মিমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ! ফুপিয়ে কাঁদছে ! আজকে ঠিক করেই রেখেছিলাম ম্যাচ হারার পরে মিমিকে খুব করে পঁচাবো কিন্তু ওর এমন কান্না দেখে সব কিছু ভুলে গেলাম ! মনে হল আর্জেন্টিনার হারাটা ঠিক হয় নি ! এমন কিছু পাগলা মানুষদের জন্য হলেও আজকে তাদের জেতা দরকার ছিল !
চারিপাশে তাকিয়ে দেখি বেশির ভাগ মানুষের অবস্থায় মিমির মত ! ছেলে গুলো হয় তো মিমির মত করে কাঁদতে পারছে না তবে আশে পাশের সব মেয়ে গুলার চোখে পানি !
কেন জানি আমার চোখেও খানিকটা পানি চলে এল ! এই পানি আর্জেন্টিনা হেরে গেছে এই জন্য, নাকি আশেপাশের পরিচিত মানুষ গুলোর চোখের পানি দেখে কে জানে !
আমি মিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম
-কিছু খেয়ে নে ! সেহরীর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে !
মিমি কোন কথার জবাব দিলো না ! এক ভাবে ফুঁপিয়েই চলল !
সন্ধ্যা থেকেই একটু টেনশনে ছিলাম কোথায় খেলা দেখবো এই নিয়ে ! হলের টিভি রুমে দেখা যায় অথবা কোন বন্ধুদের বাসায় গিয়েও দেখা যায় ! সবাই মিলে আড্ডা হবে সাথে মজা টাও হবে !
তবে সব থেকে বেশি ভাল হয় কোন বিগ স্ক্রীনে খেলা দেখলে ! কিন্তু বড় পর্দায় দেখলে হলে মানুষজন লাগবে ! টিএসসিতে এতো ভিড়ের মাঝে একা একা বন্ধু বান্ধাববীহিন খেলা দেখে মজা নাই !
খেলা দেখা নিয়ে দ্বিধা ভুগতেছি এমন সময় মিমির ফোন !
-কোথায় তুই ?
-হলে ! কেন ?
-একটু মেডিক্যালে আসতে পারবি ? আম্মু তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছে !
-এখনই ?
-হুম ! আসবি ?
-আসব না কেন ? আসতেছি !
মিমির আম্মা কদিন থেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে । সারাটা সময় মিমি মায়ের পাশে ! আমাদের সাথে ঠিক মত কথা বার্তা বলার সুযোগও পাচ্ছে না ! অবশ্য এই সময়ে মিমির ঐ খানেই থাকাই উচিৎ ! মা ছাড়া আর কে আছে ওর জীবনে এখন !
মেডিক্যালে পৌছাতে প্রায় নটা বেজে গেল ! গিয়ে দেখি মিমি আন্টির ক্যাবিনের বাইরে একজন নার্সের সাথে কি যেন কথা বলছে । আমাকে দেখে নার্সকে কি যেন বলে এগিয়ে এল আমার দিকে !
আমি একটু চিন্তিত কন্ঠে বললাম
-আন্টির শরীর ভালো তো ?
-হুম ! এখন মোটামুটি ভাল ! তুই ভিতরে যা ! আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি !
আমাকে কেবিনে রেখেই মিমি চলে গেল !
আন্টির চোখ বন্ধ করে ছিল ! আমার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো !
-এসেছো তুমি ?
-জি আন্টি ! আপনার শরীর কেমন এখন ?
-আর শরীর ! এই বয়সে আর শরীর কি ভাল থাকে ! তবে ভাল আছি ! আসলে বাবা .....
-জি বলেন !
কিছুটা সময় চুপ থেকে মিমির মা বলল
-তুমি তো জানো, মিমি খেলা খুব পছন্দ করে ! ওর বাবাও খুব খেলা পছন্দ করতো ! বাবাকে দেখে দেখেই আর্জেন্টিনার খেলা ভালবাসে !
-জি আন্টি আমি জানি !
-আজকে তো ফাইনাল খেলা । তাই না ?
-জি আন্টি !
-কিন্তু দেখো আমার শরীর খারাপ বলে ও খেলা দেখতে যাবে না বলছে ! এমন দিন কি আর প্রতিদিন আসে ? পছন্দের দলের খেলা কত বছর পরপর আসে কেউ বলতে পারে ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না !
আন্টি বলল
-তুমি ওকে নিয়ে যাবে খেলা দেখতে ? বড় পর্দায় খেলা দেখো গে ! আসলে একা একা ওকে ছাড়তে কেমন ভয় লাগছে ।
আমি হেসে বললাম
-আরে কেন নিয়ে যাবো না ? আপনি কোন চিন্তা করবেন না !
