somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ গেম-প্লান

১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক

-ক্লাস শেষ তোর ?

আমি নাম্বারটা আরেকবার ভাল করে দেখলাম । ভাইয়ার নাম্বারই । কিন্তু ভাইয়া আজকে আমাকে ফোন দিয়ে আমার ক্লাসের খোজ নিচ্ছে কেন হঠাৎ ? কারনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । ভাইয়া খুব দরকার না হলে আমাকে তো ফোন দেয় না ।
কোন কি সমস্যা হয়েছে ?
বাসায় কিছু হয়েছে ? আমি বললাম
-শেষ না । ব্রেক চলছে ।
ভাইয়া বলল
-শোন তোর রিপন ভাই যাচ্ছে তোর ক্যাম্পাসে । তোকে নিয়ে আসতে ।

আমার তখনই মনে হল নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে । হতে বাধ্য । আমি বললাম
-কি হয়েছে ? বাসায় কোন সমস্যা ? আব্বা ঠিক আছে ?

আসলে আমার আব্বা আর ভাইয়া যে কাজ করে তাতে তাদেরকে মা আর ভাবী সব সময় চিন্তা করে । যদিও আমি এই সব ব্যাপার থেকে দুরে থাকি তবুও চিন্তাটা না চাইলেও চলে আসে । আমার গলার স্বর শুনে ভাইয়া বলল
-আব্বা ঠিক আছে । বাসায় কোন সমস্যা নেই । তুই চলে আয় । তোকে একটা কাজ করতে হবে । আর তোর রিপন ভাই মনে হয় তোর ক্যাম্পাসে চলে গেছে এতোক্ষনে ।

আমি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম । মাথার ভেতরে তখনও ঠিক কিছু কাজ করছে না । কিছু আসছে না । ভাইয়ার হঠাৎ আমাকে দিয়ে কি কাজ থাকতে পারে । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
বাইক নিয়ে গেটের কাছে আসতেই দেখতে পেলাম একটা কালো রংয়ের মাইক্রোবার এসে থামলো সামনে । থামার সাথে সাথেই গেট খুলে রিপন ভাইকে বের হতে দেখলাম । তাকিয়ে দেখি ভেতরে আরও কয়েকজন বসে আছে । রিপন ভাইয়ের সাথে আরও একজন নেমে পড়লো । রিপন ভাই আমাকে বলল
-অপু বাইকটা একে দিয়ে দাও । ও বাসায় দিয়ে আসবে । তুমি এই গাড়িতে উঠো ।
-বাইকে গেলে সমস্যা ভাইয়া
-একটু সমস্যা আছে । আমরা অনেক দুরে যাবো ।

আমি আর কথা না বলে বাইকটা ছেলেটার কাছে দিয়ে দিলাম । তারপর মাইক্রোতে উঠে বসলাম । মাইক্রো চলতে শুরু করলে তাকিয়ে দেখি মাইক্রোর ভেতরে আমাকে নিয়ে মোট ৭ জন মানুষ । এর ভেতরে একজন আমার দাড়িওয়ালা মৌলবীও আছে । এদের সাথে এই মৌলবী কেন ? আর আমিই বা যাচ্ছি কেন এদের ।

এদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয় এরা কোন অপরারেশনে যাচ্ছে । কিন্তু আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে ? আমাকে খুব ভাল ভাবেই আব্বা এসব থেকে দুরে রেখেছে । আমাকে নিয়ে কোন বিপদজনক কাজে এরা যাবে না এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত, তাহলে যাচ্ছে কোথায় ?
কিন্তু জানতে চাইতে গিয়েও চাইলাম না । মাইক্রোটা দ্রুত গতিড়ে ছুটে যাচ্ছে শহরের শেষ মাথার দিকে । আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! মাথার ভেতরে তখনই সেই একই চিন্তা কাজ করছে ।
এরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় ?



দুই

মাইক্রো বাসের ভেতরে সবার মুখ বেশ গম্ভীর । সব থেকে বেশি মুখ গম্ভীর মৌলবী সাহেবের । তিনি আবার বসেছেন আমার মুখোমুখি । হাতে তজবী গুনছেন আর মাঝে মাঝে হাত তুলে কি যেন দোয়া করছেন । ওনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার মতই ওনাকেও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে । আমাকে যদিও জোর করে নি কিন্তু মৌলবী সাহেবকে যে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না ।

আমি নিজের মাঝেই একটু চিন্তা করার চেষ্টা করলাম যে এমন কি কাজ পরে গেল আমাকে এভাবে দরকার পড়লো । আমার বাবা খুব ভাল করেই আমাকে এসবের থেকে দুরে রেখেছে । ভাইয়ারও মতামত ঠিক ঐ রকমই । তাহলে আজকে এমন করে আমাকে ধরে আনার দরকারটা পরলো কি ? মারামারি যে করতে যাচ্ছে না এটা আমি নিশ্চিত কারন তাহলে আমার ডাক কোন ভাবেই পড়তো না । তবে এর থেকে কোন গুরুতর কাজ করতে যাচ্ছে ? কিন্তু সেই কাজটা কি ?
আর আমার এখানে ভুমিকাই বা কি !

আমার বাবা এলাকার প্রাক্তন সিটি মেয়র । গত মেয়াদে আব্বা ঠিক জিততে পারে নি । একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে গেছে । সত্যি বলতে কি, তার জিতে যাওয়াতে বরং আমি খুশিই হয়েছি । আমাদের বর্তমান মেয়র সাহেব, মেয়র হিসাবে আমার আব্বার থেকে হাজার গুন ভাল । সামনে আবার মেয়র নির্বচন । শোনা যাচ্ছে এবারও নাকি হাফিজ সাহেবই মেয়র হবে ।

কিন্তু যতদুর শুনেছি এবার নাকি আমার বাবা আবার মেয়র হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে । যেকোন মূল্যে তাকে মেয়র হওয়া চাই-ই । যদিও বাবা মেয়র হতে পারে নি তবুও এলাকাতে আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে নি বিন্দু মাত্র । বাবা বর্তমান রুলিং পার্টি করে । তার ক্ষমতার সীমা নাই । তবুও তার মেয়র হওয়া চাই ই চাই ।

গাড়ী থেমে গেল শহরের একেবার শেষ প্রান্তে । এখান থেকে শুরু হয়েছে খানিকটা বনজঙ্গল তার পরে পাশের জেলার সীমানা । আমাদের মাইক্রোটা একটা কাচা রাস্তায় নেমে গেল । আরও কিছুটা সময় চলার পরে একটা দুই তলা বাড়ির সামনে এসে থামলো । তাকিয়ে দেখি বাড়িটা বেশ গাছ গাছালীতে ঘেরা । খানিকটা বাগান বাড়ির মত তবে চারিপাশে কোন দেওয়াল দেওয়া নেই । বাড়ির সামনে কয়েকটা বাইক দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম । আমাদের গাড়িটা কালো রংয়ের সুজুকিটা চিনতে কষ্ট হল না । আমার বড় ভাইয়ার । তার মানে ভাইয়া ভেতরেই আছে ।

আমি সবার সাথেই বাড়ির ভেতরে ঘুকে পড়লাম । আমার মাথার ভেতরে তখনও কেবল একটা চিন্তাই কাজ করছে । আমাকে এখানে কেন আনা হল, আমার কাজটা কি ! ঘরের ভেতর ঘুকতেই দেখি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এল । বলল
-তোর কোন সমস্যা হয় নাই তো ?
-নাহ । সমস্যা কেন হবে ? কিন্তু আমাকে এভাবে আনার দরকার টা কি ? আমি তো বুঝতে পারছি না ।

আমার আমার দিকে কিছু তাকিয়ে রইলো । তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করলো । সবাই বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । তারপর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোকে আসলে একটা কাজ করতে হবে ।
-তা তো বুঝলাম । কিন্তু কাজটা কি ! আর এখানেই বা কি ?
-তুই তো জানিস এবার আব্বা মেয়র হওয়ার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে আছে ।
-জানি !
-কিন্তু অবস্থা খুব একটা ভাল না । এবারও মনে হয় হাফিজ আহমেদই মেয়র হয়ে যাবে । এলাকাতে ওনার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে ।
আমি যদিও কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম না তবুও বলে ফেললাম । বললাম
-উনি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারন আছে । মেয়র হিসাবে আমার আব্বার থেকে উনাকেই পছন্দ ।
-বেশি বুঝিস না । শোন তোকে যে কারনে এখানে এনেছি । আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি তারপর হাফিজ আহমেদ আর বাবার পথের কাটা হতে পারবে না ।
-কি করতে যাচ্ছো ?
একটু ভয় হল । আমার মেরে টেরে ফেলবে না তো ।

ভাইয়া কেমন যেন রহস্যময় হাসি দিল । তারপর 'সবুজ' বলে ডাক দিল । সাথে সাথেই একটা ছেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো । যেন দরজার ওপাশে ভাইয়ার ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিলো । ভাইয়া ইশারায় আবার কি যেন বলল । সবুজ নামের ছেলেটা আবারও বেরিয়ে গেল । আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি বলবা তো ?

ভাইয়াকে কিছু বলতে হল না । ঠিক তারপর মুহুর্তেই সবুজ এক মেয়েকে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো । মেয়ের দিকে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল মুহুর্তেই, আর যাই হোক আমি কোন ভাবেই এই মেয়েকে এখানে আশা করি নি ।

সুপ্তি এখানে কি করছে ?
সুপ্তি !
আমাদের মেয়র সাহবের মেয়ে ! হাফিজ মেয়রের মেয়ে এখানে কি করে ?

