আমাদের এলাকার কমিশনার সাহেব মাঝে মাঝেই এলাকা পরিদর্শনে বের হয় । এটাকে ঠিক পরিদর্শন না বলে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া বললেই মনে হয় ভাল হয় । এই সময়ে তিনি এলাকার সব কিছু দেখা শুনা করে । কোনটা কোথায় থাকা উচিৎ নয় সেটা দেখে বেড়ান । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যেদিন তিনি পরিদর্শনে বের হন তার আগেই সবাই সব কিছু জেনে যায় । তারপর অস্থায়ী ভাবে সব কিছু ঠিক করে ফেলে ।
উদাহরন দিয়ে বলি । আমি যে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি সেই হোটেল মালিক নিজের হোটেল ছাড়াও রাস্তার মোটামুটি অর্ধেক জায়গা দখল করে চেয়ার টেবিল বসিয়েছে । আজকে খেতে গিয়ে দেখি রাস্তার উপর আর চেয়ার টেবিল কিছু নেই । বুঝলাম আজকে আবারও কমিশনার সাহেব আসবে । অবশ্য আমি আগে থেকেই খোজ পেয়েছিলাম ।
খাওয়া শেষ করতে না করতেই কমিশনটার রাজিম ভাইয়ের দেখা পেয়ে গেলাম । গোটা ৫০ জন লোক তার আশে পাশে ঘুরাফেরা করছে । তিনি সব কিছু দেখছেন । আমি কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বুকে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম ।
-ভাই একটা কথা ছিল !
আমার কথা শুনে আসে পাশের সবাই কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেল । যেখানে সবাই কমিশনারের কথায় হ্যা হ্যা করে যাচ্ছে সেখানে আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলাম । দেখলাম একজন চামচা মত ছোকড়া এগিয়ে এসে বলল
-কি চাই ?
-ভাইয়ার সাথে একটা সেলফি তুলতে চাই ?
-কি ? কেন ? ভাইয়ের কি আর কোন কাজ নেই নাকি ?
আমি এবার আমাদের কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বললাম
-ভাই প্লিজ ! আপনি হচ্ছেন আমাদের এলাকার হিরো । হিরো বলতে একেবারে আসল হিরো । আপনার সাথে সেলফি তুলে যখন ফেসবুকে পোস্ট দিবো তখন আমার ভ্যালু কত বেড়ে যাবে জানেন !! প্লিজ ! একটা মাত্র ছবি !
আমি দেখতে পেলাম কমিশনারের চোখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো । ওঠারই কথা । এমন প্রশংসা কেই বা পছন্দ করে না । সবাই তোষামদে গলে যেতে বাধ্য ! আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু মনে এতেই কাজ হয়ে যাবে ।
কমিশনার বলল
-আচ্ছা ঠিক ঠক আছে । একটা সেলফিই তো !
-জি ভাই !
কমিশনারের সাথে একটা সেলফি তুলেই ফেললাম ।
সেলফি তোলার পরে বললাম
-আপনি সাথে সেলফি তুলতে পেরে আজকে আমি খুবই আনন্দিত ।
-আচ্ছা ঠিক আছে । কোথায় থাকো তুমি ?
-আলীম সাহেবের বাসায় ।
-আচ্ছা !
-ভাই যদিও জানি আমাকে দরকার নেই তবুও যদি কোন দিন আপনার কোন উপকারে আসতে পারি আমাকে নির্দ্বায় বলবেন । বলবেন কি হুকুম করবেন ! আপনার হুকুম শুনতে আমি সদা প্রস্তুত !
-আচ্ছা আচ্ছা ! তোমাদের মত ছেলেদেরই তো দরকার আমার দলে । মাঝে মাঝে এসে কাজ টাজ করে যেও !
-অবশ্যই ! আপনি যখন বলবেন !
-তা কোথায় পড় তুমি ?
আমি বললাম কোথায় পড়ি । নাম শুনে বেশ প্রসণ্ণ হলেন মনে হল । খুশিও হলেন । সবাই ই হয় এমন করে ।
আমাকে রেখে কমিশনার হাটা দিল তার দলবল নিয়ে । আমি দাড়িয়ে রইলাম । মনে মনে হাসলাম কেবল. আপাতত আমার কাজ এখানে শেষ । এখন কেবল অপেক্ষা করার পালা ।
আমার ডাক পড়লো আরও সপ্তাহ খানেক পড়ে । সেদিনের সেই ছোকড়াই আমাকে ডাকতে এল । আমি সুড়সুড় করে হাজির হয়ে গেলাম কমিশনারের অফিসে । আমার দিকে তাকিয়ে কমিশনার বলল
-তুমি সেদিন বলেছিলেন না তুমি কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড় ?
