এক
-ক্লাস শেষ তোর ?
আমি নাম্বারটা আরেকবার ভাল করে দেখলাম । ভাইয়ার নাম্বারই । কিন্তু ভাইয়া আজকে আমাকে ফোন দিয়ে আমার ক্লাসের খোজ নিচ্ছে কেন হঠাৎ ? কারনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । ভাইয়া খুব দরকার না হলে আমাকে তো ফোন দেয় না ।
কোন কি সমস্যা হয়েছে ?
বাসায় কিছু হয়েছে ? আমি বললাম
-শেষ না । ব্রেক চলছে ।
ভাইয়া বলল
-শোন তোর রিপন ভাই যাচ্ছে তোর ক্যাম্পাসে । তোকে নিয়ে আসতে ।
আমার তখনই মনে হল নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে । হতে বাধ্য । আমি বললাম
-কি হয়েছে ? বাসায় কোন সমস্যা ? আব্বা ঠিক আছে ?
আসলে আমার আব্বা আর ভাইয়া যে কাজ করে তাতে তাদেরকে মা আর ভাবী সব সময় চিন্তা করে । যদিও আমি এই সব ব্যাপার থেকে দুরে থাকি তবুও চিন্তাটা না চাইলেও চলে আসে । আমার গলার স্বর শুনে ভাইয়া বলল
-আব্বা ঠিক আছে । বাসায় কোন সমস্যা নেই । তুই চলে আয় । তোকে একটা কাজ করতে হবে । আর তোর রিপন ভাই মনে হয় তোর ক্যাম্পাসে চলে গেছে এতোক্ষনে ।
আমি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম । মাথার ভেতরে তখনও ঠিক কিছু কাজ করছে না । কিছু আসছে না । ভাইয়ার হঠাৎ আমাকে দিয়ে কি কাজ থাকতে পারে । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
বাইক নিয়ে গেটের কাছে আসতেই দেখতে পেলাম একটা কালো রংয়ের মাইক্রোবার এসে থামলো সামনে । থামার সাথে সাথেই গেট খুলে রিপন ভাইকে বের হতে দেখলাম । তাকিয়ে দেখি ভেতরে আরও কয়েকজন বসে আছে । রিপন ভাইয়ের সাথে আরও একজন নেমে পড়লো । রিপন ভাই আমাকে বলল
-অপু বাইকটা একে দিয়ে দাও । ও বাসায় দিয়ে আসবে । তুমি এই গাড়িতে উঠো ।
-বাইকে গেলে সমস্যা ভাইয়া
-একটু সমস্যা আছে । আমরা অনেক দুরে যাবো ।
আমি আর কথা না বলে বাইকটা ছেলেটার কাছে দিয়ে দিলাম । তারপর মাইক্রোতে উঠে বসলাম । মাইক্রো চলতে শুরু করলে তাকিয়ে দেখি মাইক্রোর ভেতরে আমাকে নিয়ে মোট ৭ জন মানুষ । এর ভেতরে একজন আমার দাড়িওয়ালা মৌলবীও আছে । এদের সাথে এই মৌলবী কেন ? আর আমিই বা যাচ্ছি কেন এদের ।
এদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয় এরা কোন অপরারেশনে যাচ্ছে । কিন্তু আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে ? আমাকে খুব ভাল ভাবেই আব্বা এসব থেকে দুরে রেখেছে । আমাকে নিয়ে কোন বিপদজনক কাজে এরা যাবে না এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত, তাহলে যাচ্ছে কোথায় ?
কিন্তু জানতে চাইতে গিয়েও চাইলাম না । মাইক্রোটা দ্রুত গতিড়ে ছুটে যাচ্ছে শহরের শেষ মাথার দিকে । আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! মাথার ভেতরে তখনই সেই একই চিন্তা কাজ করছে ।
এরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় ?
দুই
মাইক্রো বাসের ভেতরে সবার মুখ বেশ গম্ভীর । সব থেকে বেশি মুখ গম্ভীর মৌলবী সাহেবের । তিনি আবার বসেছেন আমার মুখোমুখি । হাতে তজবী গুনছেন আর মাঝে মাঝে হাত তুলে কি যেন দোয়া করছেন । ওনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার মতই ওনাকেও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে । আমাকে যদিও জোর করে নি কিন্তু মৌলবী সাহেবকে যে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না ।
আমি নিজের মাঝেই একটু চিন্তা করার চেষ্টা করলাম যে এমন কি কাজ পরে গেল আমাকে এভাবে দরকার পড়লো । আমার বাবা খুব ভাল করেই আমাকে এসবের থেকে দুরে রেখেছে । ভাইয়ারও মতামত ঠিক ঐ রকমই । তাহলে আজকে এমন করে আমাকে ধরে আনার দরকারটা পরলো কি ? মারামারি যে করতে যাচ্ছে না এটা আমি নিশ্চিত কারন তাহলে আমার ডাক কোন ভাবেই পড়তো না । তবে এর থেকে কোন গুরুতর কাজ করতে যাচ্ছে ? কিন্তু সেই কাজটা কি ?
আর আমার এখানে ভুমিকাই বা কি !