আমি কয়েক মুহুর্ত একেবারে বোকার মত একবার সুপ্তির দিকে আরেকবার ভাইয়ার দিকে তাকালাম । মেয়েটার মুখ কেমন শুকনা মনে হচ্ছে । কান্নাকাটি করেছে বোঝাই যাচ্ছে । তবে এখানে অনেকটাই সামলে নিয়েছে । ভাইয়া কি করতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে এটা আমি বুঝতে পারলাম ।
ভাইয়া আসলে আমাকে সুপ্তির সাথে বিয়ে দিতে চায় । এই জন্য মাওলানাকেও নিয়ে এসেছে । সুপ্তির সাথে বিয়ে হয়ে গেলে হাফিজ মেয়রের মেয়ে জামাই হয়ে যাবো আমি । বিয়াইয়ের বিরুদ্ধে নিশ্চয় হাফিজ সাহেব নির্বাচনে দাড়াবে না । অন্য দিকে তাকে যদি গুম টুম করার করার পরিকল্পনা করতো তাহলে এতে করে বাবার জনপ্রিয়তা আরও খারাপের দিকে যেত । কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে সেটার ভয় নেই ।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম
-ইউ আর কিডিং রাইট ?
-নো ! দেখ সুপ্তিও রাজি তোকে বিয়ে করতে !
তারপর সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল
-কি সুপ্তি রাজি না ?
সুপ্তি কোন কথা বলল না । কেবল মাথা নাড়লো । আমার সুপ্তিকে দেখে মনে হল না যে সুপ্তি স্বইচ্ছাতে রাজি হয়েছে । নিশ্চয়ই ভাইয়া এমন কিছু বলেছে কিংবা হুমকি দিয়েছে তাতে রাজি হয়েছে ।
ভাইয়া বলল
-এখান তোর রাজি হওয়ার পালা । দেখ বাবার জন্য এটা করাই যেতে পারে । পারে না ?
-তার মানে বাবা জানে না ?
-না । জানে না ।

আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । সুপ্তিকে কিভাবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সেই বিষয়েও আমার খানিকটা সন্দেহ আছে । মনে হচ্ছে ওকে জোর করেই এখানে তুলে আনা হয়েছে । তাহলে ? মেয়েটাকে যদি এখন আমি বিয়ে করতে রাজি না হই তখন ? কত বড় একটা ঝামেলার ভেতরে পরে গেছি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । মনের ভেতর থেকেই অনুভব করলাম যে মেয়েটাকে এখান থেকে উদ্ধার করে দিয়ে আসতে হবে এবং সেটা অক্ষত ভাবে ।
কিন্তু কিভাবে ?
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম
-কখন বিয়ে করতে হবে ?
-যতদ্রুত সম্ভব !
কিছুটা মানষিক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে । আর আমি সুপ্তির সাথেও কথা বলতে চাই একটু , একা । যেহেতু ওর সাথে বিয়ে করছি একটু কথা বলতে চাই ।
-ঠিক আছে । তবে তোর মোবাইল আমার কাছে দে । তোর বিশ্বাস নেই ।
বললাম
-আচ্ছা তার আগে আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই ।

ভাইয়ার চোখের ইশারায় আবারও সবাই বাইরে চলে গেল । দরজা বন্ধ হতেই আমি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম
-এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি রাজনীতি কর ?
-মানে ?
প্রায় ১৫ মিনিট ধরে ভাইয়ার সাথে কথা বললাম । তারপর আবার সুপ্তির ঘরে চলে এলাম । মেয়েটাকে সেই সকাল বেলা তুলে আনা হয়েছে । এতোক্ষনে ওর বাবার কাছে খবর জানাজানি হয়ে গেছে কি না কে জানে ! পুলিশ যদি খোজ খবর শুরু করে তাহলে কি হবে কে জানে !


আমাকে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল । আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেওয়া হল । কিছু সময় আমরা দুজনকে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না । সুপ্তিকে আমি কয়েকবার দেখেছি । কোন দিন কথা বলা হয় নি । ওর নামটা জানি কেবল । এর বেশি কিছু এখনও জানি না । আমিই প্রথমে মুখ খুললাম
-তুমি রাজি বিয়েতে ?
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার ভাইয়া আমাকে যে হুমকি দিয়েছে তাতে রাজি না হয়ে পারি নি । আপনি বুঝতেই পারছেন !
-বুঝতে পারছি । এখন ?
-আপনার ভাইয়া কি বলল শুনলেন না ?
-তুমি বিয়ে করতে চাও না ?
-আমার চাওয়া আর না চাওয়ার আসলে এখানে কোন মূল্য নেই ।

আমি দরজা খুলে বারান্দায় চলে এলাম । ফোনটা কাছে থাকলেও বাবাকে একটা ফোন দেওয়া যেত । চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আক্ষরিক অর্থেই বনের ভেতরে রয়েছি । চিৎকার করে কাউকে ডাকলেও কাজ হবে না । এখন উপায় ?


তিন

সুপ্তি আমাকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে আছে । অবশ্য এতো দ্রুত বাইক চলছে সে আমাকে শক্ত করে না ধরলে ও পড়ে যেতে পারে । আর আমিও জীবনে এর থেকে জোরে বাইক চালিয়েছি কি না আমি নিজেরও মনে নেই । ভাইয়ার বাইকটা ২৫০ সিসির । মিটারের কাটায় দেখি দুইশ ছুই ছুই করছে । তার উপর রাস্তা একদম ফাঁকা । একটু আগে আমরা দুজন যেখান আর যে ভাবে বের হয়ে এলাম, সেটা হিসাব করলে আমাদের এরকম আচরন মোটেই অস্বাভাবিক নয় ।

সুপ্তি এমন ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল সেটা থেকে স্পষ্টই যে মেয়েটা যথেষ্ঠ ভয় পেয়েছে । যদিও আমি খুব বেশি ভীত ছিলাম না, কারন আমরা যদি পালাতা গিয়ে ধরা পরে যেতাম তাহলে কিছুই হত না, আমরা কেবল জীবিত থেকে বিবাহিত হয়ে যেতাম । সেটা তো আমরা না পালালে এমনিতেও হয়ে যেতাম ।

