সময়ের সাথে সব কিছু আস্তে আস্তে সব সম্পর্ক গুলোর রং পরিবর্তন হতে থাকে ! যাকে ছাড়া একদিনও বাঁচবো না এমন মনে হত আগে, সময় যাওয়ার সাথে সাথে তার চেহারাটা কেমন ঝাঁপসা হয়ে আসে ।
আজকে মোবাইলে এলার্ম না বাজলে তো তার কথা মনেই হত না কিন্তু একটা সময় ছিল কেবল এই দিন নয়, বছরের পুরোটা দিন জুড়ে কেবল সে ই ছিল ! তাকে ছাড়া একটা নিঃশ্বাসও যেন নিতে পারতাম না ! আর আজকে ?
মোবাইলের রিমাইন্ডার তার কথা মনে করিয়ে দিল ?
কার কথা বলছি ?
বলছি আমার প্রথম প্রেমিকার কথা ! আমার জীবনের প্রথম মেয়েটির কথা যার প্রেমে পড়েছিলাম আশ্চার্য ভাবে প্রথম দেখাতেই ! প্রথম দেখাতে প্রেম যাকে বলে !
ইভা !
ইভা রহমান মনে করে ভুল করবেন না দয়া করে ! তার ভাল নাল তাসনিম আরা ইভা ! আমার ক্লাস মেইট, আমার জীবনের প্রথম প্রেম ! আজকে এসেছি তার গল্প করার জন্য !
বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখি বলে দয়া করে এটাও মনে করবেন না যে এইটাও বানানো গল্প !
প্রথমে বলি কিভাবে প্রথমে তার প্রেমে পড়লাম !
আমার সেই দিনের কথা এখনও মনে আছে । ক্লাস সেভেনে পড়ি ! শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০০১ সাল ! আমাদের তখন ছেলে মেয়ে এক সাথে ক্লাস হত !
স্যার আসে নি তাই বসে আছি ক্লাস রুমে ! চরিদিকে হইচই হচ্ছে । আমি বরাবর চুপচাপ ! মেয়েদের সারির দিকে চোখ গেল ! তখনই মেয়েটাকে আমি দেখলাম ! নীল জিন্সের জ্যাকেট পরে মেয়েটা পুরো ক্লাস জুড়ে হেটে বেড়াচ্ছে । সবার সাথে কথা বলছে, হাসছে !
আমি জানি না, আমার বুকের মাঝে কি হল ! কেবল লক্ষ্য করলাম আমার অন্য রকম একটা অনুভুতি হচ্ছে ! বুকটা একটু যেন বেশি জোরে কাঁপছে ! এই অনুভুতি আমার কাছে নতুন ছিল !
ছোট বেলা থেকেই আমি ভালা পুলা হিসাবে পরিচিত । মেয়েদের দিকে একদম তাকাতাম না, কথা তো দুরে থাকুক !
কিন্তু মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারলাম না !
তার কয়েক সপ্তাহ পরে মেয়েটির সাথে আমার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল ! একদম মুখোমুখি ! আমি যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম সেও সেখানে পড়ত ! দেখা হল সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল ! স্যারের বাসায় দরজার কাছে গিয়েছি ঠিক তখনই মেয়েটা এসে হাজির ! একদম মুখোমুখি ! সে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো আমি কিছুক্ষন ! মেয়েটা সেদিন বাদামী রংয়ের কামিজ আর বাদামী ল্যাগিংস পরেছিল ! চুল গুলো একটু যেন ভেজা ভেজা ছিল !
তারপর ইভার সাথে প্রাইভেটে দেখা হত ! কোন দিন কথা হত না ! ক্লাস এইটে ওঠার পর আমরা একসাথে বৃত্তি কোচিং করতাম ! দেখা হতে লাগলো আরও ভাল ভাবে কিন্তু কথা হয় নি ! ক্লাস নাইন গেল, এল ক্লাস টেন ! ২০০৪ সাল !
