somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরাজিত একজনের ‘অপরাজিত’র কয়েক পাতা।

০৬ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সহিত পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা মিশ্রিত- এমন কি মায়ের মৃত্যুসংবাদ প্রথম যখন সে তেলি-বেড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিশ্বাস...একটা বাধন-ছেড়ার উল্লাস... অতি অল্পক্ষণের জন্য-নিজের অজ্ঞাতসারে। তাহার পরই নিজের মনোভাবে তাহার দু:খ ও আতঙ্ক উপস্হিত হইলো। এ কি! সে চায় কি! মা যে নিজেকে একেবারে বিলোপ করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহার সুবিধার জন্য। মা কি তাহার জীবনপথের বাধা? –কেমন করিয়া সে এমন নিষ্ঠুর, এমন হৃদয়হীন-। তবুও সত্যকে সে অস্বীকার করিতে পারিল না। মা কে এত ভালবাসিত তো, কিন্তু মায়ের মৃত্যুসংবাদটা প্রথমে যে একটা উল্লাসের স্পর্শ মনে আনিয়াছিল—ইহা সত্য-সত্য তাহাকে উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। তাহার পর সে বাড়ি রওনা হইল। উলা স্টেশনে নামিয়া “হাটিতে” শুরু করিল। এই প্রথম এ পথে সে যাইতেছে-যেদিন মা নাই! গ্রামে ঢুকিবার কিছু আগে আধামজা কোদলা নদী, এ সময়ে ‘হাটিয়া’ পার হওয়া যায়- এরই তীরে কাল মাকে সবাই দাহ করিয়া গিয়াছে! বাড়ি ‘পৌছলো’ বৈকালে। ঘরের পৈঠায় অপু চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। উঠানের বাহিরে পোড়া খড় জড়ো করা। ...মা মারা গিয়াছেন অপুর এখনো বিশ্বাস হয় নাই...একুশ বত্সরের বন্ধন, মন এক মূহুর্তে টানিয়া ‘ছিড়িয়া’ ফেলতে পারে নাই...কিন্তু পোড়া খড় গুলো নগ্ন, রূঢ়, নিষ্ঠুর সত্যটা... মা নাই! মা নাই! ... বৈকালের কি রূপটা! নির্জন, নিরালা, কোন দিকে কেহ নাই। উদাস পৃথিবী, নিস্তব্ধ বিবাগী রাঙা-রোদভরা আকাশটা। ... অপু অর্থহীন দৃষ্টিতে পোড়া খড়গুলোর দিকে চাহিয়া রহিল।...

কিন্তু মায়ের গায়ের ‘কাথা’খানা উঠানে মেলিয়া দেয়া কেন? ‘কাথা’খানা মায়ের গায়ে ছিলো ...

সব মিটিয়া গেলে সে কলিকাতায় ফিরিবার উদ্যোগ করিল। সর্বজয়ার ‘জাতিখানা’, সর্বজয়ার হাতে সই-করা খানদুই মনিঅর্ডার চালের বাতায় ‘গোজা’ ছিল- সেগুলি, সর্বজয়ার নখ কাটিবার নরুনটা, ‘পুটলির’ মধ্যে ‘বাধিয়া’ লইল। দোরের পাশে ঘরের কোণে সেই তাকটা—আসিবার সময় সেদিকে নজর পড়িল। আচারভরা ‘ভাড়’, আমসত্বের ‘হাড়িটা’, কুলচুর, মায়ের গঙ্গাজলের পিতলের ঘটি, সবই পড়িয়া আছে... যে যত ইচ্ছা খুশি খাইতে পারে, যাহা খুশি ‘ছুইতে’ পারে, কেহ বকিবার নাই, বাধা দিবার নাই। তাহার প্রাণ ডুকরিয়া ‘কাদিয়া’ উঠিল। সে মুক্তি চায় না ... অবাধ অধিকার চায় না—তুমি এসে শাসন করো, এসব ‘ছুতে’ দিও না, হাত দিতে দিও না—ফিরে এসো মা... ফিরে এসো...

কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল, একটা তীব্র ঔদাসীন্য সব বিষয়ে, সকল কাজে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়ানক নির্জনতা ভাবটা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছিল, কলিকাতায় থাকিতে একদন্ড ইচ্ছা হয় না... মন পাগল হইয়া উঠে, কেমন যেন পালাই-পালাই ভাব হয় সর্বদা, অথচ পালাইবার স্হান নাই, জগতে সে একেবারে একাকী—সত্য সত্যই একাকী।

এই ভয়ানক নির্জনতার ভাব এক-এক সময় অপুর বুকে পাথরের মতো চাপিয়া বসে, কিছুতেই সেটা সে কাটাইয়া উঠিতে পারে না, ঘরে থাকা তাহার পক্ষে তখন আর সম্ভব হয় না। গলিটার বাহিরে বড় রাস্তা, সামনে গোলদিঘী, বৈকালে গাড়ি, মোটর, লোকজন, ছেলেমেয়ে। বড় মোটরে গাড়িতে কোন সম্ভ্রান্ত গৃহস্হের মেয়েরা বাড়ির ছেলেমেয়েদের লইয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছে, অপুর মনে হয় কেমন সুখি পরিবার!—ভাই, বোন, মা, ঠাকুরমা, পিসিমা, রাঙ্গাদি, বড়দা, ছোটকাকা। যাহাদের থাকে তাহাদের কি সব দিক দিয়াই এমন করিয়া ভগবান দিয়া দেন কেন! অন্যমনস্ক হইবার জন্য সে এক-একদিন সে ইউনিভার্সিটি ইনিস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে গিয়া বিলাতি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাইতে থাকে। কিন্তু কোথাও বেশিক্ষণ বসিবার ইচ্ছা হয় না, শুধুই কেবল এখানে-ওখানে, ফুটপাথে হইতে বাসায়, বাসা হইতে ফুটপাথে। এক জায়গায় বসিলে শুধু মায়ের কথা মনে আসে, মনে হয় বাহিরে কোথায়ও চলিয়া গেলে শান্তি পাওয়া যাইতো—যে কোন জায়গায়, যে কোন জায়গায়—পাহাড়ে, জঙ্গলে, হরিদ্বারে, কেদারা-বদরীর পথে—মাঝে মাঝে ঝরনা, নির্জন অধিত্যকায় কত ধরণের বিচিত্র বন্যপুষ্প, দেওদার ও পাইন বনের ঘন ছা্য়া সাধু সন্যাসী দেব মন্দির. রামচটি, শ্যামচটি কত বর্ণনা তো সে বইয়ে পড়ে, একা বাহির হইয়া পড়া মন্দ কি?—কি হইবে এখানে শহরের ঘিন্জি ও ‘ধোয়ার’ বেড়াজালের মধ্যে?

দশপিন্ড দানের সে কি তীব্র বেদনা! পুরোহিত বলিতেছেন—প্রেতা শ্রীসর্বজয়া দেবী—অপু ভাবে কাহাকে প্রেত বলিতেছে? সর্বজয়া দেবী প্রেত? তাহার মা, প্রীতি আনন্দ ও দু:খ-মূহুর্তের সঙ্গিনী, এত আশাময়ী, হাস্যময়ী, এত জীবন্ত যে ছিল কিছুদিন আগেও, সে প্রেত? সে আকাশোস্হো নিরালম্বো বায়ভুত-নিরাশ্রয়:?

তারপরই মধুর আশা বাণী—আকাশ মধুময় হউক, বাতাস মধুময় হউক, পথের ধূলি মধুময় হউক, ওষধি সকল মধুময় হউক, বনস্পতি মধুময় হউক, সূর্য, চন্দ্র, অন্তরক্ষস্হিত আমাদের পিতা মধুময় হউন।

সারাদিনব্যাপী উপবাস, অবসাদ, শোকের পর এ মন্ত্র অপুর মনে সত্য সত্যই মধুবর্ষণ করিয়াছিল, চোখের জল সে রাখতে পারে নাই। হে আকাশের দেবতা, বাতাসের দেবতা, তাই কর, মা আমার অনেক কষ্ট করে গিয়েছেন, ‘তার’ প্রাণে তোমাদের উদার আশীর্বাদের অমৃতধারা বর্ষণ কর।


[কয়েকদিন আগে এমনিতেই বসে বিভূতিভূষন এর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস সমগ্র’র পাতা উল্টাচ্ছিলাম। প্রথম যে পাতাটা খুলেছিলো সেটা ছিলো এই পাতাটা।] ব্লগে সম্ভবত নিজের কথা, বিশ্লেষন তুলে দেবার কথা, সরাসরি তুলে দেবার কথা না। সেই বিচারে বোধহয় এটা প্রকাশ হবার কথা না। কিন্তু আমি তো আর কিছু লিখতে পারলাম না। ]
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×