আমার বাবা এলাকার প্রাক্তন সিটি মেয়র । গত মেয়াদে আব্বা ঠিক জিততে পারে নি । একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে গেছে । সত্যি বলতে কি, তার জিতে যাওয়াতে বরং আমি খুশিই হয়েছি । আমাদের বর্তমান মেয়র সাহেব, মেয়র হিসাবে আমার আব্বার থেকে হাজার গুন ভাল । সামনে আবার মেয়র নির্বচন । শোনা যাচ্ছে এবারও নাকি হাফিজ সাহেবই মেয়র হবে ।
কিন্তু যতদুর শুনেছি এবার নাকি আমার বাবা আবার মেয়র হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে । যেকোন মূল্যে তাকে মেয়র হওয়া চাই-ই । যদিও বাবা মেয়র হতে পারে নি তবুও এলাকাতে আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে নি বিন্দু মাত্র । বাবা বর্তমান রুলিং পার্টি করে । তার ক্ষমতার সীমা নাই । তবুও তার মেয়র হওয়া চাই ই চাই ।
গাড়ী থেমে গেল শহরের একেবার শেষ প্রান্তে । এখান থেকে শুরু হয়েছে খানিকটা বনজঙ্গল তার পরে পাশের জেলার সীমানা । আমাদের মাইক্রোটা একটা কাচা রাস্তায় নেমে গেল । আরও কিছুটা সময় চলার পরে একটা দুই তলা বাড়ির সামনে এসে থামলো । তাকিয়ে দেখি বাড়িটা বেশ গাছ গাছালীতে ঘেরা । খানিকটা বাগান বাড়ির মত তবে চারিপাশে কোন দেওয়াল দেওয়া নেই । বাড়ির সামনে কয়েকটা বাইক দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম । আমাদের গাড়িটা কালো রংয়ের সুজুকিটা চিনতে কষ্ট হল না । আমার বড় ভাইয়ার । তার মানে ভাইয়া ভেতরেই আছে ।
আমি সবার সাথেই বাড়ির ভেতরে ঘুকে পড়লাম । আমার মাথার ভেতরে তখনও কেবল একটা চিন্তাই কাজ করছে । আমাকে এখানে কেন আনা হল, আমার কাজটা কি ! ঘরের ভেতর ঘুকতেই দেখি ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এল । বলল
-তোর কোন সমস্যা হয় নাই তো ?
-নাহ । সমস্যা কেন হবে ? কিন্তু আমাকে এভাবে আনার দরকার টা কি ? আমি তো বুঝতে পারছি না ।
আমার আমার দিকে কিছু তাকিয়ে রইলো । তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করলো । সবাই বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । তারপর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোকে আসলে একটা কাজ করতে হবে ।
-তা তো বুঝলাম । কিন্তু কাজটা কি ! আর এখানেই বা কি ?
-তুই তো জানিস এবার আব্বা মেয়র হওয়ার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে আছে ।
-জানি !
-কিন্তু অবস্থা খুব একটা ভাল না । এবারও মনে হয় হাফিজ আহমেদই মেয়র হয়ে যাবে । এলাকাতে ওনার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে ।
আমি যদিও কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম না তবুও বলে ফেললাম । বললাম
-উনি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারন আছে । মেয়র হিসাবে আমার আব্বার থেকে উনাকেই পছন্দ ।
-বেশি বুঝিস না । শোন তোকে যে কারনে এখানে এনেছি । আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি তারপর হাফিজ আহমেদ আর বাবার পথের কাটা হতে পারবে না ।
-কি করতে যাচ্ছো ?
একটু ভয় হল । আমার মেরে টেরে ফেলবে না তো ।
ভাইয়া কেমন যেন রহস্যময় হাসি দিল । তারপর 'সবুজ' বলে ডাক দিল । সাথে সাথেই একটা ছেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো । যেন দরজার ওপাশে ভাইয়ার ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিলো । ভাইয়া ইশারায় আবার কি যেন বলল । সবুজ নামের ছেলেটা আবারও বেরিয়ে গেল । আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি বলবা তো ?
ভাইয়াকে কিছু বলতে হল না । ঠিক তারপর মুহুর্তেই সবুজ এক মেয়েকে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো । মেয়ের দিকে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল মুহুর্তেই, আর যাই হোক আমি কোন ভাবেই এই মেয়েকে এখানে আশা করি নি ।
সুপ্তি এখানে কি করছে ?
সুপ্তি !
আমাদের মেয়র সাহবের মেয়ে ! হাফিজ মেয়রের মেয়ে এখানে কি করে ?
আমি কয়েক মুহুর্ত একেবারে বোকার মত একবার সুপ্তির দিকে আরেকবার ভাইয়ার দিকে তাকালাম । মেয়েটার মুখ কেমন শুকনা মনে হচ্ছে । কান্নাকাটি করেছে বোঝাই যাচ্ছে । তবে এখানে অনেকটাই সামলে নিয়েছে । ভাইয়া কি করতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে এটা আমি বুঝতে পারলাম ।
ভাইয়া আসলে আমাকে সুপ্তির সাথে বিয়ে দিতে চায় । এই জন্য মাওলানাকেও নিয়ে এসেছে । সুপ্তির সাথে বিয়ে হয়ে গেলে হাফিজ মেয়রের মেয়ে জামাই হয়ে যাবো আমি । বিয়াইয়ের বিরুদ্ধে নিশ্চয় হাফিজ সাহেব নির্বাচনে দাড়াবে না । অন্য দিকে তাকে যদি গুম টুম করার করার পরিকল্পনা করতো তাহলে এতে করে বাবার জনপ্রিয়তা আরও খারাপের দিকে যেত । কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে সেটার ভয় নেই ।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম
-ইউ আর কিডিং রাইট ?
