-এই খানে ঘুমাইবেন ?
প্রশ্নটা শুনে আমি পাশে ফিরে তাকালাম । বয়সে আমার থেকে বেশ বড়ই হবে । তবে স্বাস্থ্য বেশ খারাপ । মুখের মাংশ নেই বললেই চলে । সিগারেট খাওয়া ঠোটে এখনও একটা কম দামী সিগারেট জ্বলছে । আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম
-সমস্যা ঘুমালে ?
-সত্যই ঘুমাইবেন ?
-হু !
লোকটার চোখে এবার আমি সত্যি সত্যিই বিশ্ময় দেখতে পেলাম । লোকটা কেন অন্য যে কোন মানুষের পক্ষেই এটা বিশ্বাস করে নেওয়া কঠিন যে আমি এখানে এই ওভারব্রিজের উপর ঘুমাবো । যদিও আমি এখনও শুয়ে পরার চিন্তা করছি না । রাত বেশ হয়ে গেছে মনে হয় । কারন ওভার ব্রীজটা দিয়ে মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে । নিচে দিয়ে একটু আগেও যেখানে গাড়ির সাড়ি ভুস-ভাস করে চলছিল এখন সেখানে বেশ বিরতি দিয়ে চলছে গাড়ি ।
লোকটা নিজেই আমার দিকে একটু এগিয়ে এল ।
-বিড়ি খাইবেন ?
-জি না আমি বিড়ি খাই না ।
-সিগরেট ?
-সেই টাও না !
লোকটা একটু হতাশ মনে হল । কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ । আমি তখনও ওভারব্রিজের ফ্লোরের উপরে বসে আছি । নিচে একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে নিয়েছি । রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম এখানে কেন এসেছি ।
-বউয়ের লগে গোছা করছেন ?
-হুম !
-ভালা করছেন এইখানে আইছেন ! নারী জাতি বড়ই ঝামেলা পূর্ণ জাতি !
আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম
-আপনি বিয়ে করেছেন ?
-জে ! একটা না, দুইটা !
-আপনের বউরা কই ?
এই বলে লোকটা দাঁত বের করে হাসলো । আমি আবারও বললাম
-তা এই খানে কেন ? দুই দুইটা বউ থাকতে !
আমার কথায় যেন লোকটা আরও মজা পেল । দাঁত বেরিয়ে গেল আরও । তারপর বলল
-দুইটা বিয়া করছি বইলাইতো আইজকা এইখানে ঘুমাইতাছি । ঐ যে কইলাম না নারী জাতি বড়ই ঝামেলা পূর্ণ জাতি । শান্তির জন্য এইখানে ঘুমাই ।
আমিও কি শান্তির জন্য এখানে এসেছি ?
হুম ! শান্তির জন্যই ।
অথবা বউয়ের উপর রাগ করে ?
হতে পারে দুটোই । আজকে রাতে আমার জেরিনের চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না তাই বাসা ছেড়ে চলে এসেছি । থাকুক ও ওর মত । চলুক ওর ইচ্ছে মত ।
জেরিন এমনিতে বেশ ভাল তবে সমস্যা হচ্ছে মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করে যে যেটা আমার পছন্দ না । দুজনই চাকরী করার সুবাধে বলতে গেলে সপ্তাহের অন্যান্য দিন গুলোতে ওর সাথে আমার ভাল করে দেখাই হয় না । ওর ওর মত অফিসে আমি আমার মত । রাতের বেলাতেও সারা দিনের ক্লান্ত শরীরের কারনে খুব বেশিক্ষন জেগে থাকা হয় না । তাই ছুটির দিন গুলোতে আমার সময় কাটে এক সাথে । বলতে গেলে একেবারে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত । আমার অবশ্য বাইরে যাওয়ার থেকে ঘরের ভেতরে সময় কাটাতেই ভাল লাগে তবুও ওর জন্য ওকে নিয়ে এদিক ওদিক যাই ।
সময় কাটে বেশ ভাল কাটে । তবুও মাঝে মাঝে ওদিক এদিক চলে যায় । কতবার বলেছি যে ওর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে প্রোগ্রাম গুলো ছুটির দিন গুলো বাদ দিয়ে রেখো । এই সময়টা আমার চাই । কিন্তু কে শোনে কার কথা । তার মাসের ভেতরে যাওয়া চাই । আজকের সকালেই প্লান করে রেখেছিলাম যে ওকে নিয়ে নাটক দেখতে যাবো । ওকে না বলেই দুটো টিকিটও মেনেজ করেছিলাম । কিন্তু দুপুর বেলা আমাকে জানালো যে ওর নাকি কোন বন্ধুর বাসায় পার্টি ! ও সেখানে যাবে । ফিরতেও নাকি রাত হবে ।
আমি বললাম
-আমাকে নিয়ে যাও । আমি একা একা কি করবো বাসায় ?
-অপু তুমি কি বল ! আমাদের ফ্রেন্ডসদের পার্টি তুমি গিয়ে কি করবে আর আমি জানি তুমি এই পার্টিতে গিয়ে বোর হও ।
-তাহলে তুমি যেও না !
আমার দিকে জেরিন এমন ভাবে তাকালো যেন এর থেকে হাসির কথা আর শুনে নাই ।
আমি আবারো বললাম
-না তুমি যাবা না ! আর এতো রাত পর্যন্ত তুমি বাইরে থাকবা আমার ভাল লাগবে না !
আমার এই কথায় জেরিন যেন একটু বিরক্ত হল মনে হল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখো আমি তোমার কথা মত চলবো না ! ঠিক আছে ? আমার একটা পার্সোনাল লাইফ আছে । এটা তোমাকে বুঝতে হবে । এখানে ইন্টারফেয়ার আমি পছন্দ করি না । তোমার পারসোনাল লাইফে তো আমি ইণটারফেয়ার করি না !
আমি আর কোন কথা বললাম না । আমার চোখের সামনে দিয়ে জেরিন বেরিয়ে গেল সন্ধ্যা বেলা । যাওয়ার বলে গেল আমি যেন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি । সব কিছু রেডি করাই আছে । চাইলে আমি গরম করে নিতে পারি ওভ্যানে । আর দরজা খোলার ঝামেলা করতে হবে না ও চাবি নিয়ে যাচ্ছে ।
আমি কোন কথা বললাম না । ওকে চলে যেতে দিলাম । ও যাওয়ার কিছু টা সময় চুপ করে টিভি দেখতে লাগলাম কিন্তু কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম যে আমার প্রচান্ড রাগ উঠছে । কিন্তু রাগটা আমি প্রকাশ করতে পারছি না ! তখনই বাসা থেকে বের হয়ে এলাম । মোবাইল আর চাবি সব কিছুই টেবিলের উপরে রেখে এলাম । আর ঐ নাটকের টিকিট দুটোও । ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মানিব্যাগও নিলাম না । কেবল কিছু টাকা নিলাম পকেটে । লক করে চাবিটা আবার দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে ছুড়ে দিলাম ।
এরপর কতক্ষন হেটেছি আমি নিজেই জানি না । রাস্তার পাশেই একটা মাঝারী হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করতে করতে এই ওভার ব্রীজের উপরে এসে দাড়িয়েছিলাম । নিচ দিয়ে সাই শুই করে চলে যাওয়া গাড়ি দেখতে দেখতে কখন যে সময় কেটে গেল টের পেলাম না । এখন এই রাতের বেলা এই লোকটার সাথে কথা বলছি ।
আমি আরও কিছু জানতে চাইবো তখনই বুঝতে পারলাম কেউ ওভার ব্রীজের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছে । আমি অবশ্য খুব বেশি আমলে দিলাম না । এতোক্ষন অনেকেই আমাকে এভাবে এখানে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছে। তবে কিছু জানতে চায় নি । আমি প্রথম প্রথম তাদের দিকে তাকিয়ে তাদের বিশ্মিত হওয়াটা এনজয় করলেও সেটা এখন কমে এসেছে । তবে এই পায়ের আওয়াজ গুলো শুনে একটু সন্দেহ হচ্ছে । এক সাথে কয়েকজনের পায়ের আওয়াজ ।
যা ভেবেছিলাম তাই । পেছনে তাকিয়ে দেখি তিন জন পুলিশ এগিয়ে আসছে । আমার সামনে এসে দাড়ালো ।
তাদের চোখ দেখেই মনে হচ্ছে তারা আমার এখানে বসে থাকাটা ভাল চোখে দেখছে না ।
-আপনি ? এখানে ?
-বসে আছি । কিছুক্ষন পর ঘুমাবো ।
-এখানে ?
-জি !
-বাসা কোথায় ?
আমি জায়গার নাম বললাম !
-নাম কি ?
-নামটা বললাম
-এখানে কেন ?
-এমনি ! বাসায় কেউ নাই । একা একা ভাল লাগছিল না । তাই চলে এসেছি ।
লোকটা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমি ভেবেছিলাম আমাকে নিশ্চিত থানায় নিয়ে যাবে । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে দেখলাম আর কিছু জানতে চাইলো না । নিচে চলে গেল । আমি একটু উকি দিয়ে দেখলাম তাদের গাড়িটা ওভার ব্রিজের নিচেই দাড়িয়ে আছে । নেতা গোছের পুলিশ টা ওয়াকি টোয়াকি দিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে ।
যাক এটা ভাল দিক দিয়ে ভাল যে আমাকে ছোট ডাকাতের হাতে পড়তে হবে না । অবশ্য আমার কাছে দেওয়ার মত এমন কিছু নেই ও যে ছিনতাইকারী আমাকে ধরবে । আমি নিচের খবরের কাগজটা আরও একটু বিছিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম । পাশের লোকটা ততক্ষনে শুয়ে পড়েছে ।
-ভাইজান ?
-বলেন !
-আপনে মানুষটা আমার কাছে মজার মনে হইতাছে !
বললাম
-কেন ? এই কথা কেন মনে হইতেছে ?
-না মানে এই যে আপনে এইখানে চইলা আইলেন । অন্য কেউ হইলে এইডা করতো কন ? আইচ্ছা আপনের বউ কেমুন ?
-ভাল !
-তাইলে কি হইছিল কন তো দেখি !
-কি জানি । মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দেয় তার মাথায় !
-এইডা ঠিক কইছেন ভাইজান । মাইয়া মানুষ এমনিতে ভালা তয় মাঝে মাঝে এমুন ব্যাকা হয় আর সোজা হয় না । আমার দুইডা বউ আমি এই ব্যাকা হওয়ার জন্যই বাদ দিছি । জানেন তো ......
পাশের লোকটা আরও কয়েকটা কথা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই দেখলাম আবার সিড়ি দিয়ে কারো ওঠার শব্দ শুনতে পেলাম । লোকটঅ মনে হয় এই জন্য থামলো । আমি চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে দেখি একজন উপরে উঠছে । কেমন যেন পরিচিত মনে হল । আরেকটু ভাল করে তাকিয়ে দেখি আরে এতো সুমন । আমার খোজ পেল কিভাবে ?
সুমন আমাকে দেখে একেবারে দৌড়ে এল ।
-থ্যাঙ্ক গড ! আপনে এইখানে !
আমি আবার উঠে বসতে বসতে বললাম
-তুমি এইখানে কেন ?
-এইখানে থাকবো না আমি ? আপনি কি ছেলে মানুষ নাকি ? এই কাজ কেউ করে ?
-কি হয়েছে ? এমন কি হয়েছে বল ?
-দুলাভাই আপনার খোজে পুরো ঢাকা শহরে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে । আব্বা বের হয়েছে । বড় মামা আমি ছোট খালু সবাই !
ঢাকায় জেরিনদের আত্মীয়ের অভাব নেই আমি জানি । আমি বললাম
-কেন ? আমি কি হারিয়ে গেছি নাকি ? আশ্চর্য । বাসায় কেউ ছিল না তাই হাওয়া খেতে বের হয়েছি । সমস্যা কি ?
সুমন কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বলতে শুরু করলো । যে যা বলল তার সারমর্ম হল জেরিন পার্টিতে যাওয়ার পরেও আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে পায় নি । পাবে কিভাবে আমি তো ফোন রেখে এসেছি । শেষে না পেরে ও ১০ টার দিকেই বাসায় এসে হাজির হয় । ঘরে আমার কোথাও খুজে না পেয়ে এবং টেবিলের উপর আমার মোবাইল মানিব্যাগ আর নাটকের টিকেট দেখে বুঝতে পারে যে আমি রাগ করে বাসা থেকে চলে গেছি । তখনই ওর বাবা আর ছোট ভাই সুমন করে ফোন দেয় । তারপর সার্চ পার্ট শুরু !
সুমন বলল
-চলেন বাসায় চলেন ।
আমি বললাম
-এখানে আমার সমস্যা হচ্ছে না । আমি ঠিক আছি । কাল যাবো বাসায় । তুমি চাইলে এখানে শুয়ে পড়তে পারো আমার পাসে । ওভার ব্রীজ ঘুমানোর জন্য খারাপ না কিন্তু !
-আপু চিন্তা করছে আপনার জন্য । সেই তখন থেকে কাঁদছে ।
-আচ্ছা তোমার আপুর এতো চিন্তা থাকলে সে আমাকে ছেড়ে যেত না । আমি মানা করা সত্ত্বেও তার কাছে তার বন্ধুরা জরুরী হয়ে ওঠতো না ।
-দুলাভাই প্লিজ রাগ করে থেকেন না আর ! আব্বা এমনিতেও আপুকে সেই বকা দিয়েছে । আপনিও যদি এমন করেন !
-আরে বাবা সমস্যা নেই তো । আমি তো ঠিক আছি । আছি না ? সমস্যা কোথায় ?
সুমন আরও কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো । তারপর একটু দুরে গিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলো । নিশ্চয় জেরিনের কাছে কিংবা শ্বশুর মশাইকেই ফোন দিয়েছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি থাকেন আমি আসছি !
সুমন দ্রুত পারে নিচে নেমে গেল ।
আমার পাশের লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বললল
-যাইবেন গা এহন ?
-আরে না ! আজকের রাত এখানেই থাকবো । ডিসিশান ফাইনাল ।
আমার কথা শুনে লোকটা আবারও সেই দাত বের করে হাসলো । তারপর
-তয় একটা কথা কই ?
-বলেন !
-আমার ক্যান জানি মনে হইতেছে আপনার বউ এখনই আপনের কাছে এইখানে চইলা আইবো । নারী জাতি ঝামেলা পূর্ণ জাতি কিন্তু এরা বড় মায়া ভরা জাতি ! দেইখেন আইবো !
আমারও কেন জানি মনে হচ্ছিলো যে জেরিন ঠিক ঠিক চলে আসবে । আমাদের দুজনের ধারনাকে ঠিক করে দিয়ে আধা ঘন্টার ভেতরে ওভার ব্রীজের নিচে আবার সুমনের বাইক এসে থামলো । আমি নিচে না তাকিয়েই বুঝলাম সুমন একা আসে নি । কয়েক সেকেন্ড পরেই হিলের খটখট হাওয়াজ ভেসে এল ।
আমি তাকিয়ে দেখলাম জেরিন ওভার ব্রীজের মাথায় এসে দাড়িয়েছে । আর এগুলো না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অশ্রুশিক্ত চোখে । ওভার ব্রীজের যে কম পাওয়ার আলো জ্বলছে সেটাতে ওর চোখের জল চিকচিক করতে লাগলো ! একবার মনে হল এভাবেই বসে থাকি । কিন্তু পরে মনে হল থাক । অনেক হয়েছে । নিশ্চয়ই ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে । এবার আমার যাওয়া দরকার । আজকে রাতের জন্য মেয়েটার যথেষ্ঠ শিক্ষা হয়েছে !
আমি উঠে দাড়ালাম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪১