অনেক সময় ধরে দরজায় শব্দ হচ্ছে । কেউ একজন এসে দাড়িয়েছে দরজায় ।
বিছানায় শুয়ে শুয়েই ভাবার চেষ্টা করলাম যে আসতে পারে ! আমার কাছে এখানে কারো আসার কথা না । আর আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের ভাল করেই বলে দিয়েছি যেন খুব দরকার ছাড়া কেউ আমার বাসায় না আসে । আর ওরা কেউ আসলে তো আমাকে ফোন করে আসবে ।
তার মানে একজনই এসেছে !
বাড়িওয়ালা !
এই লোকের জ্বালায় আমার শান্তি নাই । একটা রুমের একটা ঘর তো ভাড়া দেন নাই যেন কোটি টাকার তাজ মহল ভাড়া দিয়েছে । সপ্তাহে সপ্তাহে এসে এতো দেখা শুনার কি আছে !
মনে হল দাড় করিয়ে রাখি আরও কিছু সময় বেটা কে কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল না থাক । দরকার নেই । জ্বর শরীর নিয়ে উঠে দাড়ালাম !
দরজা খুলতেই দেখি নিশি সামনে দাড়িয়ে । হাতে ইয়া বড় একটা ব্যাগ । আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । এই মেয়ে আমাকে আসলেই ডোবাবে ! আসার আগে আমাকে একবার ফোন করেও আসে নাই ।
কেন ফোন করে আসে নাই খুব ভাল করেই জানি । ও নিশ্চিত জানতো যে আমাকে যদি ও ফোন করতো তাহলে আমি ওকে প্রবল ভাবে মানা করতাম । নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ঢুকতে দিবি না ?
-না । তুই ফিরে যা । যদি বাড়িওয়ালা তোকে এখানে দেখে তাহলে আমার অবস্থা কি হবে ভেবেছিস ?
-যা হবার হবে ।
-নিশি ! পাগলামো করবি না ! আমার এই বাসাটা খুব পছন্দের । আমি এটা ছাড়তে চাই না !
আসলে আমারই ভুল হয়েছে । কাল থেকে যে আমার শরীরে জ্বর এটা ওকে বলাই ঠিক হয় নি । মেয়েটা সব সময়ই এমন করে । কিন্তু সব কিছুর একটা লিমিট থাকা দরকার । এভাবে একজন ব্যচেলরের বাসায় চলে আসা যায় নাকি, যেখানে সেই ব্যচেলরের বাড়িওয়ালা পরিস্কার ভাবেই বলে দিয়েছে যে কোন মেয়ে যেন না আসে ঘরে । এখন যদি কোন ভাবে বাড়িওয়ালা চলে আসে তাহলে কালকেই আমাকে এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে । এতো চমৎকার একটা বাসা আমি কোন ভাবেই ছেড়ে দিতে চাই না ।
আমি নিশির দিকে তাকিয়ে বললাম
-দেখ বাড়িওয়ালা চলে আসতে পারে । তুই আমাকে এভাবে ডোবাস না !
নিশি কোন কথা বলল না । কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বলল
-তোর জন্য রান্না করে এনেছিলাম ।
-কে বলেছে ? আমি তো না খেয়ে নেই ।
-আমি জানি আপনি কি রান্না করেছেন ! এখন সরেন । আমি কেবল খাইয়েই চলে যাবো । কথা দিচ্ছি । বাড়িওয়ালা জানতেও পারবে না !
এই কথার উপর আর কোন কথা চলে না । আসলে ওকে দোষই বা দেই কিভাবে । আসলে মেয়েটা সব সময় আমার এভাবে কেয়ার নিয়ে এসেছে । আমার সময় যে ওর সাথে চমৎকার কাটে সেটাও বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না । কিন্তু ওকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া টা আমার কাছে খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল না !