-নো ! দেখ সুপ্তিও রাজি তোকে বিয়ে করতে !
তারপর সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল
-কি সুপ্তি রাজি না ?
সুপ্তি কোন কথা বলল না । কেবল মাথা নাড়লো । আমার সুপ্তিকে দেখে মনে হল না যে সুপ্তি স্বইচ্ছাতে রাজি হয়েছে । নিশ্চয়ই ভাইয়া এমন কিছু বলেছে কিংবা হুমকি দিয়েছে তাতে রাজি হয়েছে ।
ভাইয়া বলল
-এখান তোর রাজি হওয়ার পালা । দেখ বাবার জন্য এটা করাই যেতে পারে । পারে না ?
-তার মানে বাবা জানে না ?
-না । জানে না ।
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । সুপ্তিকে কিভাবে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সেই বিষয়েও আমার খানিকটা সন্দেহ আছে । মনে হচ্ছে ওকে জোর করেই এখানে তুলে আনা হয়েছে । তাহলে ? মেয়েটাকে যদি এখন আমি বিয়ে করতে রাজি না হই তখন ? কত বড় একটা ঝামেলার ভেতরে পরে গেছি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । মনের ভেতর থেকেই অনুভব করলাম যে মেয়েটাকে এখান থেকে উদ্ধার করে দিয়ে আসতে হবে এবং সেটা অক্ষত ভাবে ।
কিন্তু কিভাবে ?
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম
-কখন বিয়ে করতে হবে ?
-যতদ্রুত সম্ভব !
কিছুটা মানষিক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে । আর আমি সুপ্তির সাথেও কথা বলতে চাই একটু , একা । যেহেতু ওর সাথে বিয়ে করছি একটু কথা বলতে চাই ।
-ঠিক আছে । তবে তোর মোবাইল আমার কাছে দে । তোর বিশ্বাস নেই ।
বললাম
-আচ্ছা তার আগে আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই ।
ভাইয়ার চোখের ইশারায় আবারও সবাই বাইরে চলে গেল । দরজা বন্ধ হতেই আমি ভাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম
-এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি রাজনীতি কর ?
-মানে ?
প্রায় ১৫ মিনিট ধরে ভাইয়ার সাথে কথা বললাম । তারপর আবার সুপ্তির ঘরে চলে এলাম । মেয়েটাকে সেই সকাল বেলা তুলে আনা হয়েছে । এতোক্ষনে ওর বাবার কাছে খবর জানাজানি হয়ে গেছে কি না কে জানে ! পুলিশ যদি খোজ খবর শুরু করে তাহলে কি হবে কে জানে !
আমাকে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল । আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেওয়া হল । কিছু সময় আমরা দুজনকে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না । সুপ্তিকে আমি কয়েকবার দেখেছি । কোন দিন কথা বলা হয় নি । ওর নামটা জানি কেবল । এর বেশি কিছু এখনও জানি না । আমিই প্রথমে মুখ খুললাম
-তুমি রাজি বিয়েতে ?
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার ভাইয়া আমাকে যে হুমকি দিয়েছে তাতে রাজি না হয়ে পারি নি । আপনি বুঝতেই পারছেন !
-বুঝতে পারছি । এখন ?
-আপনার ভাইয়া কি বলল শুনলেন না ?
-তুমি বিয়ে করতে চাও না ?
-আমার চাওয়া আর না চাওয়ার আসলে এখানে কোন মূল্য নেই ।
আমি দরজা খুলে বারান্দায় চলে এলাম । ফোনটা কাছে থাকলেও বাবাকে একটা ফোন দেওয়া যেত । চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আক্ষরিক অর্থেই বনের ভেতরে রয়েছি । চিৎকার করে কাউকে ডাকলেও কাজ হবে না । এখন উপায় ?
তিন
সুপ্তি আমাকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে আছে । অবশ্য এতো দ্রুত বাইক চলছে সে আমাকে শক্ত করে না ধরলে ও পড়ে যেতে পারে । আর আমিও জীবনে এর থেকে জোরে বাইক চালিয়েছি কি না আমি নিজেরও মনে নেই । ভাইয়ার বাইকটা ২৫০ সিসির । মিটারের কাটায় দেখি দুইশ ছুই ছুই করছে । তার উপর রাস্তা একদম ফাঁকা । একটু আগে আমরা দুজন যেখান আর যে ভাবে বের হয়ে এলাম, সেটা হিসাব করলে আমাদের এরকম আচরন মোটেই অস্বাভাবিক নয় ।
সুপ্তি এমন ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল সেটা থেকে স্পষ্টই যে মেয়েটা যথেষ্ঠ ভয় পেয়েছে । যদিও আমি খুব বেশি ভীত ছিলাম না, কারন আমরা যদি পালাতা গিয়ে ধরা পরে যেতাম তাহলে কিছুই হত না, আমরা কেবল জীবিত থেকে বিবাহিত হয়ে যেতাম । সেটা তো আমরা না পালালে এমনিতেও হয়ে যেতাম ।
এভাবে পালানোর কথা আমার কিংবা সুপ্তির কারোর মাথাতেই আসে নি । আমাদেরকে কথা বলার জন্য একা রেখে যখন ভাইয়া নিচে চলে গেল তখন আমার মাথাতে কিছুই আসছিলো না । আমি রুমের দরজা খুলে বারান্দাতে আসতেই চারিদিকে তাকয়ে দেখি কেবল গাছপালায় ভর্তি । তখন আমার চোখ গেল বারান্দার শেষ দিকের । দেখি একটা গাছ একদম বারান্দার পাশ দিয়ে উঠে গেছে । ডাল পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।আমি আরো কাছে গিয়ে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখলাম । আমি নিশ্চিত ভাবেই নিচে নেমে যেতে পারবো । কিন্তু সুপ্তি কি নামতে পারবে ?
