সুমন কেবল মাত্র অর্ধেক মাংশের টুকরোটা মুখে নিয়েছে তখনই মিলি কথাটা বলল । সুমন কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে তারপর আবারও খাওয়ায় মন দিলো । এই জিনিস টা দেখে মিলির মেজাজটা যেন আরও একটু বেশি খারাপ হয়ে গেল । সে সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি কিন্তু সিরিয়াস ! এভাবে চলতে পারে না !
পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সুমন এক ঢোকে সব টুকু পানি খেয়ে ফেলে তারপর বলল
-তোমার কি এই সংসারে থাকতে সমস্যা হচ্ছে ?
-কথাটা সমস্যার নয় ! সমান অধিকারের । তুমি আমাকে ইকোয়ালি মেজার করছো না ?
-করছি না ?
-না ! তাহলে কেন চাকরি থেকে এসে প্রতিদিন তোমার জন্য রান্না করতে হবে শুনি ? এক একদিকে চাকরি করবো আবার তোমার জন্য রান্না করবো তোমার সব হুকুম শুনবো ? তোমরা ছেলেরা যুগযুগ থেকে মেয়েদের কে ঠিক এই ভাবেই শোষন করে আসছো !
সুমন আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল
-আচ্ছা খাওয়া শেষ করি । কথাবার্তা হবে তারপর । আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি আমার সংসারটা হবে গনতান্ত্রিক পরিবার । সবার মত প্রকাশের সমান অধিকার থাকিবে । ঠিক আছে ?
মিলি আর কোন কথা না বলে চুপচাপ খেতে লাগলাম ।
মিলি সারা জীবন থেকে নিজেকে একজন স্বাধীন নারী হিসাবে দেখে এসেছে । অন্তত এই পুরুষতান্ত্রীক সমাজে যেখানে নারীরা পুরুষের হাতের খেলনা হয়ে বসবাস করে সেই সমাজে মিলি নিজেকে মনে করে একজন মুক্ত পাখি হিসাবে মনে করে । সারা জীবন তার মাকে দেখে এসেছে ঘরের ভেতরে থেকে বাবার কথা মত চলতে । তার বাবার জন্য রান্না-বান্না করতে এবং বাবার সব কিছু মুখ বুঝে মেনে নিতে । কেন একটা মেয়ে কে সব সময় পুরুষের জন্য রান্না করতে হবে । সে হচ্ছে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী । কোন কাজের বুয়া নয় !
সুমনের সাথে যখন বিয়ে হল, সুমনকে সে পরিস্কার ভাবেই কথা গুলো বলেছিলো । সুমন মৃদু হাসলেও কোন কথা বলে নি । কিন্তু বিয়ের দুমাসের মাথায় এসে দেখে সেও ঠিক সেই সমাজের অন্য সব মেয়েদের মতই করেই পুরুষের জন্য রান্না করেই দিন পার করছে । এমন কি অফিস থেকে এসে যখন ক্লান্ত থাকে তখনও তাকে সুমনের জন্য রান্না করতে হয় ।
মিলি প্রথম প্রথম ভেবেছিলো সুমন এটা বুঝবে এবং কিছু একটা ব্যবস্থা করবে । কিন্তু সেও ঠিক অন্য পুরুষের মতই । তাই মিলি আর সহ্য করে নি । আজকে ঠিক ঠিক প্রতিবাদ করেছে । এর একটা বিহিত না হলেই নয় !
খাওয়া শেষে মিলি নিজেই টেবিল পরিস্কার করলো । তারপর শোবার ঘরের সোফার উপর গিয়ে বসলো । আজকে সে কথা শেষ না করে যাবে না । আগামীকাল ছুটির দিন সুতরাং দেরি করে ঘুমাতে গেলেও সমস্যা নেই । সুমন আসলো আরও মিনিট পাঁচেক পরে । বসলো মিলির পাশের সোফাতে । তারপর টিভি অন করে সাউন্ড টা কমিয়ে দিলো ।
মিলি কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই সুমন বলল
-একটু পানি ...... আচ্ছা ঠিক আছে আমিই নিয়ে আসছি !