-জি !
-আমার একটা কাজ করে দিতে হবে !
-আপনি কেবল হুকুম করে ভাই । দিতে হবে কেন বলছেন । বলবেন এই কাজটা করে দে !
কমিশনারের মুখে আবারও হাসি দেখা গেল । বলল
-আমার ছোট বোনের পিসিতে কি একটা সমস্যা হয়েছে । কি নাকি করা লাগবে । একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার দরকার । তুমি কি পারবে ? আমি আবার এ ব্যাপারে কম বুঝি !
-আরে পারবো না মানে ? অবশ্যই পারবো । আর আমি না পরলে আমাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাবো । কোন সমস্যা নেই ।
তারপর কমিশনার পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল
-একে বাসায় নিয়ে যা । রুনুকে বলবি কি সমস্যা একে যেন বলে ।
সেই ছোকড়ার সাথে সাথেই কমিশনারের বাসায় এসে হাজির হলাম । দরজা খোলাই ছিল । ছেলেটা ছোট আপা বলে ডাকতেই কমিশনার ছোট বোন বের হয়ে এল ।
একে কে না চেনে । এলাকার সবাই এক নামে চেনে । একটু কথা বলার জন্য এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করে কিন্তু সাহসের অভাবে কিছু বলতে পারে না । আর যা ভাব নিয়ে চলে । অবশ্য ভাব নিয়ে চলা একে মানায়ও । একে তো ভাই কমিশনার তার উপরে কন্যা মাশাল্লা দেখতেও সেই !!
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ?
-আপনাের কম্পুটারের কি জানি সমস্যা ! এরে কইতে কইছে ভাই !
-ইনি কেন ? মিস্ত্রি ?
আমাকে দেখে কি মিস্ত্রির মত মনে হচ্ছে ? আমি একটু কেশে উঠলাম !
ছোকরা বলল
-এই ছেলে পারবে । আপনি একে বলেন ।
রুনু তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-পারবেন আপনি ?
-চেষ্টা করে দেখি ! না পারলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে । আর ভাই যখন পাঠিয়েছে । দেখতে তো হবেই ।
রুনু যেন কথা শুনে একটু বিরক্ত হল । তারপর পাশের ছোকড়ার দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে । ভাইয়াকে বল যে আজকে যেন একটু জলদি বাসায় আসে । কেমন ?
এই কথার পরেও ছোকড়া দাড়িয়ে রইলো । রুনু বলল
-কি ব্যাপার দাড়িয়ে আছো কেন ?
-না মানে .....
রুনু বলল
-কোন ভয় নেই । ভাইয়া পাঠিয়েছে না একে । তাহলে ?
আসলে ছোকড়া আমাকে এখানে একা রেখে যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছে না । তবুও রুনু ধমক শুনে দরজার দিকে হাটা দিল । আমি রুনুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম । এই মেয়ে এমন ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে ।
পেছন থেকে এক মহিলা বের হয়ে এল !
রুনু বলল
-মা, ভাইয়া একে পাঠিয়েছে পিসিটা ঠিক করার জন্য ।
তিনি মনে হয় কোন কাজে ব্যস্ত ছিলাম । আমার দিকে একটু তাকিয়ে বলল
-তোর পিসির কাছে নিয়ে যা ।
রুনু কিছু বলল না । মহিলা আবার যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিকেই চলে গেলেন ।
রুনুকে দেখলাম ঘরের অন্য দিকে হাটতে । আমি কি করবো ঠিক বুঝলাম না । আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রুনু বলল
-এই যে মিস্ত্রী সাহেব । আসুন.
আবার মিস্ত্রী ? আমি কি মিস্ত্রী ? এই মেয়ের খবর আছে কিন্তু !
আমি ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম । ওর পিসিটা ওর নিজের ঘরে । ওর ঘরের ঢুকতেই ওর হাত দুটো দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলাম । তারপর মুখটা খুব কাছে নিয়ে এসে বললাম
-আমি মিস্ত্রী ? হুম ?
রুনু আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে তারপর বলল
-ছাড় ! মা চলে আসবে !
-আসতে দাও ! দেখুক !
-প্লিজ ! এমন করে না । ভাইয়া জানতে পারলে কি করবে জানো তো !