সুপ্তিকে বলাতেই ও যেন লাফিয়ে উঠলো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার আগেই ও গাছ বেয়ে নেমে পরলো । আমি ভাবতেও পারি নি ও এতো জলদি নামতে পারবে ।মেয়েটার নিশ্চয় গাছে চড়ার অভ্যাস আছে আগে থেকেই । নতুবা এমন ভাবে গাছ থেকে নামতে পারতো না ।
একবার ভাবলাম বনের ভেতরে দৌড় দেই কিন্তু পরে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম । আমরা বনের ভেতরে গেলে আমাদের ধরে ফেলতে ভাইয়াদের খুব বেশি সময় লাগবে না । সুপ্তি আমার হাত ধরে আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেল । আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম । বাড়ির সামনের দিকে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই । সেই বাইক গুলো আর মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে । আমি পা টিপে টিপে বাইকের কাছে গিয়ে দাড়ালাম ।
প্রত্যেকটা বাইকের চাবি বাইকের সাথেই রয়েছে । অবশ্য এমনটা হবে আগ থেকেই জানতাম আমি । ভাইয়া কোনদিন বাইকের চাবি খুলে না বাইক থেকে । এই শহরে থেকে আমার ভাইয়ের বাইক চুরি করে কেউ হজম করবে এমন মানুষ এখনও পয়দা হয় নি । তাই ভাইয়াকে আমি খুব একটা বাইকে তালা মারতে দেখি নি ।
আমি সুপ্তিকে ইশারা করে ডাক দিলাম । ও আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো । আমি বারবার কেবল দরজার দিকে তাকাতে লাগলাম যদি এখনও কেউ দরজা খুলে বের হয়ে আসে তাহলে আমাদের পালায়ন কর্মসূচি এখানেই শেষ হয়ে যাবে । আমি দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে ভাইয়ার বাইকটা স্ট্যান্ড থেকে তুলে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির সামনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম । যত দূরে গিয়ে স্টার্ট দিবো ততই ভাল ।
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার কাছে না এসে সবার আগে অন্য বাইক গুলোর দিকে যাচ্ছে । সেখান থেকে প্রত্যেকটা বাইকের থেকে চাবি খুলে নিল । তারপর মাইক্রো বাসের চাবিটাও নিয়ে এল । আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে গেলাম । ভাইয়ারা যেন আমাদের পিছু না নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করে ফেলল ।এতো ভয়ের ভেতরেও মেয়েটার মাথা যে কাজ করছে সেটা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না ।
তারপর আমার বাইকের পেছনে এসে উঠে এল । আমি বাইক স্টার্ট দিতেই পেছনে থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম । কিন্তু সেদিকে তাকানোর আর সময় নেই আমার । আমি স্টার্ট দিয়ে ততক্ষণে গিয়ারে চাপ দিয়ে ফেলেছি । মাত্র তিন সেকেন্ডে গতি উঠে গেল ৬০ কিলোমিটার । তারপর সেটা হুহু করে বাড়তেই লাগলো । কাঁচা রাস্তা হলেও গতি কমালাম না । যখন পাকা রাস্তায় এলাম এখনও মনে হচ্ছিলো কেউ আমাদের পিছু পিছু ছুটে আসছে । আমি কিংবা সুপ্তি কেউ একটাবারও পেছনে তাকানোর সাহস করলাম না । কেবল অনুভব করতেছিলাম সুপ্তি আমাকে বেশ শক্ত করে ধরে ছিল ।
যখন সুপ্তিদের বাসার সামনে বাইক দাড় করালাম তখন দেখলাম ওর বাবা, সাথে আরও কয়েকজন দৌড়ে চলে এল । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে । আমাকে চিনতেও তাদের খুব একটা কষ্ট হল না । আমার দিকে তেড়ে আসতেই সুপ্তি ওর বাবাকে বলল
-বাবা অপু ভাইয়ার কোন দোষ নেই । উনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন । উনি না থাকলে আমি আসতেই পারতাম না
হাফিজ মেয়র আমার দিকে আস্তে আস্তে থেমে গেল । নিজের মেয়ের দিকে তাকালো । সুপ্তি হরফর করে বলে গেল ওর সাথে কি হয়েছে আর কিভাবে ওকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি । আমি বললাম
-আঙ্কেল আমার বাবা আসলে এসবের কিছুই জানে না । আমার ভাইয়া আর ভাইয়ার বন্ধু মিলে এসব করেছে । আমি খুবই সরি !
