(বিশ্ব চলচ্চিত্রের হাই-টেক সঙ্গীতায়ন বিশেষ করে হ্যান্স জিমারের মতো একজন সঙ্গীতজ্ঞের কম্পোজিশন; শব্দ-বাক্যে ধরতে পারাটা বেশ দুরূহসাধ্য। ব্লগ পাতাটি শ্রোতা-অভিজ্ঞতালব্ধ ভালোলাগার লিখিতরূপ মাত্র)
হ্যান্স জিমার’স মিউজিকের সাথে আমার পরিচয় গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমায়। সিনেমায় রোমান সংস্কৃতির ঐতিহাসিক অনুবন্ধ আর সাউন্ডট্রেকে মিডল ইস্টার্ন সঙ্গীতের প্রভাব ছিলো মুগ্ধ করার মতো। “নাও উই আর ফ্রি” থিম সং টির কথাই ধরুন- ইউফোরিক ট্রান্সে নাটকীয় পিচ্ বিজড়িত সুর ও গ্রুভ-সেন্ট্রিক স্তুতির ক্বণন, আপনাকে মোহিত কি করেনা ? জিমারের আরেকটি সুন্দর কাজ হচ্ছে রেইন ম্যান। আত্মবাদী উডওয়াইন্ডস এর সাথে হালকা রক ঘষে দিয়েছেন। এতে, প্রতিবন্ধী চরিত্র রেমন্ডের মানসিক দোলাচলতার স্বরূপ প্রনোদিত হয়েছে ততোধিক।
মূলত ফিল্ম-স্কোর বা সিনেমার আবহ সঙ্গীত লেখা হয় চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফির ঠাট, শুটিং লোকেশন, ক্যারেক্টার অভিব্যক্তি ইত্যাদিকে ভিত্তি ধরে। যা বন্দিকৃত দৃশ্যে সুরারোপ পর: দৃশ্যবস্তুর কথা পরিস্ফুট করে প্রার্থিত আবহ দর্শক মনে পৌঁছে দেয়। দর্শন-শ্রবণের ঐকতান যতো সফল হবে, সিনেমাও স্পর্শ করবে দর্শকের অনুভূতি তন্ত্রীতে। ঋত্বিক ঘটক বলতেন- “চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে, সাধারণ পায়ে চলার পথে তার আনাগোনা নয়”। অতি সাধারণ সিকুয়েন্সও অভিজাত ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব সুর-স্লোগান নামক অদৃশ্য তুলির ছোঁয়ায়। যেমন ধরা যাক “দ্যা লায়ন কিং” এনিমেটেড মুভিটির কথা। আফ্রিকান ভোকালস এবং আফ্রো-ক্যারিবিয়ান ছন্দের মিষ্ট কল্লোল এঁটে, গল্পটিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গেছেন কিন্তু এই হ্যান্স জিমার সাহেব !
সিন্থেসায়যারের চার মাত্রার ওয়েব কষে প্রথাগত অর্কেস্ট্রার সাথে জুড়ে দিতে জিমার পাক্কা ওস্তাদ বটে। সংগীততত্বের প্রাযুক্তিক উন্নয়ন, ইলেকট্রনিক মিউজিকের সাথে বাদ্যযন্ত্রীদের সুষম যুগলবন্দি, ওর স্কোরগুলোকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে চলেছে। রচনাশৈলী/শব্দ কাঁপুনি সমসাময়িক হলেও ধ্রুপদী পটভূমির সংযোজন ঘটিয়ে, ডিপথ্ অব পার্সপেকটিভে নিজের স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিচয়টি ঠিক বজায় রাখেন। যেনো শুনলেই ধরা যায় এটা জিমারের সাক্ষর। স্বদেশী লুডভিগ বেটোফেনের উত্তরসূরির প্রতিটি সৃষ্টি অত্যন্ত মার্জিত ও নিগূঢ়রকম। যদিও তার বেশিরভাগ কাজই এ্যাকশন থ্রিলারধর্মী সিনেমায়। দ্যা লাস্ট সামুরাই এর স্কোরে- জাপানিজ লয়ের আঞ্চলিকতা অটুট রাখার পাশাপাশি, যোদ্ধা-দামামায় দারুণ কিছু ধ্যানমগ্ন ক্যালিবার থ্রো করেছেন ! তাতে সামুরাই কিং হবার ইচ্ছে জাগতেই পারে।
“দ্যা জোকার” থিমটিতে উত্তাল সাউন্ড ইফেক্টের যে নিনাদ তিনি শুনিয়েছেন সেটি নিঃসন্দেহে মনোবিকারগ্রস্ততার আরেক আন্দাজ। তবে জিমারের স্ট্রোক অফ জিনিয়াস কৃতিটি হচ্ছে- ইনসেপশন মুভির “টাইম”। ক্রিস্টোফার নোলানের যুগান্তকারী এক সৃজন !! এখানে জিমার-মোটিফের বিচক্ষণ বিশ্লেষণ রয়েছে, রয়েছে নতুনত্বের স্বাদ। বাজারে কথিত আছে, জিমারের ফিল্ম-সঙ্গীত নাকি সবসময়ই কেতাব-বিরোধী অর্থাৎ আবেগপ্রবণ জাতের। আমার মতামত- সুরকারের বৃহত্তর স্বাধীনতা তার শিল্পসমগ্রতার কল্পনা-প্রতিভায় শোধিত হতেই পারে। যাইহোক “টাইম” এর ঝুলন্ত ট্যাম্পো সিনেমার চিত্রকল্পে একটু একটু করে অদমনীয় আকাঙ্ক্ষা জমায়। একদিকে তীব্রতার ক্রমবৃদ্ধি সহদিকে পিয়ানোর একক নোট ভং... ভং...। আরেকটি ট্র্যাক “ড্রিম ইজ কলাপসিং” তো দুর্ধর্ষ। আমাদের স্মৃতি-স্বপ্ন-আশার পরতে পরতে রিয়ালিটির উদ্ভাসন; গম্ভীর টিউনে হৃদয় গহনে ব্লক হতে থাকে। যাকে আমি বলছি- মিউজিকের হিপনোটিক লাবণ্যতা।
হ্যান্স জিমার’স স্কোর/সাউন্ড ট্র্যাকে আর যা পছন্দের; প্রায়ই শুনি এবং মনে করতে পারছি-
১.ওয়ে অফ লাইফ-দ্যা লাস্ট সামুরাই
২.এ স্মল মেজার অফ পিস-দ্যা লাস্ট সামুরাই
৩.জার্নি টু দ্যা লাইন-থিন রেড লাইন
৪.রোল টাইড-ক্রিমসন টাইড
৫.ভিদে ক্যর মিওম-হানিব্যল
৬.মাদার আফ্রিকা-দ্যা পাওয়ার অফ ওয়ান
৭.সলোমন- টুয়েল্ভ ইয়ারস এ স্লেভ
8.চেস-দ্যা পিস মেকার
৯.শ্যাডো বিট্রে য়্যু-ডার্ক নাইট রাইসেস
১০.আই সি ইবরেথিং-শার্লক হোমস্
১১.যেদ- দ্যা রক
এবং সবচেয়ে প্রিয়টি হলো, ইন্টারস্টেলারের রাজোচিত স্কোর "S.T.A.Y."। সত্যি করে বলতে ইন্টারস্টেলারের সবগুলো ট্রেক্ই ভীষণভাবে চমৎকৃত করে। সাম্প্রতিক সময়ে এহেন আবহ সঙ্গীত ও সাউন্ড ট্র্যাক খুব কমই পেয়েছি। পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিলো, সিনেমাটিক অভিজ্ঞতায় দর্শকদেরকে স্পেস ও সময়ের স্পিরিচুয়াল বা ঐশ্বরিক ভ্রমণে ধ্বনিত করা। যেখানে চরিত্রগুলোর বিপরীত পার্শ্বে, ছন্দরসায়ন সৃষ্ট মোশন-সিকনেসে দর্শকগণ আত্মহারা হবেন। মৃদু-মন্থর সিন্থস, ক্লকওয়ার্ক টিক্ টক্, মহাজাগতিক সন্নিধির অজানা-অতলে প্রবেশকালীন নৈশব্দ আর বিস্ময়ের চরম মুহূর্তে ক্লাসিক্যাল সিম্ফোনি; সব মিলিয়ে এক অসামান্য সংক্রমিত আবাহন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন হ্যান্স জিমার।
সবশেষে আপনাদের জন্য একখানা বোনাস থাকলো-
২৪ কার্তিক ১৪২২
অন্ধবিন্দু | সামহোয়্যার ইন...ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:৩১