মহাকাশ অনুসন্ধান জাতীয় সিনেমার অধিকাংশই গাণিতিক চেহারার হাই-ভোল্টেজ ফিকশন হয়ে থাকে। আর হবেই বা-না কেনও ? মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ততটাই উন্মুক্ত, যেমন কল্পনার ইকারুস। আমাদের কল্পনাশক্তি গ্রাম ছাড়িয়ে শহর দেখেছে। আকাশের পর খানিকটা দূরেও দেখতে শিখেছে―আলোকবর্ষ প্রতিফলন। শেষবার থামার আগে বহুবার তার বিস্তার ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কল্পনা চাওলার কথা ! মাটি থেকে প্রায় দু’লক্ষ ফুট উঁচুতে মহাকাশযান কলম্বিয়াকেও থামতে হয়েছিলো তেমনি। মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা সহ আরও সাতটি প্রাণের পাখা গলেছিল ঠিক তবে কল্পনারা থামেনি। ডানাবিহীন কালপুরুষ তাই উড্ডয়নের পানে তাকিয়েছে আবারও।
অ্যান্ডি উইয়ারের এমনই এক কল্পনার কথা ওঠে এলো তাঁর “দ্যা মার্সান” উপন্যাসটিতে। মার্ক ওয়াটনি নামের প্রধান চরিত্রটি ধরে বেঁচে থাকার গল্প বললেন। অথবা তিনি হয়তো রবিনসন ক্রুসো কে লাল গ্রহের ৯৫.৩% কার্বন-ডাই-অক্সাইডে কল্পনা করছিলেন। দিন-পুস্তিকার চমৎকার বর্ণনায় আর বৈজ্ঞানিক ধাঁধার খাসা মিশ্রণে, বইটি বেশ সারা পেয়েছিলো।
এবার “দ্যা মার্শান” ফিল্মের কথা বলি। সবে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ঘিরেও আমার কৌতূহল আগে থেকেই। জেনে ছিলাম- মঙ্গলগ্রহ নিয়ে বানানো, এটিই প্রথম মজবুত অভিযান হচ্ছে। কারণ গ্রহটির সাথে দেনা-পাওনার সম্পর্ক জুড়তে যাচ্ছি আমরা। নাসার একটি বিশেষ দল চিরাচরিতভাবেই সহকারীর ভূমিকা রেখেছে; বরং এবার প্রত্যক্ষ সহায়তার ঘনফল দেখে খুশিই হলাম বটে। নাসাকেও তো ওই রাজনীতি-সাহেবই পরিচালনা করে। নাকি ভুল বললেম ?
ম্যাট ঢেমন অভিনেতা ভালো। কিন্তু চ্যুইটাল এজিফর এই প্রধান রোলটিতে থাকলে আরও অনেক ভালো করতে পারতেন। চিত্রনাট্য রোমাঞ্চিত করার প্রয়াসে মূল গল্পটিকে যথেষ্ট অসুরক্ষিত করে ফেলা হয়েছে। ৪০ লাখ মাইল দূরের জীবন-বিপরীত পরিবেশে একজন মানুষের একাকী সংগ্রাম, বিশেষ করে একাকীত্বের নাটকীয় অনুরণন গুলোতে পরিচালক যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন। অ্যা ভেরি বিগ মাইনাস পয়েন্ট।
আইন প্রণেতাদের যেমন আইনজীবী হতেই হবে; বাধ্যবাধকতা নেই। সায়েন্স ফিকশনের ঘর সংসার বিজ্ঞানের বসতিতে হলেও, লেখক-পরিচালকেরা সন্ন্যাস-যাপন করতেও পারেন। হাহ হা। দ্যা মার্সান চলচ্চিত্রটি অবশ্য জমিয়ে তার গৃহবাস উপভোগ করেছে। সাধারণ দর্শক’রা মূলত কাহিনী, উন্নত ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, হট এক্ট্রেস এবং উত্তেজনাকর টুইস্ট পেলেই প্রসন্নতা প্রকাশ করে থাকেন। অর্থাৎ সিনেমা হিট। তথাপি বিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষক-অনুচরদের মন জয় করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। অ্যান্ডি উইয়ারের লেখালেখি যথাযথ―বিজ্ঞান মানতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সিনেমাতেও তার প্রভাব দৃশ্যমান।