সুমন নিজেই খাবার টেবিল থেকে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে হাজির হল । তারপর সেটা টি টেবিলের উপর রাখলো । গ্লাসে পানি ঢাললেও সেখান থেকে পানি খেল না । গ্লাসটা কেবল রাখলো টেবিলের উপরে ।
মিলির দিকে তাকিয়ে বলল
-তো তুমি বলতে চাও যে এই সংসারে ঠিক হ্যাপি না ? মনে হচ্ছে যে তোমাকে ঠিক মত অধিকার আমি দিচ্ছি না !
-তোমার কি তাই মনে হচ্ছে না ? আমাদের দেশের অন্যান্য ৮/১০ পরিবারের মতই কি আমাদের সংসারটা চলছে না ?
সুমন স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-এটাই কি স্বাভবিক না ?
-না মোটেই না ! আমাকে সারাদিন অফিস করে এসে কেন তোমার জন্য রান্না করতে হবে শুনি ? কেন তুমি রান্না করতে পারো না আমার জন্য ? গতকালকে আমাকে জানালে যে সামনের মাসে তুমি এই বাসাটা বদলে নিয়ে যাবে মোহাম্মাদ পুরে ! আমার কাছে কোন কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করনি, কেবল বলেছো । এসব দেখে তোমার মনে হচ্ছে না আমি এই সংসারে কেবল তোমার রান্না করার জন্য এসেছি । কিন্তু কথা ছিল কি ?
সুমন আরও কিছু টা মিলির দিকে তাকিয়ে রইলো । তবে সুমনের মুখ দেখে ঠিক মনে হচ্ছে না যে খুব একটা চিন্তিত । গ্লাস থেকে পানিটা এক ঢোকে আবারও খেয়ে নিয়ে সুমন মিলির দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা বুঝতে পারছি । আচ্ছা তোমার ইচ্ছে মতনই সব হবে । তুমি যখন সব কিছুতে ইকোয়ালই চাও তাহলে তাই সই । তবে একটা কথা তোমাকে আগে বলি । সমান অধিকার কিন্তু এমনি এমনি আসে না । সমান অধিকারের আগে আসে সমান দায়িত্ব পালন ।
সুমনের কথা শেষ করতে না দিয়েই মিলি বলল
-তোমার কি মনে হচ্ছে না যে আমি সংসারে সমান দায়িত্ব পালন করছি না ? বরং তোমার থেকে কাজ তো আমি বেশিই করছি !
-আচ্ছা তাই ? উই উইল সি দ্যাট ! আসো তাহলে কিছু কথা পরিস্কার ভাবেই বলে নেওয়া যাক । আগেই বলেছি এই সব কথা গুলো আসছে কেবল মাত্র এবং কেবল মাত্র তুমি সব কিছুতে সমান সমান চাও বলে ।
সুমনের চোখের দিকে তাকিয়ে মিলির কেবল মাত্র মনে সুমন যেন একটু হাসলো । তবে সেই আভাসটা মুছে গেলে মুহুর্তেই । সুমন একটু কেশে নিয়ে বলা শুরু করলো ।
-আমার মনে হয় এই মাসের আর দুই দিন আছে এই দি গুলোতে যেমন ভাবে চলছে তেমন ভাবে চলাই ভাল । সামনের মাস থেকে আমরা সব কিছু সমান সমান হিসাব করবো ঠিক আছে । সামনের মাসের এক তারিখ থেকে আমার জন্য তোমার কে আর রান্না করতে হবে না । আমি তোমাকে কোন কিছি করতে বলবো না । বরং আমি সংসারে ঠিক যে যে আচরন করি তুমিও ঠিক সেই সেই কাজ গুলোই করবে । সংসারের সব সিদ্ধান্ত দুজনের মিলিত ভাবে নেওয়া হবে । এখানে আমার কথার মূল্য তোমার কথা থেকে একবিন্দু কম হবে না আবার বেশিও হবে না ! কেউ কাউকে কোন হুকুম করবে না । কেউ কারো কোন কাজ করতে বাধ্য নয়, বাধ্য করতে পারবেও না । ইচ্ছে হলে করবে নয়তো নয় ।
-ঠিক আছে । আর রান্নার ব্যাপার টা ?