নিশিকে ঘরে ঢুকালাম । মোহাম্মাদপুরের কাটাসুরের দুই নাম্বার রোডের ৬ নাম্বার বাসায় ছাদে আমি বেশ কিছুদিন হল আছি এবং বেশ ভাল ভাবেই আছি । একটা রুম আমার জন্য সাথে কিচেন আর বাধরুম । একজন ব্যাচেলরের জন্য একেবারে উপযোগী । তাই আমি বাড়িওয়ালার নির্দেশ কাটায় কাটায় মানার চেষ্টা করি যাতে আমাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে না হয় ।
নিশি এসে যে খারাপ লাগছে সেটা আমি কোন ভাবেই বলবো না । বরং এই শরীর খারাপের ভেতরে আমার ভালই লাগছে । কিন্তু বাড়িওয়ালা চলে আসতে পারে এই ভয়টা গেল না । এই চিন্তা নিয়েই আমি আবার গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম । নিশি যখন চলে এসেছে তখন আমাকে আর কোন চিন্তা করতে হবে না । কাল রাতে খুব ভাল কিছু খাওয়া হয় নি । সকালের নাস্তায় কয়েক পিচ পাউরুটি খেয়েছি কেবল । দুপুরে কি খাবো সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম তবে এখন আর সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না ।
ঘন্টা খানের মধ্যে দেখলাম ঘরের চেহারা একদম পাল্টে ফেলল । ব্যাগের ভেতর থেকে একটা নতুন বিছানার চাদরও বের করে আনলো । আমাকে তুলে দিয়ে সেটা বিছানার বিছিয়ে দিল । আমি মনে মনে না হেসে পারলাম না । এই মেয়েটার সব দিকেই কেমন খেয়াল আছে । তারপর নিজেই চলে গেল রান্না ঘরে । খাবার গরম করতে ।
খাবার গরম করে যখনই না খাবার টেবিলে দিবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো । সেই সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো । তাকিয়ে দেখি নিশির মুখটাও কেমন হয়ে গেছে । একবার মনে করালম নিশিকে বাথরুমে লুকিয়ে রেখে তারপর দরজাটা খুলি কিন্তু তারপরেই মনে হল নিশি নিজের স্যান্ডেলটা বাইরেই রেখে এসেছে । বুঝতে কষ্ট হল না আসলে কি হতে যাচ্ছে ।
একদম নিশ্চিত বাড়িওয়ালা এসেছে ।
আমার এখানে থাকা আর হয়েছে !
আমি দরজা খুলতে যাবো কি আমাকে অবাক করে দিয়ে নিশি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল । নিজেই দরজা খুলে দিল । জোর প্রার্থনা করছিলাম যেন বাড়িওয়ালা না হয় কিন্তু আমার প্রার্থনা কাজে লাগলো না । তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালাই দাড়িয়ে আছে । নিশির দিকে একবার আমার দিকে তাকালো পালা করে ।
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । বাড়িওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কাজটা তুমি কি ভাল করলে ? তোমাকে আমি বলেছিলাম .....
কথা শেষ করার আগেই নিশি বলল
-আসলে আঙ্কেল ও আমাকে এখানে আসতে দিতে চায় নি । কিন্তু ওর শরীর খারাপ । কাল থেকে কিছুই খায় নি ।
নিশির কথা শুনে বাড়িওয়ালার মন গললো বলে আমার মনে হল না । দেখলাম বাড়িওয়ালার মুখের ভাব বিন্দু মাত্র কমলো না । নিশি বলল
-আর আঙ্কেল এখানে দোষের কি দেখলেন ?
-কোন দোষ নেই ? ব্যচেলরের বাসায় মেয়ে আসবে সেটাতে কো দোষ নেই ?
-আঙ্কেল আপনি মনে হয় জানেন না আমরা গতমাসে বিয়ে করেছি ।
কি !!
কথাটাতে বাড়িওয়ালা যতটা না অবাক হল তার থেকে বেশি অবাক হলাম আমি নিজে । এই মেয়ে বলছে কি ! আমি কখন ওকে বিয়ে করলাম । কিন্তু নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি ও কি রকম শান্ত আর দৃঢ় চোখে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছে । দেখে মনে হচ্ছে ও একটু আগে যা বলেছে সেটা আসলেই সত্যি ।
আমি একটু জোরে কেসে উঠলাম । নিশি বলল
-আসলে ও ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাচ্ছে । বোঝেনই তো এখনও আমরা ছাত্র । আর ও ওর বাবাকে বেশ ভয় পায় ।
তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালা মুখের ভাব একটু পরিবর্তন হচ্ছে । নিশির দিকে তাকিয়ে বলল
-সত্যিই তোমরা বিয়ে করেছো ?
-কাবিন মানা দেখতে চান ? যদি বলেন তাহলে ও সুস্থ হলেই মগবাজার কাজী অফিস থেকে সেটা তুলে নিয়ে আসতে পারবে ।
বাড়িওয়ালা আরও একবার আমার দিকে আর একবার নিশির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো আমরা সত্যি বলছি কি না । তারপর নিশির দিকে তাকিয়ে বলল
-ওর শরীর কেমন এখন ?
নিশির মুখে হাসি ফুটতে দেখালম । নিশি বলল
-এখন একটু ভাল । তবে কিছু খেতে চাচ্ছে না । এখন বলেন না খেলে কিভাবে হবে । আপনাকে ও খুব সম্মান করে ওকে একটু খেতে বলেন !
নিশির কথাটা শুনে যেন বাড়িওয়ালার একটু খুশি হলেন । তারপর বললেন
-আচ্ছা আমি যাচ্ছি । তুমি তাহলে ওর দেখাশুনা কর ।
আমার তখনও আসলে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না নিশি কিভাবে এতো সহজে, এতো চমৎকার একটা মিথ্যা কথা বলে ফেলল । আর বাড়িওয়ালা সেটা বিশ্বাসও করে নিল । বাড়িওয়ালা ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা আজকে রাতে তোমরা আমাদের বাসায় খাবে । ঠিক আছে ?
আমি কিছু বলার আগে নিশি আবার বলল
-আচ্ছা আঙ্কেল !
দরজা বন্ধ করতেই নিশি আমার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এল । আমি ওকে বললাম
-এটা কিছু ছিল ? তুই ....
-চুপ । এখন খেতে বস । আমি এখন থেকে তোর বাসায় যে কোন সময় আসতে পারবো । সেই লাইসেন্স পেয়ে গেলাম । যদিও মিথ্যা কথা, তবুও ঝামেলা টা যে দুর হয়েছে ।
আমার কেন জানি ব্যাপারটা ভাল লাগলো না । মিথ্যা বলার ফল কোন কালেই ভাল হয় না । আমার মনে বড় রকমের কু ডাকতে লাগলো । কেন জানি মনে হচ্ছে এই বিপদ থেকে বেঁচে গেলেও সামনে আমি আরও বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি ।
সারাটা দিন নিশির সাথে সময়টা বেশ ভাল কাটলো । সন্ধ্যায় নিশি যখন বলল ও হোস্টেলে যেতে চায় তখন ওকে মনে করিয়ে দিলাম যে বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ওকে রাতে খেয়ে যেতে বলেছে । নিশিকে একটু চিন্তিত মনে হলেও পরে রাজি হয়ে গেল । সন্ধ্যার দিকে আমার শরীরটা অনেকটাই ভাল হয়ে গেছে । আমি ওকে নিয়ে ছাদের হাটা হাটি করতে লাগলাম । সময়টা সত্যিই ভাল কাটলো । নিশি পাশে থাকলে সব সময়ই ভাল লাগে ।
রাত হতেই ওকে নিয়ে হাজির হলাম বাড়িওয়ালার বাসায় । কলিংবেল টিপে দরজায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি । নিশি আমার পাশেই দাড়িয়ে । ওকে দেখে খুব একটা চিন্তিত মনে হচ্ছে না । আমার যদিও একটু চিন্তা লাগছিলো । কারন যতই হোক একটা মিথ্যা বলেছি আমরা । তাও আবার বড় রকমের মিথ্যা । আর আমি খুব ভাল করেই জানি মিথ্যার ফল কোন দিন ভাল হয় না ।
দরজা খুলে গেল । আমি নিশির হাত ধরে ছিলাম । ভাগ্য ভাল যে নিশির হাত ধরে ছিলাম নয়তো দরজায় যে দাড়িয়ে ছিলো সেটা দেখে আমি নির্ঘাত মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম !
বাবা দাড়িয়ে !
আমার নিজের বাবা !
বাবা এখানে কি !
এখানে কি চায় !
কিভাবে এল ?
বাবা আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে । আমার মাথা ঘুরতে লাগলো । নিশির হাত ধরা না থাকলে আমি হয়তো পড়েই যেতাম । অনুভব করলাম আমার জ্বর আবারও বাড়তে শুরু করেছে ।
আমার মনে হল বাবা হয়তো এবার আমাকে মেরেই ফেলবেন । বাবার একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে । সেটা সাথে করে নিয়ে এসেছে কি না কে জানে ! আমি নিজের পায়ে জোর পাচ্ছিলাম না । আমি আগেই জানতাম মিথ্যার ফল কোন দিন ভাল হয় না ! আজকের মিথ্যার ফলটাও ভাল হবে না । আমি খুব শীঘ্রই মারা যাচ্ছি ।
দুই
দুইদিন পরে ।
আমি আমাকে আমাদের বাসায় আনা হয়েছে । এবং আশ্চর্য্যের ব্যাপার নিশিও আমার সাথেই আছে । এখানে আসার পর আমার উপর মোটামুটি একটা ঝড় বয়ে গেছে । বাবা কেবল আমাকে হাতে ধরে মারেন নাই । একবার মনে হল বলেই দেই বাবা আমরা বিয়ে করি নি । তখন অবশ্য ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যেত । বাবা এখন জানে আমি নিশিকে বিয়ে করেছি ও আমার ঘরে আসতেই পারে । এখন যদি আমি বলি আমরা বিয়ে করি নি তাহলে নিশির আমার ঘরে আসাটা অবৈধ হয়ে যাবে । তখন আমার অবস্থা আরও খারাপ হবে ।
বাড়িওয়ালার কাছে আমার বাবার নাম্বার ছিল । বদ বেটা আমার বিয়ে খবর বিন্দু মাত্র দেরি না করে বাবার কাছে বলে দিয়েছে । তারপর বাবাও দেরি না সোজা ঢাকা পথে রওনা দিয়েছে । আমাকে ফোন করে নি কারন ফোন করলে আমি পালিয়ে যেতে হয়তো ।
আমি ভয়ে ভয়ে আছি কিন্তু নিশিকে সেই তুলায় দেখলাম বেশ শান্ত । একটু আগে নিশির বাবা মা আমাদের বাসায় এসেছে । মুরব্বিরা মিলে কথা বলছে । নিশি যে আমার পাশে বসে রয়েছে তা নয় । একবার ড্রয়িং রুমে গয়ে দেখি নিশি সবাইকে চা সার্ভ করছে । এমন একটা ভাব যেন ও আসলেই এই বাড়ির সত্যি সত্যি বউ । আমি ওকে ডাক দিয়েছিলাম অনেক সময় আগে । কিন্তু ও আমার কথায় কর্ণ-পাত না করে সবাকে চা পানি দিয়ে বেড়াচ্ছে ।
নিশি আরও আধা ঘন্টা পরে আমার রুমে আসলো । হাতে চায়ের কাপ । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই নাও । চা !
আমার মনে হল আমি খানিকটা ভুল শুনছি । নিশি আমাকে তুমি করে বলছে । আমি বললাম
-তুই কি আমাকে তুমি করে বলছিস ?
-হ্যা ! এখন থেকে তুমি ! আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে না ?
-মানে ?
-মানে হল আমার বাবা মা আর তোমার বাবা ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছে । আমাকে বলল যে আমাদের যে আগে বিয়ে হয়েছিলো এটা যেন আমরা ভুলে যাই । আজকে রাতে আবার আমাদের বিয়ে হবে ।
-তোর মনে হয় খুব আনন্দ লাগছে !
নিশি কেবল হাসলো ।
এক সময়ে হয়তো আমি ওকে ঠিকই বিয়ে করতাম । নিশিই আমাকেই বিয়ে করতো সেটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম কিন্তু ব্যাপার টা এমন ভাবে হবে সেটা তো আমি কোন দিন ভাবি নি ! নিশি আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলো । তারপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ।
আমি কি করবো খুজে পেলাম না । সত্যি সত্যিই একটা ছোট্ট মিথ্যা থেকে আমি এতো বড় ঝামেলাতে পড়ে যাবো ভাবতেই পারি নি ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৩৮