সাল ২০৩৫, এটি সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহে তৃতীয় মানব-অভিযান। শক্তিশালী বালু-ঝড়ের কবলে পড়ে যা পণ্ড হবার অবস্থা। মিশন-কমান্ডারের নির্দেশে তা পরিত্যাগ করা হয়। কিন্তু পিছে রয়ে যায় মার্ক ওয়াটনি …
স্পিরিট রোভার থেকে পাঠানো দৃশ্যে আমরা লাল-গ্রহের ডাস্ট-ডেভিল দেখে শিহরিত হয়েছিলেম। সিনেমায় এর চাইতেও অনেক বড় মাত্রার ঝড় দৃষ্টি-লব্ধ হবে ঠিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফ্যাক্টস ঘাঁটলে লালগ্রহের ঝড় আদৌ শক্তিশালী টক্কর দিতে পারে বলে ধারণা করা হয় না। মার্সের ক্ষীণ বায়ুমণ্ডল এর পক্ষেই দিক-নির্দেশ করে।
অপুর্চনিটি, কিউরিওসিটির যন্ত্রাংশ স্যাটালাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারলেও সিনেমায় দেখা যায়- অধিরোহ যান ও স্থল রোভারে সুবিধাটি অনুপস্থিত। ধরে নিলাম নিরাপত্তা-জনিত কারণে যুক্তিটি সঠিক। এখানে মজার অংশটি হচ্ছে পাথফাইন্ডার ব্যোমযানের ৩৬০ ডিগ্রী ক্যামেরাটি ব্যবহার করে অ্যাসকি-ছক কষার দৃশ্য। দারুণ !!
খাবার,পানি ছাড়া তো আর মানুষ বাঁচতে পারে না। মৌলিক জৈবিক প্রক্রিয়ায় মার্ক ওয়াটনিকেও বাঁচিয়ে রাখতে হলে, ব্যবস্থা করা চাই। রকেট ফুয়েল থেকে হাইড্রাজিন সংগ্রহ, সেটাকে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনে পৃথক করা; তারপর এইচ২+ও২’র স্বাভাবিক কাজ-কারবার। লালগ্রহে আলুচাষ করতে ওয়াটনি মনুষ্য মল-মূত্রর উদ্ভিদ্বিবন্ধুত্ব ঘটালো। মার্সের রয়েছে হিমায়িত জল(মেরুদেশীয় বরফ) এবং এর মাটিতে নাইট্রেট; তাই অমূলক মনে করার কোনও কারণ নেই। যদিও রোগের জীবাণু খুব সহজেই ট্রান্স-মিট হতে পারে ! হে হে হে। সিনেমায় যে অ্যালুমিনিয়াম ও পলিকারবোনেটের গ্রিনহাউজ সেটআপ দেখানো হয়েছে, ভবিষ্যৎ যাত্রায় এর প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয়।
কক্ষীয় গতিবিদ্যা অথবা বলতে পারি মহাকর্ষীয় গুলতির আইডিয়াটি চমৎকার লেগেছে। ফিল্মের দৈর্ঘ্য এই আইডিয়াবাজকে বেশি একটা অনুগ্রহ করেনি। সিনেমা দেখলে আপনারাও একমত হবেন। আর, দড়ি ছাড়াই এস্ট্রোন্যট ক্রিস-ব্যাকের দাপাদাপি হাস্যকর লাগছিলো।
প্রামাণিকতা ঠিকঠাক রেখে “দ্যা মার্সান” সিনেমা দর্শকদের থ্রিলড করবে নিশ্চিত। ম্যাট ঢেমনের মানসিক বিপর্যয়, নাসার কর্ম- কৌশল, দূরকল্পনার গবেষণা ইত্যাদি টুইস্ট ছাপিয়ে জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপত্যকা ওয়াদি রাম দৃষ্টি কেড়ে নিবে। অর্থাৎ যেটিকে লাল গ্রহ বলে চালানো হয়েছে সিনেমায়। সিনেমাটোগ্রাফির প্রশংসা করছি। এছাড়া বইটিতে চমৎকার কথোপকথন থাকলেও ছবির ডায়ালগে তেমন মুষ্ট্যাঘাত অনুপস্থিত।
মঙ্গলে মানব মঙ্গল কতখানি সাধিত হবে। তা নিয়ে আমার জরুরি শঙ্কা রয়েছে। একে সভ্যতায়ন বলবো না-কি ধোঁকাবাজির রিয়েলিটি শো ? আমি আশাবাদী। ফিরতি টিকেট হাতে সফল হোক আমাদের কল্পনা।
২২ আশ্বিন ১৪২২
অন্ধবিন্দু | সামহোয়্যার ইন...ব্লগ
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১০