রিসিপশনের মেয়েটার নাম সম্ভবত মিলি অথবা জুলি । আমি যখন গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি তখনই মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়েছে এবং চোখাচোখি হতেই মেয়েটা একটু হেসেছে । এর অর্থ মেয়েটা আমাকে চিনতে পেরেছে । যাক, নিজে গিয়ে আর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না । প্রথমবার যখন এসেছিলাম বেশ খানিকক্ষণ লেগেছিলো মেয়েটির সাথে কথা বলতে ।
আজকে আর দেরি না করে সোজা চলে গেলাম মিলি অথবা জুলির সামনে ।
-ভাল আছেন অন্তু সাহেব ?
আরে মেয়েটা দেখি আমার নামও মনে রেখেছে !
যাক ভাল । আমি কেবল হাসলাম । মেয়েটা আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেও আমি না বসে বললাম
-ম্যাডাম কই ?
-ম্যাডাম তো আছে । আপনি ফোন করে আসেন নি ?
-আসলে অহীন কদিন থেকে আমার ফোন ধরছে না । রাগ করে আছে ।
আমার কথা শুনে মিলি কিংবা জুলি হেঁসে ফেলল । নতুন প্রেমের গল্প করলে বন্ধু-বান্ধব যেমন করে হাঁসে সেরকম । মেয়েটির নিশ্চয় প্রেমিক আছএ সেও নিশ্চয়ই তার প্রেমিকের সাথে এরকম রাগ অভিমান করে । মেয়েরা তাদের প্রেমিকদের সাথে রাগ অভিমান করতে পছন্দ করে । এই সম্পর্কটা কেবল মেয়েদের তাদের এই প্রেমিকদের সাথেই গড়ে ওঠে । আরও ভাল করে বললে ছেলেদের সাথে প্রেম করার অন্য একটা কারনই হচ্ছে মেয়েরা এমন কাউকে কাছে পেতে চায় যারা তাদের রাগ আর অভিমানকে সহ্য করবে সেটা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে ।
মিলি কিংবা জুলি বলল
-কাজের সময় বিরক্ত করলে ম্যাডাম বেশ রাগ করে । আর আজকে সকাল বেলাতেই ম্যাডাম কাউকে ভেতরে যেতে মানা করে দিয়েছে !
আমি বললাম
-ও !! তাহলে ?
মিলি কিংবা জুলি বলল
-তবুও কি আমি একবার যাবো ?
-প্লিজ ! গেলে খুব উপকার হয় । বলবেন যে আমি কেবল ওর সাথে লাঞ্চ করেই চলে যাবো । যদি সে কথা না বলতে চায় তবুও ঠিক আছে । কোন কথা হবে না । কেবল খাওয়া চলবে ।
মিলি কিংবা জুলির মুখে আবারও সেই হাঁসি দেখতে পেলাম ।
-আচ্ছা আমি যাচ্ছি !
এই বলে মেয়েটা ভেতরে চলে গেল । আমার মনে আছে গত দিন যখন এসেছিলাম আমাকে সে কিছুতেই যেতে দেবে না ভেতরে কিংবা আমার কথাও ভেতরে পাঠাবে না । আমি যে অহীনের কিছু হই সেটা বিশ্বাস করতে নারাজ । শেষে যখন অহীন নিজে এসে আমাকে ওর কেবিনে নিয়ে তখনও যেন মেয়েটার বিশ্বাস হচ্ছিলো না । আসলে অহীনে এখানে যে পোস্টে চাকরী করে তার সাথে আমার চরিত্রটা ঠিক যায় না । কারো মাথাতে আসতেই পারে না যে আমার মত বেকার একজন ছেলে এই অহীনের মত একজন সিনিয়ার অফিসার বয়ফ্রেন্ড হতে পারে ।
এই কথাটা অহীনের বাবাও মেনে নিতে পারে না কিছুতেই । আমার সাথে যেদিন প্রথম পরিচয় হল অহীনের বাবা আমাকে সরু কন্ঠে বলেছিলো
-তুমি কি জানো আমার মেয়ে কত বেতন পায় ?
আমি হাসি মুখে বলেছিলাম
-জি, পরিস্কার অংকটা আমি জানি !
-তার পরেও তুমি তাকে বিয়ে করতে চাইছো ? কোন সাহসে ?
-বিয়ে করতে যে সাহস লাগে !
-শুন হে ছোকড়া, আমি তোমার মত চাল চুলোহীন ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে তো দুরের থাকুক, তোমাকে তার গাড়ির ড্রাইভার পর্যন্ত রাখবো না !
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু অহীন চলে আসাতে কিছু বলতে পারে নি সেদিন । অবশ্য আমি যতদুর জানি অহীনের বাবা আমার সাথে যাই হোম্বী-তাম্বী করুক না কেন অহীনকে কিছু বলে না কিংবা বলতে পারে না । অবশ্য অহীনের মত মেয়েকে কেউ নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখবে সেটা ভাবারও উপায় নেই ।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি । মিলি কিংবা জুলি ফিরে এল একটু পরেই । মুখটা একটু কালো । মনে হল সে সম্ভবত অহীনের কাছ থেকে ধমক খেয়েছে । আসতেই আমি বললাম
-খবর কি খারাপ ?
-হুম !
-আমাকে চলে যেতে বলেছে ?
-বলেছে আপনি যদি না তাহলে যেন সিকিউরিটিকে ডেকে আপনাকে বের করে দেই ।
-সমস্যা হয়ে গেল তো দেখছি !
-কেন ?
-দুপুরে ওর সাথে লাঞ্চ করবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম । এখন দেখছি, না খেয়ে থাকতে হবে । আচ্ছা যা হোক । প্রেমিকার জন্য না হয় একবেলা না খেয়েই থাকলাম ! আচ্ছা আসি !!
আমি দরজার দিকে হাটা দিলাম ।
দুই
অহীন আমার সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছে । আমাদের সামনে দুপুরের খাবার । চিকেন ফ্রাইড রাইস সাথে সালাদ আর মুরগির ঝোল । অহীন কোন কথা বলে চুপ করে খেতে শুরু করলো । আমি বসেই রইলাম ।
অহীন আমাকে ঠিক যেতে দেয় নি । দিবে না ঠিক ঠিক জানতাম । আমি যখন ওর সাথে লাঞ্চ করতে এসেছি এর অর্থ ও খুব ভাল করেই জানে । আমি যখন গেট দিয়ে বের হতে যাবো তখনই অহীনের ফোন এসে হাজির । ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অহীন বলল
-ক্যান্টিনে গিয়ে বস । আমি আসছি !
আমি মনে মনে হাসলাম । এই অহীনকে আমার থেকে ভাল আর কেই বা চিনে !
আমাকে খেতে না দেখে অহীন বলল
-খাচ্ছো না কেন ?
-না মানে .....
-শোন কোন বাজে কথা বলবা না । লাঞ্চ করতে চেয়েছিলে লাঞ্চ করছো । তোমার সাথে একটা কথা বলতে আমি রাজি নই !
অহীনের কন্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে যে ও এখনও রেগে আছে । আসলেই আমার হুট করে ওরকম ভাবে চাকরীটা ছেড়ে দেওয়া মোটেই উচিৎ হয় নি । তার উপর চাকরী যে ছেড়ে দিয়েছি সেটা ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখাটাও উচিৎ হয় নি । ওর ফ্যামিলিতে প্রায় সব কিছু ও গুলিয়ে নিয়ে এসেছিলো । যখনই কথা বার্তা এগুলো তখনও ওর বাবা জানতে পারে যে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি । এই কথাটাও ও ওর বাবা কাছ থেকেই জানতে পেরে আমার কাছে আসে । সেদিন ওর অগ্নি মুর্তি দেখে আমি ভয়ই পেয়েছিলাম । ভেবেছিলাম হয়তো আমার সাথে আর ও দেখাই করবে না । রাগ করে হয়তো ওর বাবা পছন্দের সেই শাহরিয়ার না ফাহরিয়ারের সাথেই বিয়ে করে ফেলবে । অবশ্য এখনও বিপদ কাটে নি । যেহেতু এখনও ওর রাগ কাটে নি কিছু একটা হয়েও যেতে পারে ।
-আসলে আমি সরি বলার জন্য এসেছি । এরপরে চাকরি ছাড়তে হলে তোমাকে বলবো সবার আগে !
-আচ্ছা ! তার মানে চাকরী তুমি ছাড়বেই । চাকরী করবে না ? তা শুনি এমন ছেলের সাথে কোন মেয়ের বাবা তার মেয়ে বিয়ে দিবে ? আমার এখন মনে হয় তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না বলেই এমন কর । এতো চমৎকার একটা চাকরী করতেছিলে, কি হত আর দুইটা মাস করলে ? বল কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো ?
-আসলে ......।
-চুপ ! কথা না । চুপচাপ খাও তারপর বিদায় হও !
আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনও একটা সুদর্শন ছেলে আমাদের টেবিলের সামনে এসে হাজির হল । ছেলেটাকে দেখে অহীন উঠে দাড়ালো । চেনে সম্ভবত । আমার উঠে দাড়ানো উচিৎ কি না আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই সেই অন্তু ?
অহীন বলল
-শাহরিয়ার ? তুমি কেন এসেছো এখানে ?
-আমি ভাবতে পারছি না যে তুমি এর জন্য আমাকে রিজেক্ট করছো ?
-শাহরিয়ার, দিস ইজ নট দ্য প্লেস । প্লিজ লিভ !
শাহরিয়ার সাহেবের ভাব ভঙ্গি ঠিক সুবিধার মনে হল না । একটা মার মুখো ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে । এমন একটা ভাব যে আজকে সে আমাকে ঠিক ঠিক দেখে নেবে । অন্তত আমার দিকে সে যে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে । শাহরিয়ার সাহেব বলল
-আমি কত গুলো মেয়েকে রিজেক্ট করেছি তুমি জানো ? কেবল তোমার জন্য । মেয়েদের লাইন ধরে আছে আমার পেছনে ....
-ওকে ফাইন । তোমার জন্য লাইন ধরে বসে আছে তুমি যাও তাদের কাছে । আমার পেছনে কেন ঘুরছো ?
আমি অহীনের কন্ঠস্বরে একটা উত্তাপ শুনতে পেলাম । মনে এবার এই বেটার ঠিক ঠিক খবর আছে । আর একটা কথা বলেছে তো সত্যি খবর আছে এর ।
শাহরিয়ার সাহেব বলল
-তোমার বাবা আমার বাবাকে পাঁকা কথা দিয়ে ফেলেছে । এসব আগাছা ঝেড়ে ফেল । আজকের লাঞ্চটা নিশ্চয় তোমার টাকায় হচ্ছে । তাই না ? যে তোমাকে সামান্য লাঞ্চ করাতে পারে না .......
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম এবার কি হবে । ঠিক ঠিক জানি অহীন এই বেটা কে এবার ঝাড়ি দেওয়া শুরু করবে কিন্তু যা করলো সেটা আমি পর্যন্ত ভাবতে পারি নি । আমার সামনেই শাহরিয়ার সাহেবের কলার চেপে ধরলো । ওদের অফিসের ক্যান্টিনের সবাই তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে । অহীন চিৎকার করে বলল
-এক্ষুনি এখান থেকে বের যা । তোর সাহস তো কম না আমার অফিসে এসে আমার প্রিয়ন্সেকে আমারই সামনে গাল-মন্দ করছিস !
আমি তো অবাক হয়েছিই সব থেকে অবাক হয়েছে শাহরিয়ার সাহেব নিজে । কোন মেয়ে যে তার কলার চেপে ধরে এমন কথা বলতে পারে এমন ভাবনা সম্ভবত তার মাথায় কোন দিন আসেই নাই ।
অহীন চিৎকার করে ডাকলো
-আলিম ! আলিম !
দেখলাম কোথা থেকে একজন গার্ড এসে হাজির ।
-জি ম্যাডাম !
-এই বেটাকে ঘাড় ধরে বের করে অফিস থেকে ।
শাহরিয়ার সাহেব কেবল অবাক চোখে অহীনের দিকে তাকিয়ে রইলো । আমিও নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অহীনের দিকে । বলতে গেলে পুরো ক্যান্টিনের সবাই এখন অহীনের দিকে তাকিয়ে আছে ।
শাহরিয়ার সাহবেকে আলিম যখন ক্যান্টিন থেকে বের করে নিয়ে গেল, তখন অহীন আবারও টেবিলে বসে পড়লো । আমি কোন কথা বলে চুপ করে খেতে শুরু করলাম । এমন একটা ভাব যেন কএকটু আগে কিছু হয় নি !
কিছু সময় পরে বললাম
-একটা কথা বলবো ?
-না । চুপচাপ খাও । খেয়ে বিদায় হও !
-কিন্তু তুমি না বললে আমি
-চুপ । কোন কথা না !
-আহা একটা কথা । প্লিজ !
অহীন বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি বল !
-আচ্ছা বিয়ের পর আমি একটু এদিক ওদিক কিছু করি তুমি এভাবে আমার কলার চেপে ধরবে ?
অহীন বিরক্ত চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো আরও কিছুক্ষন । তারপর হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম যে ওর চোখের বিরক্ত ভাবটা কেটে যাচ্ছে ! অহীন বলল
-তোমার খুব মজা লাগছে, তাই না ?
-আরে বল না কি করবে ?
-ক্রিকেট ব্যাট চেনো ? ঐটা দিয়ে তোমার মাথা ফাঁটাবো ।
-তোমাকে বিয়ে কেন করছি না এইবার বুঝতে পারছো তো ? জেনে শুনে কেউ নিজেকে এমন বিপদের মুখে ফেলে বল ?
কথাটা বলেই কেন জানি মনে হল এবার আমার খবর আছে । কিন্তু অহীন আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ফেলল । হাসতে হাসতে বলল
-তোমার আসলেই খবর আছে । আজকে হোক আর কালকে হোক ।
আমি একটা বড় মুরগির পিচ মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললাম
-তুমি আজকে যে কাজটা করলে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শাহরিয়ার সাহেব এই অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগবে । তোমাকে বিয়ে করা হবে তার জন্য সব থেকে চ্যালেঞ্জ ! বলা যায় না তোমাকে জোর করে বিয়ে করেই ফেলতে পারে । আর তোমার বাবার তো আবার শাহরিয়ারকে খুব পছন্দ ।
-তোমার মনে হয় আমাকে জোর কেউ বিয়ে করতে পারবে ?
-নাআআআআ ! আমি তা বলছি না তবে বোঝাই তো প্রেমিকের মন করে সারাক্ষন কেমন কেমন ....
-চিন্তা কর না । আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না । যদি তুমি বিয়ে না কর তাহলে কাউ কেই বিয়ে করবো না ।
এইকথাটা অহীন প্রায়ই বলে । আমি নিজেও জানি মেয়ে ঠিক ঠিক এই কাজটা করবে । যদি আমার সাথে ওর বিয়েটা ভাগ্যে না লেখা থাকে তাহলে হয়তো অন্য কাউকে বিয়েই করবে না !
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতে যাবো ও তখন আমাকে ধরে নিয়ে গেল ওর কেবিনে । জুলি না মিলি আমাদের একসাথে দেখে কেবল মিচমিচ হাসতে লাগলো । কেবিনে নিয়ে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছুটা সময় । প্রতিবারই এমনটা করে । আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম কারন টা । কিন্তু ও আমাকে বলে নি । এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
-ভাল করে খাওয়া দাওয়া কর । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ।
-আর নিয়মিত গোসল করবা ।
-আচ্ছা । আর কিছু ?
-না আর কিছু না ।
যখন আবারও ওর অফিস থেকে বের হলাম পকেটে হাত দিয়ে দেখি দুইটা ১০০০ টাকার নোট । আমার অজান্তেই কখন আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে টেরই পায় নি । আমার পকেটে যে টাকা থাকবে না এই সময় ও ঠিক ঠিকই জানতো !
নাহ ! মেয়েটাকে দেখছি খুব জলদিই বিয়ে করে ফেলতে হবে । এই মেয়েকে বেশি দিন কষ্ট দেওয়া যাবে না !!
অন্তু_অহীন সিরিজ ০১
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:০৯