ফেডরিক জে লুকা শান্তভাবেই তাকিয়ে আছে সুমাইয়ার দিকে । এমন একটা ভাব করে তাকিয়ে আছে যেন একটু আগে সে যে খবর টা সুমাইয়াকে শোনালো সেটা খুবই স্বাভাবিকই একটা খবর । এরকম খবর সে হর-হামেশাই অনেক কে শুনিয়ে থাকে । অবশ্য সে যে পেশায় আছে তার জন্য এমন একটা কাজ খুবই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ ।
সুমাইয়া আবার বলল
-আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না । আমার পক্ষে এখন দেশে ফিরে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয় ।
-দেখুন মিস সুমাইয়া । আমরা খুব ভাল করেই খবর নিয়েছি । আপনাকে তো কেউ চিনেই না ঠিক মত । আর না চিনলে আপনাকে মারতে আসবে কিভাবে আমি সেটা বুঝতে পারলাম না ।
-দেখুন আমি সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছি ।
-ইউ মিন পালিয়ে এসেছি !
অপমান টা হজম করে নিল সুইমাইয়া । না করে অবশ্য উপায়ও নেই । সে আসলেই পালিয়েই এসেছে । অবশ্য এসব করেছে পালিয়ে আসার জন্যই তো । অনেকেই এমন টা বলে সে এসব গায়ে মাখে না । সব কিছু গায়ে মাখলে চলে না ।
সুমাইয়া আবার বলল
-আপনি আবার একটু চেক করবেন প্লিজ ।
-দেখুন আমরা সব কিছু আবার চেক করেছি । আমাদের কাছে মনে হয় নি যে আপনি সমস্যায় আছেন । আমাদের এই প্রজেক্ট টা কেবল যারা আসলেই বিপদে পরেছে তাদের জন্য । তবুও আমরা আরও কিছু দিন দেখবো । এর ভেতরে যদি মনে হয় যে না কোন সমস্যা নেই তাহল আপনাকে ফেরৎ পাঠানো হবে । তবে আপনি মানষিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকুক নিজের দেশে ফেরৎ যাবার জন্য ।
সুমাইয়া আর কোন কথা খুজে পেল না । আর কিছু বলার নেই । যে জিনিসটার জন্য এতো কিছু করলো সেটা যখন হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখে একদম ভেঙ্গে পরছে । একেবারে বিস্তত্ব লাগছে নিজের কাছে । লুকা আবার বলল
-আপনাদের সাথেই আরেকজন থাকে । অরুন চৌধুরী নামে । তার অবস্থাটাও আপনার মতই । তাকেও আপনার সাথে ফেরৎ পাঠানো হবে । তাকে ব্যাপার টা বলে বলে দিবেন । আমরা অবশ্য কয়েকদিনের ভেতরে তাকেও কাগজ পত্র পাঠাবো !
সুমাইয়া আর কিছু ভাবলো না । কিছু আর তার মাথায় ঢুকছে না । তাকে ফেরৎ চলে যেতে হবে এটা ভাবতেই কেমন জানি দুর্বল লাগছে সে যখন ফেডরিক জে লুকার অফিস থেকে বের হল তখন নিজেকে অসহায় মনে হল । সামনে কি করা যায় কিছুতেই ভেবে পেল না । কি করা যায় !
------
ওদের থাকার জায়গাটা খুব বেশি উন্নত বলা যাবে না । তবে অন্যান্য শরণার্থীশিবিরের থেকেও ওদের অবস্থা বেশ ভাল । ওদের কে একটু বেশি ভাল অবস্থায় রাখা আছে । যা যা চেয়েছিল তার সব না পাওয়া গেলেও সুইমাইয়া বেশ ভালই ছিল এখানে । যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল তার অনেকটাই পূরন হয়ে গিয়েছিল ।
রুমে আসতেই অরুন কে দেখলো ল্যাপ্টপের দিকে গভীর মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে আর একটু একটু হাসছে । মনে হয় মজার কোন জিনিস পড়ছে । ওকে ঘরে আসতেই দেখে অরুন বলল
-আরে এদিকে আসো । একটা মজার গল্প শোনাই !
-এখন ভাল লাগছে না ।
-আরে আসো না ? দেখি মজা পাবে !
