প্রথম পর্ব
আমি আমার গল্প বলে চুপ করে রইলাম কিছুক্ষন ! সূর্যটা প্রায় ডুবে গেছে ! সাথে সাথে একটু যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের পরিমান টা বেড়েছে ! আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম ! কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে ! মনে হচ্ছে দুরের ঐ সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দেই ! যদিও চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম পরক্ষনেই !
-কি ঝাঁপ দতে ইচ্ছে করছে !
আমি তাকিয়ে রইলাম তানজিনার দিকে । মেয়েটার সাথে পরিচয় এই দুদিন মাত্র ! কিন্তু কেমন কেমন করে যেন মেয়েটা সব কিছু বুঝে যায় !
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-মরতে চাইলে তো বাসাই মরতে পারতাম এতো দুর আসার তো দরকার ছিল না !
তানজিনা খানিকটা মাথা নেড়ে এমন একটা ভঙ্গি করলো যেন আমি খুব গুরুত্বপুর্ন কিছু একটা বলেছি এবং সে সেটার উপর গভীর চিন্তা ভাবনা করছে ।
এই মেয়েটা একটু অন্য রকম কি ?
মনে হয় । নতুবা একটা মেয়ে একা একা এতো দুর মানে এই সেন্টমার্টনে চলে আসতে পারে না ! এখানে আসতে যে কোন মেয়ের পক্ষ্যেই একা আসাটা খানিকটা বেমানান !
সি-ট্রাকেই তানজিনাকে দেখি আমি ! আমার থেকে কয়েক সিট দুরে বসে ছিল ! কালো জিন্স সাথে কালো টি-শার্ট ! চোখে কালো সান গ্লাস ! কালো পরেছিল বলেই মনে হয় তাকে সবার চোখে পড়ছিল বারবার এবং মেয়েটা এটে খুব বেশি কেয়ার করছিল বলে মনে হয় না !
ঐ দিন বিকেল বেলা সেন্সমার্টিনের সি- বীচে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেলাম ! সেই সময় মেয়েটা পরেছিল পুরোপুরি সাদা ! সকাল বেলা কালো তে এবং বিকেল বেলা সাদাতে মেয়েটা দেখে কেমন অন্য রকম লাগলো ! আমি কৌতুহল নিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম !
যতটা মুডি ভেবেছিলাম ততটা দেখলাম না ! আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা শুরু করলো ! টুকটাক কথা দিয়ে শুরু হল কথা । জানতে পারলাম সপ্তাহ খানেক থাকার প্লান তার । আমারও তেমনই পরিকল্পনা !
আজকে দুদিন পরে তানজিনাকে আমার জীবনের গল্পটাও বলে ফেললাম ! নীলু আমাকে ছেড়ে গেছে সেই গল্প ! তানজিনা কিছুক্ষন চুপ করে শোনার পর বলল
-আপনি মানুষটা আসলেই একটু বেকুব ধরনের আছেন !
-মানে ?
-মানে কি বুঝেন না ! এমন বোকামী কেউ করে ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না ! তানজিনা বলল
-আপনার বউকে কষে একটা থাপ্পড় দিতেন তাহলে এটা হত না ! আর আপনি কি করলেন ঘর বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হলেন ! আজিব !
-আচ্ছা ! আমি বোকা ! তা আপনি কি শুনি ?
তানজিনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি আবার কি করলাম ?
-আপনিও তো দেশান্তরী হয়েছেন !
-কে বলল আপনাকে ?
-বলতে হবে কেন ? আমি তো দেখতেই পাচ্ছি ! কোন মেয়ে একা একা এতো দুর আসে না ! নিশ্চই আমার মত আপনারও কোন একটা ঘটনা আছে !
-ঘোড়ার ডিম ! আপনার সাথে আসলে কথা বলাটাই ভুল হয়ে গেছে !
দেখতে দেখতে তানজিনা রেগে উঠলো ! আমার পাশ ছেড়ে উঠে চলে গেল ! আমি খানিকটা নিশ্চিত হলাম যে মেয়েটারও আমার মতই কোন না কোন সমস্যা আছে ! তা না হলে রাগতোই না !
আমি ঐ জায়গাতেই বসে ছিলাম ! রুমে গিয়ে কোন কাজ নেই এর থেকে সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকি বেশ রাত পর্যন্ত ! অবশ্য খুব বেশি রাত করার উপায় নেই ! রাত দশটার পর মোটামুটি দোকান পাট সব বন্ধ হতে থাকে ! কারন এগারোটা রপরেই একালার জেনারেটর সার্ভিজ বন্ধ হয়ে যায় ! তার আগেই অবশ্য অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে ! আমিও দশটার দিকে বাজারে যাই একবারে খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি !
দেখলাম আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরেই আবার তানজিনা এসে হাজির ! আমার পাশে বসতে বসতে বলল
-রুমে বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছি ! তার আবার এলাম !
-হুম !
-আপনি রাগ করেছেন ?
-কেন রাগ কেন করবো ? রাগ তো আপনি করে উঠে চলে গেলেন !
-আমি সরি !
-ওকে ! সরি হওয়ার কিছু নেই !
কিছুক্ষন নিরবতা ! তারপর তানজিনা নিজেই বলল
-আসলে আপনার ধারনা ঠিক !
-আমি জানি !
-আমি আমার হাজবেন্ড কে নিয়ে কিছু টেনশনে আছি ! আরও ভাল করে বললে আমিও তাকে ছেড়ে আসার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ! কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্যই আমি এখানে এসেছি !
-ভাল ! তা বলা যায় কি সমস্যা ?
-হুম !
আবারও কিছুটা সময় নিরবতা ! তারপর তানজিনা বলল
-আসলে আমাদের বিয়েটা ছিল পারিবারিক ভাবে ! বিয়ের কদিন পরে জানতে পারি জনির আগের একটা প্রেমিকা ছিল । এবং এখনও সে তাকেই ভালবাসে ! ভেবেছিলাম এরকম সবার অতীত থাকে । সব কিছু ভুলে হয়তো সে নতুন করে সংসার করবে ! কিন্তু বিয়ের তিন বছরেরও কিছুই হল না !
-এখনও তার সাথে যোগাযোগ আছে ?
-কেবল যোগাযোগ ? আরও কত কিছু ! এবং এখন ব্যাপার টা লুকোচুরি নয় ! আমি যে জানি সেটা সে কেয়ারই করে না !
আমি কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম ! তানজিনা আবার বলল
-আসলে আমি আর নিতে পারতেছি না ! আসার সময় একটা চিঠি লিখে এসেছে ! বলে এসেছি কাগজ পত্র রেডি করতে ! ফিরে গিয়ে বাকি কাজটা করবো !
-হুম ! ভাল !
-ভাল ?
-ভাল না ? বারবার কষ্ট পাওয়ার থেকে একবারে কষ্ট পাওয়া ভাল !
এভাবে দেখতে দেখতে তানজিনার সাথে আরও সাতদিন থাকলাম সেন্টমার্টিনে ! বলতে গেলে সময়টা বেশ কাটলো ! আমরা প্রায় সারাদিনই একসাথে থাকতাম ! সারাদিনই প্রায় সমুদ্রের পাড়ে । ছুটে আসা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর নিজেদের জীবনের ছোট ছোট কথা গুলো শেয়ার কতাম !
ও সাতদিন পরে চলে গেল ! আমি রয়ে গেলাম আরও কয়েকদিন থাকবো বলে ! কিন্তু দুদিন পরেই আমার ভাল লাগলো না ! আসলে একাকিত্ব আমার কখনই ভাল লাগে নি ! এখানে তানজিনার সাথে সময় বেশ কেটেছে ! নীলুর কথা একদমই মনে পড়ে নি ! দুদিন পরেই আমিও উঠে পড়লাম সি-ট্রাকে !
ঢাকায় এসে আমার জন্য যেন অন্য রকম কিছু অপেক্ষা করছিল ! বাসায় যেদিন ফিরে গেলেন সেদিনই কোথা থেকে খবর পেয়ে নীলু আর আর ওর বাবা মা এসে হাজির ! আমি ভেবেছিলাম ওরা আসবে তবে এতো জলদি আসবে ভাবি নি !
দরজা খুলে দিতেই দেখি ওরা দাড়িয়ে ! আমি দরজা থেকে সরে দাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে দিলাম !
নীলু কিছু না বলে কেবল চুপ করে দাড়িয়ে রইলো ! নীলুর বাবা আমার হাত ধরে বললেন
-দেখো বাবা, কিছু একটা ভুল হয়েছে ! আমার মেয়েটা সব সময় একটু এমন । হুট হাট করে সব কিছু করে ফেলে !
আমি কিছু না বলে দাড়িয়ে আছি !
-কিছু একটা বল !
-কি বলব আমি ?
-তুমি ওর উপর রাগ রেখও না !
-নাতো ! রাগ কেন রাগবো ? কিন্তু ....
-কিন্তু কি ?
-কিন্তু আপনার মেয়ে তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে ! এবং সেটা মনে কার্যকরও হয়ে গেছে । তাই না ! সবার উপর কথা হল এতে আপনার সমর্থনও ছিল ! ছিল না ?
