টেবিলে দুইটা প্লেটে ভাত দেখে দেখে রিফাত একটু অবাক হয়ে তার কাজের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো
-দুইটা প্লেট কেন ?
-আফাও খাইবো !
রিফাত এবার বেশ খানিকটা অবাক হয়ে বলে
-তোর আপা বাসায় ?
-হ !
-কখন এসেছে ?
-আজকা আফা বাসা থাইকাই বাইর হয় নাই !
রিফাতের মনের ভেতর একটু চাঞ্চল্য দেখা দেয় । এমন তো সাধারনত হয় না । জারিন তো এমনি এমনি বাসায় বসে থাকার মানুষ না । তাহলে কি ওর শরীর খারাপ হল নাকি ?
কাজের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো
-তোর আপার শরীর ভালো আছে তো ?
-জে !
কাজের ছেলেটি আর কোন কথা না বলে ভাত বেড়ে দিয়ে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে । তার একটু পরে জারিন ওর স্টাডি রুম থেকে বের হয়ে আসে ।
রিফাতের প্রশ্ন জাগে জারিন ওর স্টাডি রুমে কি করে হঠাৎ ! ওখানে ওর কাজের তো তেমন কিছুই নেই । কিছু বই আছে । সাথে অফিসের কিছু ফাইল পত্র আর ওর কম্পিউটার । একটা ছোট্ট খাট আর বারান্দায় একটা রকিং চেয়ার । বিগত ছয় মাসে জারিন ওর স্টাডি রুমে ঢুকেছে কি না রিফাত মনে করতে পারে না !
রিফাতের দিকে তাকিয়ে জারিন মৃদু ভাবে হাসলো ! এমন হাসি দেখে যে কোন স্বামীর সারা দিনের ক্লান্তি সব কিছু দুর হয়ে যাওয়া কথা । কিন্তু নিজের বউয়ের এমন হাসি দেখে রিফাতের মনে হল কিছু একটা যেন ঠিক নেই কোথায় ! কিন্তু কি ঠিক নেই !
জারিন আজকে শাড়ি পরেছে । খুব সাধারনত ও শাড়ি পরে না । বড় কোন পার্টিতে না গেলে ওর জিন্স টিশার্ট কিংবা টপসই পরে সব সময় আজকে শাড়িতে জারিনকে অন্য রকম লাগছে ।
রিফাত বলল
-তোমার শরীর ঠিক আছে ?
-হুম ! কেন ?
-না মানে এই সময়ে বাসায় যে !
-কেন ? আমি কি বাসায় থাকতে পারি না ?
-না ! তা না ! রুটিনের ব্যতিক্রম তো ! তাই ! আর শাড়ি পরেছ দেখছি !
প্রথম কথা শুনে জারিনে মুখ টা একটু মলিন হয়ে উঠলো । দ্বিতীয় কথা টা শুনে মুখে একটা আনন্দের আলো দেখা গেল । রিফাতের কাছে জানতে চাইলো
-কেন ভাল লাগছে না ?
-আরে না না ! কি যে বল !
রিফাত তাড়াতাড়ি করে উত্তর দিল ! তারপর খাবার টেবিলে বসতে বসতে বলল
-তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে ! তুমি তো শাড়ি পরই না তাই দেখাও হয় না আজকাল ! তাই জানতে চাইলাম আর কি !
জারিন ঠিক যেন এই কথা টাই শুনতে চাচ্ছিল রিফাতের কাছ থেকে । ওর মুখের হাসিটা আরও একটু বিস্তৃত হল । খাবার টেবিলের ঠিক রিফাতের মুখোমুখি বসতে বসতে বলল
-আচ্ছা এবার থেকে শাড়ি পরবো ! সব সময় । হবে ?
রিফাত আসলেই কিছু বুঝতে পারছে না ! কিছু একটা সমস্যা কি হয়েছে ! কোন প্রকার ঝামেলা ! গত সপ্তাহের কথা কাটাকাটির পরে জারিন ঠিকমত ওর সাথে এই কদিন কথাও বলে নি । আর আজকে হঠাৎ এমন আচরন কেন করছে !