এভাবে পালানোর কথা আমার কিংবা সুপ্তির কারোর মাথাতেই আসে নি । আমাদেরকে কথা বলার জন্য একা রেখে যখন ভাইয়া নিচে চলে গেল তখন আমার মাথাতে কিছুই আসছিলো না । আমি রুমের দরজা খুলে বারান্দাতে আসতেই চারিদিকে তাকয়ে দেখি কেবল গাছপালায় ভর্তি । তখন আমার চোখ গেল বারান্দার শেষ দিকের । দেখি একটা গাছ একদম বারান্দার পাশ দিয়ে উঠে গেছে । ডাল পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।আমি আরো কাছে গিয়ে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলাম । আমি নিশ্চিত ভাবেই নিচে নেমে যেতে পারবো । কিন্তু সুপ্তি কি নামতে পারবে ?
সুপ্তিকে বলাতেই ও যেন লাফিয়ে উঠলো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার আগেই ও গাছ বেয়ে নেমে পরলো । আমি ভাবতেও পারি নি ও এতো জলদি নামতে পারবে ।মেয়েটার নিশ্চয় গাছে চড়ার অভ্যাস আছে আগে থেকেই । নতুবা এমন ভাবে গাছ থেকে নামতে পারতো না ।

একবার ভাবলাম বনের ভেতরে দৌড় দেই কিন্তু পরে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম । আমরা বনের ভেতরে গেলে আমাদের ধরে ফেলতে ভাইয়াদের খুব বেশি সময় লাগবে না । সুপ্তি আমার হাত ধরে আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেল । আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম । বাড়ির সামনের দিকে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই । সেই বাইক গুলো আর মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে । আমি পা টিপে টিপে বাইকের কাছে গিয়ে দাড়ালাম ।

প্রত্যেকটা বাইকের চাবি বাইকের সাথেই রয়েছে । অবশ্য এমনটা হবে আগ থেকেই জানতাম আমি । ভাইয়া কোনদিন বাইকের চাবি খুলে না বাইক থেকে । এই শহরে থেকে আমার ভাইয়ের বাইক চুরি করে কেউ হজম করবে এমন মানুষ এখনও পয়দা হয় নি । তাই ভাইয়াকে আমি খুব একটা বাইকে তালা মারতে দেখি নি ।

আমি সুপ্তিকে ইশারা করে ডাক দিলাম । ও আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো । আমি বারবার কেবল দরজার দিকে তাকাতে লাগলাম যদি এখনও কেউ দরজা খুলে বের হয়ে আসে তাহলে আমাদের পালায়ন কর্মসূচি এখানেই শেষ হয়ে যাবে । আমি দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে ভাইয়ার বাইকটা স্ট্যান্ড থেকে তুলে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির সামনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম । যত দূরে গিয়ে স্টার্ট দিবো ততই ভাল ।

সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার কাছে না এসে সবার আগে অন্য বাইক গুলোর দিকে যাচ্ছে । সেখান থেকে প্রত্যেকটা বাইকের থেকে চাবি খুলে নিল । তারপর মাইক্রো বাসের চাবিটাও নিয়ে এল । আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম । ভাইয়ারা যেন আমাদের পিছু না নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করে ফেলল ।এতো ভয়ের ভেতরেও মেয়েটার মাথা যে কাজ করছে সেটা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না ।

তারপর আমার বাইকের পেছনে এসে উঠে এল । আমি বাইক স্টার্ট দিতেই পেছনে থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম । কিন্তু সেদিকে তাকানোর আর সময় নেই আমার । আমি স্টার্ট দিয়ে ততক্ষণে গিয়ারে চাপ দিয়ে ফেলেছি । মাত্র তিন সেকেন্ডে গতি উঠে গেল ৬০ কিলোমিটার । তারপর সেটা হুহু করে বাড়তেই লাগলো । কাঁচা রাস্তা হলেও গতি কমালাম না । যখন পাকা রাস্তায় এলাম এখনও মনে হচ্ছিলো কেউ আমাদের পিছু পিছু ছুটে আসছে । আমি কিংবা সুপ্তি কেউ একটাবারও পেছনে তাকানোর সাহস করলাম না । কেবল অনুভব করতেছিলাম সুপ্তি আমাকে বেশ শক্ত করে ধরে ছিল ।

যখন সুপ্তিদের বাসার সামনে বাইক দাড় করালাম তখন দেখলাম ওর বাবা, সাথে আরও কয়েকজন দৌড়ে চলে এল । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে । আমাকে চিনতেও তাদের খুব একটা কষ্ট হল না । আমার দিকে তেড়ে আসতেই সুপ্তি ওর বাবাকে বলল
-বাবা অপু ভাইয়ার কোন দোষ নেই । উনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন । উনি না থাকলে আমি আসতেই পারতাম না

হাফিজ মেয়র আমার দিকে আস্তে আস্তে থেমে গেল । নিজের মেয়ের দিকে তাকালো । সুপ্তি হরফর করে বলে গেল ওর সাথে কি হয়েছে আর কিভাবে ওকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি । আমি বললাম
-আঙ্কেল আমার বাবা আসলে এসবের কিছুই জানে না । আমার ভাইয়া আর ভাইয়ার বন্ধু মিলে এসব করেছে । আমি খুবই সরি !
-আমি সব কটাকে জেল খাটাবো । সব কটা । এতো বড় সাহস .... !

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । আমার কথা যে উনি শুনবেন সেটা আশাও আমি করতে পারি না । তবে খুব একটা চিন্তার ব্যাপার না অবশ্য । ভাইয়াকে এতো সহজে জেলে ঢুকাতে পারবে না কেউ । আর ঢুকলেও ভাইয়া খুব জলদি বের হয়ে আসবে । এটা ভাইয়ার কাছে খুব একটা ব্যাপারও না ।

এখানে থাকাটা আর বেশি সমীচীন হবে না । সুপ্তির বাবার মেজাজ যে কোন সময় অন্য দিকে মোড় নিতে পারে । আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম
-সাবধানে থেকো । আমি যাই ।
-আপনিও সাবধানে থাকবেন ।
আমি বাইকে ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম । মনের ভেতরে কাজ করছে এখন ভাইয়ার সাথে দেখা হলে কি হবে কে জানে । অবশ্য তার সাথে আমার দেখা হওয়াটা জরূরী । তাকে কিছু কথা বলার আছে ।



চার

ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । এমন সময় বন্ধু সবুজ আমার কাছে এসে বলল
-হাফিজ মেয়রের মেয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে কি করছে রে ?
আমি সবুজের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ও সত্য বলছে নাকি মিথ্যা বলছে । ওর চেহারা দেখে মনে হল না যে মিথ্যা বলছে । আমি বললাম
-কোথায় ?
-শহীদ মিনারের কাছে দাড়িয়ে আছে ।
-কি করছে ?
-সেটা আমি কিভাবে বলবো ? দেখলাম তাই বললাম ।

আমি ওদের থেকে একটু দুরে সরে গিয়ে সুপ্তিকে ফোন দিলাম । দুবার রিং বাজতেই মেয়েটা ফোন রিসিভ করলো ।
-হ্যালো ।
ওপাশ থেকে কয়েক মুহুর্ত কোন কথা নেই । আমি বললাম
-আছো ?
-জি !
-তুমি কি আমাদের ক্যাম্পাসে ?
-হ্যা ।
-কোন কাজে এসেছো ?
-জি ।
-ও ! আচ্ছা কাজ করো । কোন দরকার হলে আমাকে জানিও ।

এই লাইন বলে আমি চুপ করে লাইন ধরে রইলাম । আমি জানি সুপ্তি আমার কাছেই এসেছে । আমার ধারনা সত্যি প্রমান করে দিয়ে সুপ্তি বলল
-আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছি ।
-আবার কোন ঝামেলা ?
-না না । আসলে আপনার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম ।
-আচ্ছা । কোথায় আছো তুমি এখন ?
-শহীদ মিনারের কাছে দাড়িয়ে আছি ।
-আচ্ছা থাকো । আসছি ।

আমি ফোনের লাইণ কেটে দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হাটা দিলাম ।

ঐ দিন সুপ্তিকে বাসায় পৌছে দেওয়ার পরে মনের ভেতরে একটা ভয় ছিল যে হাফিজ মেয়র নিশ্চয়ই পুলিশ কেস করবে । তবে ব্যাপারটা হয়েছিলো খুব গোপনে । বলতে গেলে আমাদের এবং ওদের কাছের মানুষ গুলো বাদ দিয়ে আর কেউ ব্যাপার জানে না । আর ব্যাপারটা যদি জানাজানি হয়ে যায় যে তার মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল, তাহলে সেটা তার পরিবারের সুনামের জন্য মোটেই ভাল কিছু হবে না । তাই হয়তো সে কেস করে নি । তবে আমি ঝুকি নিতে চাই নি । পরদিন রাতেই সুপ্তিকে ফোন করেছিলাম । আমার ফোন পেয়ে একটু অবাক হয়ে গেছিলো । আমি কিভাবে ওর নাম্বার জানি কোথা থেকে জোগার করলাম জানতে চাইলো ।
আমি একটু হেসে বললাম
-চাইলে বাঘের দুধও পাওয়া যায় ।
সুপ্তিকেও দেখলাম হাসতে । বলল
-নাহ এখন চাইলে আপনি বাঘের দুধ পাবেন না । জানেন না সুন্দর বনের কি অবস্থা । যখন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ চালু হবে তখন কিন্তু আর বাঘ পাবেন না । টাকা দিলেও তখন বাঘের দুধ পাবেন না !

আমি কয়েক মিনিট খুব হাসলাম । তারপর বললাম
-আসলে আমি একটা দরকারে ফোন দিয়েছি ।
-আমি যেন আপনার ভাইয়ার নামে পুলিশের কাছে কিছু না বলি ? কিংবা আমার বাবাও যেন কিছু না বলে ? এই তো ?

আমি এবার সত্যিই চমকালাম । তারপর বললাম
-হ্যা । এটাই । আসলে সে যাই-ই করুক না কেন সে আমার বড় ভাই তো । বুঝতেই পারছো । জানি এটা অন্যায় আবদার হচ্ছে তবুও ।
-আমি বুঝতে পারছি । বাবাও বুঝতে পেরেছে । প্রথমে সে খুব রেগে ছিলো । কোন ভাবেই আপনার ভাইয়াকে ছাড়বে না এমন একটা ভাব । পরে মাথা একটু ঠান্ডা হয়ে আসলে বুঝতে পারলো যে পুলিশ কেস হলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না । আর আমিও থানাতে গিয়ে কিছু বলতে রাজি ছিলাম না ।
-কেন ?
-কারন টা আমি জানি না । তবে হয়তো আপনি ওভাবে আমাকে ওখানে থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন এটাও একটা কারন হতে পারে !

দুদিন পরের ঘটনা । সকালে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য বের হব তখনই সুপ্তির ফোন এসে হাজির । খানিকটা ভীত কন্ঠে বলল
-আপনি কোথায় আছেন ?
-এই তো বাসা থেকে বের হব । কেন ?
-আপনি কি একটু জামসেদ রোডে আসতে পারবেন এখন ?
-কেন ? কোন সমস্যা ?
-কাল থেকে দেখছি দুটি ছেলে আমাকে ফলো করছে । কালকে গাড়ি নিয়ে যেখানে যেখানে গিয়েছি ছেলে দুটো বাইকে করে আমার পেছন পেছন গিয়েছে । আজকে এখন আমার পেছন পেছন আসছে । বাবা আমার সাথে একটু লোক দিয়ে দিতে চেয়েছিলো । আমি নিতে রাজি হই নি । বলেছি যে কোন ভয় নেই কিন্তু যদি জানতে পারে যে কেউ ফলো করছে তাহলে ঝামেলা শুরু হবে ।
-আচ্ছা আমি আসছি । ওখানেই দাড়িয়ে পড় তো দেখি । দেখতে চাই ওরা কি করে ।
-আচ্ছা ।


আমি বাইক নিয়ে দ্রুত জামসেদ রোডের দিকে রওনা দিলাম । পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না । গিয়ে দেখি বড় বট গাছের নিচে সুপ্তির গাড়িটা দাড়িয়ে আছে । ও ভেতরেই বসে আছে । ঠিক ওদের গাড়ির থেকে একটু দুরে একটা বইকে দুটো ছেলে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । আমি সুপ্তির দিকে একটু হাত নাড়লাম । তারপর সোজা গিয়ে থামলাম ছেলে দুটোর সামনে । আমি যে ওদের সামনেই দাড়াবো । ওদের সামনে গিয়ে বললাম
-এখানে কি ?
ছেলে দুটো একটু থমত খেয়েগেল । তারপর কোন মতে বলল
-দাড়িয়ে থাকি আপনার কি !

যে ছেলেটা আমার বাম দিকে ছিল তাকে কষে এক চড় মারলাম । এতোই আওয়াজ হল যে দেখলাম সুপ্তি পর্যন্ত গাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে । আমার দিকে তাকিয়ে অন্য ছেলেটা বলল
-দেখুন কাজটা কিন্তু আপনি ....
আবার হাত তুললাম ছেলেটা মাঝ পথেই থেমে গেল । আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি ওদের মেরে তক্তাও বানিয়ে ফেলি তবুও ওরা আমাকে কিছু বলার সাহস পাবে না । আমি বললাম
-এখান থেকে ভালই ভালই কেটে পর । সুপ্তি যদি আর একদি কম্প্লেইন করে যে তোরা ওর পিছু নিয়েছিস তাহলে কিন্তু খবর আছে ।

ছেলে গুলো আর দাড়ালো না । আমি সুপ্তির কাছে যেতেই সুপ্তি বলল
-ওদের মারার কি দরকার ছিল ?
-দরকার ছিল । এবার থেকে ওরা কিংবা অন্যকেউ পিছু নিলেই আমাকে বলবে । সাথে সাথেই ।

তারপর কয়েকবার ফোন দিয়েছে ও আমাকে তবে ওর কন্ঠে আর কেন জানি আমি ভয় ব্যাপারটা অনুভব করতে পারি নি । একদিন জানতে চাইলে ও আমাকে হেসে বলল
-আমার কেন জানি আর ভয় লাগে না । মনে হয় আপনি রয়েছে । ওরা কিংবা অন্য কেউ আমাকে কিছু করার সাহস পাবে না ।

এভাবে মাস খানেক কেটে গেল । আর আজকে এই মেয়ে আমার ক্যাম্পাসে এসে হাজির । আমার কাছে । আমি শহীদ মিনারের কাছে গিয়ে দেখি সুপ্তি মেয়েটা পুরো এলাকা আলো করে দাড়িয়ে আছে । এই ক'দিয়ে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে মেয়েটা যেন দিন দিন আরও বেশি সুন্দর হচ্ছে । কারন টা অবশ্য আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । আমাকে দেখে সুপ্তি একটু হাসলো । আমিও প্রতি উত্তরে হাসলাম । কাছে গিয়ে বললাম
-সব কিছু ঠিক আছে ?
-কেন ঠিক থাকবে না কেন ? আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে আসতে পারি না এমনিতে ?
-না তা তো বলি নি । পারো । পারবে না কেন ? আসো ক্যাফেটরিয়াতে গিয়ে বসি ।
-নাহ । আপনি বরং আমার সাথে চলুন !
-কোথায় ?
-চলুন । গেলেই দেখতে পাবেন !