নীলুর বাবা আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন ! আমি বললাম
-সেদিন আমি কি বলেছিলাম আপনাকে মনে আছে ? বলছিলাম ঐ দিনটার কথা মনে রাখতে ! আপনার মেয়ে আমার সাথে ঘর করতে চায় নি, আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি বিনিময়ে সে আমাকে রেখে চলে গেছে, আমার সাথে কোন প্রকার কথা না বলেই আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছে ! সব কিছুই সে করলো আমি তো কিছুই করি নি !
-আমরা মানছি ! ভুল টা আমাদের ছিল !
-ভুল যেমন আপনাদের মেয়ে ছিল তেমনি ভুলের মাসুল টাও তাকেই দিতে হবে ! তাই না ? আপনারা আসুন এবার ! আমি ঘুমাবো !
নীলু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আমার কথা গুলো ! আমারও প্রথমে মনে কি করছি আমি ? সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করি সব কিছু । কিন্তু পরক্ষনেই সেই সেদিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেল ! হঠাৎ রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম ! নীলুর প্রতি ভালবসা টুকুর চেয়ে সেই রাগ আর অভিমানের পরিমান টা অনেক অনেক বড় !
রাতে দুলাভাই ফোন দিলেন ! বললেন যে তিনি সব কিছু ওদের কে বলেছেন ! এবং আমার আজকের অবস্থান সম্পর্কেও তিনি জানেন ! বললেন
-দেখো আমি তোমাকে কিছু বলবো না তবে আরেকবার কি ভেবে দেখবে ?
-ভাইয়া কিভাবে দেখবো বলেন ? এই কদিনে আমি কি পরিমান মানষিক কষ্টে ছিলাম আপনাক আমি বলে বোঝাতে পারবো না ! যতবার ই আমি আরেকবার ভাবা রকথা চিন্তা করি তটবারই নীলুর সেই নিষ্ঠুর ভাবে চলে যাওয়ার কথা মনে যায় ! সারা জীবনে আমি কোন দিন এটা ভুলতে পারবো কি না জানি না !
পরদিন নিজের কাবিনে কাজ করছিলাম । এমন সময় তানজিনা এসে হাজির ! রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল
-বাহ ! কাজে লেগে গেছেন দেখছি !
-হুম ! কি করবো ?
-আপনার না আরও কদিন পরে আসার কথা ছিল ?
-হুম ! ছিল ! আসলে আপনি চলে এসেছেন দেখে একা একা ভাল লাগছিলা না আর !
-তাই ?
তানজিনা আমার দিকে তাকয়ে অদ্ভুদ ভাবে হাসলো !
-আপনার কি খবর ?
-হুম ! খবর ভাল ! নিজেকে খানিকটা মুক্ত মুক্ত লাগছে !
আমি কিছু বলতে যাবো দেখি নীলু আমার কেবিনে এসে হাজির ! আামাকে আর তানজিনা কে দেখে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না ! আমি নিজেও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ! তবে সামলে নিলাম । খানিকটা কঠিন কন্ঠেই বললাম
-কি দরকার ?
-সুমন ? প্লিজ আমার একটা কথা শুনো !
-বল !
নীলু তানজিনার সামনে কিছু বলতে ইতস্তত বোধ করছিল ! আমি বললাম
-ওর সামনেই বল ! ও নাম তানজিনা ! আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছি !
আমার কথা শুনে রুমে ভিতর যেন বোমা পড়লো ! বোমা পড়ার পর যে একটা শুনশান নিরোবতা দেখা দেয় ঠিক তেমনই নিরব হয়ে রইল কিছুটা সময় ! নীলু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । তার থেকেও তানজিনা বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ! নীলু আর কিছু বলল না ! কেবল চোখে পানি নিয়ে চলে গেল ! নীলুর চলে যাওয়ার পর তানজিনা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
-কি বললেন আপনি ?
-কিছু না ! আসলে ঐ টা আমার এক্স ওয়াইফ ছিল !
-বুঝতে পারছিলাম ! কিন্তু বিয়ে .....
-ঐ টা জাস্ট কথার কথা ! মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে !
-তাই ?
এই কথাটা বলেই তানজিনা আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে হাসলো ! সেই চোখে অন্য কিছু ছিল !
-আচ্ছা চলুন ! লাঞ্চ করা যাক !
তানজিনা সেইঅদ্ভুদ চোখের তাকিয়েই রইলো ! আমার কেন যেন একটু অস্বস্তি লাগা শুরু করলো ! ভাল লাগার অস্বস্তি !
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৪ সকাল ১১:৫৩