ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছিল জাহিদ। এবারে প্রায় আট মাস পর বাড়ি যাচ্ছে। গত সেমিস্টার শেষে যাওয়া হয়নি টিউশনি থেকে ছুটি না পাওয়ার কারণে। এবারে নিজের পরীক্ষা আর ছাত্রদের পরীক্ষা একই সময় শেষ হবার কারণে সুযোগ মিলল। তাই আর পরীক্ষা দিয়ে দেরি করেনি, সোজা হলে গিয়ে কোনরকম গোছগাছ করেই ছুটে এসেছে স্টেশনে। গতরাতেও ঘুম হয়নি ঠিক মত, উত্তেজনায় এত সময় সেটা টের না পেলেও এখন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। ঘুম আর ক্লান্তি একসাথে আক্রমণ করছে, চোখ মেলে রাখাই দায়। কোলের উপর তল্পি-তল্পার ব্যাগটা কোলে নিয়ে তার উপর মাথা রেখেই ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। চোখটা লেগে আসলেই ঝাড়া দিয়ে নিজেকে সজাগ রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওদিকে ট্রেন এখনো এসে পৌঁছায়নি, কখন আসবে তারও কোন ঠিকঠিকানা নেই।
এমন করতে করতেই লেগে গেলো চোখ। ঘুমের মাঝেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল। ঝট করে চোখ মেলে দেখে রাত হয়ে গেছে! পুরো বোকা বনে গেলো। এই মাত্রই তো চোখ বন্ধ করেছে আর এর মাঝেই রাত! অন্তত ট্রেনের শব্দে তো ঘুম ভেঙ্গে যাবার কথা, কিন্তু কোথায় কি। মরার মত ঘুমিয়েছে আর এখন হ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে, স্টেশনে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। কোন শব্দ নেই, একেবারেই নিশ্চুপ চারিদিক। মাথার উপর বাতি জ্বলছে, কিন্তু রাত কত হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। রাতে অন্তত কেউ না কেউ স্টেশনে ঘুমাতে তো আসে। এখন তো কাউকেই চোখে পড়ছে না। নাকি কোন বিশেষ কারণে কারফিউ জারি হল? হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়, দেশের পরিস্থিতি এখন একরকম অশান্তই বলা চলে। হুট করেই কারফিউ জারি করাটা কিছুটা সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র।
শেষ কথাটা মনে হতেই হাতের ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল জাহিদ। দ্রুত পায়ে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে যাবে দেখে বাইরে থেকে গেটে তালা ঝুলিয়ে স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে! বাইরে রাস্তায় কিংবা কোন বাড়িতে কোন লাইট নেই, চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন কি হল যে রাস্তার লাইট পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে? এটা চিন্তা করতে করতেই আবার প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াল। ঐ দিক দিয়ে যেহেতু বন্ধ এইদিক দিয়েই রাস্তায় যেতে হবে তাকে। প্লাটফর্ম ছেড়ে রেললাইনে নেমে আসল। এরপর আস্তে আস্তে সামনে এগুতে শুরু করল। কি এক অবস্থা! যেখানে সারারাত স্টেশনে কয়েকটা বাতি জ্বলে, রেল লাইনের মাঝে ল্যাম্পপোস্টে বাতি থাকে আজ তার কিছুই নেই! শুধু সে যেই বেঞ্চটাতে বসে ছিল তার উপর একটা বাতি জ্বালানো, বাকি সব বন্ধ। আর ঐ একটা বাতি আলোকিত করার চেয়ে অন্ধকারটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অনুমানের উপর ভিত্তি করেই হাঁটতে হচ্ছে।
গুঞ্জনটা যেন হঠাৎ করেই কানে আসল, লোহায় লোহা ঘষা গুঞ্জন। অনুমানে কতদূর এসেছে তাও বোঝার উপায় নেই। গুঞ্জনটা কোনদিকে থেকে হচ্ছে সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলবার ভয়ে রেল লাইন থেকেও নামতে পারছিল না। গুঞ্জনটা হুট করেই যেন কয়েক ধাপ বেড়ে গেল, কিন্তু যতক্ষণে এই গুঞ্জনের উৎস বুঝতে পারলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ট্রেনটা একদম তার পিছনে, তিন হাত দূরত্বও নেই তাদের মাঝে। আর যতটুকু আছে ততটুকুও ধেয়ে আসছে পাগলা ঘোড়ার মত করে। এত সময় পর কান ঝালাপালা করা ট্রেনের হুইসিল শুনতে পেল আর চোখ ধাঁদিয়ে দিচ্ছিল ট্রেনের হেডলাইটের আলো। নিয়তিকে মেনে নিয়েই মাথার মুখের উপর দু’হাত তুলে ধরল। শিরশিরে সেই অনুভূতিটা আবার নতুন করে বুঝতে পারল, হয়তো এটাই শেষবারের মত কিছু অনুভব করা...
