-আমি সাহায্য করবো ?
মেয়েটি একটু যেন চমকে উঠলো । একবার আমার দিকে তাকালো । তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিচে আবার নিচে পড়ে থাকা ব্যাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! আমি আবার বলে উঠলাম
-কখন থেকে দেখছি বারবার ব্যাগ গুলো পড়ে যাচ্ছি । আমি সাহায্য করি ?
মেয়েটি একটু হাসলো । তবে হাসিটা জোর করে ফোটানো । আমার কেন জানি মনে হল আজকে মেয়েটার অসম্ভব মন খারাপ । আমি আর অনুমুতি তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে গেলাম । তারপর পড়ে থাকা কয়েকটা ব্যাগ তুলে নিলাম আমার হাতে ।
মেয়েটাকে আমি বেশ কিছু সময় ধরেই লক্ষ্য করছি । বসুন্ধরাতে আসলেই আমি এমনটা করি । আসে পাসের মানুষ গুলোকে দেখি । কোন কাজ নিয়ে আমি এখানে আসি না । আসি সময় কাটাতে । আজকে অবশ্য এসেছিলাম মুভি দেখতে কিন্তু সেটা শুরু হতে আরও বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে । তাই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম । দুই হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হাটছে এদিক ওদিক । ব্যাগ গুলো ঠিক মত সামলাতে পারছে না ।
অবশ্য মেয়েটাকে লক্ষ্য করার আরেকটা কারন হচ্ছে মেয়েটা সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে আছে । শুভ্র একটা সৌন্দর্য মেয়েটার সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে । আমার চোখটা তাই মেয়েটার দিকে বার বার ফোরে যাচ্ছিলো ।
আমি ব্যাগ গুলো হাতে নিলেও মেয়েটা কোন বাধা দিলো না । আমার চেহারায় সব সময়ই একটা ভাল ভাল মানুষ ছাপ আছে । মানুস খুব আমাকে প্রথম দেখাতে খারাপ মনে করে না । মেয়েটাও হয়তো তাই করছে । আমি বললাম
-আপনি এখন কোন দিকে যাবেন না ? নিচে নাকি উপরে ?
-উপরে ! ক্ষুধা লেগেছে ।
মেয়েটা এমন কন্ঠে ক্ষুধা লেগেছে কথাটা বলল যেন ক্ষুধা লাগাটা কোন অপরাধ কিংবা এবং সে এখন এই অপরাধ টা করে লজ্জিত । আমি মেয়েটার কথা বলার ধরন দেখেই হেসে ফেললাম । বললাম
-আচ্ছা চলুন । আপনাকে আট তলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি ।
মেয়েটা কোন কথা না বলে আমার সাথে সাথে হাটতে লাগলো । আমি আটতলায় ক্যাপ্রিকর্নে মেয়েটাকে পৌছে দিয়ে যখনই ফেরৎ আসতে যাবো তখনই মেয়েটা বলল
-আপনি কিছু খাবেন ?
-আমার এখন এতো ক্ষুধা লাগে নি । আমি মুভি দেখে তারপর কিছু খাবো ভাবছি ।
-কি মুভি দেখবেন ?
-যেটা চলছে । ক্যাপ্টেন আম্রিকা !
আমার বলার ধরন দেখে মেয়েটা হেসে ফেলল । আবারও সেই বিষণ্ণ হাসি ! নাহ একটা কিছু করতে হবে দেখছি । মেয়েটার বিষণ্ণতার কারনটা শুনতে হবে । তাহলে হয়তো একটু হালকা হতে পারবে । আমি বললাম
-তবে ....
মেয়েটি আচ্ছা বলে নিচের দিকে তাকাতে যাচ্ছিলো আমার তবে শুনে আবার আমার দিকে ফিরে চাইলো । বলল
-তবে ?
-তবে কিছু অবশ্য এখন খাওয়া যায় যদি একটা শর্ত মানেন !
