আমার বোনের বিয়ে হয় আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বছর। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমার বোন শশুড়বাড়ি চলে যায়। আমারও দীর্ঘ দিন কোন পড়া-লেখা বা তেমন কাজ-কর্ম নাই। তাছাড়াও আমার একমাত্র আপু, আমার দ্বিতীয় মাতা, ছোট বেলা থেকেই আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, অনেক স্নেহ করেছে, সেকারণে আপুকে অনেক মিস করি, তাই ছোট-খাট ছুতো করে মাঝে মাঝেই আপুর শশুড়বাড়ি চলে যাই, তাকে দেখতে।
আপুর শশুড়বাড়ি একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। ঘর-বাড়ি খুব কম। বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে বাজার। এ ছাড়া আর কোন বাজার নেই এমনকি গ্রামের আর কোথাও কোন দোকান পর্যন্ত নেই। সামান্য কিছু জিসিষ প্রয়োজন হলেও দুই কিলোমিটার ধুলি-কাদা মাখা কাচা রাস্তা মাড়িয়ে তা কিনতে হয়। আগষ্ট মাসের কোন এক দিনে দুপুর বেলা আপুর শশুড়বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। দিনটা ছিল রোদেলা, আকাশ পরিস্কার, ঝড়-বৃষ্টির কোন মম্ভাবনা একেবারেই ছিল না। দুপুর বেলার খাওয়া-দাওয়া সেরে দুলামিয়া তখন হাটে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। আমাকে বলল, তুমি একা একা বাড়িতে থাকবে, তার চেয়ে বরং চল আমার সথে বাজার থেকে ঘুরে আসি। আমি ভাবলাম, দুলাভাই বাজারে চলে যাচ্ছে আর আপুও তো সারা বিকাল কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে, আমার তো একা একাই থাকতে হবে; আর তাছাড়া অতবড় ঐতিহাসিক হাট, কখনো যাইওনি। দুরত্ব যদিও একটু বেশি এবং সম্পুর্ণ দুরত্ব পায়ে হেটে অতিক্রম করতে হবে, এই অসুবিধাটুকু থাকা সত্বেও আমার দুলাভাইয়ের সাথে বাজারে যেতে খুব ইচ্ছা করছিল। পাছে আপু আবার কিছু বলে, তাই তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমি চুপ-চাপ থাকলামা। এদিকে আপুও বলল, যা, বেড়িয়ে আয়, খামখা বাড়িতে বসে থেকে কি করবি! কাজেই আর কোন কথা না বলে দুলামিয়ার সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
বাড়ি থেকে বাজরের দুই কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করতে হয় একটি কাচা রাস্তা ধরে। আমি আগে আর কখনোও এই রাস্তায় আসিনি। রাস্তা শুকনা, কিন্তু ধুলা নেই, মাঝে মাঝে বরং ছোট-খাট গর্তে দুই-একদিন আগের বৃষ্টির জমে থাকা পানি আর কাদা দেখা যাচ্ছে। বাড়ি থেকে কিছুদুর এগিয়ে গেলেই একটি পুরান সরকারি পুকুর। পুকুরে পাড় গুলো প্রসস্ত করে বাধানো। বাজারের রাস্তাটি পশ্চিম পাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। পুর্ব পাড়ে ঘন গাছ-গাছালিতে ঢাকা একটি পরিত্যক্ত বাড়ির মত। দুলাভাইর কাছ থেকে জানতে পারলাম, ৭/৮ বছর আগে লীজে মাছ চাষ করতে আসা এক ব্যবসায়ী বানিয়েছিল, তার লীজের মেয়াদ শেষ হলে সে ব্যাবসা গুটিয়ে চলে যায় কিন্তু ঘর গুলো আর ভেঙ্গে নিয়ে যায়নি এবং তার পরে আর কেউ মাছ চাষ করতে আসেওনি। আর ওইটা মুলতঃ কোন বাড়ি নয়, মাছের খাবার রাখা ও মাছ পাহারা দেয়ার জন্য দুইটা মাত্র ঘর তোলা হয়েছিল।
রাস্তার আশ-পাশ খুবই নীরব। আপুর বাড়ি থেকে অর্ধ কিলোমিটার দুর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে তাকালে দুই-একটা বাড়ি-ঘর দেখা যায়। এর পর বাজারের আগ পর্যন্ত আর কোন বাড়ি-ঘর নাই। অর্থাৎ দেড় কিলোমিটারের মত রাস্তা খা খা মাঠের উপর দিয়ে চলে গেছে। দুলাভাইদের বাড়ি আর বাজারের মাঝা-মাঝি যায়গায় ১০০/১৫০০ হাত যায়গা জুড়ে বাঁশবন। রাস্তার দুই পাশে ঘন বাঁশঝাড়। রাস্তার দুই পাশ থেকে বাঁশ গুলো হেলে এক পাশের গুলোর মাথা আরেক পাশের গুলোর সাথে ঠেকে ঘন বাঁশ পাতার ছাউনি তৈরী করেছে। বাঁশ বনের ভিতরে গজারী গাছ সহ আরও অনেক ঘন পাতা যুক্ত বন্য বৃক্ষ মিলে বাশ বনটাকে এমন ঘন ছায়া নিবিড় করে তুলেছে যে ঠিক দুপুর বেলাদেও সেখনে এক চিলতে রোদের আলো পৌছায়না। বাঁশবনটির ঠিক মাঝ বরাবর পৌছে ঝলমলে রোদের দুপুরেও যে গোমট পরিবেশে দেখলাম, তাতে দিনের বেলাতেই ভয়ে আমার গা ছম ছম করতে লাগলো।
আমার ভয় পাওয়া টের পেয়ে দুলাভাই মুচকি হেসে বলল, এই জংলার মাঝখানের এই জায়গাটা বৈশাখ মাসের গরমের সময়ও স্যাতস্যাতে ভিজা থাকে, জানো!
আমি বললাম, তাই তো হওয়ার কথা, যে পরিমাণ ছায়া, রোদ আসার সুযোগই তো নাই, শুকাবে কি করে!
তিনি আমাকে বলেলন, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
আমি ভয়ই পাচ্ছিলাম, তবুও বললাম, দিনের বেলা আবার ভয় কিসের?
তিনি বলেলন, এই যায়গাটার কিন্তু অনেক বদনাম আছে!
আমি বললাম, কি রকম বদনাম, ভাই?
তিনি বলেলন, সন্ধ্যার পর বাজার থেকে ফেরার পথে অনেকেই এখানে ভুত দেখতে পায়। গত বছর তো উত্তর পাড়ার কালু চাচা এইখানে ভয় পেয়ে অসুখে পড়লেন, এবং সেই অসুখে ভোগে মারাই গেলেন।
দুলাভাইয়ের কথা শুনে আমি আরও ভয় পাইতে শুরু করলাম।
তারপর ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কখনও ভয় পাননি এখানে?
তিনি বলেলন, আমি বাজার থেকে ফিরতে কখনোও রাত করি না। আর যদি কখনোও রাত হয়েও যায়, আমি একা ফিরি না, পাড়ার কাউকে খুজে নিয়ে তার সঙ্গে ফিরি অথবা বাজারের কাছেই তো আমার মামাদের বাড়ি, অনেক মামাত ভাই আছে, কোন একজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরি।
বাজার পর্যন্ত কথা বলতে বলতে গেলাম। মাঝখানে বেশ কয়েকবার প্রসঙ্গ বদল হওয়াতে বাজার পর্যন্ত পৌছাতে পৌছাতে ভুত ও ভুতুড়ে বাঁশ-ঝাড়ের কথা ভুলেই গেলাম।
বাজারে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সপ্তাহে দুইদিন মাত্র বসে এই বাজার। আশে আর কোন বাজার-ঘাট নাই। তাই আশ-পাশের সকল গ্রামের মানুষ-জন তাদের অর্ধ সপ্তাহের পণ্য সামগ্রী সংগ্রহ করতে আসে, তাইতো বাজারে এত ভীড়।
বাজারে দুলাভাইয়ের এক মামার একটি ছোট ওষুধের দোকান আছে। বাজারের উপচে পড়া ভীড়ের মধ্যে আমাকে টানা-হিচড়া করাটা দুলাভাইয়ের কাছে শোভনীয় মনে হল না। তাই আমাকে তার মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে ওনার দোকানে বসিয়ে রেখেতিনি বাজারের কাজ সারতে চলে গেলেন।
অনেক সময় পার হয়ে গেল, দুলাভাই আসছে না। দোকানদার তালুই মশাইও তার অষুধ বেচার কাজে ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলার টাইমই পাচ্ছে না। আমার বিরক্ত লাগছিল চুপ-চাপ বসে থাকতে। তাই তালুই মশায়কে বললাম, আমি বাহির থেকে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি!
তিনি বলেলন, কোথায় যাবা?
আমি বললাম, কোথাও না, এদিক ওদিক একটু হেটে-গুটে দেখি।
তিনি বলেলন, যাও, তাড়াতাড়ি চলে এস।
আমি “আচ্ছা, ঠিক আছে” বলে বের হলাম।
আনমনে হাটতে হাটচতে বাজারের এক প্রান্তে চলে এলাম। এখানে কোন মানুষ নাই। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন ডাক দিল, এই যে ভাইয়া, শুনুন!
আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার সমবয়সী একটা ছেলে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, ভাইয়া, আপনি আমিনা ভাবীর ছোট ভাই না?
আমি বললাম হ্যা, কিন্তু, আপনাকে ঠিক…………
সে বলল, আমি রফিকুল ভাইর মামাত ভাই। ভাইয়ার বিয়ের সময় আপনাকে দেখেছিলাম। আমার মনে আছে। আপনি হয়ত চিনতে পারতেছেন না…।
আমি আমাতা আমতা করছি দেখে সে হেসে দিয়ে বলল, ভাবী তো আপনার কথা অনেক গল্প করে, তাই আপনার চেহারা মনে আছে আমার। আমাকে চিনতে পারতেছেন না বলে লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই।
আমি জিজ্ঞাস করলাম, কি গল্প করে?
সে বলল, আপনি পড়া-শোনায় ভাল, খেলা ধুলায়ও নাকি ভাল!
আমি বললাম, না, তেমন কিছু না। আমি তার একমাত্র ভাই ত, তাই হয়ত একটু বাড়িয়েই বলে।
এভাবে তার সাথে অল্পক্ষণ কথা বলেই বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। বেশ কিছু প্রিয় প্রিয় কথা বলে অল্পক্ষণেই খাতির জমিয়ে ফেলল।
কিছুক্ষণ পর সে বলল, আচ্ছা রফিকুল ভাই তো বাজার থেকে তাড়াতাড়িই চলে যাবে । আপনি নাহয় এক কাজ করেন কি, ভাইকে চলে যেতে বলে আসেন, আমরা সারা বিকাল ঘুরে বেড়াই, আড্ডা-সাড্ডা মারি, পরে সন্ধ্যার পর আমি আপনার সঙ্গে একসাথে ভাইদের বাড়ি যাব এবং আপনি যে কয়দিন থাকেন, আমিও থাকব সে কয়দিন আপনার সাথে!
প্রস্তাব টা আমার খুবই পছন্দ হলো। দুলাভাইদের বাড়িদে আমার সমবয়স্ক কেউ নাই। দুলাভাইয়ের সথে ফিরে গেলে সারা বিকাল আমাকে একা একা বোরিং সময় কাটাতে হবে। তাই তার সাথে থেকে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
আমি বললাম, আপনিও চলেন, আমার সাথে, একসথে যাই, বলে আসি ভাইয়াকে!
সে বলল, আমার একটা ছোট কাজ আছে, আমি ওইটা সেরে আসি, আপনি বরং ভাইকে বলে এসে এখানে দাঁড়ান।
আমি “আচ্ছা, ঠিক আছে” বলে তালুই সাহেবের দোকানের দিকে অগ্রসর হলাম।
দোকানে গিয়েই দুলাভাই কে পেয়ে গেলাম, খোজা-খুজি আর করতে হলো না।
দুলাভাই আমাকে দেখেই বলল, কই গেছিলা?
আমি তার কথার জবাব দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, ভাইয়া, আপনার এক মামাত ভাইয়ের সাথে পরিচয় হল, উনি বলল, সন্ধ্যার পর উনি আপনাদের বাড়িতে যাবে। আমি ওনার সাথে এইদিকে কিছুক্ষণ ঘুরা-ঘুরি করি, পরে সন্ধ্যার দিকে ওনার সাথে একসাথে চলে আসব।
দুলাভাই বলেলন, কোন মামাত ভাই?
আমি তো তার নাম জিজ্ঞাস করিনি, কি করে বলি এখন কোন মামাত ভাই? নাম বলতে পারলাম না, শুধু বললাম, অহহো ভাই! ওর নাম তো জিজ্ঞাস করিনি! তবে আমার বয়সী, লম্বা-সম্বা দেখতে!
আমার বয়সী এবং লম্বা-সম্বা দেখেতে দুলাভাইয়ের ২/৩ জন মামাত ভাই ছিল।
দুলাভাইয়ের মোট ছয়জন মামা, এবং মামাদেরও সকলেরই উৎপাদনশীলতা উচ্চ মাত্রার। কাজেই মামাত ভাই-বোনের বিশেষ প্রাচুর্য ওনার। তিনি সঠিক ভাবে বুঝতি পারল কি পারল না, যে আমি কোন মামত ভাইয়ের কথা বলেছি, তা জানি না, তবে আমাকে রেখে যাওয়ার বিষয়ে রাজি হলেন।
বলেলন, তাড়াতাড়ি চলে এস, বেশি দেরি করলে কিন্তু তোমার আপা রাগ করবে।
আমি “আচ্ছা, চলে আসব” বলে বেয়াই মশায়ের সাথে সাক্ষাতের নির্ধারিত স্থানের দিকে আগাতে থাকলাম।
আমার নতুন বিয়াই বন্ধুর বন্ধুতা ও বিনয়ের পাল্লায় পড়ে বাজার থেকে আপুর বাড়ি ফিরার পথের সেই জন-শুন্য রাস্তা, মাঝ রাস্তার ঘুট ঘুটে অন্ধকারময় গা ছম ছম করানো ভুতুড়ে বাঁশঝাড়, সবকিছুর কথাই ভুলে গেছি। বিয়াই মশায় আমার সারা বিকাল আমাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে, ভুবন ভুলানো গল্প-রসিকতায় আর দুরন্তপনায় আমার মন জয় করে নিল অল্প সময়ের ভিতরেই। হাসি-ঠাট্টা আর গল্প কথায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। সারাদিন কোন মেঘ-বৃ্ষ্টির আভাস ছিল না, হঠাৎ করে ঝড়ো বাতাস শুরু হল আর কয়েক মিনিটের ভিতরেই আকাশ মেঘে ছেয়ে কাল হলে গেল।
ততক্ষণে আমার আচ্ছন্নতা কাটল। আমি তাকে বললাম, ভাই, রাত তো হয়ে যাচ্ছে, যেতে হবে! তার উপর আবার আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসতে পারে। তাড়াতাড়ি চলেন।
তাদের বাড়ি বাজারের কাছা-কাছি হলেও সারাবিকালে সে একবারও তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেনি এবং এখনও বলল না, যে বৃষ্টি আসতেছে তো কি হয়েছে! আমাদের বাড়িতে থাকবেন। তা না বলে সে বলল, আরেকটু সময় দেখি, যদি আকাশ পরিস্কার হয়!
আমিও প্রতিবাদ না করে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে।
প্রায় ঘন্টা খানেক বাজারের পাশে দেউরি বিহিন একটা পরিত্যক্ত দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আকাশটা ঘন মেঘে আচ্ছন্ন, হাল্কা হাল্কা বাতাশ, মৃদু মেঘের গর্জন আর অল্প অল্প বিজলির ঝিলিক আসছে। সেখান থেকে বাজারের ভিতরে জন-মানুষ দেখা যাচ্ছে কিন্তু আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি সেদিকে কেউ আসছে না। এইদিকের রাস্তাটার উপর ঘন সবুজ দুর্বা ঘাস দেখেই বুঝা যায় যে এই রাস্তায় তেমন একটা লোকজন চলাচল করে না।
হঠাৎ সে বলেউঠল, ধুর! বৃষ্টি নামবে না। চলেন আমরা আগাই।
আমারও মনে হল বৃষ্টি নামবে না। তাই তার কথায় সায় দিয়ে চলতে শুরু করলাম। আমরা যেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, আপুর শশুরবাড়িতে ফিরার রাস্তা তার বিপরীত দিকে। কাজেই, বাজারের মাঝখান দিয়ে গিয়ে আমাদেরকে রাস্তায় উঠতে হবে। আমরা কথা বলতে বলতে বাজারের ভিতরে চলে আসলাম। বাজারের লোকজন তাড়াহুড়া করে যে যার যার ব্যাবসা-পাতি গোছাচ্ছে, যাতে বৃষ্টি আসলে ভিজে না যায়। এমন সময় বেয়াই কি একটা হাসির কথা বলল আর আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। আমার হাসি শুনে পাশ থেকে এক লোক বললল, ”কি ভাই!, ম্যাঘের দিনে কিয়ের এত খুশি, এল্হা এল্হাই আসুইন য্যা বড় !”
আমি অবাক হলাম আর মনে মনে বললাম, শালা কানা নাকি! তার পর “না ভাই, কিছু না, এমনি” বলে আমরা আগাতে থাকলাম। তার দিকে আর মসযোগ দিলাম না।
বাজারের ক্ষীণ আলো পিছনে ফেলে যখন রাস্তায় উঠলাম, মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যারাতের জমাট অন্ধকারে ডুবে গিয়ে এতক্ষণে আমার মনে পড়ল সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভুতুড়ে বাঁশ বাগারের কথা। মনে পড়ার সাথে সথেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসল, বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে লাগলো। সারাবিকাল বিয়াই মশায় এত কথা বলল, অখচ বাজার পার হয়ে রাস্তায় উঠার পর থেকে সে আর কোন কথাই বলতেছে না। আমি ধারণা করলাম সেও হয়ত ভয় পাচ্ছে।
আমি ভয়ে যবুথবু হয়ে আছি। ভয় মাখানো কন্ঠেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কোন কথা বলতেছেন না যে, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
প্রশ্নটা করার পর প্রচন্ড ভয়ের মাঝেও নিজেরেই খুব হাসি পেতে লাগল। যে লোক নিজে ভয়ে জাবু থাবু খেয়ে হাটার শক্তি হারিয়ে বসেছে, সে আবার নিচ্ছে অন্যজনের ভয়ের খোজ!
আমার প্রশ্নের কোন জবাব সে দিল না। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বিজলির চমক দেখা গেলেও অন্ধকারটা খুব ঘন। নিজের হাত নিজে দেখা যাচ্ছে না। আমি খুব দেখে-শুনে, সাবধানে পা ফেলে হাটতেছি, কখন না আবার আছাড় খাই। সে প্রথম দিকে আমার সমান গতি নিয়ে হাটলেও নির্জনতার দিকে যতই আগাচ্ছি, তার গতি ততই বাড়ছে। আমি তাকে বললাম, ভাই, একটু আস্তে হাটেন, আমার তো অচেনা পথ, আমি আপনার মত এত দ্রুত হাটতে পারতেছি না। সে কোন কথা না বলে এমন ভাবে হন হনিয়ে হাটতে থাকল যেন দিনেরে আলোতে হাটছে। কোন মতে টাল সামলে সামলে তার সাথে তাল রেখে হাটতে থাকলাম। সেই বাঁশবনের কাছাকাছি আসার পর সে হঠাৎ থমককে দাড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞাস করল, আচ্ছা আপনি কি ভুতে ভয় করেন?
তার প্রশ্ন শুনে ভয়ে আমার হার্ট এটাক হবার যোগাড় হল। এমনিতেই ভয়ে আমার হাত-পা কাপতেছিল, তার উপর এরকম নির্জন বাঁশবাগানের ধারে এরকম খাপছাড়া প্রশ্ন শুনলে কি অবস্থাটা হতে পারে? আমি প্রায় হাটার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। গলা এমন ভাবে শুকিয়ে এল যে তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত কোন শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে পারলাম না।
তার পর সে আর কোন কথা না বলে এবার ধীর পায়ে আগাতে থাকল। আস্তে আস্তে আমরা প্রবেশ করলাম সেই ভয়ংকর ঘুটঘুটে বাঁশবাগানের ভিতর। আমার হার্টবিট কয়েকগুণ বেড়ে গেল। বাঁশবাগানের ঠিক মাঝ বরাবর আসার পর আকস্মিক দাড়িয়ে আমাকে ভয়ের মাঝে আরও আতংকে দিশেহারা করে দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, আমার একটা সিক্রেট কথা ছিল আপনাকে বলার। আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। সে আমার কথার অপেক্ষাও করল না। সে বলতে থাকল তার সিক্রেট।
শুনুন আমি কিন্তু এখন আর বেঁচে নাই। আজথেকে কয়েকমাস আগেই আমি মারা গেছি!
এরকম সিচুয়েশনে এই কথা শুনলে অবস্থা কি হতে পারে? তার কথা শুনে হতভম্ভ হয়ে তারদিকে তাকালাম। তাকিয়ে এমন জমাট অন্ধকারের ভিতরেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, তার চোখের যায়গায় চোখের বদলে দুটি বিশাল গর্ত আর মুখমন্ডল থেকে মাংশ খসে খসে পরছে, দুই চোয়াল জুড়ে দেখা যাচ্ছে গোড়া সহ বিশাল বিশাল দাঁত। থুতনি বেয়ে তাজা রক্ত পড়ে গায়ের জামা ভিজে যাচ্ছে।
এইটার সাথে আমি সারাবিকাল গল্প করেছি, কি বিভষিকা!
প্রাণ পণে দৌড় দিলাম দুলাভাইদের বাড়ির দিকে। জমাট অন্ধকারে অচেনা রাস্তায় দৌড়াতে গিয়ে কতবার আছাড় খেলাম, উঠে আবার দৌড়ালাম। কিছু পথ দৌড়ানের পর দেখলাম কেউ একজন টর্চ লাইট নিয়ে এদিকে আসছে, দেখে স্বস্তি পেলাম, ভাবলাম প্রাণটা বুঝি বাঁচল। আমি আরও জোরে সোরে দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার দুলাভাই তার এক চাচাত ভাইকে নিয়ে এদিকে আসছে। আহ! তাদেরকে দেখে উদ্গত প্রাণটা যেন ফিরে পেলাম!
তিনি আমাকে দেখেই বলেলন, এত দেরী করতেছিলা কোথায়? আমরা সবাই তো ভিষণ দুশ্চিন্তা করতেছি! এত রাত হল, ছেলেটা ফিরে না কেন! শেষমেস তো খুজতেই বের হয়ে পড়লাম।
বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল। তার পর আমি বললাম, কেন এবং কিভাবে দেরি হল।
আমি অন্ধকারে এভাবে দৌড়িয়ে হাপাতে হাপাতে তাদের সামনে আসলাম, কাজেই তাদের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথই আমাকে দৌড়ানোর কারণ জিজ্ঞাস করা তাদের উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা জিজ্ঞাসা না করে বরং আমাকে দেরী হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করল।
আমার দেরী হওয়ার কারণ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করার পর তিনি আমাকে বলেলন, এবার বল, এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন?
আমি তখন বললাম, আপনার যে মামাত ভাই আমাকে দেরী করাল, বাঁশবাগানে এসে সে আমাকে বলে কি, সে নাকি বেচে নাই। অনেক আগেই মরে গেছে। তার কথা শুনে তার দিকে তাকাতেই অন্ধকারের মধ্যেও দেখলাম যে তার চোখের যায়গায় চোখের বদলে বিশাল বিশাল গর্ত, মুখ থেকে এরং সারা গা থেকে টপ টপ করে মাংশ খসে পড়ছে, সারা গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর কি বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ! কথা গুলো বলা শেষ করে খেয়াল করলাম, দুলাভাইর সাথে যে ছেলেটা ছিল সে এই মুহুর্তে আশে পাশে কোথাও নেই।
এই কথা শুনে আমার দুলাভাই বলল, ও আচ্ছা, এই কথা!বলে তার মুখের দিকে টর্চলাইট ফোকাস করে বলল, তাকিয়ে দেখ ত আমার মত এরকম ছিল নাকি!
আমি তাকিয়ে দেখলাম, এতক্ষণ যার সাথে আমি দুলাভাই ভেবে কথা বলছিলাম, তার গা থেকও একই ভাবে মাংশ খসে পড়ছে, তার চোখের কোটর গুলোতে যেমন বিভৎস গর্ত ছিল, এর চোখের কোটর গুলোতেও তেমনই বিভৎস গর্ত! আর চারিদিকের বিকট দুর্ঘন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছিল। আর কিছু ভাবতে পারলাম না। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
পরে আমার জ্ঞান ফিরল রাত ১:০০ টার দিকে। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমি আপুদের বাড়িতে শুয়ে আছি আর তাদের বাড়ির সবাই আমার পাশে জটলা করে বসে আছে। জানতে পারলাম দুলাভাই তার এক চাচাত ভাইকে নিয়েই আমাকে খুজতে গিয়েছিল এবং আমাকে রাস্তার উপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়।
জ্ঞান ফিরার পর আপু আমাকে জিজ্ঞাস করল, কি হয়েছিল। আমি বিকাল থেকে সব ঘটনা খুলে বললাম।
শুনে দুলাভাই বলল, আট মাস আগে তোমার বয়সী আমার এক মামাত ভাই সত্যি আত্মহত্যা করেছিল ওই বাঁশ বাগানে এসে, গতকাল যাওয়ার পথে ওখানে গিয়ে তোমার ভয় পাওয়া দেখে আর সে কথা তোমাকে বলিনি। কিন্তু সে কেন তোমার উপর চড়াও হলো, সে কথা তো বুঝতে পারছি না……………………!!!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:২৬