-আমি সব কটাকে জেল খাটাবো । সব কটা । এতো বড় সাহস .... !
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । আমার কথা যে উনি শুনবেন সেটা আশাও আমি করতে পারি না । তবে খুব একটা চিন্তার ব্যাপার না অবশ্য । ভাইয়াকে এতো সহজে জেলে ঢুকাতে পারবে না কেউ । আর ঢুকলেও ভাইয়া খুব জলদি বের হয়ে আসবে । এটা ভাইয়ার কাছে খুব একটা ব্যাপারও না ।
এখানে থাকাটা আর বেশি সমীচীন হবে না । সুপ্তির বাবার মেজাজ যে কোন সময় অন্য দিকে মোড় নিতে পারে । আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম
-সাবধানে থেকো । আমি যাই ।
-আপনিও সাবধানে থাকবেন ।
আমি বাইকে ঘুরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম । মনের ভেতরে কাজ করছে এখন ভাইয়ার সাথে দেখা হলে কি হবে কে জানে । অবশ্য তার সাথে আমার দেখা হওয়াটা জরূরী । তাকে কিছু কথা বলার আছে ।
চার
ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । এমন সময় বন্ধু সবুজ আমার কাছে এসে বলল
-হাফিজ মেয়রের মেয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে কি করছে রে ?
আমি সবুজের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ও সত্য বলছে নাকি মিথ্যা বলছে । ওর চেহারা দেখে মনে হল না যে মিথ্যা বলছে । আমি বললাম
-কোথায় ?
-শহীদ মিনারের কাছে দাড়িয়ে আছে ।
-কি করছে ?
-সেটা আমি কিভাবে বলবো ? দেখলাম তাই বললাম ।
আমি ওদের থেকে একটু দুরে সরে গিয়ে সুপ্তিকে ফোন দিলাম । দুবার রিং বাজতেই মেয়েটা ফোন রিসিভ করলো ।
-হ্যালো ।
ওপাশ থেকে কয়েক মুহুর্ত কোন কথা নেই । আমি বললাম
-আছো ?
-জি !
-তুমি কি আমাদের ক্যাম্পাসে ?
-হ্যা ।
-কোন কাজে এসেছো ?
-জি ।
-ও ! আচ্ছা কাজ করো । কোন দরকার হলে আমাকে জানিও ।
এই লাইন বলে আমি চুপ করে লাইন ধরে রইলাম । আমি জানি সুপ্তি আমার কাছেই এসেছে । আমার ধারনা সত্যি প্রমান করে দিয়ে সুপ্তি বলল
-আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছি ।
-আবার কোন ঝামেলা ?
-না না । আসলে আপনার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম ।
-আচ্ছা । কোথায় আছো তুমি এখন ?
-শহীদ মিনারের কাছে দাড়িয়ে আছি ।
-আচ্ছা থাকো । আসছি ।
আমি ফোনের লাইণ কেটে দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হাটা দিলাম ।
ঐ দিন সুপ্তিকে বাসায় পৌছে দেওয়ার পরে মনের ভেতরে একটা ভয় ছিল যে হাফিজ মেয়র নিশ্চয়ই পুলিশ কেস করবে । তবে ব্যাপারটা হয়েছিলো খুব গোপনে । বলতে গেলে আমাদের এবং ওদের কাছের মানুষ গুলো বাদ দিয়ে আর কেউ ব্যাপার জানে না । আর ব্যাপারটা যদি জানাজানি হয়ে যায় যে তার মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল, তাহলে সেটা তার পরিবারের সুনামের জন্য মোটেই ভাল কিছু হবে না । তাই হয়তো সে কেস করে নি । তবে আমি ঝুকি নিতে চাই নি । পরদিন রাতেই সুপ্তিকে ফোন করেছিলাম । আমার ফোন পেয়ে একটু অবাক হয়ে গেছিলো । আমি কিভাবে ওর নাম্বার জানি কোথা থেকে জোগার করলাম জানতে চাইলো ।
আমি একটু হেসে বললাম
-চাইলে বাঘের দুধও পাওয়া যায় ।
সুপ্তিকেও দেখলাম হাসতে । বলল
-নাহ এখন চাইলে আপনি বাঘের দুধ পাবেন না । জানেন না সুন্দর বনের কি অবস্থা । যখন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ চালু হবে তখন কিন্তু আর বাঘ পাবেন না । টাকা দিলেও তখন বাঘের দুধ পাবেন না !
আমি কয়েক মিনিট খুব হাসলাম । তারপর বললাম
-আসলে আমি একটা দরকারে ফোন দিয়েছি ।
-আমি যেন আপনার ভাইয়ার নামে পুলিশের কাছে কিছু না বলি ? কিংবা আমার বাবাও যেন কিছু না বলে ? এই তো ?