-দেখ, আমার পক্ষে রান্না করা সম্ভব না তুমি জানো । তাই আমরা একটা বুয়া রাখবো যার কাজ হবে যে সে আমাদের জন্য রান্নাকরবে ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ।
-আসলে তুমি ঠিকই বলেছো । তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্য কেবল রান্না করার জন্যই আমাকে বিয়ে করো নি । তুমি কেন কাজ করবে ? আমারও সমান ভাবেই কাজ করা উচিৎ !
মিলির কেন জানি সুমনের গলায় স্বরটা ঠিক সুবিধার মনে হল না । এতো সহজে সুমন সব কিছু মেনে নিবে এটা ঠিক মিলির ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । সুমন বলল
-এই গেল তোমার অধিকারের ব্যাপার. এবার আসা যাক দায়িত্বের ব্যাপার টা ! আসলে তোমার জন্য এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলা আরো সহজ হয়ে যেত তুমি আমাকে বিয়ে না করে তোমার কোন কলিগকে বিয়ে করলে ।
-মানে ?
-আরে আরে আমার কথার অন্য কোন মানে বের করো না । আমি আগে বুঝিয়ে বলছি ! দেখো, আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত ধারনা হচ্ছে পুরুষেরা বাইরে কাজ করে সংসারের জন্য উপর্জন করবে আর মেয়েরা সেই উপার্জন দিয়ে সাংসার চালাবে । এটা প্রচলিত । তোমরা এটা মানতে চাও না । তাহলে কি করতে হবে ?
-কি করতে হবে ?
-তাহলে তোমাদের কে ঠিক ঠিক পুরুষের মত বাইরে বের হয়ে সংসারের জন্য উপার্জন করতে হবে ।
-আমি কি উপার্জন করছি না ?
-এই জন্যই আমি বলেছিলাম যে তোমার কলিগদের কাউকে বিয়ে করা দরকার ছিল । এর মানে হচ্ছে তুমি ঠিক ঠিক যে পরিমান উপার্জন করবো সেই পরিমান উপার্জনের কারো সাথে তোমার বিয়ে করা দরকার ছিল । তাহলে ব্যাপারটা আরও সহজ হত তোমার জন্য । একটু আগে যে সমাজের প্রচলিত ধারনার কথা বললাম ঠিক সেই রকম প্রচলিত আরেকটা ধরনা হচ্ছে মেয়েরা সব সময়ই নিজের থকে উচ্ছে লেভেলের কাউকে বিয়ে করে । মানে মধ্যবিত্ত কোন মেয়ের মনে সব সময় আশা থাকে উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের কোন ছেলেকে বিয়ে করা অন্তত এমন কাউকে বিয়ে করা যে সেই মেয়েটা থেকে বেশি টাকা আয় করে । একটা ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিজীবী মেয়ে কোন দিন ১০ হাজার টাকা বেতনের ছেলেকে স্বইচ্ছায় বিয়ে করতে চায় না, কোন দিন না । তুমিও কিন্তু কর নাই । এখানেই তুমি পিছিয়ে গেছ এখন এই নিয়মন টাও কিন্তু বদলানো দরকার । তাহলে এই বৈষম্যটা অনেকটাই কমে যেত । যাই কোন যে কথা বলি । এখন বলতে পারো টাকা পয়সাই কি সব ? হ্যা । আমাদের সমাজে টাকা পয়সা জিনিস টা সব না হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় । এই টাকা দিয়েই মোটামুটি সব হিসাব হয়, সবাইকে বিচার করা হয় । এই যে তুমি চাকরী করতেছো, টাকা আয় করতেছো এটা যদি না করতে তাহলে এই কথা তুমি কোণ দিন আমাকে বলতেই পারতে না । টাকা আয় করতেছো বলেই কিন্তু পারছো । টাকাটা অনেক অনেক জরুরী । এখন যে মানুষটা তোমার থেকে বেশি টাকা আয় করে এবং সংসারের জন্য বেশি টাকা খচর করে সেই মানুষটার মতামত তোমার থেকে বেশি গ্রহনযোগ্য হবে । এটা কি তোমার কাছে স্বভাবিক মনে হচ্ছে না ?