-হুম ! দেখলে না তোমার ভাইয়াই তো আমাকে এখানে পাঠালো তোমার সমস্যা সমাধানে ! তা ম্যাডামের সমস্যা সমাধান করবো না ?
-যাও ! ফাজিল !
বলে আমাকে সরিয়ে দিয়ে পিসি চালু করতে গেল ।
অনেক দিন আগে কথায় কথায় রুনুলে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম যে আমি ওদের বাসায় ঢুকবো । আমি জোর গলায় বলেছিলাম যে ওর নিজের ভাই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে । সেই জন্যই ওর ভাইয়ের সাথে সেলফি, তেল দেওয়া এই সব । আমি যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এটাই খানিকটা জানানো । তারপর রুনুকে দিয়ে তার ভাইকে জানানো যে তার পিসিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সেটা যেন তেন ভাবে ঠিক হবে না । একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার লাগবে !
আমি নিশ্চিৎ জানতাম যে আমার কথা তার মনে পড়বেই । ঐদিন যেভাবে তেল মেরেছি না মনে পড়ে কি পারে !
রুনু পিসি চালু করে বলল
-দেখো কি সমস্যা ?
-আগে আমার পুরুস্কার !
-কিসের ?
-মনে নেই ? বলেছিলাম আমি যদি আসতে পারি তাহলে কি দিতে হবে !
-আচ্ছা বাবা দেবতো মানা তো করি নি ! আগে পিসিটা একটু দেখো । নয়তো ধরা পড়ে যেতে পারে !
দুই
রুনুকে আমি প্রথম দেখি যেদিন এই এলাকাতে প্রথম আসি সেদিনই । বাসার সামনে ভ্যানে মাল পত্র নিয়ে বসেছিলাম তখন দেখি রুনু সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । আমি তাকিয়ে দেখলাম তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলাম । এই আমাদের প্রথম দেখা ।
ঠিক তার পরের দিনে আবার দেখা । আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি । টিউশনীতে যাবো । কঠিন রোড উঠেছে । রুনুকে দেখলাম সামনে দিয়ে আসতে । আমার দিকে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-সামনের মোড়ে গিয়ে একটা রিক্সা ডেকে দিন তো !
আমি অবাক হয়ে কিছু সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । তখনও ওর নাম ধাম ওর পরিচয় কিছুই জানি না । তাই একটু অবাক লাগলো । চিনি না জানি না এরকম একজনকে রিক্সা ডেকে দিতে বলা । তাও আবার অনুরোধের সুরে বললেও হয়, বলছে হুকুমের সুরে । আমি বললাম
-আমি ওদিকে যাবো না । পেছনের দিকে যাবো
মেয়েটি আমার দিকে এবার ভাল করে তাকালো । তারপর বলল
-আপনি জানেন আমি কে ?
-তুমি কে সেটা তো আমার জানার দরকার নেই । আছে ? নিজের রিক্সা দরকার নিজে ডেকে নাও । আর কথা না বলে পেছনের দিকে হাটা দিলাম । এখনও দুপুরের খাওয়া হয় নি । কালকেই পেছনের দিকের এই হোটেলের খোজটা পেয়েছি আমি ।
যদিও আমি একবারও পেছনের দিকে তাকাই নি তবে আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা আমার দিকে খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে রয়েছে । যদিও আমার তখনও কোন ধারনা নেই আমি কার সাথে কথা বলছি । রুনুর খোজ পেলাম আরও সপ্তাহ খানেক পরে । সাথেই আমার রুমমেট ছিল । দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম । তখনই রুনুকে দেখতে পেলাম ।
জিজ্ঞেস করতেই আমার রুমমেট সব হড়বড় করে বলে দিল । সত্যি বলতে কি একটু ভয় লাগলো নিজের কাছেই । ঐ দিন মেয়েটা যদি ওর কমিশনার ভাইকে সব বলে দেয় তাহলে আমার খবরই আছে । কে জানে বলে দিয়েছে কি না । আমি পরের কয়েকদিন একটু ভয়ে ভয়ে থাকলাম । কিন্তু একটা সময় ভয় কেটে গেল । মনে হল যে কিছু হবে না । মেয়েটা আমাকে চিনে আমিও মেয়েটাকে চিনি না । কিন্তু ভয় ভাঙ্গলো কয়েকদিন পরেই । আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরছিলাম । ধানমন্ডির আল ফ্যাসকোর সামনে দেখি রুনু দাড়িয়ে আছে । খানিকটা বিরক্ত মুখে । আমার কি মনে হল আমি রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম । তারপর রুনুর সামনে গিয়ে হাজির হলাম ।
-আপনি এখানে ?