শিরশিরে ঐ অনুভূতিটা বাড়তে বাড়তে একেবারেই অতিষ্ঠ করে তুলল। কিন্তু অবাক হল সেই গুঞ্জন একেবারে মিলিয়ে গেলো বলে। এতক্ষণ ধরে যে গুঞ্জন আর ট্রেনের হুইসিলে কান ঝালাপালা করে তুলেছিল, এখন সেটা থেমে যাওয়াতেই যেন নৈশব্দ অবস্থাটা খুব বেশি কানে লাগছে। ঝট করেই আবার চোখ মেলে তাকাল জাহিদ। আলোর উজ্জ্বলতার কারণে আবারও চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হল। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু কোথায় কি! চারিদিক একদম নিঃশব্দ। মিটমিট করে চোখ মেলে দেখে দিনের আলোই দেখা যাচ্ছে! হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল। এত সময় তাহলে সে নিশ্চিত দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কি এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন!
ধীরে ধীরে চোখে সয়ে আসলে ভালো করে চারিদিকে তাকাল, কিন্তু একি! সে তো স্টেশনের বারান্দায় বেঞ্চে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর এখন বসে আছে একটা বিল্ডিং এর বারান্দায়! আশে পাশে আর কাউকে দেখতে পেলো না। দাড়াতে গিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারল, বুঝল মাটিতে ভর দেবার জন্যে তার পা দুটোর অস্তিত্ব সে খুঁজে পাচ্ছে না। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখে হাঁটুর অংশ থেকে সামনে আর কিছু নেই। বিমূঢ় অবস্থা নিয়েই সেখানে হাত বুলিয়ে দেখে সামনের অংশে চামড়া পর্যন্ত আছে। যেন কোনদিনই সেখানে পা বলে কিছু ছিল না তার।
বসে আছে হুইল চেয়ারে! এখন পরিষ্কার লাগছে ব্যাপারটা। সে স্টেশনে ঘুম থেকে উঠার পর ব্যাপারগুলি তাহলে সত্যিই ঘটেছিল। ট্রেনেই হয়তো তার পা কাটা পড়েছে, আর কেউ এখানে দিয়ে গেছে তাকে। হয়তো এক্সিডেন্টের কারণে লম্বা সময় তার জ্ঞান ছিল না।
চিন্তাভাবনা করে এরচেয়ে ভালো কোন সমাধানে আসতে পারছিল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু কাঁদাল না। মনে পড়লো বাসার কথা, মায়ের কথা। কেউ হয়তো এখনো জানতেই পারেনি তার এই অবস্থার কথা। জানলে নিশ্চই এতদিন এখানে পড়ে থাকতো না, কেউ না কেউ ঠিকই তাকে বাসায় পৌঁছে দিতো।
খুট করে ভেতরের রুমে শব্দ হল, মনে হচ্ছে কেউ দরজা খুলেছে। কিন্তু আর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেই হুইল চেয়ারের হুইল ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকল। রুমে একটি মাত্র বিছানা, সেটাও বেশ উঁচু। তার নিজে নিজে সেই বিছানায় এখন আর উঠার মত অবস্থা নেই। কেউ নিশ্চই তাকে ধরে সেই বিছানা থেকে নামিয়ে এই চেয়ারে বসিয়েছে। কিন্তু তার কিছুই এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
দরজাটা অল্প একটু করে খোলা, সে এগিয়ে গেলো দরজাটার দিকে। টেনে দরজাটাকে সরিয়ে দিয়ে বাইরে নিয়ে আসলো নিজেকে। বাইরে লম্বা করিডোর, শুধু লম্বাই নয় বেশ অনেক লম্বা। দরজা দেখে বোঝা যায় পাশাপাশি অনেক গুলি রুম, আর প্রতিটা রুমেরই তার রুমের দরজার মত দরজা। সম্ভবত প্রতিটি রুমই এক একটি কেবিন। কিন্তু তার কেবিনের দরজাটা বাদ দিয়ে বাকি আর কোনটাই দরজা খোলা নেই। আর জায়গাটা এত নিশ্চুপ যে নিজের নিশ্বাস নেবার শব্দটা পর্যন্ত তার কানে লাগছে।
এক জায়গাতে বসে না থেকে সামনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। হয়ত এখানে যারা আছে তারা এখনো জানে না তার পরিচয়, তাই হয়ত এভাবে রাখা হয়েছে তাকে। কাউকে পেলে এখন সেটা বুঝিয়ে বলা যাবে, হয়তো দ্রুতই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে এবার। নিজের হুইল নিজেই টেনে নিচ্ছে, কিছুটা অবাক হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়েও। বেশ সাবলীল ভাবেই সে হুইল টেনে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, বেশ অনেকদিন হুইল টেনে অভ্যস্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। কিন্তু এগিয়ে এসে খুব একটা লাভ হল না। করিডোরের এ প্রান্তে লিফট, আর কিছুই নেই। ও প্রান্তেও যে কিছু নেই তা এখন থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
সম্ভবত বেশ খরচে হসপিটাল এটা, সিঁড়ি নেই পর্যন্ত। সরাসরি লিফটে যাতায়াত করতে হয়। সে কতদিন এখানে আছে তা নিশ্চিত নয়, কিভাবে এদের চার্জ পরিশোধ করবে এমন চিন্তা নিয়েই লিফটের বাটনে চাপ দিল। বেশ খানিকটা সময় পর প্রায় নিঃশব্দে লিফট খুলে গেলো। মনে মনে আবারও চমৎকৃত হল। অন্তত তার দেখা সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন লিফট এটাকে বলতেই হবে। হুইল টেনে ঢুকে পড়লো লিফটে। ডায়াল বোর্ডে মাত্র একটি বাটন ছাড়া আর কোন বাটন দেখতে পেলো না। সেটাতেই চাপ দিয়ে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। যেভাবে নিঃশব্দে লিফটের দরজাটা খুলেছিল ঠিক ঐভাবেই তা বন্ধ হল। একেবারেই কোন শব্দ ছাড়া লিফট তাকে নিয়ে নিচের দিকে ছুটছে।
এবারে লিফটের উপর বেশ বিরক্ত হল সে, এত সময় নিশ্চয় প্রয়োজন পড়ে না কোন ফ্লোর থেকে নিচে নামতে। অনুমানের উপর ভিত্তি করলেও প্রায় ১০ কিংবা ১২ মিনিট পার হয়ে গেছে এতক্ষণে, কিন্তু এখনো সেটা নামতেই আছে। লিফটটা যেমন নিঃশব্দে চলছে তাতে মনে হচ্ছেনা সেটা আদৌ চলছে, কিন্তু তার ছুটে চলার গতি সে ঠিকই বুঝতে পারছে। ওদিকে কত তলা পর্যন্ত পার করেছে সেটা বোঝারও কোন উপায় নেই। কি আজব লিফট এটা!
বিরক্তি নিয়েই লিফটের ভেতরটায় চোখ বুলচ্ছিল। লিফটটা কিছুটা অন্যরকম, চারপাশে প্রায় পুরোটাই আয়না দিয়ে ঢেকে দেয়া, কিন্তু আয়নাটা সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ। সিলিংটারও একই অবস্থা। লিফটের ভেতর আলো আসছে নিচ থেকে। ফ্লোরের পুরোটাই আলো বিচ্ছুরণ করছে। এভাবে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে লিফটের সেই একমাত্র বাটনের দিকে নজর গেলো তার। একমাত্র বাটনটার স্টেইলনেস স্টিল দিয়ে তৈরি। আয়নার মাঝে আরেকটা ছোট্ট আয়নার মত। তবে আয়না গুলি যেমন ঘোলাটে এটা তার তুলনায় বেশ অনেকটাই উজ্জ্বল। দূর থেকেও নিজের আয়বয় বেশ বোঝা যাচ্ছে সেখানে। বোঝা যাচ্ছে নিজের বিকৃত মাথাটার অবস্থা। নিজে কিছু বোঝার আগেই অভ্যস্ত হাত দুটি চলে গেলো হুইলের চাকায়, নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছে একটু একটু করে সেই বাটনটার দিকে। বাটনটাতে নিজের রূপ দেখে নিজের ভেতরেই গোলাতে শুরু করলো, কোন মানুষের মাথার আয়বয় এমন অবস্থা কেউ কল্পনাতেও নিয়ে আসতে পারবে না! অবিশ্বাস নিয়ে হাতটা উঠিয়ে দিল মাথার দিকে, আঙ্গুলের স্পর্শ দিয়ে অনুভব করলো নিজের খসখসে আঁশটে ত্বক।
শিরশিরে সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে আসতে শুরু করলো। নিজের ত্বকের সেই খসখসে অবস্থাটা নিজের ভেতরেই কেমন একটা ঘিনঘিনে অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এবারে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। পাগলের মত চিৎকার শুরু করে দিল। একই সাথে শিরশিরে অনুভূতিটা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।
শিরশিরে ঐ অনুভূতি তার চিৎকার ছাপিয়ে তাকে আবার অতিষ্ঠ করে তুলল। তারপরে যেন ধুপ করেই লিফটটা থেমে গেলো, সাথে সাথে থেমে গেলো সেই শিরশিরে অনুভূতিটাও। চোখ মেলে চেয়ে দেখে সে ট্রেনে স্টেশনের ঐ বেঞ্চটাতেই বসে আছে। তার কোলের উপর তার সেই তল্পি-তল্পার ব্যাগ। নিজে বোঝার আগেই হাত চলে গেলো মাথার দিকে। আর হাত মাথায় দিয়েই স্বস্তির নিশ্বাস নিলো তার নিজের ঝাঁকড়া চুল স্পর্শ করে। আর তারপরই ঝাড়া দিয়ে দাড়িয়ে গেলো নিজের পায়ে। নিজে নিজেই হাসতে লাগলো মনে মনে। স্বপ্নের মাঝেও আরেক স্বপ্ন! কি বীভৎস অবস্থা। কত বাস্তব অনুভূতি সম্পন্ন স্বপ্ন! ধুপ করেই আবার বসে পড়লো বেঞ্চটাতে। এখনো ট্রেন এসে পৌঁছায়নি স্টেশনে। চারিদিকে রাজ্যের হাউকাউ চলছে। কিন্তু এটাই এখন তাকে বেশ স্বস্তি দিচ্ছে।
চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে এক হকার যাচ্ছিল, তাকে ডেকে চা দিতে বলল। ঘুম ঘুম ভাবটা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। চা খেলে কিছুটা কাটবে বলে মনে হয়, সময়ও কাটবে। স্বপ্নের সেই ঘিনঘিনে অনুভূতিটা এখনো পুরোপুরি যায়নি। অনিচ্ছাতেই বার বার হাত উঠে যাচ্ছে, বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছে নিজের মাথা আর মুখমণ্ডল। গালের ছোট ছোট দাড়ি গুলিও হাতে লাগছে বার বার। এবারও বাসায় গেলে মা বেশ খানিক কথা শোনাবে এই নিয়ে। কে বোঝাবে তাকে এক দিন পরপর শেভ করাও একটা ঝামেলা। মায়ের কথা মনে পড়তেই মনটা অন্যরকম হয়ে গেলো।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হকার তার দিকে কাপ এগিয়ে দিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেটাকে কেমন তেতো মনে হল, আর সাথে সাথেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ধমক দিয়ে হকার ছেলেটাকে বলল তাতে ভালো করে চিনি মিশিয়ে দিতে। কিন্তু ধমক খেয়ে হকারের কোন বিকার দেখা গেলো না, সম্ভবত এমন ধমক খেয়ে খেয়েই সে অভ্যস্ত। ফ্লাক্সের সাথে বাঁধা চিনির পুটলি থেকে দু’চামচ চিনি নিয়ে শব্দ করে চামচ নাড়া দিতে লাগলো। তার এই চা নাড়ানোতে কিছু একটা পার্থক্য চেখে বাঁধছিল, কিন্তু সেটা কি তা বুঝে উঠতে পারছিল না জাহিদ।
চা শেষ করে হকারকে টাকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটু হাটাহাটি করা দরকার। ট্রেন কতক্ষণ লেট হবে এটাও জানা দরকার। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে কাউন্টারের দিকে রওনা দিল। কিন্তু যেখানে কাউন্টার ছিল সেখানে এসে বোকা হয়ে গেলো। এই কিছুক্ষণ আগেই এখান থেকে টিকেট কিনেছিল সে, আর এখন এখানে কিছুই নেই! স্টেশনের সাদা দেয়াল সেই কাউন্টারের জায়গাতে। সাথে সাথেই ভুলটা বুঝতে পারলো। সে উল্টো পথে এসেছে, স্টেশনের ঐ প্রান্তে তাকিয়েই বুঝল সেখানে রয়েছে সেই কাউন্টার। আবার হাটতে লাগলো কাউন্টার উদ্দেশ্য করে। মাথা নিচু করে জিজ্ঞাস করলো ট্রেন কতক্ষণ লেট হবে। ভাবলেশহীন চেহারার কাউন্টার যেন তার কথাটা প্রথমে বুঝলোই না। আবার জিজ্ঞাস করলো কতক্ষণ লেট হবে ট্রেনের। এবারে লোকটা বলল, “আসবে, খুব দ্রুতই আসবে ট্রেন।”
এমন উত্তর শুনে মেজাজ কার না খারাপ হয়। এত সময় ধরে অপেক্ষা করছে, ট্রেন এরই মাঝে চলে আসার কথা, সেটাও আসেনি। আর এর মাঝেও যদি কেউ বলে “দ্রুত আসবে” তখন মেজাজ ধরে রাখাই দায় হয়ে পড়ে। বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। আরও একটু ঝুঁকে কাউন্টারের ভেতরে ঝোলানো ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করলো। ঘড়ির কাঁটায় সেখানে নয়টা বাজে এখন! কি আজব! তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেলা ১টায়। দেড়টা নাগাদ সে স্টেশনে পৌঁছেছে, মাঝে যতটুকু সময় ঘুমিয়েছে তাতে তো মনে হয় না এখন তিনটার বেশি বাজার কথা। আর স্টেশনের ঘড়িতে এখন সময় ৯টা! মনে মনে একটা গালি দিল কাউন্টারে বসা লোকটাকে। ট্রেন কখন আসবে সেটা বলতে পারে না, কথা বললে একবার বোঝে না আর নিজের রুমে যে ঘড়িটা আছে তার সময়টা পর্যন্ত ঠিক রাখতে পারে না। কোন যোগ্যতা দিয়ে টিকিট বিক্রি করে এরা!
মুখে কিছুই বলল না। ফিরে যেতে লাগলো ঐ বেঞ্চটার দিকেই। গিয়ে দেখে সে যে স্থানে বসেছিল সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছে। পাশ ঘুরে বেঞ্চির অপর দিকে গিয়ে বসল সে। ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে বসে আছেন। ট্রেন লেট করার এই ব্যাপারটা সম্ভবত উনার নিয়মিত দেখা একটি ঘটনা। ভদ্রলোকের হাতে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। উসখুস করতে করতে জাহিদ তাকে সময়টা জিজ্ঞাস করেই ফেললো। প্রথমে যেন ভদ্রলোক শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গি নিয়ে তার দিকে ফিরে একটু কপাল কুঁচকে তাকাল। জাহিদ আবারও বলল ‘কয়টা বাজে সেটা জানতে চেয়েছিলাম’। ভদ্রলোক একটু অবজ্ঞা নিয়েই ঘড়ির দিকে তাকালেন, তারপর বললেন ‘এখন তিনটা দশ বাজে’। তার অনুমান মিথ্যে নয়, তিনটার কিছু বেশি বাজে। মোটামুটি লম্বা ঘুম হয়ে গেছে এর মাঝে।
বেশ অনেকক্ষণ এভাবেই বসে রইলো। কিন্তু ঘুরে ফিরে বার বার একটু আগে দেখা সেই স্বপ্নের কথাই মনে পড়ছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেই নিজের মাথা আর গাল বুলিয়ে দিচ্ছিল একটু পর পর, আর বার বার নিজের এই অদ্ভুত আচরণটা তার বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কিছু সময় বাদে বেশ বিরক্তি নিয়ে আবারও ট্রেনের খবর জানতে কাউন্টারের দিকে রওনা দিল। এবারে মাথা নিচু করে বেশ জোরেই জিজ্ঞাস করলো “ট্রেন আর কতক্ষণ লেট হবে”। লোকটি পিছনের দিকে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এইতো, কিছুক্ষণের মাঝে এসে যাবে।
জাহিদ মনে মনে ভাবল, পাগল নাকি লোকটা! নষ্ট ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে কিছুক্ষণের মাঝেই এসে যাবে! কিন্তু সে নিজেও আগের বারের মত আরও একটু নিচু হয়ে রুমের ঘড়িটি দেখার চেষ্টা করলো। কি আজব! ঘড়িতে এখন সময় আটটা দশ! আরও একটু ভালো করে তাকাল এইবার, আর ঘড়িটাকে আরও একটু ভালো করে দেখে একটু অবাক হল। ঘড়িটা উল্টো ঘুরছে! শুধু তাই নয়, ডায়ালে যে সংখ্যা গুলি লেখা তাও উল্টো করে লেখা। ঐ হিসেবে সময় এখন প্রায় চারটা। তার মানে ঘড়িটা সম্ভবত উল্টো দিকে ঝুলানো, আর ওইপাশের দেয়ালে আয়না লাগানো আছে। তার কারণেই সেটা উল্টো দেখাচ্ছে! আর আয়নাটাও এমন ভাবে লাগানো যে এই দিক থেকে বোঝাই যায় না সেখানে ওটা আয়নায় দেখছে কেউ।
সোজা হয়ে দাঁড়াল জাহিদ। কিন্তু দাড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভড়কে গেলো। কাউন্টারের উপর বড় করে লেখা রয়েছে ‘টিকিট কাউন্টার’ কিন্তু সেটা লেখা রয়েছে উল্টো করে। এইসব কি ধরণের পাগলামি!
ঘুরে আবারও বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ে তার। সূর্যের আলোটা উল্টো দিকে পড়েছে। দুপুর পেরিয়ে এখন বিকেল। আলোটা পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে পড়ার কথা, কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো পূর্ব থেকে পশ্চিমে আলো পড়েছে! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!
হুট করেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে সে। দৌড়ে গিয়ে বেঞ্চে বসা লোকটার হাত টেনে ধরে তার ঘড়িটা দেখে নেয়। যা ধারণা করেছিল সেটাই দেখছে চোখের সামনে, লোকটার হাতের ঘড়ির ডায়লারও উল্টো। ঘড়ির কাটা গুলি সেখানে বাম থেকে ডানে না ঘুরে ডান থেকে বামের দিকে ঘুরছে! লোকটি ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়া তার থেকে। চিৎকার করে বলে “পাগল নাকি!” কিন্তু ঐসব শোনার মত অবস্থা নেই জাহিদের। সে পকেট হাতড়ে ট্রেনের টিকেটটা বের করে। হাতের কাগজটার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এখন। প্রতিটা বর্ণ তার অবস্থানে আছে, কিন্তু আছে উল্টো হয়ে।
শিরশিরে সেই অনুভূতিটা আবারও ফিরে আসছে তার। ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে সেই অনুভূতি। খুব ঠাণ্ডা লাগছে এবার। সে খুব করে জেগে উঠতে চাইছে, সে জানে এইসবই তার দুঃস্বপ্ন। শুধু কোনভাবে একবার জেগে উঠতে পারলেই হবে, তারপরই মুক্তি। কিন্তু কিভাবে জেগে উঠবে? বার বার করেও জেগেও তো জেগে উঠতে পারছে না সে…..
________ শেষাংশ ________
: তোমার সিমুলেশনে বেশ ঝামেলা করছে আইরিন, বার বার প্রোগ্রামটা ফল করছে।
: কিন্তু লজিক্যাল ভাবে তো পুরোটাই ঠিক ছিল, আমি কয়েকবার করেই চেক করেছি। প্রোগ্রামটা লেখার সময়ও দেখেছি, কোন ভুল হয়নি।
: কিন্তু এখন তো হচ্ছে। কিছু সময় চালানোর পরই সেটা ক্রাশ করছে।
: কই! সেটা তো পুরোপুরিও ক্রাশ করছে না..
: এটাই তো আরও বড় সমস্যা। পুরোটা ক্রাশ করলে ডিবাগ করে তোমার প্রোগ্রামের প্রবলেমটা ধরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সেটা না করে নিজেই নিজেকে ভিন্ন স্থানে ট্রান্সমিট করছে। পয়েন্টার কন্ট্রোল নিয়ে নিজেকে হাইলাইট করছে বার বার।
: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রোগ্রামে লজিক্যাল সকল তথ্যই দেয়া আছে। কিন্তু এমন কোন অংশ নেই যেখানে নিজেকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ট্রান্সমিট করে দিবে।
: কিন্তু রেজাল্ট তোমার হাতের সামনেই দেয়া। এই A.I. প্রোগ্রামের ক্যারেক্টার নিজেকে বার বার বিভিন্ন সিচ্যুয়েশনে নিয়ে যাচ্ছে। বার বার আমার লেভেল প্রোগ্রামিং এর ডেটা পাল্টে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। আমার পুরো ইন্টারফেস প্রোগ্রামিং এর এক্সেস নিয়ে নিয়েছে লোডিং এর শুরুতেই।
: তাহলে একে টার্মিনেট করে দিন।
: সেটাও সম্ভব নয়।
: কেন?
: এখন একে টার্মিনেট করতে গেলে আমার পুরো ইন্টারফেস প্রোগ্রামিং ক্রাশ করবে। ইন্টারফেস প্রোগ্রামের কোর ফাইলের Key এক্সেস তোমার A.I. প্রোগ্রামের মুল Key ফাইলে যুক্ত করে নিয়েছে। এখন আমি টার্মিনেট করতে গেলে সিস্টেম ওভার লোড হয়ে যাবে। সাথে পুরো সিমুলেশনের সাথে আমাদের পুরো প্রজেক্ট ফাইলের ডেটা মুছে যাবে।
: কিন্তু আমাদের ফাইল তো মূল সার্ভারে জমা। এখান থেকে ক্রাশ করলেও তো ওখানে ব্যাকআপ থাকবে।
: থাকার কথা ছিল, কিন্তু এখন আর থাকবে না। তোমার A.I. প্রোগ্রাম নিজেকে লোড করার সময় সার্ভার এক্সেস চেয়ে নিয়েছে। আর সার্ভার সেই এক্সেস ডিনাই না করে ডাইরেক্ট গ্রান্ট করেছে।
: তার মানে?
: তার মানে তুমি যে A.I. প্রোগ্রাম তৈরি করেছো তাকে Independent করতে গিয়ে অনেক বেশি Independent করে ফেলেছো। এখন সে নিজেকেই নিজেকে নিজেই মডিফাই করতে পারবে। সাথে ওর যা কিছুর প্রয়োজন পড়ছে তার এক্সেস সব স্থান থেকে নিতে পারবে।
: একে থামানোর জন্যে আমাদের কিছুই করার নেই? সার্ভার এক্সেস টোকেন পরিবর্তন করে দিলে হয় না?
: তোমার কি মনে হয় আমি এর মাঝে চেষ্টা করি নি সেটা? কিন্তু এটা এতটাই ন্যাচারাল প্রোগ্রামিং হয়েছে যে এখন এটা নিজের পুরো আর্টিফিশিয়াল পাওয়ার কাজে লাগিয়েছে। আমরা যখন এর বার বার লেভেল পরিবর্তন দেখছিলাম তখন ব্যাকগ্রাউন্ড প্রোগ্রাম আমাদের নিজেদের সকল কন্ট্রোল টোকেন পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন আমাদের কারও হাতেই কোন কন্ট্রোল নেই, শুধু ভিউ পরিবর্তন করার অপশন আছে।
: এখন?
: এখন একে থামাতে হলে প্লাগ পুলিং ছাড়া আপাতত আমাদের হাতে আর কোন অপশন নেই...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৫