ঠিক এই সময়ে মিমি পেচন থেকে বলল
-মা আমি তোমাকে ছেড়ে খেলা দেখতে যাবো না ! আর এখানকার করিডরেও টিভি আছে ! আমি ওখান থেকেই দেখতে পারবো !
মিমির মা বলল
-শোন তোকে বেশি বুঝতে হবে না ! তোকে যা বলছি তাই কর ! সুমনের সাথে যা ! দুই ঘন্টার খেলা ! দেখে আবার চলে আসবি ! এই দু ঘন্টায় আমার কিছুই হবে না ! আর আমি রাতের বেলা ঘুমিয়েই থাকি !
-আমি যাবো না !
-থাপ্পড় খাবি ! তোকে যা বলছি শোন !
আন্টি তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি ওকে নিয়ে যাও তো বাবা ! আর মিমি তুই যদি সত্য না যাস তাহলে আগামী এক সপ্তাহ আমি একটা ঔষধও মুখে নিবো না !
খেলা শুরুর আগে পৌছে দেখি সারা এলাকা জুড়ে মানুষ আর মানুষ ! এক তিল জায়গা ধরার জায়গা নেই ! তবে কাপলদের বসার জন্য পাশে আলাদা জায়গা আছে দেখছি ! মিমি সাথে থাকায় একটু সুবিধাই হল ! একবারে সামনে চলে এলাম !
মিমির চোখে মুখে একটা আলাদা আনন্দ দেখতে শুরু করলাম ! মানুষ খেলা নিয়ে এতো উত্তেজিত হতে পারে মিমিকে কাছ থেকে না দেখলে জানতে পারতাম না ! বিশেষ করে মেয়েরা স্বাধারনত এমন হয় না ! আমি মিমির কানের কাছে বললাম
-আজকে যদি আর্জেন্টিনা হেরে যায় !
আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে মিমি বলল
-এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো !
-আরে এখানে থাপ্পাড় দেওয়ার কি হল ? জার্মানদের কেও তোকে গোনার ভিতর আনতে হবে !
-থাপ্পড় দেওয়ার মানে কি, তোর সাথে আমি খেলাই দেখবো না ! তুই থাক !
এই বলে মিমি উঠে যেতে চাইলো ! আমি কোন রকমে হাত ধরে থামালাম ! পাশ থেকে এক ছেলে আমার কানের কাছে মুখ রেখে বলল
-ভাইয়া মেসি হেরে যাবে এই কথা খবরদার বলবেন না ! কেবল আপনার নিজের জন না, আসে পাশের আরও অনেকের কাছ থেকে হামলার স্বীকার হতে পারেন !
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম
-তাই নাকি ?
-হুম ! পরিস্থিতি এমনই ! ২৪ বছর পরে ফাইনালে ! ২৮ বছরের বিশ্বকাপের স্বপ্ন ! সাবধান !
আমি সাবধান হয়ে গেলাম ! বেশি কথা বলা যাবে না ! মিমি যা বলবে চুপচাপ শুনতে হবে !
খেলা শুরু হলে মনে হল আমি যেন মাঠের ভিতর বসেই খেলা দেখছি ! চারিদিকে এতো চিৎকার চেঁচামিচি ! ব্রাজিলের স্টেডিয়াম থেকে কোন অংশে কম না ! সব থেকে বেশি লাফাচ্ছে মিমি ! হিগুয়েনের ইজি গোল মিস করার দেখলাম সব থেকে বেশি মেজাজ গরম মিমির !
আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই ছাগলটারে কেন নামাইছে ! মনে কইতাছে.......
মিমির মনে কি বলতে আমি খানিকটা বুঝতে পারলাম !
চারিদিকে তাকয়ে দেখি সবর মন ভাবই দেখি এমন ! আমি সত্যি সত্যিই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম !
হাফ টাইমের পরে প্রথম দিকে মেসিও একটা গোল মিস করলো । নয়্যারের অসাধারন পজিশন সেন্সের কারনে মেসি গোলটা মিস করল। অন্য যে কোন গোলকিপার হলে আরেকটু ফার্স্ট বার ঘেষে দাড়াত আর কাজ হয়ে যেত। কিছু করার নেই ! দেখলাম মিমির মুখ আবার কালো হয়ে গেছে !
আমি শান্তনা দিয়ে বললাম
-আরে টেনশন নিস না ! দেখছিস না ! কেবল গোল হওয়ার লক্ষ্যন ! গোল একটা হয়ে যাবে !
কিন্তু কাজ হল না ! দেখতে দেখতে ৯০ মিনিট পার হয়ে গেল ! অতিরিক্ত সময়েই আর্জেন্টিনার এক জন নিশ্চিত গোল মিস করলো ! প্লেয়ারটার নাম দেখতে পেলাম না ! ঠিক তখনই মনে হল আর্জেন্টিনা হেরে যাবে ! যদি পেনাল্টিশুট আউটে যায় পরপর দুবার মেসিরা জিততে পারবে কি না সন্দেহ ! কিন্তু পেনাল্টিতে যাওয়ার আগেই ১১৩ মিনিতে গোৎজে একটা অসাধারন একটা গোল দিয়ে দিল ! দেখতে দেখতে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল । কেবল কিছু মানুষকে দেখলাম নাচানাচি করতে !
মিমি বিস্ফোরিত চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে । যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ! আমার বিশ্বাস টা যদি সত্যি হয়ে যায় তাহলে মিমির কি অবস্থা হবে ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম !
মেসিরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠলেও শেষ ৭ মিনিটে আর কিছুইকরতে পারলো না ! শেষ মিনিটে একটা ডিবক্সের বাইরে থেকে শর্টের দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই ! কিন্তু মিমিকে দেখলাম চোখে বন্ধ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে ! আমি ওর হাত ধরে বললাম
-চিন্তা করিস না ! মেসি গোল দিয়ে দিবে ! এই রকম শট দিতে ও ওস্তাদ !
কিন্তু নিজের কাছেই কেমন যেন শোনালো !
মিমি চোখ খুলল না ! কিন্তু যখন বুঝলো মেসির শটে গোল হয় নি দেখলাম ওর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল ! খেলা শেষ হওয়ার বাশি বাজার সাথে সাথেই সাথে কেঁদে উঠলো ! চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই কেমন হয়ে বসে আসে ! যেন একটু আগে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে ! এখান আর বেঁচে থেকে লাভ নেই ! মিমি কে কিছু বলতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কঁদতে লাগলো !
ইস ওরা যদি জানতো নিজের দেশ না হয়েও এই পাগলা দেশের কিছু মানুষ তাদের জন্য কি হারে চোখের পানি ফেলছে তাহলে কি করতো কে জানে ! এমন ভাবে সমর্থন আর কেউ তাদের কে দেয় নাকি কে জানে !
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সেহরীর সময় আর নেই বললেই চলে । এক প্রকার জোর করেই মিমিকে তুলে নিয়ে গেলাম ! প্যাকেট বিরানী সাথেই ছিল কিন্তু মিমি কিছু খেল না ! কেবল কয়েক ঢোক কোক খেল ! আমি অল্প কিছু মুখে দিলাম ! কিন্তু স্বাধ লাগলো না ! ভেবেছিলাম খেলা শেষে মিমিকে পঁচাবো কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই আসলো না ! টিএসসির এক পাশে কিছুটা সময় বসে রইলাম দুজনে ! ততক্ষনে ভিড় ককমে গেছে অনেক ! অনেক টাই নিস্তবদ্ধ হয়ে গেছে চারি পাশে ! মিমির কান্নাও থেমে গেছে ! কিন্তু চোখ টা এখনও একটু ফোলা ফোলা হয়ে আছে !
আমি মিমিকে বললাম
-চল একটা কাজ করি !
-কি ?
-হাটি ! আজকে তোর সাথে হাটতে হাটতে সকাল হওয়া টা দেখি ! দেখবি ? তোর ভাল লাগবে !
-হাসপাতালে যাওয়া দরকার !
-হুম ! যাবো তো ! আর একটু পরেই সূর্য উঠবে ! ঘন্টা খানেক ! হাটবি !
মিমি কিছুটা সময় কি যেন ভাবলো ! তারপর বলল
-আচ্ছা চল ! তবে ....
-তবে ?
-আমার হাত ধরে হাটতে হবে !
আমি হাসলাম !
সকাল হতে আর খুব বেশি বাকি নেই ! একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ঢাকার হাজারও পাকা রাস্তার ভিতরে একটা ভাঙ্গা রাস্তা ধরে হাটতে লাগলো হাত ধরাধরি করে ! তাদের দুজনের মনে কি আছে তারা কেউ জানে না ! কেবল এই চিন্তা যে একটু পরেই সূর্য উঠবে ! প্রথম রোদের আলোতে তারা গোসল করবে একে ওপরের হাত ধরে ! এক সাথে ।
(গল্পটি ঐ মেয়েটির জন্য যে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ায় চোখের পানি ফেলেছে)
জার্মানির জয় সূচক গোলটি
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৬