই যাওয়া হত । আমরা যে একটা কাজ করে ফেলতে পারি এটা তারা ভাবতেই পারে নি ।
রাত ভর মিটিং হল ডুই পরিবারের ভেতরে । তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এখন যা হওয়ার হয়ে গেছে । আমাদের পড়ালেখা শেষ করার পর সব কিছু আনুষ্ঠানিক ভাবে করা হবে । ওকে নিয়ে যেতে চাইলে নিশি যেতে রাজি হল না । ও তখন ঠিক ভরশা করতে পারছে না । শেষে বাবা বলল যে আজকে থাকুক এখানেই । যেহেতু বিয়ে করেই ফেলেছে ও এখন তো এই পরিবারের অংশ হয়ে গেছে ।
-এটা আর এমন কি ! এমন কাজ অনেকেই করেছে ।
সায়েমকে খুব বেশি ইম্প্রেসড মনে হল না । বৃদ্ধ হাসলেন আবার । বললেন
-গল্প এখনও শেষ হয় নি তো । আসল টুইস্ট তো এখনও বাকি !
-আচ্ছা !
-হুম ! ঐ রাতেই আমি আসলে কথা জানতে পারি । নিশি রাতে আমার ছোট বোনের সাথে ঘুমাতে গেল । আমিও নিজের বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলাম কি থেকে কি হয়ে গেল । অবশ্য খুব বেশি চিন্তা লাগছিল না কেন জানি । মনে হচ্ছিলো যা হয়েছে হয়তো এটাই লেখা ছিল । নিশির ব্যাগ টা আমার ঘরেই ছিল । নিশি নিশ্চয়ই অনেক প্রস্তুতি নিয়েছিল বিয়ের জন্য । বেনারশি শাড়ি কি কিনেছিলো ? নিশ্চয়ই কিনেছিল ।
আমি ব্যাগ খুলে শাড়ি খুজতে গিয়ে হঠাৎ করে অন্য কিছু আবিস্কার করলাম । ব্যাগ ভর্তি ছেলেদের শার্ট টি শার্ট আর পাঞ্জাবি । আরও একটু ভাল করে খেয়াল করতেই আমি প্রায় সব গুলো চিনে ফেললাম । এগুলো সেই জামা কাপড় যেগুলো নিশি ওর বয়ফ্রেন্ডের জন্য কিনেছিল আমাকে নিয়ে গিয়ে !
প্রথমে কিছুটা সময় আমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না । এগুলো এখানে কি করছে ? যখন ব্যাপারটা মাথার ভেতরে আসলো আমি ফোন করে ওকে আমার রুমে আসতে বললাম । আমার রুমে এসে ব্যাগের জিনিস পত্রের দিকে তাকিয়ে নিশি কিছুটা সময় চুপ করে । আমি বললাম
-এসব কি ? এগুলো না তো তোর বয়ফ্রেন্ডের জন্য কিনেছিলি । এগুলো এখানে কেন ?
নিশি কোন জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমি আবার বললাম
-সত্যিই করে বল, তোর বয়ফ্রেন্ড কই ?
-জানি না !
-আদৌও কি এমন কেউ ছিল ?
নিশি কিছু সময় কোন কথা বলে চুপ করে থাকলো । আমি আবার বললাম
-সত্যি করে বল এমন কেউ আছে নাকি ছিল । যার ছবি দেখিয়েছিলো সে কে ?
-আমাদের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলে । আমার থেকে ছোট বয়সে !
-এসব করার মানে কি !
-মানে বুঝিস না গাধা কোথাকার ! একটা মেয়ে যে তোকে কি পরিমান পছন্দ করে তোর জন্য কি পরিমান অপেক্ষা করে থাকে তুই তো সেটা কোন দিন দেখবি না । শেষে উপায় না দেখে আমি নিজের পথ নিজে বেছে নিয়েছি !
সায়েম বড় বড় চোখ করে বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর বলল
-তার মানে তার এমন কেউ ছিল না । সে সব কিছু প্লান করে করেছে আপনাকে বিয়ে করার জন্য !
বৃদ্ধ হাসলেন !
-ওয়াও ! দাদী আসলেই আপনাকে খুব ভালবাসতো ।
-হুম ! সেই ভালবাসা জ্বালায় জীবন যে .......
-এই বললা ।
বৃদ্ধ কথা শেষ করতে পারলেন না তার আগেই পেছন থেকে আরেক টা কন্ঠস্বর ভেসে এল । সায়েম তাকিয়ে দেখে সাদা পাকা চুলের আরেক বৃদ্ধা পেছনে এসে দাড়িয়েছে । বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললেন
-কি ব্যাপার আমার নামে তুমি বলছো এই ছেলেকে ! আর তোমার না পার্কটা আরও দুইবার চক্কর মারার কথা । এখানে বসে আছো কেন ?
-আরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি ।
-বিশ্রাম বাসায় গিয়ে নেবে । আগে জগিং শেষ কর । আসো আসো জলদি !
বৃদ্ধ উঠে দাড়ালানে । সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকে উঠি ভাই । বুড়ির জন্য একটুও শান্তি নেই । সেই যে জ্বালানো শুরু করেছে এখনও থামে নাই । ভালো থাকো কেমন ...
সায়েম দুজনকে চলে যেতে দেখলো । দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেন জানি সামেয়ের মেজাজ খারাপ ভাবটা কেটে গেল । বরং সেখানে একটা অসম্ভব ভাল লাগা কাজ করতে লাগলো । মিথিলা আসুক তাকে এই গল্প বলতে হবে । কেবল মিথিলা কেন সায়েম ঠিক করে ফেলল সবাই কে এই গল্প বলবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৫