মিলি কোন কথা না বলে সুমনের দিকে তাকিয়ে রইলো । কি বলবে খুজে পাচ্ছে না ।
সুমন বলল
-আচ্ছা বাদ দাও । আমরা এসব নিয়ে আর কথা না বলি । আমরা সমান অধিকার নিয়ে কথা বলেছি । সব কিছু ঠিক করে নিয়েছি । এবার আসা যাক সংসারে কার কন্ট্রিবিউশন কেমন হবে সেটা ঠিক করা ।
এই লাইন বলে সুমন আবার জগ থেকে পানি ঢেলে রাখলো সামনে । তারপর বলা শুরু করলো ।
-আমাদের সংসারটা কি ? একটা ছোট্ট প্রতিষ্ঠান । এটা আমরা দুজন মিলে চালাই । তাই তো ? যেহেতু আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে আমার অধিকার সমান হবে তাই তার আগে এখানে আমাদের কন্ট্রিবিউশনটা সমান হতে হবে । সমান সমান পার্টনার !
এই বলে সুমন টি টেবিলের নিচের র্যাক থেকে একটা প্যাড আর কলম বের করলো । তারপর লেখা শুরু করলো
-আমাদের এই ফ্ল্যাট টার ভাড়া ২২ হাজার টাকা ।
-বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাস বিল দিয়ে আরও ৩ হাজার টাকা
-বুয়ার বেতন ৩ হাজার
-খাওয়া খচর আনুমানিক ৬ হাজার ।
আরও অন্যান্য ২ হাজার ।
এই হল মোট ৩৬ হাজার ।
-এই হল আমার সংসারের মোট খচর । ঠিক আছে ?
সুমন তাকালো মিলির দিকে । মিলি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে যে সুমন এর পরে কি বলতে যাচ্ছে । সমুন বলল
-সামনের মাসে তুমি এই ৩৬ হাজার টাকার ১৮ হাজার টাকা দিবে । আমি দিবো বাকি ১৮ হাজার, ব্যস । এরপর সব কিছু সমান সমান । তোমাকে আমার জন্য আর রান্না করতে হবে না । আমি যেমন ভাবে থাকবো তুমিও ঠিক তেমন ভাবেই থাকবে । ওকে । এবং পর পরে যদি সংসারে কোন কিছু কিনতে হয় তাহলে সেটাও দুজন মিলেই সমান কন্ট্রিবিউশনে কিনবো । সব কিছুতেই সমান সমান ! ঠিক আছে ?এটা তো গেল কেবল খরচের ব্যাপার । এরপর আরও সংসারে যে যে কাজ আছে সেই সব কিছুই আমরা সমান সমান ভাবে করবো ! আসো ঘুমানো যাক !
সুমন একটু মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো । তারপর শোবার ঘরের দিকে হাটা দিল । খুব ভাল করেই জানে মিলির মাথা থেকে এই সমান সমান জিনিসের ভুত কদিনের জন্য দুরে চলে যাবে । মিলি সব মিলিয়ে স্কুল থেকে বেতনই পায় ১৬ হাজার টাকা ।
উঠে যেতে গিয়ে আবার দাড়িয়ে পড়লো । তারপর বলল
-পার্টনারশীপে প্রতিষ্ঠানে কি রকম হয় ? যে কম টাকা ইনভেস্ট করে সে কম সুবিধা কম মুনাফা ভোগ করে ঠিক সেই ভাবেই এখানেও চলে । এখন তোমার সামনে দুইটা পথ খোলা আছে । এক. আমাদের সমাজ টা যেভাবে চলে ঠিক সেভাবে চলা, সংসারটা সেভাবে চালানো । আর দুই, সমাজের প্রচলিত নিয়ম মত না চলে তোমার মন মত চলা । কিন্তু সেই ক্ষেত্রে তোমাকে এই ক্রাইটেরিয়াকে পূরন করতে হবে । মুখ দিয়ে চিৎকার করে "আমাকে সমান অধিকার দাও" এই টাইপের কথা বার্তা বললে লাভ হবে না । তোমাকে সেটা অর্জন করতে হবে । আশা করি আমি আমার বক্তব্যটা পরিস্কার করেছি ।
মিলি কোন কথা না বলে চুপ করে বসেই রইলো ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:০০