আলী আকবার কখন যে নিজের মেয়ের গালে ঠাশ করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন নিজেই ঠিক মত বলতে পারবেন না । এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, কি করছেন তার সবটুকুর উপর তার নিজের নিয়ন্ত্রন নেই ।
চড় মারার আওয়াজটা এতো জোরে হল যে রান্না ঘর থেকে আলী আকবার সাহেবের স্ত্রী সায়রা বানু দৌড়ে এলেন ! এসেই জানতে চাইলেন
-কি হয়েছে ?
আলী আকবার এখনও ঠিক মত সুস্থির হতে পারে নি । তিনি ঠিক মত বিশ্বাসই কারতে পারছেন না তার শান্তশিষ্ট মেয়ে নিশি তার সামনে দাড়িয়ে এমন কিছু বলে ফেলেছে !
নিশি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল
-মা কিছু হয় নি । বাবা আমাকে একটা চড় মেয়েছে !
সায়রা বানু মুখটাতে আরও বেশি হা করে বললেন
-সেকি ! কেন ? চড় মারবে কেন ?
-এটা তুমি বাবার কাছেই শুনে নিও ।
নিশি আর কোন কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল । তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে তেমন কিছুই হয় নি । এভাবে চড় খাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক !
নিশি চলে যাওয়ার সাথে সাথে সায়রা বানু তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল
-মেয়েটা কে এতো জোরে মারলে কেন ?
-মারলাম কেন ? ওকে ..... ওকে ........
আলী আকবার ঠিক মত কথা বলতে পারছেন না । তিনি আসলে বুঝতে পারছেন না তিনি কিভাবে কথাটা বলবেন । তার নিজেরই কথাটা ঠিক হজম হচ্ছে না ।
প্রতিদিন কার মত তিনি সকালে নাস্তা করে চা খাচ্ছিলেন এমন সময় নিশি তার সামনে এসে বলল
-বাবা তুমি কি আমার জন্য ছেলে দেখছো ?
আলী আকবার একটু চমকে গেল । নিশি অন্য মেয়েদের মত সব বাবাদের কাছে জিজ্ঞেস করার মত মেয়ে না । তিনি এতো দিন পোষাক থেকে শুরু করে যে স্কুল কলেজ ঠিক করে দিয়েছেন নিশি কোন প্রকার বাক্য ব্যয় না করে সেটা মেনে নিয়েছে । কোন দিন কোন প্রশ্ন করে নি । কিন্তু আজকে হঠাৎ এমন কথা কেন জানতে চাইলো ।
আলী আকবার সাহেব বলল
-হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ?
-দেখছো কি না বল ?
-মেয়ে বড় হলে সব বাবাই মেয়ের জন্য ছেলে দেখে !
-দেখো না !
আলী আকবার একটু যেন ধাক্কার মত খেলো ! তিনি ঠিক বুঝতে পারলো না তিনি কি বলবেন !
নিশি তার হাতে ধরে রাখা একটা ছবি বাবার সামনের টি টেবিলে রাখলো !
আলী আকবার টেবিলের উপর রাখা ছবিটা দেখলো সেটা একটা ছেলের ছবি । তবে ছেলেটার পাশে তার নিজের মেয়ে নিশিও রয়েছে ।
নিশি বলল
-আমি এই ছেলে কে বিয়ে করবো !
-এই ছেলে কে বিয়ে করবো মানে ?
আলী আকবার যেন গর্জে উঠলো । কিন্তু আলী অবাক হয়ে দেখলেন নিশি তার গর্জনে বিন্দু মাত্র ভয় না পেয়ে বলল
-এই ছেলে মানে এই ছেলেকেই ! অন্য কাউকে না ! যদি জোর কর তাহলে আমার ঘরে ৪১ টা ঘুমের ঔষধ আছে সেগুলো আমি এক সাথে খেয়ে ফেলবো !
আলী আকবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ! উঠে গিয়ে নিশির গালে চড় বসিয়ে দিল ! এবং চড় মারার পর অবাক হয়ে দেখলেন নিশি তাতে বিন্দু মাত্র বিচলিত হল না ! নিশির চোখের দিকে তাকিয়ে আলী আকবারের নিশিকে খুব বেশি অচেনা মনে হল । তার মনে হল সে তার মেয়েকে চিনে না ! যেন কোন অচেনা মেয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে ।
-----
-তুমি সত্যি বলেছো তোমার বাবাকে ?
-হুম !
-তিনি কি বললেন ?
-কিছু না ! আমার গালে একটা চড় মারলেন ! তারপর বড় বড় দম নিতে লাগলেন !
অপু বুঝতে পারছে না সামনে বসা মেয়েটাকে সে কি বলবে ? এই কদিনেই মেয়েটা কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠেছে । বিশেষ করে সাহসের দিক দিয়ে ! অপুর নিজেরই কেমন ভয় লাগতে শুরু করেছে ।
আগে মেয়েটা কেমন শান্ত আর ভিতু ছিল । সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতো ! আর এখন মেয়েটা কেমন করে তাকায় । তার তাকানোর ধরন টা বদলে গেছে ।
নিশি বলল
-শুনো ছেলে আগামী কাল তুমি বাবার সামনে গিয়ে দাড়াবে ।
-তারপর ?
-তারপরপ কি ? কথা বলবে । বাবা যা জানতে চাইবে তার উত্তর দিবে !
-যদি আমাকে তার পছন্দ না হয় ?
-সেটা পরের ব্যাপার ! তোমাকে যা করতে বলছি তাই করবে !
-আচ্ছা !