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেরও অরুনের দিকে এগিয়ে গেল । অরুন ল্যাপ্টপ টা ওর দিকে এগিয়ে দিল । ছোট একটা গল্প লেখা আছে ।
দুই বন্ধুর চিড়িয়াখানার যাওয়ার গল্প
আজিম আর নুরু দুইজন গেছে চিড়িয়াখানা ঘুরতে । এর ভেতরে আজিমের মাথায় বেশ দুষ্ট বুদ্ধি আছে অন্য দিকে নুরু একটা একটু হাবলা কিছিমের । তারা দুজনেই একটা আফ্রিকান হিংস্র পশুর খাঁচার সামনে গিয়ে হাজির হল । খাঁচা ছাড়াও খাঁচার দেওয়াল থেকে আরও এক হাত দুরে আরেকটা ছোট ফুট তিনেক উচু দেওয়াল দেওয়া আছে । দর্শকদের সেই দেওয়াল পার হওয়া নিষেধ । পশুটাকে দেখেই আজিমের মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো । সে নুরুকে বলল এই পশু মোটেই হিংস্র নয় ।
নুরু বলল কিন্তু এইখানে যে লেখা আছে ।
-আরে ধুর । তোর কি মনে হয় যা লেখা থাকে তার সবই ঠিক । আমি এটাকে টিভিতে দেখেছি । ডিসকভারীতে । খুবই শান্ত স্বভাবের । চিরিয়াখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের বকা বানাচ্ছে । নুরু তবুও বিশ্বাস করতে চায় না । তারপর বলল না না । দরকার নেই ।
-আরে দেখ না ।
এই বলে আজিম একটা ইট নিয়ে পশুটার দিকে ছুড়ে মারলো । পশুটা কেবল একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো তারপর আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ।
আজিম বলল
-দেখলি তো । এবার একটা কাজ কর ।
-কি ।
পাশে পরে থাকা একটা লম্বা লাঠি দেখিয়ে বলল
-এটা দিয়ে ওকে খোঁচা মেরে দেখ । কিভাবে কিভাবে পাঠায় !
-না না । দরকার নেই
-আরে ভয় পাস কেন ? আমি মারলাম দেখলি না । কিছু হয়েছে ?
একটু দ্বিধা থাকলেই নুরু লাঠিটা তুলে নিল হাতে । তারপর দেওয়াটা টপকে চলে গেল একেবারে খাঁচার দেওয়ালের কাছে । এরপর লাঠিটা নিয়ে পশুটাকে পেঁছনে খোচাতে লাগলো । প্রথম প্রথম খোচানোর পরেই পশুটা কিছুই বলল না । ওদের দিকে কেবল রিরক্ত চোখে দেখতে লাগলো । এটা দেখে দুজনেই আরও বেশি উৎসাহ পেয়ে গেল যেন । কিন্তু কত ক্ষণ আর স হ্য করবে । পশুটা একটা সময় আর স হ্য না করে ক্ষিপ্ত গতিতে এগিয়ে এল খাচার কাছে । লোহার শিক দিকে হাত বের করে দিয়ে নুরু বুকের কাছ থেকে মাংশ তুলে নিল । তারপর আজিমের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়তে লাগলো । আজিম একটু ভয় পেলেও সামলে নিল । সে জানে পশুটা ওর কাছে পৌছাতে পারবে না ।
এদিকে আজিম কিন্তু সেই নিরাপদ দুরুত্বেই আছে । তাকিয়ে আছে নুরুর দিকে । ও জানতো এমন কিছু হবে তবুও নুরুকে এর ভেতরে ঠেলে দিয়েছে । তারপরই চিৎকার চেঁচামিচি শুরু হয়ে গেল । আজিম চিৎকার করতে করতে পশুটাকে । পশুটা বড় হিংস্র । বড় খারাপ । তাররপ চিরিয়াখানা কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করতে লাগলো যে তারা যথাযত ব্যবস্থা নেয় নি । কিছু কিছু দর্শক যারা চিৎকার শুনে এগিয়ে এল তারাও আজিমের সাথে সুর মেলালো । বলল আসলেই চিরিয়াখানা কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাক মত ব্যবস্থা নেই নি । নিজে আজকে এই জিনিস টা হত না । অন্য দিকে সেই সময় যারা খাচা কাছে ছিল, দেখেছে এই জন কি করেছে তারা কেবল বিরক্ত চোখে তাকালো দুজনের দিকে ।
গল্প পড়ে সুমাইয়া আবার অরুনের দিকে তাকালো । ছেলেটা এখনও মিচমিচ করে হাসছে । ছাগল হয়েছে একটা । নিজেকে সব সময় সব থেকে জ্ঞানী ভাবে । বাপের নামের জোরেই এতো দুর এসেছে । ভেতরে যদি কিছু থাকতো । সুমাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল
-এটা মজার গল্প হল কিভাবে । যত্তসব , আমি আসি আমার টেনশনে ।
-আরে বুঝলে না ?
-কি বুঝবো ?
-গল্পের চরিত্র গুলো আরেকভার ভাল করে ভেবে দেখো । গল্পের চরিত্র গুলোর সাথে আমাদের একটা মিল খুজে পাচ্ছো না ? আমাদের দেশের পরিস্থিতি কিন্তু এরকম । বুঝেছে ?
সুমাইয়া কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর আবার তাকালো অরুনের দিকে । ব্যাপার টা ধরতে একটু সময় লাগলো ।গল্পে নিজেদের কে কোন চরিত্রে বুঝতে পেরেই একটু যেন হেসেও উঠলো । কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই চিন্তাটা ফেরৎ চলে এল ।
আরে তোমার এতো চিন্তা কেন শুনি ?
-হবে না ? তুমি জানো কিছু ? আজকে কি হয়েছে ? আমি কোথায় গিয়েছিলাম ।
-আরে জানি । আমার কাছে মেইল এসেছে । আমাদের কে দেশে চলে যেতে হবে । এই তো ?
সুইমাইয়া অবাক হয়ে বলল
-তোমার টেনশন লাগছে না ?
-নাহ !
-কেন ? তুমি আবারও ফেরৎ যেতে চাও ?
-নাহ !
-মানে কি এসেবের মানে কি ? তোমার কি আসলেই চিন্তা লাগছে না ?
-মাথা ঠান্ডা কর । আমাদের সমাধান এই গল্পের ভেতরেই আছে ।
সুমাইয়া আরও কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো । কিন্ত কিছুই বুঝতে পারলো না ।
অরুন বলল
-আরে শুনো, অনেক দিন থেকেই আমাদের দেশে তেমন কোন ঘটনা ঘটছে না । তাই এটা নিয়ে কেউ কোন আলোচনা করছেও না । আমরা ফোকাসের বাইরে চলে এসেছি । তাই তো ওরা আমার এমনটা ভাবছে যে আমাদের দেশে ফেরৎ যাওয়াটা এখনও কোন সমস্যা নেই । এখন আমাদের এমন কিছু করতে হবে যাতে আমরা আবারও আলোচনা আসতে পারি । আর আমাদের দেশের মানুষকে তো তুমি চেনই ।
-তার মানে ?
-তার মানে আমরা শুরুর দিকে ঐ পশুটাকে যেভেবে ইট মেরেছি ঠিক সেভাবে একটা ইট মারবো । দেখবা ঠিক ঠিক নুরুর মত বেকুব পাব্লিকের অভাব হবে না । তারা তখন লাঠি দিয়ে খোঁচাতে শুরু করবে । ঝামেলায় পড়বে ওরা কিন্তু ফোঁকাসে চলে আসবো আমরা ! আমাদের দেশের মানুষ এমনিতে শান্ত কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তারা খুব দ্রুতই অশান্ত হয়ে যায় । মৌলবাদীদের তো ভয়ংকর হয়ে ওঠে । অবশ্য ওদের একটা ধন্যবাদ না দিলেও চলে না । ওদের জন্যই তো আজকে আমরা এখানে আসতে পেরেছি ।
-তাহলে কি করা যায় ?
-রিলাক্স । সব কিছু ভেবে রেখেছি । সামনে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসতেছে । কেবল একটা ইভেন্ট খুলবো আমরা । দেখবো কিভাবে সবার সামনে চলে আসি । আমাদের ওরা গালি দিবে হুমকি দিবে আরও কত কিছু করবে ইভেন্টে । কিন্তু বোকা গুলো জানবেই না এরা আমাদের কত উপকার করছে । আমরা এখানে নিরাপদে বসে আমাদের ভিসার মেয়াদ বাড়াবো । আর আমি কয়েকটা অনলাইণ পোর্টালের সাথে কথা বলেছি । ওরা আমাদের কে দেওয়া হুমকির ব্যাপারটা হাইলাইট করবে । ব্যস । হয়ে যাবে । এসব ফেডরিক কে দেখালেই সামনের বছর খানেক আমরা আবারও নিশ্চিৎ !
তিন দিন পর !
সুমাইয়া ভাবতেই পারি নি ব্যাপারা এতো সহজ হয়ে যাবে । পাব্লিকের পেছনে ভালই আঙ্গুল দেওয়া গেছে । দুটো নিউজও হয়েছে । ও নিজে মেয়ে হওয়াতে ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে গেছে । ওরা যেমন জানে সুমাইয়া নিজেও জানে যে ওরা কিছুই করতে পারবে না । ও এখানে নিরাপদেই থাকবে । তার উপর এই গুলো ফলে ওর উদ্ভাস্তু ভিসা আরও নিশ্চিৎ হয়ে গেল ।
আর দেশের যারা যারা ঐ ইভেন্টে যাবে তাদের নিয়ে কিছু ভাবার নেি । কোন দিন তারা ভাবেও নি । কেবল ভাবার একটা অভিনয় করে গেছে । ঐ বেকুব গুলোর জন্যই তো সে এবং তার মত আরও অনেকে আজকে এখানে এতো সুখ শান্তিতে থাকতে পারছে ।
-------
কাল্পনিক গল্প । বাস্তব ঘটনার সাথে কেউ মিল খুজবেন না
মিলে গেলে যেতে পারে তবে তার জন্য লেখক কোন ভাবেই দায়ী নয় ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩১