ভোর বেলা এমন একটা সময় যখন কেউ যদি আমার কাছে এসে বসে অপু সাহেব উঠুন আপনাকে লাখ টাকা দেওয়া হবে ! আমি তাকে চোখ না খুলেই বলব দুরে গিয়া মর ব্যাটা ! সেই আমি যখন ফোন কানে নিয়ে বিরক্ত হয়ে হ্যালো বললাম তখন ওপাশ থেকে একটা মাত্র শব্দ আমার সকল ঘুম নিমিশের ভেতরে গায়েব করে দিল !
আরিন কেবল মাত্র একবার বলেছে হ্যালো !
আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম যে এতো দিন পরেও আমি ওর গলা একদম পরিস্কার মনে রেখেছি !
আমি আরেকবার ফোনের নাম্বার টা দেখলাম ! ততক্ষনে আমার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে ! একবার মনে হল স্বপ্ন দেখছি না তো ! ও চলে যাওয়ার পরে বেশ কয়েকবার ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু এতো স্পষ্ট কখন মনে হয় নি !
আরিন আবার বলল
-হ্যালো ! অপু ! কেমন আছো ?
কেমন আছো ?
এই নয়মাস পরে আমার খোজ নিতে মনে পড়লো !
আমি বলতে গেলে চিৎকার করে বলে উঠলাম
-থাপ্পাড় দিয়ে তোমার দাঁত খুলে ফেলবো ফাজিল মেয়ে ! এতো দিন পরে এই ভোর বেলা ফোন দিয়ে বলছো আমি কেমন আছি !
ফাজলামি পেয়েছো বদ মেয়ে ! একবার তুমি কেবল আমার সামনে এসো ! তারপর তোমাকে আমি মজা দেখাবো !
আমি ফোনের ওপাশে ওর হাসির আওয়াজ পেলাম !
-আবার হাসছো ! সিরিয়াসলি আমার সামনে আসো তোমাকে ...... তোমার সিওর খবর আছে !
-রাগ করেছো আমার উপর ?
-না রাগ করবো কেন ? আদর করবো ?
-মিস কর নি ?
আরে এই মেয়ের সমস্যা কি ! আমি এতো এতো চিৎকার করছি আর ও যেন মজা পাচ্ছে !
-নাহ ! তোমাকে মিস করবো কেন ? ঐ যে তোমার বাসার পাশে যে সুন্দর মত মেয়ে টা থাকতো না ওকে খুব মিস করেছি !
-তাই ? তা যেতা ওর কাছে ! ও আর হারিয়ে যায় নি আমার মত !
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম ! আমার মাথার ভেতরে কত গুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ! কোন আগা মাথা খুজে পাচ্ছি না ! আরিন আমার সাথে এমন কেন করলো ! আর যদি ঠিকই করে রাখে তাহলে আমার সাথে আবারও কেন যোগাযোগ কেন করলো ?
আরিন বলল
-শুনো তোমার মেইলে একটা মেইল গেছে ! ঠিক আছে ! ওটা ওপেন কর !
-ওসব পরে হবে !
-আহা শুনো না ! প্লিজ একটু শান্ত হয়ে শুনো ! আমাকে যা ইচ্ছা কর ! কিন্তু এখন যা বলছি শুনো !
-বল !
-ঐ মেইলে একটা টিকেট আছে ! আর কিছু কাগজ পত্র আছে ! ঠিক আছে ! তুমি এই সকাল বেলাতেই এম্বাসিতে যাবা ?
-মানে ?
-মানে অস্ট্রেলিয়ান আম্বাসিতে !
-কেন ?
-আরে গাধা আমার সাথে দেখা করবা না !
-দেখা তো করবোই ! তোমার দাঁত ফেলতে হবে না ?
-ঐ তো !
-তুমি কোথায় এখন ?
-সিডনিতে !
-সে কি ! কেন ?
-এখানে আমার মা থাকে !
-তোমার মা না আগে ইউ এস এ তে ছিল !
-ছিল মুভ করেছে ! আমার জন্য !
-কেন ?
-আহা এতো কেন কেন করছো কেন ? তোমার সব প্রশ্নের উত্তর এখানে এসে পেয়ে যাবা ! আমি টিকেট পাঠিয়েছি ঐ মেইলেই ! কাগজ পত্র গুলো দেখালে আশা করি ভিসা হয়ে যাবে ! ঠিক আছে ! রাখছি এখন, আমাকে এখন রাখতে হচ্ছে ! বাই !