বলতে গেলে এই বছরটাই আমার জীবনের একটা অর্থ পূর্ন দিন !
আমাদের স্কুলে ছেলেমেয়ে উভয়ই পড়লেও হলেও ছেলে মেয়ে আলাদা ক্লাস হত । কেবল ক্লাস টেন এ ছেলে মেয়ে এক সাথে ক্লাস হত !
আসল গল্প এখান থেকেই শুরু !
তখন আমার কয়েক জনের সাথে আমার বন্ধুত্ব খুব ভাবে জমে ওঠে ! একদিন সেই একজনের সাথে ক্লাসের ফাঁকে বসে বসে গল্প করছি । আমার সেই বন্ধুটা খুব হাসতেছে হঠাৎই ! আমি হাসির কারন জানতে চাইলেই সে আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল ! চিঠিটা ছিল আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ের ! এবং মেয়েটা ইভার খুব কাছের এক বান্ধবী !
ঘটনা হল আমার সেই বন্ধুটি কিভাবে সেই মেয়ের সাথে রিলেশন করে ফেলেছে ! আমি কিছু জানিই না !
আমার মনে কেন জানি আবার ইভার কথা টা খুব বেশি করে মনে পড়ে গেল ! বারবার মনে হল, ইস ! ইভা যদি আমাকে এই ভাবে চিঠি লিখতো !
তার কদিন পরেই আমার সেই বন্ধু আমার কাছে জানতে চায় যে আমার কোন পছন্দ আছে নাকি ?
এতোদিন লজ্জার কারনে কথা টা কারও কাছে বলতে না পারলেই সেদিন বলে দিলাম যে আমার কাকে পছন্দ !
তার দিন পনের পরেই খবর এল যে ইভাও নাকি আমাকে খুব পছন্দ করে ! আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! বলে কি ?
অবশ্য ক্লাসে আমি সহ কয়েকজন বেশ জনপ্রিয় ছিলাম ! আর সত্যি সত্যি ভালা পুলা হিসাবে একটা সুনাম ছিল !
কিন্তু কথা হল যে আমাকে আগে প্রেমের অফার পাঠাতে হবে । তাহলেই নাকি সে রাজি হবে !
অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে পাঠিয়ে দিলাম প্রেমে প্রস্তাব !
অফ পিরিয়ড ছিল ! দুই বন্ধুর কাছে একটা রুমালে একটা কাগজ লিখে পাঠালাম ! আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে উত্তর হ্যা আসছে কিন্তু উত্তর এল "না" !
তার বান্ধবী টেনে টেনে বলতে লাগলো "দেখো এখন ও এই সব কোন সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছে না" !
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম !
আসলে আমার বন্ধুরা আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল ! ইভার সাথে আমার ব্যাপারে তাদের কোন কথা হয় নি ! তার মানে আমি প্রথম প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে গেলাম ! তারা আমাকে দিয়ে কেবল প্রেমের প্রস্তাব পাঠাতে চেয়েছিল ! তাদেরও একটা আশা ছিল যে ইভা নিশ্চই রাজি হয়ে যাবে !
কিন্তু সে রাজি হল না !
এইডা কুনো কথা !!
খাওয়া দাওয়া করে যখন আবার ক্লাস রুমে আসলাম তখন পুরো ক্লাস জেনে গেছে যে আমি ইভাকে প্রোপোজ করেছিলাম কিন্তু সে রিজেক্ট করে দিয়েছে !
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হল !
ছুটির সময় যখন সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল নিতে যাবো দেখি ইভা তার বান্ধবী সহ এসে হাজির ! বলতে গেলে এই প্রথম সে আমার মুখোমুখি হল ! আমি চলে যেতে চাইলে আমার সাইকেল আটকে দাড়ালো !
আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল
-তুমি রাগ করেছ !
আমার তখন মনে হয়েছিল না রাগ করবো কেন ? আমি তো অনেক খুশি হয়েছি ফাজিল মেয়ে !
কিছু বলললাম না ! ইভা বলল
-দেখো আমরা একই সাথে পড়ি ! আমরা কি ভাল বন্ধু হতে পারি না ?
বন্ধু ! আমি তো বন্ধু হতে চাইছি ? থাপড়ায়া দাঁত ফেলে দেওয়া উচিৎ !
কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না ! বললাম
-আচ্ছা !
-বল তুমি এবার থেকে আমার সাথে কথা বলবা ! তুমি এমনিতে কারো সাথে কথা বল না ! বলবা তো কথা ?
-হুম বলব !
তারপর ইভার সাথে টুকটাক কথা হতে থাকে ! ইভা নিজ থেকে কথা বলতো, মাঝে সাঝে চকলেট খাওয়াতো ! ঝালমুড়ি খাওয়াতো !
কিন্তু মন ভরছিল না ! ইভাকে নিজের প্রেমিকা না বানানো পর্যন্ত যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না ! তারপর থেকে একটা পাগলামো শুরু করি ! নিজের হাত কেটে কাগজে চিঠি লিখে ওকে দিলাম !
মনে হল যেন কাজ হল ! ওর বান্ধবীর ছোট বোনের জন্মদিনে ওর সাথে দেখা হল ! ও নিজে হাতে আমাকে কেক খাইয়ে ছিল ! কিছুটা নাকে ঘষে দিল ! তারপর নিজ থেকেই আমাদের বাসায় যাওয়ার দাওয়াত নিল !
ঠিক হল পহেলা বৈশাখের দিন তারা আমার বাসায় যাবে ! ঠিক ঠিক এসে হাজির ! ততদিনে ইভার মন গলে গেছে !
ওরা চার বান্ধবী আমাদের বসার ঘরে বসে রয়েছে ! এই সময়ে ইভা আমাকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে গেল ! আমি চুপ করে ছিলাম । কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ! ইভা বলল
-আমাকে কিছু বলতে চাও না ?
-উহু !
-তোমার কিছু বলার নেই ?
-আছে তো !
-তাহলে বল না কেন ?
-মুখে কিভাবে বলবো ? লিখে দেই ?
শুনতে হাস্যকর হলেও সেদিন এই কথাটাই বলেছিলাম !
তারপর কাগজে লিখলাম
ডু ইউ লাভ মি ? ইয়েস / নো !
সে আমার হাত থেকে কলম টা নিয়ে ইয়েস এ টিক দিয়ে নো টা কেটে দিল !
পুরাই মাল্টিপল চয়েজ প্রোপোজ !
তারপর ব্যাগ থেকে ছোট একটা উপহার ধরিয়ে দিল আমার হাতে !
তখন মনের ভিতর কি পরিমান আনন্দ হচ্ছিল বলে বোঝানো যাবে না !
আবার যখন রুমে ফিরে এলাম তখন আমি যেন অন্য জগতে ছিলাম ! আমাদের বন্ধু এবং ওর বান্ধবীরা জিজ্ঞাসু চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ! ইভা রহস্যময় হাসি দিয়ে অন্য কথায় ব্যস্ত হয়ে গেল ! ওর এক বান্ধবী আমাকে বলল সব ঠিক আছে ? আমি বললাম ঠিক আছে !
ঠিক আছে মানে ? ঠিক না থেকে পারে ! তখনই একটা কাজ হল ! টেবিলের উপর আমার কাটার টা ছিল যেটা দিয়ে আমি হাত কেটে রক্ত বের করে ইভার কাছে চিঠি লিখে পাঠাতাম ! ইভা ওটা হাতে নিয়ে বলল
-এটা দিয়ে হাত কাটতে ?
আমি খানিকটা গর্বের স্বরেই বললাম
-হু !
-এখন কাটো তো !
নিজের কাছে কেমন যেন লাগলো ! যদি না কাটতে পারি তাহলে ছোট হয়ে যাবো ওর কাছে ! কাটার টা নিয়ে কেবল বা হাতের কব্জির নিচে একটা টান দিলাম ! কোন কিছু না ভেবেই ! প্রথমে কিছুক্ষন কিছুই হল না কিন্তু অনুভব করলাম একটু পরেই !
আআআআআআআআআআআ !! মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ না বেরুলেও কি পরিমান জ্বলতেছিল আমি জানি ! হাত কেটে রক্তারক্তি অবস্থা ! পাঞ্জাবী পরা ছিল । সাদা পাঞ্জাবীতে রক্ত লেগে গেল !
অন্যরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ইভা চুপ করে ছিল ! ওর চোখে একটা অন্য রকম আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলাম ! চাপা আনন্দ !
সেই কাটা দাগ এখনও আমার আছে !
এর পরেই আমার অন্য রকম একটা জীবন শুরু হল ! ইভার সাথে মোট ১০ মাস রিলেশন ছিল ! বলতে কোন বাঁধা নেই কোন দ্বিধা নেই দশটি মাসের প্রতিদিনই আমি আমি কাটিয়েছি অন্য এক জগতে ! জীবনে অন্য রকম একটা আনন্দময় সময় ছিল সেটা !
ওকে চিঠি লিখতাম খুব বেশি ! এত্তবড় বড় সব চিঠি ! একটা ঠিক চিঠি না লিখলে ওর রাগ কে দেখতো !
ওকে নিয়ে সাইকেল ভ্রমনে যেতাম প্রায়ই ! দুইজনের সকালের প্রাইভেট কামাই দিয়ে চলে যেতাম যেদিকে চোখ যায় !
মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে আমাদের দেখাই হয় নি ! ও আমাকে এক জায়গায় দাড়াতে বলেছে আমি বুঝি নি, দাড়িয়ে রয়েছি অন্য জায়গায় ! ও রাগ করে আছে আমিও রাগ করে আছি !
এরকম কত স্মৃতি যে আমাদের রয়েছে । কতদিন হয়ে গেল তবুও যেন চোখের সামনে যেন সব ভাসে !
ওর সাথে সম্পর্কের পুরোটা সময়ে আমি আসলেই অন্য এক জগতে ছিলাম ! ছোট ছোট অনে ঘটনা ইচ্ছে করলে বর্ণনা করা যায় তাহলে আজকে আর শেষ হবে না !
একটা সময় নিজেদের ভুলের কারনে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায় ! দোষ ছিল দুজনেরই ! কারও বেশি কারও কম ! কে বেশি দোষী ছিল সেটা আজকে আর নাই বলি !
সেই কবেকার কথা ! প্রথম প্রেম ছিল, কোন চিন্তা ভাবনা ছিল না কেবল আবেগ ছিল ! আজও আছে মনের কোথাও ! আজও তাকে মনে পড়ে !
এর আগেও তাকে নিয়ে ব্লগ লিখেছি বেশ কয়েকটা ! আজকে লেখার কারন হচ্ছে আজে তার জন্মদিন ! আমাদের সম্পর্ক থাকা সময়ে তার জন্মদিন টা আমি পাইনি ! তার জন্মদিনের পরে সম্পর্ক শুরু আর পরের টা আসার আগেই শেষ !
শুভ জন্মদিন প্রথম প্রেমিকা !
হয়তো আজকে আমাকে আর আগের মত মনে পড়ে না ! মনের গভীরে কোথাও আমার স্মৃতি গুলো ফেলে রেখেছো অবহেলায় ! তবে এই টুকু নিশ্চিত জানি আমাকে তুমি মনে রেখেছো ! মনের কোথাও না কোথাও আমার কথা কোন এক বিষন্ন বিকেলে ঠিকই মনে পড়ে তোমার ! যেমন টি আমার মনে পড়ে !
সবার শেষে তার কয়েকটা লাইন দিয়ে শেষ করি ! সে একটা চিঠিতে আমাকে লিখেছিল !
When I will Die,
Come to my grave
No Cry, No pray
On just Say "I love you"