উদ্দেশহীন ভাবে শহর ঘুরে দেখছিল ছেলেটি। দুনিয়ার সব আশ্চর্য দিয়ে ভরপুর এ শহর হাজার বছর ধরে দেখলেও দেখা শেষ হবে না। প্রতিটি মুহূর্তেই এই শহরের রং বদলাচ্ছে, সাথে বদলাচ্ছে তার ভঙ্গী। আর এই বদলানো রং আর ঢং এর সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের ভঙ্গিমাকেও শহুরে আদতে বদলে নিচ্ছে শহরে বাস করা মানুষগুলি।
এখানে সবাই ক্রেতা, আবার একই সাথে সবাই বিক্রেতা। রাস্তায় হেটে যাওয়া ভিক্ষুকটিও তার দুরবস্থা বিক্রি করে মানুষের মায়া কিনে ফিরছে, আর সেই মায়াই তার হাতের পাত্রে পয়সার ঝনঝনানি আওয়াজ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ওদিকে যে পয়সা দিয়ে এই ঝনঝন আওয়াজ সৃষ্টি করল, সেও এই পয়সা দিয়ে কিনে নিলো আত্মতৃপ্তি।
অদ্ভুত এই শহরে কেউ থেমে থাকে না, কিছুই থেমে থাকে না। সবাই তার নিজের মত নিজেকে নিয়ে ছুটছে। বলার জন্যে তো সে নিজের থেকে বেশি অন্যের কারণেই ছুটছে, তবুও দিন শেষে সবাই শুধু নিজের লেনদেনের হিসেবটাই করে। সেই হিসেবের খাতায় যেমনি করে ক্লান্তি উঠে আসে, দুশ্চিন্তা উঠে আসে তেমনি উঠে আসে প্রিয়জনের আনন্দের হাসির হিসেবটুকুও। কোন কোন দিন এইসব আনন্দ মাখা হাসির সংখ্যার হিসেব অন্য সব হিসেবের থেকে কম থাকে, সেদিন বিষাদেরা ঘিরে ধরে তাদের সবাইকে। আবার কোন কোন দিন পাওয়া না-পাওয়া গুলিকে পেছনে ফেলে এরাই অকারণে আনন্দে ঝিলমিল করে উঠে। সেদিন তাদের ঘরে সে সম্পদ অবস্থান করে, তা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটার কাছেও সঞ্চিত থাকে না।
ঘুরে ঘুরে এইসব ছুটে চলা আনন্দ-বেদনাই দেখে যায় ছেলেটি। কোন উদ্দেশ্য নেই, তবুও দেখে যাওয়া, তবুও ছুটে যাওয়া। তারপর কোন একদিন এক শহরের নাম না জানা কোন এক রাস্তার মোড়ে ছেলেটি দাড়িয়ে যায়। ছোট একটা জটলা ছিল সেখানে। ভেতর থেকে ভেসে আসছিল গিটারের মনমাতানো সুর। সেই ভিড়ের ভেতর কেউ একজন নিজের প্রতিভা বিক্রি করছে পয়সার ঝনঝনানি শব্দের বিনিময়ে। সেও ছুটে যায় ভিড়ের মাঝে, গাঁটের কিছু পয়সার বিনিময়ে নিজের জন্যে কিছু মুগ্ধতা কিনতে। ভিড়ের মাঝে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সেও শুনতে থাকে অজানা সেই গিটারের সুর।
এরপর বিকেল পেরিয়ে রাত হয়, রাত শেষে হয় সকাল আর সকালকে বিদায় দেয় দুপুর। তবুও ছেলেটির মুগ্ধতা কমে না। সে পুরোটা সময় ঐ ভিড়ের মাঝে দাড়িয়ে মুগ্ধতা কিনতেই থাকে। যখন ভিড় করার মত কেউ থাকেনা তখনও সে দাড়িয়ে থাকে মুগ্ধতা কিনবে বলে। কিন্তু তার মুগ্ধতা কেনা হয়ে উঠে না।
একটা ছোট টুলের উপর বসে একটা ছেলে তার কোলের উপরে রাখা গিটারটা আপন মনে বাজিয়ে যাচ্ছে। কি নেই সেই সুরে? ভালোবাসা, হতাশা, প্রাপ্তির অনাপ্রাপ্তি, বিদ্রোহ ফের ভালোবাসার গল্প, সবই আছে। দুঃখ আছে, সুখ আছে, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আছে, আরও আছে ভালো সময়ের আহ্বান। কিন্তু যে সুর শুনিয়ে এত শত মানুষকে বিমুগ্ধ করে যাচ্ছে ছেলেটি, সে নিজেই কোনদিনই ঐ সুরে ডুবে যাওয়া এইসব মানুষের আনন্দ নিজ চোখে দেখতে পায় নি। সে শুধু জানে আপন সৃষ্ট সুর আর ছন্দের মত মানুষের এইসব আনন্দকে অনুভব করতে। আর এখানেই এসে সেই মুগ্ধতায় ডুবে থাকা ছেলেটি ধোঁকা খেয়ে যায়।
প্রশ্ন জাগে ছেলেটির মনে। হাজার বিনিময় হোক, সুরের ঝঙ্কারের বিপরীতে হাজার পয়সার শব্দের টুংটাং গর্জে উঠুক, তবুও কি এই শ্রোতারা গিটার বাদক ছেলেটাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে না? নিজেদের আনন্দটুকু পুরোপুরি আদায় করে নিলেও বিনিময়ের আনন্দটা তারা তো পুরোপুরি ফিরিয়ে দিচ্ছে না, কিংবা দিতে পারছে না। তবে কিভাবে একে পরিপূর্ণ বিনিময় বলে কেউ? আর সেও যদি এভাবে গিটার বাদক ছেলেটার কাছ থেকে শুধুই নিজের মুগ্ধতাটুকু পয়সার বিনিময়ে কিনে নিলে চলে যায়, আর ফিরতি আনন্দটুকু না দিতে পারে, তবে সেও কি বাকি সবার মত গিটার বাদক ছেলেটিকে ঠকিয়ে দিবে না? আর এখানেই যত বিপত্তি তার। সে চায় না এইভাবে কাউকে ঠকিয়ে নিজের অংশের পূর্ণ মুগ্ধতা কিনে নিতে। কিন্তু কিভাবে এই বিনিময়কে পরিপূর্ণতা দিবে তাও বুঝে উঠতে পারে না।
এই শহরে কিছুই থেমে থাকে না, সবাই ছুটে চলেছে। ছুটে চলা এই মানুষ গুলির কেউই হয়তো আলাদাভাবে ভিড়ের মাঝে দাড়িয়ে থাকা এই ছেলেটিকে কোনদিন দেখেও দেখবে না। সেই একই ভাবে গিটার বাদক ছেলেটির কথাও কেউ মনে রাখতে পারবে না। শুধু মনে থাকবে কোন এক দুপুর কিংবা বিকেলে অজানা কোন এক রাস্তার পাশে দাড়িয়ে তারা কিনেছিল কিছু মুগ্ধতা। ভুলে যাবে সেই মুগ্ধতার বিনিময়ে যে পয়সার ঝঙ্কার তারা তুলেছিল তাতে কখনোই পরিপূর্ণ হয়নি তাদের বিনিময়। আর এভাবেই ছুটে চলা শহরের মানুষ গুলি হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১১:৩১