আমি এবার সত্যিই চমকালাম । তারপর বললাম
-হ্যা । এটাই । আসলে সে যাই-ই করুক না কেন সে আমার বড় ভাই তো । বুঝতেই পারছো । জানি এটা অন্যায় আবদার হচ্ছে তবুও ।
-আমি বুঝতে পারছি । বাবাও বুঝতে পেরেছে । প্রথমে সে খুব রেগে ছিলো । কোন ভাবেই আপনার ভাইয়াকে ছাড়বে না এমন একটা ভাব । পরে মাথা একটু ঠান্ডা হয়ে আসলে বুঝতে পারলো যে পুলিশ কেস হলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না । আর আমিও থানাতে গিয়ে কিছু বলতে রাজি ছিলাম না ।
-কেন ?
-কারন টা আমি জানি না । তবে হয়তো আপনি ওভাবে আমাকে ওখানে থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন এটাও একটা কারন হতে পারে !
দুদিন পরের ঘটনা । সকালে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য বের হব তখনই সুপ্তির ফোন এসে হাজির । খানিকটা ভীত কন্ঠে বলল
-আপনি কোথায় আছেন ?
-এই তো বাসা থেকে বের হব । কেন ?
-আপনি কি একটু জামসেদ রোডে আসতে পারবেন এখন ?
-কেন ? কোন সমস্যা ?
-কাল থেকে দেখছি দুটি ছেলে আমাকে ফলো করছে । কালকে গাড়ি নিয়ে যেখানে যেখানে গিয়েছি ছেলে দুটো বাইকে করে আমার পেছন পেছন গিয়েছে । আজকে এখন আমার পেছন পেছন আসছে । বাবা আমার সাথে একটু লোক দিয়ে দিতে চেয়েছিলো । আমি নিতে রাজি হই নি । বলেছি যে কোন ভয় নেই কিন্তু যদি জানতে পারে যে কেউ ফলো করছে তাহলে ঝামেলা শুরু হবে ।
-আচ্ছা আমি আসছি । ওখানেই দাড়িয়ে পড় তো দেখি । দেখতে চাই ওরা কি করে ।
-আচ্ছা ।
আমি বাইক নিয়ে দ্রুত জামসেদ রোডের দিকে রওনা দিলাম । পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না । গিয়ে দেখি বড় বট গাছের নিচে সুপ্তির গাড়িটা দাড়িয়ে আছে । ও ভেতরেই বসে আছে । ঠিক ওদের গাড়ির থেকে একটু দুরে একটা বইকে দুটো ছেলে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । আমি সুপ্তির দিকে একটু হাত নাড়লাম । তারপর সোজা গিয়ে থামলাম ছেলে দুটোর সামনে । আমি যে ওদের সামনেই দাড়াবো । ওদের সামনে গিয়ে বললাম
-এখানে কি ?
ছেলে দুটো একটু থমত খেয়েগেল । তারপর কোন মতে বলল
-দাড়িয়ে থাকি আপনার কি !
যে ছেলেটা আমার বাম দিকে ছিল তাকে কষে এক চড় মারলাম । এতোই আওয়াজ হল যে দেখলাম সুপ্তি পর্যন্ত গাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে । আমার দিকে তাকিয়ে অন্য ছেলেটা বলল
-দেখুন কাজটা কিন্তু আপনি ....
আবার হাত তুললাম ছেলেটা মাঝ পথেই থেমে গেল । আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি ওদের মেরে তক্তাও বানিয়ে ফেলি তবুও ওরা আমাকে কিছু বলার সাহস পাবে না । আমি বললাম
-এখান থেকে ভালই ভালই কেটে পর । সুপ্তি যদি আর একদি কম্প্লেইন করে যে তোরা ওর পিছু নিয়েছিস তাহলে কিন্তু খবর আছে ।
ছেলে গুলো আর দাড়ালো না । আমি সুপ্তির কাছে যেতেই সুপ্তি বলল
-ওদের মারার কি দরকার ছিল ?
-দরকার ছিল । এবার থেকে ওরা কিংবা অন্যকেউ পিছু নিলেই আমাকে বলবে । সাথে সাথেই ।
তারপর কয়েকবার ফোন দিয়েছে ও আমাকে তবে ওর কন্ঠে আর কেন জানি আমি ভয় ব্যাপারটা অনুভব করতে পারি নি । একদিন জানতে চাইলে ও আমাকে হেসে বলল
-আমার কেন জানি আর ভয় লাগে না । মনে হয় আপনি রয়েছে । ওরা কিংবা অন্য কেউ আমাকে কিছু করার সাহস পাবে না ।
এভাবে মাস খানেক কেটে গেল । আর আজকে এই মেয়ে আমার ক্যাম্পাসে এসে হাজির । আমার কাছে । আমি শহীদ মিনারের কাছে গিয়ে দেখি সুপ্তি মেয়েটা পুরো এলাকা আলো করে দাড়িয়ে আছে । এই ক'দিয়ে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে মেয়েটা যেন দিন দিন আরও বেশি সুন্দর হচ্ছে । কারন টা অবশ্য আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । আমাকে দেখে সুপ্তি একটু হাসলো । আমিও প্রতি উত্তরে হাসলাম । কাছে গিয়ে বললাম
-সব কিছু ঠিক আছে ?
-কেন ঠিক থাকবে না কেন ? আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে আসতে পারি না এমনিতে ?
-না তা তো বলি নি । পারো । পারবে না কেন ? আসো ক্যাফেটরিয়াতে গিয়ে বসি ।
-নাহ । আপনি বরং আমার সাথে চলুন !