রুনু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময় । একবার মনে হল আমাকে মনে হয় ঠিক চিনতে পারছে না কিন্তু পরমুহুর্তেই রুনু বলল
-আপনি আগের দিন আমাকে তুমি করে বলছিলেন !
-ও তাই নাকি ! তাই বলেছি বুঝি !
-জি !
-তো এখানে কি !
-কিছু না । আপনার এখানে কি !
-না আমি দেখলাম আমাদের এলাকার এক সুন্দরী মেয়ে এখানে একা একা দাড়িয়ে আছে । মনে হয় আজকেও রিক্সা খুজে পাচ্ছে না । তাই সাহায্য করতে এলাম ।
-ঐদিন তো সাহায্য করেন নি । আজকে কেন হঠাৎ !
আমি খানিকটা কাব্যবিক সুরেই বললাম
-আমি অতীতকে ভুলে যেতে চাই । আসলে অতীতের ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোই সফলকাম হয় ।
সাধারনত এই ধরনের কথায় মেয়েরা পটে না বরং বিরক্ত হয় । কিন্তু রুনুর মুখে হাসি ফুটতে দেখলাম । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-একজনের আসার কথা !
মনে মনে বললাম যাহ শালা । এই মেয়ের দেখি আগে থেকেই বয়ফ্রেন্ড আছে । তাহলে আর হল কি ।
রুনু বলল
-না । আমার বয়ফ্রেন্ড না । মেয়ে বন্ধু ।
-আমি বয়ফ্রেন্ডের কথা ভাবছিলাম তোমাকে কে বলল ?
-আপনার চেহারা ।
-চেহারায় লেখা ছিল নাকি ?
-ওরকমই মনে করতে পারেন । যাই হোক ও দেরি করছিল । একটু আগে ফোনে ঝাড়ি মেরেছি বলেছি আসতে হবে না ।
-ভাল করেছো । ঝাড়ি মারাই উচিৎ । চল এখনও চল ।
এইবার আমিস ব থেকে সাহসিকতার কাজটা করলাম । আলফ্রাসকোর সিড়ির দিকে হাটা দিলাম রুনুর হাতটা ধরে । এমন একটা ভাব করলাম যে ওর হাত আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধরতে পারি । যখন সিড়ি দিয়ে উপড়ে উঠছিলাম তখনও ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখে খানিকটা বিশ্ময় কাজ করছে । কিন্তু সেটা হাসিতে পরিনত হত সময় লাগলো না । সিড়িতে উঠতে উঠতেই রুনু বলল
-ভেরি ব্রেভ । এতো সাহস দেখানো কিন্তু ভাল নয় ।
-জানি । সাথে এও জানি যে মেয়েরা সাহসী ছেলেদের পছন্দ করে ।
-কিন্তু মেয়ের ভাইয়েরা কিন্তু এরকম ছেলে পছন্দ করে না ।
-না করুক । মেয়ে পছন্দ করলে মেয়ের ভাই বোন, বাবা মা সবাই এক সময় ঠিকই পছন্দ করে ফেলবে !
যদিও আমার কোন ধারনা ছিল না আমি কি করছি কিন্তু ঝোকের মাথায় ঠিক ঠিক জায়গায় কোপ পড়েছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । রুনুর সাথে আমার লুকোচুরি প্রেম শুরু হয়ে গেল । এলাকাতে আমরা এমন ভাবে থাকতাম যেন একে অন্যকে চিনিই না । ও মাঝে মাঝে আমার ক্যাম্পাসে আসতো আমিও যেতাম !
তিন
কমিশনার রাজিম ভাইয়ের সাথে তারপর থেকেই বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল । মাঝে মাঝে ওনার এলাকার কাছে অনেক লোকজন দরকার হত । আমার ডাক পড়তে লাগলো । আমিও যেতে লাগলাম । এবং এক সময় আবিস্কার করলাম যে রাজিম ভাই আমাকে বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছে । বিভিন্ন কাজে আমি যেতাম । সব থেকে বেশি পছন্দ করতে শুরু করলো যেদিন আমি ওনার জন্য ভাষনের স্ক্রিপ্ট লিখে দিলাম ।
এলাকাতে একটা ফাংশনের আয়োজন করা হয়েছিল । বেশ নেতা এসে হাজির হবে । রাজিম ভাই চিন্তিত কি ভাষন দিবে সেটা নিয়ে । আমি স্ক্রিপ্ট লিখে দিলাম । রাজিম ভাই যখন স্পিচ দিল । হাত দিল যেন থামতেই চায় না । তারপর থেকে আমি আরও একটু পেয়ারের পাত্র হয়ে উঠলাম । এর মাঝে অবশ্য আরও কয়েকবারই আমি রাজিম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছি কম্পিউটার ঠিক করার জন্য । শবে-বরাতের দিন রাজিম নিজে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে হাজির হল । রাতের খাবার খেলাম একই টেবিলে বসে । রুনু আমার দিকে মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছিলো । মাঝে মাঝে পা দিয়ে খোচাও মারছিলো । আমি কিছু বলতেও পারছিলাম না কারন পাসে রাজিম ভাই বসে ছিল ।
সময় যেতে লাগলো । রুনুর সাথে প্রেমটাও জমে উঠেছে বেশ । তবে মনের ভেতরে একটা চিন্তা আর ভয় ঠিকই কাজ করছিলো । যদি রাজিম ভাই জেনে যায় তাহলে এই ভালবাসা কিসে পরিনত হবে আমি জানি না । তাই একটা সাহসী কাজ করেই ফেললাম । রুনু আমাকে প্রবল ভাবেই মানা করলো । কিন্তু আমি শুনলাম না । আমার মনে হল কাজটা করেই ফেলা দরকার ।
সোজা গিয়ে হাজির হলাম কামিশনারের অফিসে । আমার চেহারা দেখেই রাজিম ভাই কিছু একটা আচ করতে পারলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে রে তোর ? এমন কেন লাগছে ?
-ভাই আপনার সাথে একটা কথা বলতাম ।
-বল !
-একটু একা বলা দরকার ।
ঘরের ভেতরে আরও যারা ছিল সবাইকে চলে যেতে বলল । ঘর ফাকা হলে গেলে রাজিম ভাই বলল
-এবার বল কি হয়েছে । কোন সমস্যা ? কেউ কিছু বলেছে ?
-না ভাই !
আমি আরেকবার চিন্তা করলাম বলবো কি না কিংবা বলা ঠিক হবে কি না । ফলাফল যেকোন দিকে যেতে পারে । আমি বললাম
-ভাই আমি একটা খুব বড়ত অন্যায় করে ফেলেছি আপনার সাথে ।
-কি করেছিস ?
-জানি না ভাই কিভাবে করলাম । আপনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত দেখেন নিজের বাসায় নিয়ে আমাকে ভাত পর্যন্ত খাওয়ালেন আর আমি কি করে করলাম এই কাজ টা । আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে । আমি কিভাবে করলাম এই কাজটা ।
এটা যদিও একটু বাড়িয়ে বলছি । আসলে রাজিম ভাইকে ইমোশনালী ব্লাকমেইল করার জন্য বলা । রাজিম ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হল কিছুটা কাজ হয়েছেও । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আরে বলবি তো কি করেছিস ?
-ভাই রুনু !
এবার রাজিম ভাই একটু সোজা হয়ে বসলো । আমার কাছে মনে হল যা বলেছি এই পর্যন্তই থাক । আর বেশি কিছু বলার দরকার নেই । কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এতো দুর যখন চলে এসেছি তখন আর অপেক্ষা করে লাভনেই । বললাম
-আপনার পরিবারের সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় । রুনুর সাথে আমার দেখা হয়েছে অনেক বার । কথাও হয়েছে । কিন্তু কদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করলো আমি রুনুর ব্যাপারে অন্য রকম ফিল করা শুরু করেছি ।
-কি বলছিস ?
-জি ভাই । আমি মনে হয় রুনুর প্রেমে পরেছি । কিন্তু এই কথাটা মনে হওয়ার পর থেকেই নিজেকে বড় হীন আর ছোট মনে হচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে বিট্রে করেছি । তাই রুনুকে আমার মনের কথা জানানোর আগে আমি আপনাকে বললাম । আমি আপনাকে না জানিয়ে কিছু যদি করি তাহলে আপনাকে পেছন থেকে ছুরি মারা হবে যা আমি কোন দিন পারবো না । এখন আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো । যদি আমাকে শাস্তি দিতে চান তাও আমি মাথা পেতে নেব যদি এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে কালই চলে যাবো । আর কোন দিন আপনার সামনে আসবো না ।
শেষ কথা গুলো বলার সময় গলার স্বর এমন করলাম যে নিজের কন্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম ।
রাজিম ভাই সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-রুনু জানে ?
-না ভাই ওকে বলি নি ।
-কিছু বলার দরকার নেই । তোকে চিনি বলে কিছু বলছি না । কালকেই চলে যাবি এলাকা ছেড়ে । তোকে যেন এই এলাকায় আর না দেখি ।
-আচ্ছা !
যখন অফিস থেকে বের হলাম তখন নিজের গালেই একটা চড় মারতে ইচ্ছে । রুনুর কথা শুনলেই মনে ভাল হত । তাহলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হত না । বেশি বুদ্ধি দেখাতে গিয়ে সব কিছু হারাতে হল । রুনু সব শুনেও খুব রাগারাগি করলো ।
সন্ধ্যার সময় আবার যখন আমার ডাক পড়লো তখন একট ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হল এবার আমার মাইর খাওয়ার সময় এসেছে । নিজেকে খানিকটা প্রস্তুত করেই নিলাম । কিন্তু রুনুকেও রুমের ভেতরে দেখে খানিকটা অবাক হলাম । আমাকে রাজিম ভাইয়ের অফিসে নয় বরং রুনুদের বাসায় আনা হয়েছে । আমি সোজা হয়ে বসে রইলাম । রুনুও বসে রইলো চুপ করে । রাজিম ভাই বলল
-যা হয়েছে হয়েছে । ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখলাম । অনেক ভেবে দেখেছি ..... তুই ছেলে হিসাবে খারাপও না । ভাল জায়গায় পড়াশুনা করিস ! সব দিক দিয়ে ফিট ....
কি হয়েছে ঠিক বুঝলাম না । কি বলবো ঠিক বুঝতেও পারলাম না । কিছু বলা উচিৎ হবে না ভেবে চুপ করেই রইলাম ।
রাজিম ভাই বলল
-আমি বড় ভাই হয়ে ব্যাপারটার অনুমুতি দিচ্ছি তবে খারাপ কিছু যেন কোন দিন না শুনি !
-কিসের.......
বলতে গিয়ে থেমে গেলাম । রুনু আমাকে থামতে বলল চোখের ইশারায় !
রাজিম ভাই এর পর আরও কতকথা বলতে লাগলো । এখনকার ছেলে মেয়েরা কেমন । কি করে না করে । আমাদের কি করা উচিৎ নয় কিংবা কি করা উচিৎ তবে উনি বেশ খুশি হয়ে আমি এমন কিছু করি নি ।
তারপর আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেই উনি চলে গেলেন । আমি রুনুর দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি হল এসব ?
-কি হবে । আরেকটু হলেই নৌকা ডুবতে বসেছিল । তবে এখন ঠিক আছে !
-মানে কি । কিভাবে হল ? আমি ভেবেছিলাম আমার আজকে খবর আছে ।
-খবরই ছিল যদি আমি কিছু উল্টা পাল্টা বলতাম ।
পরিশিষ্টঃ
আমারকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার বলার পরে আমি যখন রুনুকে সব বললাম তখন রুনু ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি বলবে । দুপুরে রাজিম ভাই যখন খেতে যায় তখন রুনুকে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওর সাথে কখনও কোন খারাপ ব্যবহার করেছি কি না কিংবা কিছু বলেছি কি না ! তারপর রুনুকে অবাক করে দিয়ে জানতে চায় আমাকে তার কেমন লাগে !
রুনু একটু ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলে যে আমাকে ওর বেশ ভাল লাগে তবে রাজিম ভাইয়ের জন্য যে কিছু বলে নি কোন দিন । সেও তার ভাইয়ের মান সম্মান নিয়ে ভাবে খুব !
ব্যাস এতেই পটে যায় । আমরা দুজনই আমাদের পছন্দের থেকে রাজিম ভাইকে বেশি মূল্যায়ন করেছি সে খুবই খুশি হয়ে ওঠে এবং কথা বলার অনুমুতি দেয় আরও ভাল করে বললে প্রেম করার অনুমুতি দেয় ! তবে অনেক শর্তও জুড়ে দেয় ।
তারপর ?
আমরা দুজন সেই শর্ত গুলো মেনেছি কি না কিংবা আমাদের আসল সত্য রাজিম ভাই কোন দিন জানতে পেরেছে কিনা, সেটা অন্য কোন গল্প ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩১