এক
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে বেশ জোরে সরে বৃষ্টি নেমে গেল ! একটু আগেও আকাশে মেঘ ছিল না আর এখন কেমন মেঘ জমে কালো অন্ধকার হয়ে গেছে । আমিতো ভেবেছিলাম হয়তো বাসায় পৌছানোর আগেই আমি ভিজে একাকার হয়ে যাবো । যাক ভাল যে বাড়িতে পৌছাতে পেরেছি !
দরজা খুলে দিল কাজের মেয়েটা !
-তোমার আপু কোথায় ?
-আপু বারন্দায় ?
-বারান্দায় কি ? এই বৃষ্টির ভিতর বারান্দায় দাড়িয়ে আছে কেন ? আশ্চর্য !
আমাদের বারান্দাটা ঠিক অন্য বারান্দা গুলোর মত না ! একেবারে খোলা ছাদের মত । ঝুল বারান্দা এবং সেটার উপরের দুই তৃতাংশতেই ছাদ নেই !
আমি বারান্দায় যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে । গিয়ে দেখি মিরা মনের আনন্দে বারান্দায় ভিজতেছে । আমি ওকে দেখেই চিৎকার করে উঠলাম
-এই কি কর তুমি ?
মীরা আমার দিকে তাকিয়ে কেমন কিশোরী সুলভ হাসি দিল ! আমি চোখ গরম করে বললাম
-তুমি এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতেছো কেন ?
-এমনি !
-এখনই ভেতরে আসো !
-আসবো না ! আসো বলতেছি !
-না !
-দেখো ভাল হবে না বলতেছি !
-না হোক ! আসবো না ! আসবো না ! আসবো না !
আমি খানিকটা অসহায়ের মত মীরার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! বলা যায় আমার এখানে কিছুই করার নেই ! মীরা জোরে ধমক দিয়ে লাভ নেই ! আগে অবশ্য কাজ হত হত কিন্তু এখন সে আমার ধমকে ভয় না । কেবল হাসে !
একটা কাজ অবশ্য করা যায় ! এখন বৃষ্টিতে নেমে গিয়ে ওকে নিয়ে আসা ! কাজ টা করবো কি না বুঝতে পারছি না !
বৃষ্টিতে একটা সময়ে অনে ভিজতাম কিন্তু এখন আর তেমন ভেজা হয় না ! আমি পকেটের জিনিস পত্র গুলো এক পাশে রেখে শার্টের হাটা গুটিয়ে নেমে পড়লাম বৃষ্টিতে ! আমাকে বৃষ্টিতে নামতে দেখে মীরা বাচ্চা মেয়েদের মত খুশি হয়ে উঠলো ! আমি ওকে নিয়ে যাবো কি আমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো !
আমি বললাম
-চল এখন ! অনেক ভিজেছো !
-আরেকটু ভিজি না ! আর তো সুযোগ পাবো না !
-মানে ?
-মানে এমন দিন গুলো আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছে ! আমার দিন....
-চাপ.....
হঠাৎই মেজাজ টা খারাপ হয়ে উঠলো ! মীরার দিকে তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বললাম
-তোমাকে না বলেছি এই কথা আরেকবার না বলতে !
-সরি !
-রাখো তোমার সরি ! ভিজো যত ইচ্ছা !
এই বলে আমি ঘরের দিকে হাটা দিতেই মীরা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো ! তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরলো আরও শক্ত করে ! বুকের ভিতর মুখ লুকিয়ে বললল
-এমন কেন কর আমার সাথে ?
-জানো না কেন করি !
-আচ্ছা বাবা সরি ! সরি বলেছি তো ! আর বলবো না এমন কথা !
আর কিছু বলতে পারলাম না ! মীরা আমাকে জড়িয়ে ধরেই রাখলো ! আকাশ থেকে তখন ঝুম বৃষ্টি পড়েই চলেছে ।
দুই
-তুমি কি বুঝতে পারছো তোমাকে কি করতে হবে ?
-কিছুটা !
দুজনেই কিছুটা সময় নিরব থাকলাম ! আমি তাকে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । অন্য দিকে তিনি আমাকে কি বলবে সেটাও হয় তো তিনি খুজে পাচ্ছে না ! অনেক টা সময় চুপ থাকার পরে তিনি বললেন
-দেখো আমার মেয়েটা সব সময় শান্ত স্বভাবের ! কখনও আমার কথার অবাধ্য হয় নাই ! আমি তাকে যা বলেছি সেই সেটাই নেয়ে নিয়েছে !
ভদ্রলোক আবারও কিছুটা বিরতী নিলেন !
-কিন্তু কপাল দেখো, মেয়েটার কত জলদিই না আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ! আর আমি কিচ্ছুই করতে পারছি না !
-কিছুই কি করার নেই ?
-ভেবেছো আমি কম চেষ্টা করি নি ! কোন লাভ হয় নি ! এমন কি যেই জিনিস আমি বিশ্বাস করি না সেই ফকির ওঝার কাছেও আম গেছি ! লাভ হয় নি !
-আপনি কি চান আমার কাছ থেকে ?
তিন
-মীরা ! এই মীরা !
তাকিয়ে দেখি মীরা ঘুমিয়ে পড়েছে !
মীরার ঘুমানোর টা আমার কাছে বেশ ভাল লাগে ! সব সময় বিশেষ করে ও যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশি ভাল লাগে !
প্রথম দিন রাতে এমনিতেই রাতে বাধরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল । বাধরুম থেকে ফিরে এসে যখন আবার শুতে যাবো তখনই হঠাৎ চোখ পড়লো মীরার ঘুমন্ত মুখের উপর ! আবছায়া চাঁদের আলো আসতেছিল ! আমি খানিকটা সময় কেবল অবাক হয়ে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! কি হল আমি বুঝতেই পারলাম না ! আমার মনে আছে সেদিন ভোরের আযান পর্যন্ত আমি মীরার চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ! মাঝে মাঝে ও নড়ে উঠছিল আমার বুকের ভেতর কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠছিল !
সেদিনই হয় তো আমার মীরার প্রতি প্রথম কিছু একটা শুরু হয় !
তারপর থেকে প্রতিদিনই এই কাজটা করতাম ! মাঝে মাঝে মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ওর ছবি তুলতাম । অফিসের ফাকে মোবাইল বের করে দেখতাম ! কেন দেখতাম আমি নিজেই জানি না ! আমি যে এখানে একটা কন্ট্রাকে এসেছি আমার মনেই থাকতো না ! অথবা আমার সেই কথা আর মনেই রইলো না আর !
চার
-আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চান ?
আমি মীরার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চান বলুন ?
মীরার চোখটা ঝট করে আমার দিকে উঠে গেল ! আমার সাথে কিছুটা সময় চোখাচোখি হয়ে তাকিয়ে রইলো ! চোখ জুড়ে কত কিছুই না বলতে চাইছে । মীরা বলল
-আপনাকে কে বলল যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি ?
-ও চাইছেন না ? তারমানে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না ?
-আমি তো এই কথা বলি নি !
-তাহলে ? আমাকে কি আপনার পছন্দ না ?
-আমি এই কথাও বলেছি ?
-তাহলে ? আমাকে কি আপনার পছন্দ ?
মীরা এই কথার জবাব না অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো !
আমি বললাম
-দেখুন, জীবনে অনেক কিছুই চাওয়ার থাকে ! অনেক কিছু পাওয়া হয় না ! আবার অনেক কিছু অপ্রত্যাশিত ভাবে হাতে চলে আসে ! আপনি তেমন একজন মানুষ !
-কিন্তু সব কিছু জেনে আপনি কেন এমন টা করতে চাইছেন ?
-জানি না ! দেখুন হয়তো অন্য কাউকে বেছে নেওয়া আমার উচিৎ ! কিন্তু তার সাথে জীবনের বাকী সময় আমি যে সুখে থাকবো এটার কোন গ্যারান্টি নেই ! আছে বলেন ?
মীরা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার সাথেই যে সেই গ্যারান্টি আছে আপনি এতোটা শিওর হচ্ছেন কিভাবে ?
আমি মীরার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার চোখ বলছে ! আর কিছু না !
পাঁচ
-আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি কি কর ?
পরোটা মুখে দিতে দিতে গিয়ে আটকে গেলাম ! মীরার দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি বললে ?
মীরা বলল
-বললাম আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি কি কর ?
-কি করবো ? আমিও ঘুমাই !
-তাই ?
-হুম ! অবশ্যই ! কেন ?
মীরা আমার কথার জবাব না দিয়ে নিজের মবাইল বের একটা ছবি দেখালো !
তারপর বললল
-এটা কি ?
আমি তাকিয়ে দেখি মীরার সেই ঘুমন্ত মুখের ছবি !
আমার মুখের ভেতর পরোটা আটকে গেল ! আমি পানি দিয়ে কোন মতে আধ খাওয়া পরোটা পেটের ভিতর চালান দিয়ে বললাম
-ও ! তোমার এই ছবিটা কে তুলেছে ?
-আমি কিভাবে বলবো ? তোমার ক্যামেরা ! তোমার ছবি ! তুমি জানো কে তুলেছে !
-দেখো ঢং করবা না বললাম !
-আশ্চার্য আমি ঢং করলাম কোথায় ?
-এমন একটা ভাব করছো যেন আকাশ থেকে পড়লা ?
-আকাশ থেকে না পড়ি, চেয়ার থেকে তো পড়বই !
-দেখি তোমার মোবাইল দাও !
-আমার মোবাইল দিয়ে কি করবা ?
-দিতে বলছি দাও !
-না দিবো না !
-আমি যখন ঘুমিয়ে তাকি তুমি আমার দিকে তাকয়ে কি দেখো ? কেন দেখো ?
আমি কিছু বলতে পারলাম কি দেখি !
-বলবা না কি দেখো ?
-আমি জানি না !
-তাহলে কেন দেখো ?
-ভাল লাগে, তাই !
মীরার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে ! আগে এই আশ্রুশিক্ত চোখ দেখে হয়তো নিজের কাছে খানিকটা লজ্জিত হতাম কিন্তু এখন আমি এই অশ্রুকে অনভব করতে পারি ! প্রতিটা বিন্দু আমার প্রতিটি শিরা উপশিরা মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২৪