ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথে সবার চোখ আমার দিকে ঘুরে গেল । আগেই ধরনা ছিল এমন হবে । গত রাতে তাইফা যা করেছে তাতে এরকম হবে আমি আগে থেকেই জানতাম । কেউ কেউ দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মিচমিচ করে হাসছে ।
আমি চোখ বুলালাম পুরো ক্লাসে । পাশ থেকে সিমি বলল
-হিরো তোমার নায়িকা এখনও আসে নাই ।
এই কথাটা যেন খুব একটা মজার কথা । দেখলাম পুরো ক্লাস হেসে উঠলো এক সাথে । আমি আরেকবার চোখ বুলালাম । তাইফা না আসলেও সুচি ঠিকই এসেছে । আমার সাথে চোখাচোখি হতেই দেখলাম ও আমার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো । আমি আর দ্বিতীয়বার তাকালাম না ওর দিকে । কাল পর্যন্তও এই মেয়ে আমার দিকে কত চমৎকার চোখে তাকাতো আর আজকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে ! বদের হাড্ডি একটা !
যাক তাকাক ।
আমার কি এমন দরকার !
আমি আমার সিটের দিকে এগিয়ে গেলাম । আজকে কেমন জানি লাগছে নিজের কাছে । অবশ্য আমার কাছে সব সময়ই এখানে ক্লাস করতে আসাটা একটা অস্বস্তিকর বিষয় । আর হবেই বা না কেন ! পুরো ক্লাস ভর্তি মেয়ে । ৫১ জন স্টুডেন্টের মধ্যে আমরা ছেলে মাত্র ৪ জন । আর বাকি ৪৭ জন মেয়ে । ক্লাস করতে আসলে মনে হয় আমি কোন গার্ল-কলেজে ক্লাস করতে এসেছি ।
অন্যান্য ক্যাম্পাসে তো আমরা ইভ-টিজিংয়ের কথা শুনি কিন্তু এখানে আমরা ছেলেরা প্রতি নিয়ত এডাম টিজিংয়ের শিকার হই । আমাদের পুরো মেডিক্যাল কলেজে মেয়েদের আধিক্য । প্রত্যেক ক্লাসেই মেয়ের সংখ্যা বেশি । কিন্তু আমাদের ক্লাসে সেটা একেবারে বাড়া-বাড়ি টাইপের বেশি ।
সুতরাং আমরা ছেলেরা এখানে সংখ্যায় কম । আমাদেরকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় কিন্তু বলার কিছু নাই । আমি নিজের সিটে বসতে বসতেই দরজার দিকে চোখ গেল । তাকিয়ে দেখি তাইফা প্রবেশ করছে ।
মেয়েটা আজকে আসবে ভাবতে পারে নি । কালে ওকে যেভাবে সবাই পঁচানি দিয়েছে । তাতে আজকে এখানে আসার কথা না । মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে ! অবশ্য এই মেয়ে বরাবরই সাহসী !
তাইফা আজকে সাদা রংয়ের লং কামিজ পরেছে সেই সাথে সাদা লেগিংস, আমার পছন্দের ! যেদিন থেকে মেয়েটা জানতে পেরেছে মেয়েদের এই পোষাকটা আমি পছন্দ করি সেদিন থেকে প্রায়ই ও এই ধরনের পোষাক পরে আসে । আমি নিশ্চিত ওর হাতেো আজকে নতুন মেহেদী দেওয়া থাকবে । থাকতেই হবে !
মেয়েটার চোখটা একটু যেন ফোলা ফোলা মনে হল ।
হুম ! কান্না কাটি করেছে !
আসলে গতকালকে সবাই মিলে ওকে বেশ ভাল করেই পঁচিয়েছে গ্রুপে ।
তা ছাগলের মত কাজ করলে মানুষ পঁচাবে না ?
ভাল কথা ভিডিও আপলোড করেছো তা নিজের ওয়ালে করলে কি এমন ক্ষতি হত ?
কিন্তু মহা রানী বাহাদুরি করে আপলোড দিয়েছে আমাদের ক্যাম্পাসের গ্রুপে ।
তাইফা আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো । সেই হিসাবে সুচিও আমাকে পছন্দ করতো । ভাবছেন আমি এমন কি হয়ে গেলাম যে মেয়েরা কেবল আমাকে পছন্দ করবে !