সুপ্তি আমার বাইকের পেছনেই উঠে বসলো । তারপর আমাকে বলে দিতে লাগলো কোন দিকে যেতে হবে । কিছু সময়ে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কা করলাম যে আমি আমার বাইক নিয়ে ওদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি ।
সুপ্তি বলল
-আসুন ।
-ভেতরে ?
-হ্যা । কেন সমস্যা কি ? ভয় পাচ্ছেন ?
-না আসলে ....

সুপ্তি কেন জানি খুব জোরে হেসে ফেলল । বলল
-ভয় নেই আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলবো না । আসুন প্লিজ । আব্বু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ।

আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম হাফিজ মেয়র ড্রয়িং রুমে বসে আছে । আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল । আমি এমন মুখ করে থাকলাম যে আমি কিছুই যেন বুঝতে পারছি না । মেয়র সাহেব আমাকে আসলে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য । সেই সেদিন যে আমি তার মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি এবং আমি আমার পরিবারের অন্য কারো মত হয় নি এইটা নিয়ে তিনি বড় রকমের একটা লেকচারও দিয়ে দিলেন । তবে তার ধন্যবাদ দেওয়ার ভেতরে যে কোন ভনিতা ছিল না যেটা আমি বুঝতে পারলাম । খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বাইরে চলে এলাম মেয়র সাহেব নিজে আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল । দোতালায় সুপ্তিকেও দেখতে পেলাম । বাপ মেয়ের মাথায় আসলে কি চলছে কে জানে !

দিন যাওয়ার সাথে সাথে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতে শুরু করলাম যে সুপ্তির সাথে আমার কথা বলার পরিমানটা বেড়েই যাচ্ছে । একদিন জানতে চাইলাম যে তাকে আবার কেউ ফলো করে কি না ?
সুপ্তি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
-হ্যা করে তো । আমি যেখান যাই সেখানেই তারা যায় ।
-তোমার ভয় লাগে না ? আমাকে বল নি কেন ?
-নাহ ! আমার কেন জানি আর ভয় লাগে না । মনে হয় আপনি তো আসেনই আমার জন্য ।
-তাই ?
-জানেন ঐ দিনের পর থেকে এমন একটা রাতও যায় নি আমি আপনার কথা না ভেবে ঘুমিয়েছি !

আমি কি বলব খুজে পেলাম না । সুপ্তি বলল
-তবে বাবার জন্য ভয় লাগে ।
-কেন ?
-জানি না । জানেন না ভাল মানুষের শত্রু বেশি থাকে ।
-হুম ! তোমার বাবাকে সাবধানে থাকতে বল একটু । ইলেকশনের সময় এগিয়ে আসছে এই সময়টা খারাপ ।


পাঁচ

আমার কথা মুখেই রয়ে গেল ঠিক তার পরদিনই হাফিজ মেয়রের উপর হালমা হল । খুব বড় কোন হামলা নয় তবে আরেকটু হলে হয়তো বড় ব্যাপার হতে পারতো । তার গাড়ি বরাবর একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়েছে সেই সাথে কয়েক রাউন্ড গুলো । তবে কেউ হতাহত হয় নি । গাড়িটার একটু ক্ষতি হয়েছে এই যা ।

সবাই জানে আসলেকে হামলা করেছে তবে কোন প্রমান নেই কারো হাতে । আমার ভাইয়া তো সেই দিনের পর থেকেই আর সামনেই আসে নাই কারো আর বাবা ঠিক হামলার আগের দিন থেকেই শহরের বাইরে গিয়ে বসে রয়েছে ।
পুলিশ খুব ধর-পাকড় করলো কিন্তু কোন লাভ হল না ।

ঐদিনর রাতের বেলাতেই সুপ্তির ফোন এসে হাজির । রাট তখন এগারোটা বাজে । আমি হ্যালো বলতেই সুপ্তি বলল
-আপনি একটু আসতে পারবেন ?
-এখন ? কোথায় ?
-আমি ঠিকানা দিচ্ছি চলে আসুন । খুব দরকার । প্লিজ ।
-আচ্ছা আসতেছি !
আমি বাইক নিয়ে আবারও বের হয়ে গেলাম । মা অবশ্য জানতে চাইলো এতো রাতে আমি কোথায় যাচ্ছি বলল যে এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি !



-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি না বোঝার মত কোন কথা বলি নি । ঐদিন আপনার বড় ভাইও আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিল ।

আমি সুপ্তির এক বন্ধুর বাসায় এসেছি । মেয়েটাকে দেখে অনেক বেশি বিলচিত মনে হচ্ছে । একটু আগে যে কথা ও আমাকে বলল সেটা শুনে আমি নিজেও বিচলিত বোধ করতে লাগলাম । সুপ্তি বলল
-ঐদিন আপনার ভাইও আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলো ।
-তাহলে পালালে কেন আমার সাথে ?
-জানি না । মনে হয়েছিল যে হয়তো এমন টা হবে না । কিন্তু .....
-আমি যে কি বলবো তোমাকে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । আমার পরিবারের লোকজন এমন করছে আর তুমি কি না আমার কাছেই সাহায্য চাইছো ?
-আমি এর থেকে ভাল আর কিছু খুজে পাচ্ছি না । প্লিজ এই অনুরোধটা রাখুন ! তবে আপনি যদি আমাকে পছন্দ না করেন তাহলে ....।
-আমি সেই কথা বলি নি, তুমি অপছন্দ করার মত মেয়ে নও । তবে তোমার বাবা কি রাজি হবে ?
-সেটা আমি দেখবো । আমি রাজি তো ?
আমি একটু সময় ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকালাম । তারপর বললাম
-আমি রাজি ।

বাইক নিয়ে আবার যখন বাড়ির দিকে রওনা দিলাম তখন মনের ভেতরে সুক্ষ একটা আনন্দ বোধ হচ্ছিলো । সুপ্তির সাথে ঐদিন পালানোর পথে আমার মনের ভেতরে একটা সুক্ষ ইচ্ছে কাজ ছিল যে মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়ে গেলেই মনে হয় ভাল হত । এভাবে পালানোর জন্য মনের ভেতরে একটা অল্প বিস্তার আফসোস হচ্ছিলো । তবে সেদিন সেটা গায়ে মাখি নি । আর আজকে মেয়েটা নিজ থেকেই আমাকে কি না বিয়ের প্রস্তার বিয়ে বসলো । যদিও এর পেছনে একটা কারন আছে !

সুপ্তি আমাকে আজকে সরাসরিই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছে । আমি যখন জানতে চাইলাম তখন কারন হিসাবে বলল যে যখন আমি ওকে বিয়ে করবো তখন ওরা আমাদের আত্মীয় হয়ে যাবে । খুবই কাছেই আত্মীয় । তখন নিশ্চয়ই আমার বাবা কিংবা ভাইয়া তার বাবার উপর এভাবে হামলা করতে পারবে না । ঐদিন ভাইয়াও নাকি সুপ্তিকে ঠিক একই ভাবে ভয় দেখিয়েছিলো । তার বাবা এবং পরিবারের উপরে নাকি চোরাগুপ্তা হামলা হতেই থাকবে যদি না সে রাজি হয় ।


পরিশিষ্টঃ

তারপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো । ঠিক তিন দিন পর হাফিজ মেয়র তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির । আমি এর ভেতরে খোজ নিয়ে জানলাম যে সুপ্তি নাকি গত দুইদিন থেকে একটা ডানা-পানিও মুখে নেয় নি ও বাবাকে রাজি করাতে । প্রথমে ওর বাবা ঠিক রাজি হচ্ছিলো না সে কিন্তু পরে মেয়ের জিদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে ।

বাবাও রাজি হয়ে গেলেন তবে একটা শর্ত ঠিকই জুড়ে দিলেন । আমি জানতাম হাফিজ মেয়র ঠিকই সেটা মেনে নিবে । নিতে সে বাধ্য । নিজের একমাত্র মেয়ের জন্য মেয়র পদটা একবার না থাকলে কি বা যায় আসে !

এক সপ্তাহের মাথায় আমাদের স্থায়ীয় পত্রিকায় অন্যতম একটা সংবাদ ছিল এটাই যে হাফিজ মেয়র এবার মেয়র পদের জন্য দাড়াবেন না । এবং ঘটনা এখানেই শেষ নয়, তিনি এবার আমার বাবার পক্ষেই প্রচারণা চালাবেন ! অনেকেই চমকে গেল খবর শুনে । কিন্তু তার পরের সপ্তাহে যখন আমার সুপ্তির বাগদানের কথা সবাই শুনতে পেল তখন ব্যাপারটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না । দুই প্রতিদ্বন্দী একেবারে এভাবে আত্মীয় হয়ে গেল ।

বাগদানের দিনে আমরা ছোট খাটো অনুষ্ঠান করবো ভাবছিলাম তবুও ব্যাপারটা ছোট রইলো না । মানুষ জনে ভর্তি হয়ে গেল কমিউনিটি সেন্টারে । সবাই খুব ব্যস্ত । আমার বাবা আর সুপ্তির বাবা একসাথে অতিথিদের অভ্যার্থনা জানাচ্ছেন । সুপ্তি ওর বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছে । ওকে দেখে আসলেই আনন্দিত মনে হচ্ছে । আমিও বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছি ।

ঠিক তখকনই আমার চোখ ভাইয়ার দিকে গেল । ভাবীর সাথে কি যেন একটা কথা বলল । ভাবী চলে গেল কিছু আনতে । মুখ ঘুরাতে গিয়ে আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল । ভাইয়ার ঠোঁটে একটা সুক্ষ হাসি দেখতে পেলাম । প্রতি উত্তরে আমিও হাসলাম । তবে হাসিটা ঠোঁটের চেয়ে চোখে চোখেই বেশি । কেউ জানলো না দুই ভাইয়ের ভেতরে এই দৃষ্টি বিনিময়ের আসল রহস্য কি !



সমাপ্ত ।

মূলত গল্প এখানেই শেষ তবে গল্পের মাঝেও অনেক গল্প থাকে । এই গল্প শেষ করে অনেকেরই সেটা বুঝতে পারার কথা । তবুও যদি কেউ না পারে তাহলে নিচের লিংকে যাওয়ার অনুরোধ করছি ।
মাঝের কথা


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২৭
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×