-কি শর্ত !
-এখানে খাওয়ার পরে আমার সাথে মুভি দেখতে হবে !
মেয়েটা সত্যি একটু অবাক হল । প্রথম দর্শনে কোন মেয়েকে এভাবে প্রস্তাব দেওয়াটা কোন ভাবেই যুক্ত দেখায় না কিন্তু মেয়েটা মন কোন কারনে অসম্ভব খারাপ । আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা স্বাভাবিক আচরন করছে না এই কারনে । কোন স্বভাবিক মানুষ এক সাথে এতো শপিংও করতে পারে না । হাতে নেওয়ার সময়ে দেখি সেখানে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যে গুলো মানুষের একটার বেশি দরকারই পরে না । মেয়েটা সেখানে তিন চারটা কিনেছে । আমি নিশ্চিত মেয়েটা এগুলো ব্যবহারও করবে না । একেবারে প্রয়োজন ছাড়া কেনা কাটা । অস্বাভাবিক আচরন !
মেয়েটা বলল
-আচ্ছা । আগে খাওয়া শেষ করি । তারপর দেখা যাবে !
আমি হাসলাম কেবল ।
খেতে বসতে বসতেই প্রথমে আমি নিজের নাম বললাম । মেয়েটা নিজের নাম বলল মীরা চৌধুরী । তারপর টুকটাক কথা বলতে লাগলো । তবে খুব আস্তে আস্তে । সম্ভব মেয়েটা এমন ভাবেই কথা বলে । মেয়েটার কথা বলার ধরন দেখে আমার মনে আগের ধারনাটা আরও দৃঢ় ভাবে আসন গেড়ে বসলো যে মেয়েটার মন আজকে সত্যিই খারাপ কোন কারনে । আমি কেবল এই কারনেই মেয়েটাকে মুভি দেখার প্রস্তাবটা দিলাম । যদি মেয়েটার কিছুটা ভাল লাগে ।
খাওয়া শুরু করতেই আমি মেয়েটাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই বললাম
-আপনার আজকে মন খারাপ কেন ?
মীরা চামচ মুখে নিতে গিয়ে থেমে গেল । তাকিয়ে রইলো আমার দিকে কিছুটা সময় । মেয়েটা আসলেই বেশ খানিকটা অবাক হয়েছে আমার কথা শুনে ।আমি বললাম
-আজকে কোন কারনে আপনার মন খারাপ । এই মন খারাপ ভাব টা কাটানোর জন্যই মনে হয় এতো এতো শপিং করেছেন তাই ?
মীরা আবারও কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রাইসের চামচ টা মুখে দিলো । একটু চিবিয়ে তারপর গিয়ে ফেলল । তারপর বলল
-হুম ! মন খারাপ থাকলে আমি শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি করি খুব ।
-মন খারাপের কারন টা কি আমাকে বলা যায় ?
-যায় !
আবারও কিছুটা সময় চুপ করে থেকে মীরা বলল
-আজকে আম্মুকে খুব বেশি করে মনে পড়ছিলো । কেন জানি না খুব বেশি ।
-উনি .....
-মারা গেছে !
-সরি, আসলে আমি জানতাম না !
-নাহ ঠিক আছে । সরি বলার কিছু নেই । মাঝে মাঝে আম্মুকে খুব মিস করি ! খুব বেশি ! আর কেউ নেই আমার !
আর কেউ নেই তো এই কথাটা এমন ভাবে বলল আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগলো । আমি তাকিয়ে দেখি মীরার চোখে পানি চলে এসেছে । চোখের জল বিষণ্ণতা দুর করনে খুব কার্যকরী । এটা যত বের হবে তত মানুষের মন হালকা হবে ! অবশ্য কিছু সময় পরেই মীরা সমনে নিল ।
মীরা ওর মায়ের ব্যাপারে আরও অনেক কথা আমাকে বলল । আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম । মীরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো যে আমাকে বলতে পেরে মীরা ভাল লাগছে । আসলে কষ্টের কথা গুলো অন্যের সাথে শেয়ার করে নিলে মন খারাপের ব্যাপারটা কমে আসে । ঠিক তেমনি মীরাও যেন একটু হালকা হয়ে নিচ্ছিলো নিজের কাছে ।
খাওয়া শেষে দুজন মিলে মার্কিন অধিনায়ক দেখলাম । একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে মুভি দেখাটা খারাপ লাগলো না । বরং বেশ ভাল লাগলো । মুভি শেষ করে মীরার সাথে সাথে হাটতে হাটতে পার্কিং লরের সামনে এলাম । মীরা ওর ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলল । এবার মীরা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল
-আপনার মন কেন খারাপ শুনি ?
-মানে ? আমার মন খারাপ আপনাকে কে বলল ?
-দেখুন একজন বিষণ্ণ মানুষ অন্য একটা বিষণ্ণ মানুষের চোখ খুব ভাল করেই চিনতে পারে । আপনি যেমন আমার কষ্ট টা বুঝতে পেরেছে তেমনি আপনারও যে কোন কারনে মন খারাপ সেটাও আমি আপনার চোখ দেখেই বুঝেছি । কেন জানি মনে হয়েছে আপনার সাথে বললে কষ্ট খানিকটা কমবে । আপনার বেলাতেও সেটা সত্যি ।
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । ততক্ষনে গাড়ি চলে এসেচে । মীরা আমাকে প্রায় জোর করেই গাড়িতে তুলে নিলো । তারপর আমার বাসার ঠিকানা জানতে চেয়ে সেদিকে গাড়ি ছোটাতে বলল ।
মীরা বলল
-না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না ।
আমি কিছুটা সময় মীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম
-আসলে গত সোমবার সুপ্তির বিয়ে গেছে ।
-আপনার প্রেমিকা ?
-হুম !
-এই কথাটা আমি কাউকে বলতে পারছি না, ভেতরে যে কি হচ্ছে সেটা কাউকে বলতেো পারছি না । আমি ....।
আমি অনুভব করলাম আমার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়ে । সুপ্তির বিয়ে হওয়ার পর এই প্রথম আমি কাঁদতে শুরু করলাম । কেন জানি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না । মীরার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটার চোখেও পানি চিকচিক করছে । আমার জন্য মেয়েটা কোন করুনা নয় বরং স হানুভুতি অনুভব করছে । এটা যেন আমার কান্না কে আরও একটু বেশি বাড়িয়ে দিল ।
আমি জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম !
রাস্তা এই সময়ে বেশ ফাঁকাই বলা চলে । মীরার গাড়িটা বেশ দ্রুতই চলছিলো মোহাম্মাদপুরের দিকে । মীরা অনেক টা সময় পরে বলল
-এখন ভাল লাগছে ?
-হুম ।
আসলেই আমার একটু হালকা লাগছিলো , অন্তত একটা মানুষের সামনে নিজের কস্ট টাকে বের করে দিয়ে আসলেই একটু হালকা লাগছিলো । আমি বললাম
-থ্যাঙ্কিউ ! আজকে এই কষ্ট টা বের না হলে হয়তো আর কোন দিন বের হত না ।
-আমার বেলাতেও তাই । কাউকে না বললে হয়তো কষ্ট টা ভেতরই রয়ে যেত । তোমাকেও ধন্যবাদ !
গাড়িটা একেবারে আমার বাসার সামনে এসে থামলো । আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা যখন চলে যাচ্ছিলো আমার মনের ভেতরে তখন একটা মিশ্র অনুভুতি হল । মেয়েটার সাথে হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না তবে মেয়েটা আজকে আসলেই বড় উপকার করলো আমার । আজকে রাতে আমি হয়তো একটু ঘুমাতে পারবো !
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:১০