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না ! আরিন হঠাৎ করেই এমন কেন করলো আমার সাথে ! ৮ টা মাস আমার থেকে এভাবে দুরে থাকার পরে আজকে বলছে সে সিডনিতে আছে । আমার জন্য টিকেট পাঠিয়ে বলছে চলে আসতে !
আমি মেইল চেক করলাম ! আসলেই ও যা যা বলেছে সব চলে এসেছে ।
সকালে এম্বাসীতে গেলাম ! আশ্চার্য ভাবেই দেখলাম কাজ হতে লাগলো দ্রুত ! এটো দ্রুত কাজ হয় না স্বাধারনত ! হয়তো আরিন ওখান থেকে ব্যবস্থা করেই রেখেছিল তাই এতো দ্রুত হল সব কিছু ! নয়তো হত না !
অফিসের সব থেকে গম্ভীর এম্লোয়ী হিসাবেই অরিন পরিচিত ছিল ! গম্ভীর সাথে বদমেজাজী ! সবাইকে সব সময় বকাবকি করছে ভুল ধরছে ধকাচ্ছে ! সহ্য না করে উপায় ছিল না । ওর পোস্টাই এমন ছিল ! অফিসের এক সেমিনার আয়োজন হল কক্সবাজারে । প্লান হল সেখনে একটা ট্রেনিং হবে, সাথে অফসি পিকনিক ! সবাই হাজির কেবল আমি ছাড়া ! আমার নিজের কক্সবাজারে একটু এলার্জি ছিল ! একটা ব্যক্তিগত কারন ছিল ! আমি গেলাম না !
পিকনিক শেষ করে দেখলাম আরিন আর আগের মত সবাইকে ধকাচ্ছে না ! একটু যেন ইজি হয়ে গেছে সবার সাথে । যাই হোক আমাকে কেবিনে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার না যাওয়ার কারন জানতে চাইলো ! বললাম
-নিজের ব্যক্তিগত !
-সবাই আপনাকে খুব মিস করছিল ! আপনি নাকি চমৎকার গান করেন ! আমরা আপনার গান মিস করেছি !
আমি কিছু না বলে হাসলাম একটু !
আরিন তারপর বলল
-কারন টা কি বলা যাবে ? যদি খুব বেশি পার্শনাল না হয়ে থাকে !
ঠিক বুঝলাম না আরিন হঠাৎ করেই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এতো আগ্রহ কেন দেখাচ্ছে ঠিক বুঝলাম না ! তারপর মনে হল বলেই দেই !
-আসলে আমার একজনের সাথে সমুদ্র সৈকত টা দেখার কথা ছিল ! একজনের হাত ধরে !
-তারপর ?
-কথা দিয়েছিলাম তার হাত না ধরে কোন দিন কক্সবাজারের সমুদ্রে দেখবো না !
-সে কোথায় ?
-অন্য কারো সাথে আগেই সমুদ্র দেখে ফেলেছে !
-আর আপনি ? এখনও মুভ করেন নি ?
-সবাই সব কিছু পারে না ! আরও ভাল করে বললে ......।
কথাটা শেষ না করে চুপ করে রইলাম কিছু সময় !
আরিনও কিছুসময় চুপ করে থেকে বলল
-আসলে আমাদের সবার জীবনেই এমন কষ্টের ঘটনা গুলো আমাদের কে বেঁধে রাখে ! মুভ করতে দেয় না । তাই না ?
কৌতুহল থেকেই বললাম
-আপনার জীবনেও আছে নাকি এমন কিছু ?
আরিন জবাব দিল না ! কেবল অন দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় !
পিকনিকে গিয়ে নাকি আরিন সবার সামনে গানের তালে তালে নেচে ছিল ! সবাই তো অবাক ! তাদের ম্যাম এমন হতে পারে তারা ভাবতেও পারে নি । সবার শেষে এতো বলেছিল সে তার আগের জীবন টা পাল্টাতে চাচ্ছে ! ঐ জীবনে নাকি ক্লান্ত হয়ে উঠেছে ! অফিসে সবার সাথেই তার আস্তে আস্তে ভাব হয়ে উঠলো ! আমার সাথে যদিও কথা কম বলতো তবুও কথা হত মাঝে মাঝে !
একদিন অবাক করার মত একটা কাজ করলাম ! আমি রিক্সা নিয়েছি বাসায় যাবো ! অফিসের ঠিক সামনেই আরিনের গাড়ি জ্যামে আটকে আছে ! আমার রিক্সাটা থামলো ঠিক তার পাশেই ! কাঁচ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো ! তারপর কাঁচ নামিয়ে বলল
-এদিকে কোথায় ? আপনার বাসা কি এদিকে নাকি ?
-হুম ! এদিকেই !
-আসুন ! গাড়িতে আসুন ! আমি নামিয়ে দেই !
আমি হেসে বললাম
-তার চেয়ে বরং আপনি গাড়ি থেকে নেমে রিক্সায় আসুন ! আকাশের অবস্থা ভাল না । যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে । দেখবেন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফেরায় কি মজা !
আমি এমনি সিরিয়াসলি বলি নি ! এমনি কথার কথা বলেছি ! কিন্তু সত্যি সত্যি চলে আসবে আমি ভাবি নি ! আমাকে অবাক করে দিয়ে আরিন আমার রিক্সায় উঠে এল !
জ্যাম ছেড়ে যাওয়ার পরপরই শুরু হল বৃষ্টি ! পুরাতন বেইলি রোড দিয়ে আমার রিক্সা ছুটে চলেছে তীব্র বৃষ্টির মধ্যে । আমার পেছন পেছন আরিনের গাড়ি আসছে । আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজছি ! মাঝখানে আরিন রিক্সা থামিয়া রাস্তার উপর বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো ! মানুষজন অবাক হয়ে আমাদের দেখছে । ভাবছে ফরলাম পোষাকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বৃষ্টির ভেতরে কি করে ! নিশ্চয় তারা আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা ভাবছে।
অবশ্য আরিনের সেদিকে লক্ষ্য নেই ! সে যেন অন্য জগতে রয়েছে ।
প্রায় ঘন্টা খানেক ভেজার পরেও বৃষ্টি থামলো না ! বরং আরও বাড়লো ! সেই সাথে তীব্র বাতাস ! আকাসে মেঘ ডাকতে লাগলো আরও জোড়ে ! আমরা যখন আরিনের বাসার সামনে এসে থামলাম তখন রীতিমত ঝড় শুরু হয়ে গেছে ।
আমি ওকে নামিয়ে দিয়ে বললাম
-আচ্ছা তাহলে আসি !
আরিন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-থেঙ্কিউ !
-কেন ?
-এই বৃষ্টিতে ভিজতে ডাকার জন্য ! কবে শেষ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম মনে নেই !
-আচ্ছা আসি !
-বাইরের অবস্থা দেখেছেন ! আপনার বাসা কোথায় ?
-এই তো কাছেই ।
-কোথায় ?
-মোহাম্মাদপুর ।
-মোহাম্মাদ পুর !!!
আরিন কেবল অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে ! মোহাম্মাদপুর আপনার কাছে কাছে মনে হল ! এদিকে কেন তাহলে !
-একটা কাজে যাচ্ছিলাম !
-শুনুন এখন অতদুর যেতে হবে না ! আপনি বাসায় আসুন ! ঝড় থামলে তারপর যাবে ! আসুন !
-আরে না ঠিক আছে ! সমস্যা হবে না !
-হবে ! এই ভেজা কাপড়ে এতোদুর গেলে জ্বর চলে আসবে ! তারপর কাল অফিস কামাই !
আরিন আমাকে জোর করেই নিয়েই গেল !
নয়তলার একটা ফ্ল্যাটে আরিন একাই থাকে । আমার জন্য তোয়ালে, টিশার্ট আর ট্রাইজারও নিয়ে এল ! এগুলো নাকি ওর এক্স হাজব্যান্ডের ! আগেই শুনেছিলাম যে ওর ডিভোর্স হয়েছে । তাও অনেক দিন আগেই নাকি !
আমি যখন গা মুছে বাইরে বের হয়ে এলাম দেখি আরিন আগেই বের হয়ে এসেছে ! টিভির ঘরের টি টেবিলের উপর চায়ের কাপে ধোয়া উড়ছে । আমি বসতে বসতে আরিন এসে পাশে বসলো ! ঝড় হলেও দেখি এদিকে কারেন্ট ঠিকই আছে । আমাদের এলাকায় অবশ্য ঝড় বৃষ্টির দিনে কারেন্ট থাকার নিয়ম নেই !
আরিন যেন আমার মনের কথাই ঠিক ঠিক ধরে ফেলল !
বলল
-কারেন্ট নেই । আই পিএস ।
-ও তাই বলেন । আমাদের এলাকায় কারেন্ট থাকে না এই সময় । সেই সময় আমরা মোমবাতি জ্বালাই । কেন জানি পুরো সময়ের ভেতরে এই সময়টাতেই অন্য রকম লাগে ।
-তাই ?
-হুম !
-আচ্ছা দাড়ান !
এই বলেই আরিন ভেতরে চলে গেল । ফিরে এল বেশ কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে । তারপর সেগুলো ঘরের কয়েক জায়গায় জ্বালিয়ে দিয়ে আইপিএস এর লাইণ বন্ধ করে দিল ।
মোমের আলোতে চারিদিকে কেবল একটা রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল !
আমি হঠাৎ করেই বললাম
-আমাদের প্রায়ই আগে এরকম জিনিস নিয়ে কথা হত ।
-কি রকম ?
-না মানে সেই সমুদ্র কন্যার কথা বলছি । তার খুব পছন্দের ছিল এই মোমের আলো । বলতো মোমের আলোতে সে রাতে আমার সাথে প্রতিদিন ডিনার করবে । মানে ক্যান্ডেল টাইট ডিনার আর কি ! কত কিছু করার প্লান ছিল বিয়ের পর । কিন্তু .....
-আসলেই মানুসের প্লান মাফিক কিছু হয় না তাই না ?
-হুম ! এই যে দেখেন প্লান ছাড়া আজকে বৃষ্টিতে ভেজা হল ! তারপর আপনার সাথে বসে চা খাওয়া হচ্ছে । ভাল হচ্ছে না !
কিছু সময় আবারও দুজন চুপ করে রইলাম । আসলে কি বলবো খুজে পেলাম না ! দেখলাম আরিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল । আমিও গেলাম পেছন পেছন । তখনই বাইরে বেশ ঝড় হচ্ছে । দুজন কিছু সময় চুপ থাকার পরেই হঠাৎ করেই আরিন বলল
-আমি চার চার বার বাচ্চা কনসিভ করেও রাখতে পারি নি ! কেন পারি নি কেউ বলতে পারলো না ! ডাক্তারেরা বলল আমি নাকি আর পারবো না ! এর বেশি ট্রাই করলে নাকি আমার শরীরের জন্য ভাল হবে না ! তারা সার্টিফিকেট দিয়ে দিল ! সেই সাথে আমার হাজব্যন্ড আর শ্বাশুড়িও !
-কি !
-আমাদের সমাজে মেয়েরা বাচ্চা জন্ম দিতে না পারলে সেটাকে বড় অন্যায়ের কাজ মনে করা হয় । যেন দোষ টা মেয়ের নিজের ।
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ! আরিন বলল
জাভেদ কে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম । যদিও ওর মায়ের তাতে মত ছিল না । এবার সে সুযোগ পেয়ে গেল । সেই সাথে জাভেদেরও বদলে যেতে দেখলাম !
আরিনের কন্ঠস্বর শুনে মনে হল ও হয়তো কাঁদছে । তাকিয়ে থাকি ওর দিকে । সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-না ! আমি কাঁদছি না ! অনেক আগেই সেটা বন্ধ করে দিয়েছে ! কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না ! আমি মুভ করছি ! আপনারও উচিৎ মুভ করা ! ঠিক আছে । তার সাথে সমুদ্র দেখতে পারেন নি তো কি হয়েছে অন্য কারো সাথে দেখবেন !
ঐ দিন রাতে আরিনের বাসায় থাকতে হল । রাত এমনিতেই অনেক হয়েছিল । ঐ দিন অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম ! আমার অতীত ছোট বেলার কথা আরও কত । কত কথা দুজনের জমা ছিল জানতাম না ! আরিনেরও মনে হয় কথা বলার মানুষ পেয়ে সব কিছু বলতে লাগলো !
ফ্রিজে রান্না করা খাবার ছিল কি মনে হল আবার দুজন নতুন করে রান্না করতে বসলাম ! দুজনের ভেতরেই একটা অস্বাভাবিকত্ব কাজ করছিল । আমরা কেন এই কাজ গুলো করছিলাম আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা ছিল না । কেবল ভাল লাগছিল তাই করছিলাম !
তারপর আমরা মুভি দেখতে বসলাম । শোফায় না বসে দুজনেই কার্পেটের উপর বসলাম ! একদম কাছাকাছি !
এইচবিও শ্যা শাইনিং নামে একটা ভুতের মুভি দেখাচ্ছিল !
আরিন বলল
-আমি এই মুভি দেখবো না !
-আরে কেন ?
-না না ! আমি এই মুভি দেখলে রাতের বেলা ঘুমাতে পারবো না ! প্লিজ সরান !
-না ! এটা তো সরানো যাবে না ! খুব চমৎকার মুভি ! দেখেন মজা পাবেন !
আরিন আমার হাত থেকে রিমোর্ট কেড়ে নিতে চাইলো । কিন্তু পারলো না । তবে হাল ছেড়ে দিল না ! আমি ও রিমোর্ট নিয়ে টানা টানি শুরু করে দিয়েছি ! ঠিক তখনইখুব ভয়ংকর দৃশ্য দেখা গেল স্ক্রিনে । একটা হিম শীতল চিৎকার ভেসে এল । এমনিতেই লাইট অফ ছিল ! খাওয়ার পরে আমরা লাইট অফ করে দিয়েই টিভি দেখতে বসেছিলাম ! এই চিৎকারে আরিন সত্যি সত্যিই ভয় পেল ! রিমোর্ট ছেলে দিয়ে আমার দিকে আরও ঘেষে এল ! তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে আমি কি করবো ঠিক বুঝলাম না ! টিভির আলোতে ওর চোখের চাহনী দেখে আমার বুকের ভেতর টা কেমন করে উঠলো ! আমি বলে বোঝাতে পারবো না !
কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে যাবে আমি ভাবি নি ! আরিনও নিশ্চয়ও ভাবে নি ।
অফিসের ভেতরে আমাদের সম্পর্ক আগের মত থাকলেও বাইরে আগের মত থাকলো না ! সত্যি বলতে কি পরের এক মাস আমি বাসা আর অফিস একটা মিনিটের জন্য আরিন কে চোখের আড়াল করি নি । অফিসে আমরা একই সাথে যেতাম আসতাম একই সাথে । নিজের বাসা রেখে আমি ওর বাসায় থাকতে লাগলাম ! আরিন বলেছিল অন্য কারো সাথে মুভ করতে তাই বলে ওর সাথে আমি সামনের দিকে মুভ করবো সেটা ভাবি নি !
একদিন আমার হাতে দুইটা কক্সবাজারের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলল
-যাবে ?
-সমুদ্রে ?
-হুম ! আমাকে সমুদ্র কন্যা না বানাও অন্তত হাত ধরে একটা বার সমুদ্র কি দেখা যায় আমার সাথে ?
এক সপ্তাহে পরে টিকিট ছিল ! আমি যে ওয়াদা করেছিলাম সেটা ভেঙ্গে ফেলবো ঠিক করলাম ! সত্যি যে আমার জন্য অপেক্ষা করে তার জন্য নিজের আনন্দ নষ্ট করবো কেন ? নিজের বেঁচে থাকাটা কেন অন্যের জন্য নষ্ট করবো !
সোম বারে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল ! আমি মাঝে এক দিনের জন্য বাসায় গিয়েছিলাম কাজে । বাসা থেকে মা ফোন করেছিল ! কি একটা জমি নিয়ে নাকি সমস্যা হচ্ছিলো ! আরিন কে বলেছিলাম যে আমি বাসা থেকে এসেই আমরা যাবো এক সাথে !
কিন্তু বাসা থেকে এসে আমি একেবারে আকাশ থেকে পরলাম ! আরিনের ফোন বন্ধ পেলাম ! তারপর অফিসে এলে শুনলাম ও নাকি রিজাইন করে চলে গেছে ! এক দিনের মাথায় এমন কিছু হবে আমি ধরনাই করতে পারি নি !
কি এমন হয়ে গেল যে একেবারে চাকরী ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে !
ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি সেখানে তালা মারা !
পরপর আরও সাত দিন গেলাম । কোন খোজ নেই ! আশ্চার্য্যজনক ভাবে আরিন আফসিন আমার জীবন থেে হারিয়ে গেল দুম করে ! আমি আজকের আগ পর্যন্তও ওর কোন খোজ খবর পাই নি ! কোন উত্তরও পাই নি !
সিডনি এয়ারপোর্টে ভেবেছিলাম আরিন আমাকে নিতে আসবে কিন্তু তার কোন খোজ খবর নেই । এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম তখন কেউ একজন আমার পেছনে এসে আমার কাধে হাত । ফিরে তাকিয়ে দেখি এক মহিলা ! চেহারা একটু চেনা চেনা লাগলো !
-তুমি অপু ?
এইখানেও বাংলা শুনবো ভাবি নি ! তখনই মনে হল এই মাঝ বয়সী নারীকে আমি চিনি !
আমি বললাম
-জি !
-আমি আরিনের মা !
-আমি বুঝতে পারছি ! ও কোথায় ?
-হাসপাতালে ।
-কি হয়েছে ?
বারবার মনে হল কোন দুর্ঘটনা কি ঘটলো ! এই জন্য কি আরিন না এসে ওর মা এসেছে !
-চল !
এয়ারপোর্ট থেকে হাসপাতালের রাস্তা টুকু আমাদের মাঝে কোন কথা হল না । আমি তখনও চিন্তায় বাঁচি না ! এদিকে আরিনের মায়ের ভাব দেখে মনে তিনি কিছু বলবেন না ! যখন করিদোরে পা রাখলাম তখনও জানি না কি দেখবো কি অবস্থায় দেখবো ওকে । আট মাস পরে ওর দেখতে কেমন হয়েছে কে জানে !
আরিনের মা আমাকে একটা কেবিনে নিয়ে এল । প্রথম পা দিতেই কেমন অদ্ভুদ একটা অনুভুতি হল ! বেডের দিকে তাকিয়ে দেখি আরিন সেখানে শুয়ে আছে । আগের থেকে একটু যেন ফর্সা হয়েছে । হয়তো আবাহাওয়ার কারনে ! আরেকটু এগোতেই আমি থেমে গেলাম ! আরিনের ঠিক পাশেই একটা সাদা তোয়ালেতে একটা ছোট্ট শিশু শুয়ে আছে !
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ! আস্তে গিয়ে ওর বেডের পাশে গিয়ে বসলাম ! আমার মনে তখনই হাজারও প্রশ্ন ! কি হচ্ছে এখানে ? আরিন এখানে কেন ?
আর এই ছোট্ট শিশু টা ওর পাশে কেন শুয়ে আছে ?
এটা কে ?
আরিনের মা বলল
-তোমার মেয়ে !
-আমার !!
আমি তো বিয়েই করি নি ! ঠিক তখনই আমার কাছে সব কিছু আস্তে আস্তে পরিস্কার হয়ে এল । কিন্তু আমাকে না জানিয়ে এতো আসার কি দরকার ছিল ! একবার আমাকে বলাটা কি অরিনের দরকার ছিল না !
আরিন চোখ মেলেছে ততক্ষনে ! আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু !
আমি কেবল বললাম
-তুমি আমাকে একবার বলতে পারতে ?
-পারতাম ! কিন্তু ..... বলতে পারি নি !
-তাহলে এখন কেন বললে ?
আরিন কিছু সময় চুপ করে থেকে বললাম
-কেন জানি মনে হয়েছিলো যে আমি হয়তো মারা যাবো ! তখনই আমার মেয়ের কি হবে ? কে দেখবে ? দেখবে তো তুমি ?
-মারা যাচ্ছো তুমি ?
আরিন কোন কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ! আমি বললাম
-তোমার না চড় মেরে দাত ফেলে দেওয়ার কথা ছিল আমার ! এসব ধানাই পানই বন্ধ ! আগে আমি তোমার কাছে আমার আট মাসের হিসেব চাই ! তোমার খবর আছে । সত্যি সত্যি ! আগে একটু সুস্থ হও ! তোমার.....
আচ্ছা ভাল । খবর কর ! আগে আমার মেয়ে একটু কোলে নাও !
-আমার মেয়ে ! কেবল তোমার একার মেয়ে !
-তো ?
-আবার ! একে তো এতো দিন আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে অন্যায় করেছো তার উপর আবার ......
আরও কথা চলতে থাকে । বোধ করি আরিনের মনের ভেতরে যে হীনমন্যতা ছিল সেটা আর নেই ! ওর চেহারা দেখেই সেটা বেশ ভাল করেই বোঝা যাচ্ছিলো ! আমি আমাদের মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বললাম
-আর এভাবে হারিয়ে যেও না কেমন ! আমাদের এখনও সমুদ্র দেখা বাকি !
-হুম ! এবার আমরা আমাদের জলপরীর সাথে সমুদ্র দেখতে যাবো ! ঠিক আছে !
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৮