কারন তো আছেই । আমাদের এই মেডিক্যাল কলেজে মেয়েদের সংখ্যায় অনেক বেশি । আগেই বলেছি আমাদের ক্লাসে আমরা ছেলেরা মাত্র চার জন । এমনটা পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই ।
প্রথম প্রথম ঠিক থাকলেও আস্তে আস্তে যত দিন যেতে লাগলো লক্ষ্য করতে লাগলাম মেয়েগুলো আমার প্রতি আগ্রহী উঠতেছে । এর মধ্যে সজিবের আগে থেকেই গার্লফ্রেন্ড ছিল । আমরা তিনজন কেবল ফাঁকা ছিলাম । এক পর্যায়ে দেখলাম বাকি দুইজনেরও ক্লাসের দুজনের সাথে সম্পর্ক হয়ে গেছে । এর ফলে একটা লাভ ওদের হয়েছে । ওদের আর অন্যান্য মেয়েরা ঠিক নাড়া নাড়ি করতো না । কিন্তু আমার জীবনে সমস্যাটা প্রবল আকার ধারন করলো । বাকি গুলো আমাকে বেশ ভাল করেই নাড়তে শুরু করলো, খোঁচা মারতে শুরু করলো । একটা ছেলে যে এতো টিজিংয়ের শিকার হতে পারে তা আমি জানতেই পারতাম না । একা একা সহ্য করা ছাড়া উপায়ও ছিল না । স্যারদের কাছে নালিশ করাটাও একটা মান ইজ্জতের ব্যাপার ।
কিন্তু কিছু দিন পরেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে টিজিংয়ের মাত্রাটা একটু কমে এসেছে । ভাবলাম হয়তো আমার প্রতি ওদের আগ্রহ কমে এসেছে । কিন্তু তুহিনের কাছে শুনতে পেলাম যে তাইফা নামের একটা মেয়ে নাকি আমার প্রেমে পড়েছে । তাইফা হচ্ছে তুহিনের গার্লফ্রেন্ডের বান্ধবী । ঐ মেয়েই নাকি সবাইকে মানা করছে আমাকে না নাড়ার জন্য । ঠিক যেমন টা অন্যান্য গার্লফ্রেন্ড গুলো তাদের বয়ফ্রেন্ডের দের রক্ষা করে চলে অন্য মেয়েদের হাত থেকে । আর ক্লাসের একজন যখন জানতে পারে ছেলেটার সাথে ওমুক মেয়ের সম্পর্ক আছে তখন সে নিজেও কম আগ্রহ বোধ করে সেই ছেলেটার উপর । তাইফার সাথে যদিও তখনও আমার কিছু হয় নি, আসলে আমি তখনও তাইফাকে ঠিক মত চিনিও না, তবুও লক্ষ্য করলাম টিজিংটা একটু কমে এসেছে । একটু শান্তি লাগছিলো অবশ্য মনে মনে ।
তুহিনের সাহায্যেই তাইফাকে চিনলাম ।
আমার সাথে যে কয়টা মেয়ের পরিচয় ছিল, কথা হত টুকটাক, তাদের ভেতরে সুচি নামের একটা ছিল । মেয়েটার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হত মেয়েটা আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করে । অবশ্য আমার ওরকম অনুভুতি ছিল না । আমাকে মাঝে মাঝে ঐদিকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেও আমি সেটা না বোঝার ভান করেই থাকতাম ! আমি ঝামেলায় জড়াতে চাইতাম না । কি দরকার মামা এসব ঝামেলাতে নিজেকে জড়ানো । সুচিও খুব একটা সাহস দেখাতো না ।
অন্য দিকে তাইফা বেশ সাহসী ছিল । একদিন ক্যাম্পাসের বারান্দায় বসে আছি । এমন সময় তাইফা আমার পাশে এসে বসলো । আমি দেখেও না দেখার ভান করে রইলাম । একটা বই পড়ছিলাম সেটা পড়তে লাগলাম । হঠাৎই তাইফা মৃদ্যু স্বরে বলল
-মেয়েরা আইসক্রিম পছন্দ করে । আর ....
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কি বলা উচিৎ । মেয়েরা আইসক্রিম পছন্দ করে এটা সবাই জানে । আইসক্রিম আর চকলেট । কিন্তু এই কথা মেয়েটা আমাকে কেন বলছে ? আমি বললাম
-আর ?