আর এদিকে জারিনের কেন জানি খুব বেশি মজা লাগছে । বিশেষ করে রিফাতের অবাক হওয়া চেহারা টা দেখতে ভাল লাগছে । বেচারা কিছু বুঝতেও পারছে না ।
হঠাৎ করে কেন জারিন ওর সাথে এমন আচরন করছে । যে মানুষ টা ওর সাথে ঠিক মত কথাও বলতো না সপ্তাহ খানেক আগে আজকে সারাটা দিন সে ওর জন্য অপেক্ষা করেছে বাসায় ! এটা একটু অবাক করে দেওয়ার মত বিষয়ই বটে !
জারিনের সাথে রিফাতের বিয়েটা অনেক টা বিয়ে না বলে ব্যবসায়িক ডিল বলা চলে । বড় লোক বাপের উৎশৃঙ্খল মেয়ে বলতে যা বোঝায় জারিন ঠিক তাই । আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেই বিয়েটা টেকে নি । স্বামীর সাথে বনিবনা হয় নি । মাস ছয়েকের মাথায় তাকে ছেড়ে চলে আসে জারিন !
এদিকে যতই বড়লোক আর আধুনিক হোক না কেন, এদেশে মেয়েদের বিয়ে না হওয়া কিংবা বিয়ের স্বামীর ঘর করতে না পারাটা মেয়েদের জন্য একটা কলংকই বটে । জারিনের বাবার মান সম্মানের প্রশ্নও আছে এখানে । সামনে কিছু না বললেও পিছনে অনেক কথাই বলে সেটা তার ভাল করেই জানা আছে ।
এই কারনে মেয়ের জন্য একটা গৃহপালিত স্বামীর ব্যবস্থা করলেন । ওনার নিজের অফিসেই ছোটখাটো চাকরি করে রিফাতের সাথে জারিনের বিয়ে দিয়ে দিলেন ।
কথা ছিল রিফাত যেন জারিনের কাজ-কারবারে সে খুব একটা নাক না গলায় ! রিফাতও সেটা মেনে নিল । উজ্জল আর নিশ্চিত ভবিষ্যতের কাছে এইটুকু ওর কাছে ছোটই মনে হল !
সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল ! জারিন চলছিল নিজের মত । রিফাতও চলছিল তার মত । প্রতিদিন অফিস সাথে প্রায় বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা ! এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল !
কিন্তু গত সপ্তাহে রাতে বাসায় এসে দেখলো জারিন গম্ভীর মুখে সোফার উপর বসে আছে । ছুটির দিন গুলোতে রিফাতও একটু রাত পর্যন্তই বাইরে থাকে । নিজের ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দেয় বন্ধুদের সাথে ।
-কোথায় ছিলে তুমি ?
রিফাত একটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো
-হঠাৎ এই প্রশ্ন ?
-জানতে চাইতে পারি না ?
-জানতে চাইতে পারো কিন্তু কেন জানতে চাইছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ! জানতে চাওয়ার তো কথা না !
জারিন আর কিছু জানতে চায় নি । ও আসলে জানতে চাইতো না কিন্তু ঠিক তার আগের দিন গাড়িতে করে যাওয়ার সময় জারিন ওকে একটা মেয়ের সাথে রিক্সায় করে যেতে দেখেছিল । দুজন এমন ভাবে হেসে হেসে কথা বলছিল যেটা দেখে জারিনের কেন যেন মোটেই ভাল লাগে নি । এই কেন ভাল লাগে নি এই ভাবটা প্রথমে জারিন মোটেই ধরতে পারে নি । এমন তো হওয়ার কথা না ! জোর করে চিন্তা টা মাথা থেকে দুর করে দিতে চাইলেও কাজটা করতে পারলো না । শেষে একটা সময় আবিষ্কার করলো যে নিজের স্বামীর সাথে অন্য অন মেয়েকে দেখে জারিনের কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না ।
-তুমি ব্লগ লেখো ?
রিফাত চুপ চাপ ভাত খাচ্ছিল । জারিনের কথা শুনে খানিকটা চমকে উঠলো । তারপর বলল
-কি !
-বললাম তুমি ব্লগ লেখ ?
-তুমি কিভাবে জানলে ?
-জেনেছি যেভাবেই হোক ! লেখ, তাই না ?
-হুম !
-তোমার স্টাডি রুমে বসে তোমার ব্লগ পড়ছিলাম । সরি তোমার অনুমুতি না নিয়েই !
একটা অস্বস্থি রিফাতের মন জুড়ে প্রবাহিত হল । তবে সেটা খারাপ লাগার অস্বস্থি না ! একটা ভাল লাগার অস্বস্থি ! কিন্তু এর পরে জারিন যে প্রশ্ন টা করলো সেটা শুনে আসলেই জারিন একটু অবাক হয়ে গেল । সাথে সাথে একটু যেন লজ্জাও পেল !
জারিন বলল
-চারুলতা কে ?
রিফাত কোন রকমে বললল
-কেউ না ! এই লেখার একটা চরিত্র আর কি !
ওর মুখ দেখে যে কারো মনে হবে যে ও আসলেই একটু লজ্জা পাচ্ছে । যেন অনেক দিনের লুকানো কোন কথা কারো সাথে ধরা পরে গেছে ! জারিন কিছুটা সময় ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-আমি ?
যেটার ভয় ছিল জারিন ঠিক সেই কথা টাই বলে ফেলল । রিফাত ঠিক কি বলবে খুজে পেল না !
জারিন বলল
-আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি প্রায়ই আমার বিছানায় উঠে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, তাই না ? থাকো ?
রিফাত কোন কথা না বলে চুপ করে রইলো !
কিন্তু জারিনের তখন কোন কিছু করার ছিল না । বিয়ের প্রথম দিনই জারিন রিফাতকে বলে দিয়েছিল যেন ও কোথায় যায় কার সাথে মেশে এটা যেন তাকে প্রশ্ন না করা হয় । নিজের স্বাধীনতার বিষয়ে কারো কাছে জবাব দিতে সে পছন্দ করে না । এখন সে কিভাবে রিফাতের কাছে তার ঘোরাফেরার ব্যপারে প্রশ্ন করবে !
কিন্তু কোন ভাবেই শান্তি পাচ্ছিলো না মনে । শেষে আর উপায় না দেখে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়ে দিল রিফাতের পেছনে ! রিফাত কোথায় যায় কার সাথে মেশে, বিশেষ করে ওর বন্ধুদের সাথে কি টাইপের কথা বার্তা বলে এসব খোজ খবর নেওয়ার জন্য ।
কিন্তু কোন খবর নিতে গিয়ে কোন খবর বেরিয়ে আসবে সেটা জারিন কোন দিন ভাবে নি । এমন কি প্রথমে ঠিক মত বিশ্বাসও করে নি । যখন প্রাইভেট ডিকেটিভ বন্ধুদের সাথে আড্ডার কিছু রেকর্ডেড অংশ শোনালো তারপর জারিন রিফাতের ব্লগটা পড়লো তখন ওর অবিশ্বাসের কোন কারন রইলো না । সেই সাথে এক অজানা অনুভুতিতে সারা দেহমন আছন্ন করে ফেলল !
জারিন নিজের ভেতরের এই পরিবর্তন টা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিল ! সেই সাথে অবাকও হচ্ছিল খুব ! অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে রিফাত এতো টা সময় চুপি চুপি ওকে কি পরিমান ভালবেসে এসেছে । বন্ধুদের সাথেও কথা বার্তায় ওর প্রসঙ্গে সব সময় পজেটিজ ছিল ।
রিফাত খাওয়া বন্ধ করে চুপ করে বসে আছে ।
জারিন বলল
-খাচ্ছো না কেন ?
-খাওয়া শেষ !
-মোটেই না ! পুরো প্লেট শেষ করবে ! তারপর উঠবে ! আর তুমি যদি মনে কর খাবার শেষ না করেই উঠে গেলে তুমি আমার কাছ থেকে বেঁচে যাবে তাহলে ভুল ভাবছো ! আজকে তোমার খবর আছে । আমাকে নিয়ে নিয়ে কি কি ভেবেছো আর আমাকে না জানিয়ে কি কি করেছো আজকে সব কিছু আমাকে বলতে হবে ! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে !
রিফাত কি বলবে খুজে পেল না ! চুপচাপ ভাত মুখে দিতে লাগলো ! জারিন আবার বলল
-না ! চোখ লুকিয়ে লাভ নেই ! তোমার খবর আছে আজকে বুঝছো ! লুকিয়ে লুকিয়ে ভালবাসা তোমাকে দেখাচ্ছি মজা ! তোমাকে আজকে মজা বুঝাবো !! এই তাকাও আমার দিকে ! তাকাও বলছি !!
---------------]
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৪৪