নিশি অপুর দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা কেমন যেন কনফিউজড হয়ে গেছে । কেমন ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে । নিশির অপুর এই তাকানোটা দেখতে বেশ ভালো লাগছে । কথা জোরে অবশ্য বলা যেত কিন্তু বললে ছেলেটা নিশ্চই আরও একটু কনফিউজড হয়ে যাবে ! নিশি মনে মনে বলল শোন ছেলে তোমাকে ছাড়া আমার কিছুতেই চলবে না ! কিছুতেই না !
------
-তা বিয়ের পর আমার মেয়েকে খাওয়াবে কি ?
অপু কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ! নিশির বাসায় এসেছে মিনিট পাঁচেক হল ! এর ভিতরেই নিশির বাবার প্রশ্ন শুরু হয়েছে ।
-কি কর ?
-কোথায় থাকো ?
-বাবা কি করে ?
-নিশির সাথে কত দিন ধরে পরিচয় ?
অপু কোন প্রশ্নের ঠিক মত জবার দিতে পারছে না । কথা বলার সময় তার গলা কাঁপছে । ভাইভা বোর্ডে গিয়েও তার এতো ভয় কোন দিন লাগে নি !
অপু কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশি ঘরে ঢুকলো । হাতে নাস্তার ট্রে !
ওকে দেখে অপুর বুকে যেন একটু বল এল ! নিশি ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় একটু হাসলো !
নিশির দিকে তাকিয়ে আলী আকবার অপুর সামনেই বলল
-এই ছেলে আমার পছন্দ না !
নিশি আবারও শান্ত কন্ঠে বলল
-বাবা, তোমার পছন্দ হচ্ছে না কারন তুমি তাকে পছন্দের চোখ দিয়ে দেখোই নি । তুমি তো ওর আসার আগেই ওকে অপছন্দ করে বসে আছো !
কথা সত্যি ! তিনি আসার আগে থেকেই অপুকে অপছন্দ করে বসে আছেন । পরিবারের তার উপর কেউ কথা বলবে তিনি এটা মেনে নিতেই পারছেন না । কিন্তু তিনি খানিকটা ভয়েও আছেন নিশির কথার বিপরীতে তিনি কিছু বলতেও পারছেন না । মেয়েটা এই দুদিনেই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে । তিনি কিছুতেই আগের মত জোর দিয়ে নিজের মেয়েকে কিছু বলতে পারছেন না । পাছে মেয়েটা অন্য কিছু করে ফেলে । কেবল বুড়ো সিংসের মত কেবল হুংকার ছাড়তে লাগলেন তাও কেবল মনে মনে !
নিশি বলল
-মায়ের তো অপুকে পছন্দ হয়েছে বেশ !
আলী আকবার বলল
-মানে কি ?
-মানে হচ্ছে নিশি এর প্রথম এ বাড়িতে আসে নি । মায়ের সাথে এর আগেও দেখ করে গেছে ।
-ও আচ্ছা ! তাহলে তলে তলে এতো দুর....।
ততক্ষনে সায়রা বানু বসার ঘরে চলে এসে দাড়িয়েছে । তিনি কিছুটা সময় নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর নিজের কাছে খানিকটা অসহায় বোধ করলেন ! তিনি বুঝলেন এতো দিন কেবল তিনি মনেই করতেন তার পরিবার তার কন্ট্রলে আছে । কিন্তু বাস্তবতা তো অন্য কিছু !
নিশি হঠাৎ আলী আকবারের পাশে গিয়ে বসলো ! তারপর তার হাত ধরে বলল
-বাবা, আমি সারাটা জীবন তোমার কথা মত চলে ছি ! তুমি যা চেয়েছো তাি শুনেছি ! আজকে আমার কথা টা শুনো একটু ! প্লিজ !
-----
অপুর আসলেই একটু একটু ভয় ভয় করছে । নিশি মেয়েটার ভেতরকার এরকম হঠাৎ পরিবর্তন তার ভয়ের প্রধান কারন ! মেয়ের চোখের ভাষাও কেমন বদলে গেছে ।
তার উপর আরেকটা ভয়ের কারন টা হচ্ছে নিশির বাবার ওর কাছ থেকে ওর বাবার নাম্বার নিয়েছেন । নিশির সামনে ও কিছুতেই সেটা না দিয়ে পারে নি । অবশ্য অপুর মা নিশিকে চেনে । কিন্তু বাবাকেই অপুর সব থেকে বড় ভয় ! নিশিতো ওর বাবার সামনে ঠিকই সাহস দেখিয়েছে । অপু কি পারবে সেই সাহস দেখাতে !
-এই নাও !
পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশি দাড়িয়ে । ওর হাতে একটা সাদা চায়ের কাপ !
অপুর হাতে কাপ টা দিতে দিতে বলল
-তোমার আব্বাকে ফোন করা হয়েছে । ওনারা আসছেন !
-বুঝতে পারছি !
-তুমি কি ভয় পাচ্ছো ?
-পাওয়া কি স্বাভাবিক না ?
-ও !! বাবুটা ভয় পেও না ! আমি আছি না !
অপু মনে মনে বলল "তুমি আসো এই জন্যই তো ভয় পাচ্ছি"
নিশি বলল
-এই মনে মনে কি বললা তুমি ?
-কিছু বলি নি তো ! কিচ্ছু না !
-তাই না ? যা ইচ্ছে বলে নাও । বিয়ের পরে মনে মনেও কিছু বলতে পারবে না বলে দিলাম !
এই বলে নিশি খুব জোরে হেসে ফেলল ! এটো জোরে হাসতে লাগলো যে নিশির হাসি দেখে অপুর কেন সব ভয় নিমিষেই দুর হয়ে গেল । মনে মনে বলল যে মেয়ে এরকম ভাবে প্রাণ খুলে হাসতে পারে সেই মেয়ে পাশে থাকলে কোন ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই !
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৪:০৫