-যারা আইসক্রিম খাওয়ায় তাদের কেউ পছন্দ করে !
আমি কিছুটা সময় বোকার মত চেয়েই রইলাম তাইফার দিকে । মেয়েটা আসলে কি চাচ্ছে সেটা আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি আর মেয়েটার কথা বার্তা শুনে অবাক হচ্ছি । মেয়েটার এই মেয়ের সমস্যা কি । বললাম
-আচ্ছা ভাল ।
তাইফা আমার দিকে আরও কিছুটা সময় চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল
-তুমি যে একটা গাধা মার্কা ছেলে এটা কি তুমি জানো ?
-কেন ? এই কথা কেন বলছো ?
-শুনতে হবে না ।
তাইফার রাগ দেখে মনে মনে মনে হাসালাম । এর আগেও তাইফা আমার কাছে বেশ কয়েকবার এরকম বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করেছে । আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে থেকে । ও মনে হয় বুঝতেই পানি নি আমি আসলে এই সব কিছু বুঝেছি কি না । কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে রয়েছি । আমি ক্লাসে এমন করেই থাকি । কিছুই যেন বুঝি না এমন একটা ভাব !
মেয়েরা আসলেই নিজেদেরকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে । বিভিন্ন সময় ছেলেদেরদের বিভিন্ন ইশারা ইঙ্গিত দেয় । যারা সেই ইঙ্গিত ধরতে পারে তারা হচ্ছে মেয়েদের চোখে বুদ্ধিমান । আর যারা ধরতে পারে না তারা গাধা ।
আর যারা বুঝেও না বোঝার ভান করে তারা ?
আমি জানি তাইফা আমাকে গাধাই মনে করছে । করুক । সরল সোজা হয়ে থাকার ভেতরে একটা সুবিধা আছে । মানুষ মনে করে তারা আসলে গাধা টাইপের মানুষ । কিন্তু এই সরল টাইপের ভেতরে তাদের আসল দিকটা কারো চোখে পড়ে না ।
তাইফা বলল
-আমার জন্য একটা আইসক্রিম নিয়ে এসো তো !
-তুমি যাও । তোমারও পা রয়েছে । হেটে হেটে যাও !
-যাবা না তুমি ?
-নাহ ! আমি কেন যাবো ? আইসক্রিম পছন্দ কর তুমি, খাবা তুমি আর যাবো আমি ?
তাইফা নিজেকে যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রন করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি জানো আমি ডাকলে এই মাঠের প্রত্যেকটা ছেলে আমার জন্য আইসক্রিম আনতে দৌড়াবে !
আমি আর দেরী না করে চিৎকার করে তুহিনকে ডাক দিলাম । তুহিন এগিয়ে এল । আমি তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললাম
-এই তাইফার আইসক্রিম পছন্দ । ওর জন্য একটা আইসক্রিম নিয়ে আয় তো !
তাকিয়ে দেখি তাইফা রাগে লাল হয়ে গেছে । তুহিনও বুঝতে পারছে না । আমি আর সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে মাঠে নেমে পড়লাম । মনে হল এই কটা দিন মেয়েটা একটু শান্ত থাকবে ! কিন্তু আমার ধারনাও ছিল না মেয়েটা রাতের বেলা কি করতে যাচ্ছে ।
রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম । এমন সময় তুহিন ফোন করে বলল যে আমার ক্যাম্পাসের গ্রুপে ঢুকতে । আমি কারন জানতে চাইলেও তুহিন কিছু বলল না । কেবল বলল আমি যেন গ্রুপে ঢুকে দেখি । আমি বই রেখে ভেতরে ঢুকে ধাক্কার মত খেলাম ।
তাইফা একটা ৪২ সেকেন্ডের ভিডিও আপলোড করেছে সেখানে । যেখানে ও সবার সামনে আমাকে প্রোপোজ করেছে । সেটাও একটা কথা ছিল কিন্তু পুরো ক্যাম্পাসের ছেলে মেয়েরা সেখানে তাইফাকে সেই পঁচানী দেওয়া শুরু করেছে । সাথে সাথে আমাকেও খানিকটা !
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কোন কিছু না ভেবে চুপচাপ কিছু সময় দেখে আইডি বন্ধ করে আবার বই পড়ায় মন দিলাম । যা হয় হোউক । আমার দেখার দরকার নেই ।
আজকে সকালে এই অবস্থা । তাইফা ক্লাসে ঢুকতেই পুরো ক্লাস আবারও চিৎকার করে উঠলো । তাইফা সেদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে ক্লাসের শেষের দিকে গিয়ে বসলো । অনেকেই হাসি ঠোট্টার করতে লাগলাম । তবে তাইফা কোন কথা বলল না । তুহিনের কাছে শুনেছি তাইফাও নাকি রাতে বেলা ট্রোল সহ্য করতে না পেরে আইডি বন্ধ করে রেখেছে । আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না যে মেয়েটা আজকে ক্যাম্পাসে এল কেন ? জানে না আজকেও ওকে ট্রোল করা হবে ?
তারপরই আমার মনে কথাটা মনে হল ! মনে হতেই আমি তাকালাম তাইফার দিকে । ও যেন জানতো আমি ঠিক এই সময়ে ওর দিকে তাকাবো । দুজনের চোখাচোখি হল । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটা আজকে কেন এসেছে !
আমার জন্য !!
ক্লাস শেষে সবাই যখন বের হয়ে গেল তাকিয়ে দেখি তাইফা তখনও বসে আছে । অন্যান্য দিন ক্লাস শেষ করেও কয়েকজন থাকে আজকে দেখি কেউ নাই । মেয়েটা তখনও বসেই আছে । মুখটা খানিকটা বিষণ্ণ । আমি পায়ে পায়ে তাইফার দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়েটা আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করলো । এমন একটা ভাব যেন আমাকে দেখেও দেখছে না ।
আরে মানে কি ! এই মেয়ের সমস্যা কি ! আমাকে ইগনোর করতে যাচ্ছে ?
নাহ ! এমন তো হওয়ার কথা না ।
গতকালকের ঘটনার জন্য কি কোন ভাবে আমাকে দায়ী করছে ?
কিন্তু এতে আমার কি এমন হাত ছিল যে আমাকে দায়ী করবে ?
আমি বললাম
-মেয়েরা কি কেবল আইসক্রিমই পছন্দ করে নাকি অন্য কিছুও ?
-কেন ?
-না মানে জানতে চাইছি । যদি আইসক্রিম বাদ দিয়ে চকলেট পছন্দ করে তাহলে একটা ব্যবস্থা করা যায় !
-আমি চকলেট খাই না !
-ও ! তাহলে আর কি !
-তবে .....
-তবে কি ?
-তবে তুমি দিলে খাবো !
আমি মুখে হাসি নিয়ে বললাম
-আচ্ছা !
ওর পাশে বসতে বসতে পকেট থেকে চকলেট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম । ভাববেন না আবার আমি আগে থেকেই চকলেট নিয়ে এসেছি । বাস্তব জীবনে আমার পকেটে আর কিছু থাকুক আর না থাকুক চকলেট থাকবেই ।
তাইফা চকলেট টা হাতে নিয়ে মুঠ করে ধরে রাখলো । এমন একটা ভাব যেন খুব দামী একটা জিনিস । বললাম
-প্যাকেট খুলো খাও ।
-না !
-কেন ?
-এটা আমি যত্ন করে রেখে দিবো । তোমার দেওয়া প্রথম উপহার !
এই বলে তাইফা আমার দিকে তাও একটু এগিয়ে এল । গা ঘেষে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কাল এলে না কেন ? সবাই আমাকে কেমন কেমন কথা বলছিলো !
-তুমি ওমন বোকার মত কাজ কেন করলে ? অনলাইন বড় বাজে একটা জায়গা জানো না ?
জানি না সামনে কি লেখা আছে তবে মেয়েটার চোখে তখনই আমার জন্য অন্য রকম কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলাম আমি যা আর কারো চোখে দেখি নি । ঝামেলা মনে করে যেদিকে আমি এতোদিন যাই নি সেই দিকেই যেতে হচ্ছে এই মেয়েটার জন্যই ।
ওর খালি হাতটা নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে সেই অনুভুতিটা যেন আরও ভাল করে অনুভব করতে পারলাম ।
(সমাপ্ত)
কিছু বানান ভুলের জন্য দুঃখিত
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:০২