রুনিদের ঐদিকে আর যাওয়া পড়ে না অনেক দিন হয়। আম্মুর বান্ধবীর মেয়ে রুনি। কোন প্রাইভেট টিউটরই তার এক দেড় মাসের বেশি টেকে না। ছাত্রীর যেমন একগাদা নালিশ তার টিউটর নিয়ে তেমনি টিউটরেরও সমপরিমাণ কিংবা তারচেয়ে বেশি পরিমাণে অভিযোগ থাকতো। বাবা-ময়ের একমাত্র মেয়ে তাই আদর আবদারে সবদিকেই প্রাধান্য দেয়া হতো তাকে। কিন্তু এমন করলে কিভাবে কি হবে বুঝে উঠতে পারছিল না তার বাবা-মা। ওদিকে মাথার উপর চলে আসলে মাধ্যমিক পরীক্ষা, এই সময় এমন করলে তো নির্ঘাত খারাপ করবে। এভাবেই বলেছিল আম্মার কাছে সায়মা আন্টি।
তখন সবে মাত্র ভার্সিটির ফুরফুরে হাওয়া গায়ে মাখিয়ে ঘুরাঘুরি আর ক্লাস ঘুরে ঘুরে, ক্যান্টিনে নতুন নতুন মুখের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করছিলাম। আম্মার অনুরোধেই গেলাম রুনিদের বাসায় টিউটর কম তার পড়ালেখার বাইরের আজব সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। প্রথম সপ্তাহেই বুঝে গেলাম কেন তার টিউটর এক মাসের বেশি টিকতে চায় না। আমিও মানা করে দিবো ভাবছিলাম। কিন্তু আম্মা বলল এভাবে আমিও যদি চলে আসি তবে সায়মা আন্টির কাছে সে ছোট হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই সেই আজব আজব প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে তাকে পড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
তবে মেয়েটা এভাবে বাচাল আর ফালতু হলেও মূল বিষয় গুলি দ্রুত বুঝে নেবার ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিল। কোন জিনিষ তাকে ২য় বার করে বোঝাতে হয়েছে এমন খুব কম হয়েছে। আর পরীক্ষার ফলাফল প্রথম ৫ জনের ভেতরই ধরে রাখতো। মাস খানিক যাবার পর যা বুঝলাম তা হল, রুনির আসলে কোন প্রাইভেট টিউটর প্রয়োজন কোন কালেই ছিল না। কিন্তু হালের চাহিদা বাসায় অন্তত একজন টিউটর থাকতে হবে সেই কালচার থেকে তার বাবা-মা'য়ের একজন টিউটর প্রয়োজন হচ্ছিল। ২য় মাস পার করার পর আন্টি খুব খুশি হয়েই একটা খাম নিয়ে হাজির। খুব ইতস্ততা হচ্ছিল খামটা নিতে, কারণ আমি এই ধরণের কোন চুক্তি করে এখানে আসি নি, এসেছিলাম শুধুমাত্র আম্মার অনুরোধেই।
পরদিন যখন রুনিদের বাসায় গেলাম তখন রুনি তার আম্মুর সাথে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। যাওয়া মাত্রই সায়মা আন্টি বলল-
তোমার ছাত্রী বায়না ধরেছে তোমার টাকায় চাইনিজ খাবে। একটা যে এক ধরণের অশোভন কাজ সেটা সে মানতেই নারাজ। আর তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকে চাইনিজই খাওয়া হবে, তবে তোমার টাকায় নয়। টাকাটা আমি দিবো তুমি বিল দিবে। এতে কোন সমস্যা আছে আবির?
আমি আসলে গতকালের থেকে আরও বেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আন্টির কথা শুনে। কিন্তু সে যেভাবে বলছে তাতে আমার আর মানা করার কোন উপায় নেই। আর উপরন্তু তারা রেডি হয়েই আমার অপেক্ষা করছিল। তাই অনিচ্ছা স্বতেও "ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই" বলতেই হল। তারপর ঘুরাঘুরি করে চাইনিজ খেয়ে রাতে তাদের গাড়িতে করেই বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল।
এভাবেই চলছিল, রুমির নতুন নতুন সব টপিকের প্রশ্ন আর আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে তার কিছু কিছু জবাব দেয়া আর জোড় করে তার পাঠ্য বই গুলির ভেতরের জিনিষ গুলি আলোচনা করেই দিন যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে খুব বিরক্তি হলেও আম্মু আর আন্টির কথার কারণে ছেড়ে আসতে পারছিলাম না। আর আন্টি তো মহা খুশি। কারণ তার মেয়ে টানা ৫ মাস কোন টিউটর টিকিয়ে রাখতে পেয়েছে এবং অভিযোগ আগের তুলনায় নেই বললেই চলে। যদিও আন্টি আমাদের বাসায় এলে আম্মার সাথে একবার কথা বলার সময় কানে এসেছিল আমার ছাত্রী নাকি আমাকে বোকার হদ্দ বলে তার মায়ের সাথে আলোচনা করে। সেটা শুনে মেজাজ খুব চটেছিল, আর তারপর দিন কয়েক যাইনি। পরে আন্টি বাসায় এসে জিজ্ঞাস করেছিল কি কারণে যাচ্ছি না আমি। তাকে আর উত্তর হিসেবে সেই কারণ বলা হয়নি, অজুহাত দেখাতে হয়েছিল ক্লাস টেস্টের নামে।
রাত ৩টার দিকে আম্মু এসে ভয় পাওয়া গলায় আমাকে জোড়ে জোড়ে নাড়া দিয়ে ডাকতে শুরু করলো। আম্মুর ডাক শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আব্বার খারাপ কিছু হয়েছে এই ভেবে। কি হয়েছে জিজ্ঞাস করতেই বলল-
» না, তোর আব্বুর কিছু হয়নি। ঘুমাচ্ছে। তুই দ্রুত রেডি হ।
» কেন কি হয়েছে?
» সায়মা ফোন করেছিল এইমাত্র। রুনিকে নাকি হসপিটালাইজড করতে হয়েছে।
» কি?!!
» হ্যাঁ। চিৎকার দিয়ে ডাক দিয়েই নাকি জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা। তুই দ্রুত রেডি হ। ওর আম্মু গাড়ি পাঠাচ্ছে বলল, চল গিয়ে দেখে আসি।
আমি ফ্রেস হয়ে টি-শার্ট গায়ে চড়াতে চড়াতে গাড়ি চলে এসেছে। ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আন্টি। দ্রুতই পৌঁছলাম হসপিটালে জ্যাম ছাড়া রাস্তা পার করে। আম্মুকে দেখা মাত্রই সায়মা আন্টি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমি দেখলাম কেবিনের ভেতর রুনি অচেতন অবস্থায় বেডে শুয়ে আছে। বেডের দুই পাশেই বেশ কিছু মেশিন রয়েছে। টিপ টিপ করে শব্দ করে চলেছে। একজন ডাক্তার একপাশের মেশিনের সামনে দাড়িয়ে কিছু একটা করছেন। বিকেল তাদের বাসা থেকে ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিবর্তন বলতে রুনির চেহারায় দুষ্ট-দুষ্ট ভাবটা নেই বরং সেখানে একটা কোমল ক্লান্তি চেহারা অবস্থান নিয়েছে। আর এই অল্প সময়েই চোখের নিজে কালো হয়ে গেছে।
রাতেই নাক-মুখ দিয়ে হঠাৎ করে রক্ত আশা শুরু করলো রুমির। কয়েকজন ডাক্তার উত্তেজিত ভাবে এটা সেটা করতে শুরু করলো। শেষে কোন দিকেই কিছু লাভ হচ্ছে না দেখে ICU তে নিয়ে গেল। ICU তে নেবার পর পরই ব্লাড প্রয়োজন পড়লো। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় আমিই দিয়ে দিলাম এক ব্যাগ আর ২ ব্যাগ হসপিটাল মেনেজ করে দিল।
ভোর হবার কিছুক্ষণ আগেই রুনির অবস্থার একটু উন্নতি দেখছেন বলেই জানালো ডাক্তার। সায়মা আন্টি এতক্ষণ কেঁদে কেটে একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছেন। আম্মাকে জোড়ে করে ধরে বসে আছে সে। এখন আর কাঁদছে না। ভোরের আলো ফোটার একটু পর আমি আম্মাকে বললাম বাসায় হয়ে আসার কথা। আম্মা বলল সায়মা আন্টিকে এভাবে রেখে সে যাবে না। আমাকে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পরে আসতে বলে নিজে থেকে গেলো। আমিও আর তেমন কিছু বললাম না। বাসায় ফিরে এসে গোসল করেই ঘুম দিলাম।
ঘুম ভাঙ্গল ১১টার পর আম্মুর ফোন পেয়ে। আম্মার কণ্ঠে চরম উৎকণ্ঠা, আমাকে বলল যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে চলে আসতে। রুনির অবস্থা আবারও খারাপ পর্যায়ে আছে। ডাক্তার বলছেন ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে। আমি শুধু মুখটা ধুয়েই আবার ছুট লাগালাম। হসপিটাল পৌছতে পৌছতে আধাঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেছে। গিয়ে দেখি গতকাল যে কেবিনে রুনি শুয়ে ছিল আজ সেই কেবিনে আন্টিকে অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে শুইয়ে রেখেছে, আম্মা আন্টির হাত ধরে বসে বসে কান্না করছে। আমাকে দেখে আম্মার কান্না যেন আরও বেড়ে গেল।
সকালের পর রুনির মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আবার। কিন্তু এবার আর রুনি পারেনি, ICU তে থাকা কালীনই সে হারিয়ে যায় সবার সামনে থেকে। এখন শুধু একটা মৃত দেহ পড়ে আছে ঐ রুমটা তে। দুষ্ট সেই রুনিটা ছুটি নিয়েছে দুষ্টামি থেকে। আম্মুর কান্না দেখে আমি সেখানে খুব শক্ত থাকার অভিনয় করছিলাম। কেবিনের বাইরে বেরুতেই কান্না পেয়ে বসলো আমায়। দ্রুত হসপিটালের পার্কিং এ চলে আসলাম। কান্না চেপে রেখে কান্না করার কষ্ট সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।
আজকে সেই দিনটার পর ঠিক কাটায় কাটায় ৫টা বছর পার হয়ে গেছে। সায়মা আন্টি ঐদিনের শকের পর একটু অন্যরকম হয়ে গেছে, কথা বলতে পারে না। আমি তারপর বেশ অনেকদিন গিয়েছি রুনিদের বাসায় ঠিক ঐ সময়টাতেই। কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিলে আন্টির পাশে গিয়ে বসে থাকতাম অনেকটা সময় নিয়ে। আন্টি রুনির সেলফটার পাশে ছবিগুলির সামনে শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকতো। হঠাৎ হঠাৎ জোরে জোরে হেসে ফেলত কিন্তু হাসি দিয়েই আবার চোখ ভিজিয়ে দিতো। না, জোরে জোরে শব্দ করে আর কান্না করতে শুনিনি আন্টিকে। শুধু চোখ গড়িয়ে পানি পড়তো তার।
আঙ্কেল মাস খানিকের ভেতর আন্টিকে নিয়ে বাইরে গেলেন ডাক্তারের পরামর্শে। এরপরই আমার ঐদিকে যাওয়া বন্ধ হয়। আসলে ঐ এলাকাটাকেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। কোন প্রয়োজন থাকলে অন্য কোন ভাবে করিয়ে নিতে চাইতাম। আর একান্তই বাধ্য হলে যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত এলাকাটা ত্যাগ করতাম। আর ভার্সিটির চাপ আর ছোট একটা জব হয়ে যাওয়ায় আর সেদিকে যাওয়ার সময়ই হতো না।
আম্মা মাঝে মাঝেই আন্টিকে গিয়ে দেখে আসতেন। বাইরে থেকে ফিরেও আন্টির বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনো আগের মতই। আম্মা গিয় দেখে আসে, আর ফিরে এসে কান্না করে প্রিয় বান্ধবীটা আর তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার জন্যে। আমি অনুভূতিহীন মানুষের মত সেই সব দেখি। এখন আর কান্না আসে না। বিশ্বাস হতে চায় না এমন একটা মেয়েকে চিনতাম আমি।
আজ অফিস শেষে বাসে করে যখন হসপিটালটা পার হচ্ছিলাম তখন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক ৫ বছর, কোন ভুল নেই। নেমে গেলাম মহাখালী পার হয়ে বনানী পৌঁছে। তারপর হেটে হেটে বনানী গোরস্থানে গেলাম। আশে পাশে অনেকেই তাদের স্বজনদের কবরের সামনে দাড়িয়ে কান্না করছে, হাত দুলে দোয়া করছে। আমি রুনির কবরটার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। আবিষ্কার করলাম আমি বোকার মত মনে মনে অপেক্ষা করছি রুনির আজব কোন প্রশ্নের, অথচ রুনি কোন দিনই আর কোন ধরণের আজব প্রশ্ন করতে পারবে না সে বাস্তবতা আমি জানি।
চেপে রাখা সেই কান্না গুলি কোথা থেকে জানি জমা হচ্ছে আবার। চোখ থেকে তরলও গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ সেটা দেখছে না। বৃষ্টি হচ্ছে আজ, আকাশটাও যেন কান্না করছে দুষ্ট রুনিটার জন্যে........
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:৩১