-কোথায় ?
-চলুন । গেলেই দেখতে পাবেন !
সুপ্তি আমার বাইকের পেছনেই উঠে বসলো । তারপর আমাকে বলে দিতে লাগলো কোন দিকে যেতে হবে । কিছু সময়ে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কা করলাম যে আমি আমার বাইক নিয়ে ওদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি ।
সুপ্তি বলল
-আসুন ।
-ভেতরে ?
-হ্যা । কেন সমস্যা কি ? ভয় পাচ্ছেন ?
-না আসলে ....
সুপ্তি কেন জানি খুব জোরে হেসে ফেলল । বলল
-ভয় নেই আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলবো না । আসুন প্লিজ । আব্বু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ।
আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম হাফিজ মেয়র ড্রয়িং রুমে বসে আছে । আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল । আমি এমন মুখ করে থাকলাম যে আমি কিছুই যেন বুঝতে পারছি না । মেয়র সাহেব আমাকে আসলে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য । সেই সেদিন যে আমি তার মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি এবং আমি আমার পরিবারের অন্য কারো মত হয় নি এইটা নিয়ে তিনি বড় রকমের একটা লেকচারও দিয়ে দিলেন । তবে তার ধন্যবাদ দেওয়ার ভেতরে যে কোন ভনিতা ছিল না যেটা আমি বুঝতে পারলাম । খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বাইরে চলে এলাম মেয়র সাহেব নিজে আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল । দোতালায় সুপ্তিকেও দেখতে পেলাম । বাপ মেয়ের মাথায় আসলে কি চলছে কে জানে !
দিন যাওয়ার সাথে সাথে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতে শুরু করলাম যে সুপ্তির সাথে আমার কথা বলার পরিমানটা বেড়েই যাচ্ছে । একদিন জানতে চাইলাম যে তাকে আবার কেউ ফলো করে কি না ?
সুপ্তি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
-হ্যা করে তো । আমি যেখান যাই সেখানেই তারা যায় ।
-তোমার ভয় লাগে না ? আমাকে বল নি কেন ?
-নাহ ! আমার কেন জানি আর ভয় লাগে না । মনে হয় আপনি তো আসেনই আমার জন্য ।
-তাই ?
-জানেন ঐ দিনের পর থেকে এমন একটা রাতও যায় নি আমি আপনার কথা না ভেবে ঘুমিয়েছি !
আমি কি বলব খুজে পেলাম না । সুপ্তি বলল
-তবে বাবার জন্য ভয় লাগে ।
-কেন ?
-জানি না । জানেন না ভাল মানুষের শত্রু বেশি থাকে ।
-হুম ! তোমার বাবাকে সাবধানে থাকতে বল একটু । ইলেকশনের সময় এগিয়ে আসছে এই সময়টা খারাপ ।
পাঁচ
আমার কথা মুখেই রয়ে গেল ঠিক তার পরদিনই হাফিজ মেয়রের উপর হালমা হল । খুব বড় কোন হামলা নয় তবে আরেকটু হলে হয়তো বড় ব্যাপার হতে পারতো । তার গাড়ি বরাবর একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়েছে সেই সাথে কয়েক রাউন্ড গুলো । তবে কেউ হতাহত হয় নি । গাড়িটার একটু ক্ষতি হয়েছে এই যা ।
সবাই জানে আসলেকে হামলা করেছে তবে কোন প্রমান নেই কারো হাতে । আমার ভাইয়া তো সেই দিনের পর থেকেই আর সামনেই আসে নাই কারো আর বাবা ঠিক হামলার আগের দিন থেকেই শহরের বাইরে গিয়ে বসে রয়েছে ।
পুলিশ খুব ধর-পাকড় করলো কিন্তু কোন লাভ হল না ।
ঐদিনর রাতের বেলাতেই সুপ্তির ফোন এসে হাজির । রাট তখন এগারোটা বাজে । আমি হ্যালো বলতেই সুপ্তি বলল
-আপনি একটু আসতে পারবেন ?
-এখন ? কোথায় ?
-আমি ঠিকানা দিচ্ছি চলে আসুন । খুব দরকার । প্লিজ ।
-আচ্ছা আসতেছি !
আমি বাইক নিয়ে আবারও বের হয়ে গেলাম । মা অবশ্য জানতে চাইলো এতো রাতে আমি কোথায় যাচ্ছি বলল যে এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি !
-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি না বোঝার মত কোন কথা বলি নি । ঐদিন আপনার বড় ভাইও আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিল ।
আমি সুপ্তির এক বন্ধুর বাসায় এসেছি । মেয়েটাকে দেখে অনেক বেশি বিলচিত মনে হচ্ছে । একটু আগে যে কথা ও আমাকে বলল সেটা শুনে আমি নিজেও বিচলিত বোধ করতে লাগলাম । সুপ্তি বলল
-ঐদিন আপনার ভাইও আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলো ।
-তাহলে পালালে কেন আমার সাথে ?
-জানি না । মনে হয়েছিল যে হয়তো এমন টা হবে না । কিন্তু .....
-আমি যে কি বলবো তোমাকে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না । আমার পরিবারের লোকজন এমন করছে আর তুমি কি না আমার কাছেই সাহায্য চাইছো ?
-আমি এর থেকে ভাল আর কিছু খুজে পাচ্ছি না । প্লিজ এই অনুরোধটা রাখুন ! তবে আপনি যদি আমাকে পছন্দ না করেন তাহলে ....।
-আমি সেই কথা বলি নি, তুমি অপছন্দ করার মত মেয়ে নও । তবে তোমার বাবা কি রাজি হবে ?
-সেটা আমি দেখবো । আমি রাজি তো ?
আমি একটু সময় ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকালাম । তারপর বললাম
-আমি রাজি ।
বাইক নিয়ে আবার যখন বাড়ির দিকে রওনা দিলাম তখন মনের ভেতরে সুক্ষ একটা আনন্দ বোধ হচ্ছিলো । সুপ্তির সাথে ঐদিন পালানোর পথে আমার মনের ভেতরে একটা সুক্ষ ইচ্ছে কাজ ছিল যে মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়ে গেলেই মনে হয় ভাল হত । এভাবে পালানোর জন্য মনের ভেতরে একটা অল্প বিস্তার আফসোস হচ্ছিলো । তবে সেদিন সেটা গায়ে মাখি নি । আর আজকে মেয়েটা নিজ থেকেই আমাকে কি না বিয়ের প্রস্তার বিয়ে বসলো । যদিও এর পেছনে একটা কারন আছে !
সুপ্তি আমাকে আজকে সরাসরিই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছে । আমি যখন জানতে চাইলাম তখন কারন হিসাবে বলল যে যখন আমি ওকে বিয়ে করবো তখন ওরা আমাদের আত্মীয় হয়ে যাবে । খুবই কাছেই আত্মীয় । তখন নিশ্চয়ই আমার বাবা কিংবা ভাইয়া তার বাবার উপর এভাবে হামলা করতে পারবে না । ঐদিন ভাইয়াও নাকি সুপ্তিকে ঠিক একই ভাবে ভয় দেখিয়েছিলো । তার বাবা এবং পরিবারের উপরে নাকি চোরাগুপ্তা হামলা হতেই থাকবে যদি না সে রাজি হয় ।
পরিশিষ্টঃ
তারপর ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো । ঠিক তিন দিন পর হাফিজ মেয়র তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির । আমি এর ভেতরে খোজ নিয়ে জানলাম যে সুপ্তি নাকি গত দুইদিন থেকে একটা ডানা-পানিও মুখে নেয় নি ও বাবাকে রাজি করাতে । প্রথমে ওর বাবা ঠিক রাজি হচ্ছিলো না সে কিন্তু পরে মেয়ের জিদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে ।
বাবাও রাজি হয়ে গেলেন তবে একটা শর্ত ঠিকই জুড়ে দিলেন । আমি জানতাম হাফিজ মেয়র ঠিকই সেটা মেনে নিবে । নিতে সে বাধ্য । নিজের একমাত্র মেয়ের জন্য মেয়র পদটা একবার না থাকলে কি বা যায় আসে !
এক সপ্তাহের মাথায় আমাদের স্থায়ীয় পত্রিকায় অন্যতম একটা সংবাদ ছিল এটাই যে হাফিজ মেয়র এবার মেয়র পদের জন্য দাড়াবেন না । এবং ঘটনা এখানেই শেষ নয়, তিনি এবার আমার বাবার পক্ষেই প্রচারণা চালাবেন ! অনেকেই চমকে গেল খবর শুনে । কিন্তু তার পরের সপ্তাহে যখন আমার সুপ্তির বাগদানের কথা সবাই শুনতে পেল তখন ব্যাপারটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না । দুই প্রতিদ্বন্দী একেবারে এভাবে আত্মীয় হয়ে গেল ।
বাগদানের দিনে আমরা ছোট খাটো অনুষ্ঠান করবো ভাবছিলাম তবুও ব্যাপারটা ছোট রইলো না । মানুষ জনে ভর্তি হয়ে গেল কমিউনিটি সেন্টারে । সবাই খুব ব্যস্ত । আমার বাবা আর সুপ্তির বাবা একসাথে অতিথিদের অভ্যার্থনা জানাচ্ছেন । সুপ্তি ওর বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছে । ওকে দেখে আসলেই আনন্দিত মনে হচ্ছে । আমিও বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছি ।
ঠিক তখকনই আমার চোখ ভাইয়ার দিকে গেল । ভাবীর সাথে কি যেন একটা কথা বলল । ভাবী চলে গেল কিছু আনতে । মুখ ঘুরাতে গিয়ে আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল । ভাইয়ার ঠোঁটে একটা সুক্ষ হাসি দেখতে পেলাম । প্রতি উত্তরে আমিও হাসলাম । তবে হাসিটা ঠোঁটের চেয়ে চোখে চোখেই বেশি । কেউ জানলো না দুই ভাইয়ের ভেতরে এই দৃষ্টি বিনিময়ের আসল রহস্য কি !
সমাপ্ত ।
মূলত গল্প এখানেই শেষ তবে গল্পের মাঝেও অনেক গল্প থাকে । এই গল্প শেষ করে অনেকেরই সেটা বুঝতে পারার কথা । তবুও যদি কেউ না পারে তাহলে নিচের লিংকে যাওয়ার অনুরোধ করছি ।
মাঝের কথা
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২৭