
শিরোনামটায় ভড়কালেন! ভড়কানোর কিছুই নেই। আজ এই ২০১০ সালে এসে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি একটি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে। খুব কম পরিবারই আছে যেখানে মাদক ছোবল দেয়নি। এমন ভাগ্যবান পরিবার কম, যাদের কোনো সদস্য মাদকের নেশায় উম্মত্ত হয়ে জিম্মি করে রাখেনি তাদের। হালের ক্রেজ ইয়াবা হলেও পরিসংখ্যানে এখনও সবচেয়ে ক্ষতিকর মাদক হিসেবে বর্তমান হেরোইন। ব্রাউন সুগার এবং ইনজেকশন ফরমে এটা আসক্তদের প্রিয় গভীর নেশা এবং স্বল্প দামের কারণে। ৪০০ টাকার ইয়াবা কিংবা ৬০০ টাকার ফেন্সিডিলের বদলে ১০০ টাকা খরচ করেই তারা চলে যাচ্ছে নেশার রাজ্যে। এই নেশার টাকা যোগাড় করতে তারা কি করে এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পরিচিত বা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের দেখেই মোটামুটি এ ব্যাপারে কম বেশী সবাই জানেন। এই যে চুরি ছ্যাচরামি করে, ডাকাতি-ছিনতাই করে, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে মাদকাসক্তরা নেশার রাজ্যে ঘোরাফেরা করে যাচ্ছে- টাকাটা যাচ্ছে কোথায়? উত্তরটা শিরোনামেই দিয়েছি। এ টাকা কাজে লাগছে ইসলামী বিপ্লবের পুঁজি জোগাতে।
হেরোইন একটি কেমিক্যাল ড্রাগ। মূল উৎস পপি। আর এর চাষাবাদ এশিয়াতে তিনটি অঞ্চলে। লাওস, বার্মা এবং আফগানিস্তান। শীতল যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে শায়েস্তা করতে এশিয়াতে যে গোপন যুদ্ধ চালিয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উপজাত হয়েই পপির প্রসার। ভিয়েতনামে নিজেদের অব্স্থান সংহত করতে ষাটের দশকে লাওসে মং (hmong)উপজাতিদের কাজে লাগিয়েছিলো সিআইএ। বিনিময়ে তাদের একমাত্র অর্থকরী ফসল পপির উৎপাদন ও বিপননে সহায়তার চুক্তিতে যেতে হয়েছিলো তাদের। আশির দশকে আফগানিস্তানে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। রাশিয়াকে হটাতে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হাতকে শক্ত করার রাস্তা নেয় তারা। মাধ্যম হয় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। মুজাহেদিনদের জন্য বরাদ্দ অনুদানের ২ বিলিয়ন ডলারের অর্ধেক পান হেকমতিয়ার যার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে আফগানিস্তানের বেশীরভাগ আফিম ক্ষেত্র। (১) এসব আফিম চলে যেত পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশের ল্যাবরেটরিতে। সেখানে তৈরি হতো হেরোইন। এরপর বাজারজাত হতো। বাজার? খোদ পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ। সঙ্গে প্রতিবেশী ইরানও। (২)
আবাদী অঞ্চলগুলো আশির দশকের শুরুতেই কব্জায় নিয়ে এসেছিল মুজাহেদিনরা। কৃষকদের বিপ্লবী কর হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে পপি চাষের নির্দেশ দেয় তারা। ’৮১ সালে ২৫০ টন থেকে উৎপাদন ১০ বছরের মাথায় ২০০০ টনে উত্তীর্ণ হয়। (৩) মুজাহেদিনদের কাজ ছিলো সীমান্ত পার করে পাকিস্তানে নিয়ে আসা। সেখানে আইএসআই’র জেনারেল ফজলে হকের রক্ষাকবচে থাকা পাকিস্তানী হেরোইন রিফাইনারদের কাছে এসব বিক্রি করতো তারা। ফজলে হক একই সঙ্গে নর্থওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের গভর্নরও। ধারণা করা হয় ১৯৮৮ সালে শুধু খাইবার জেলাতেই হেরোইন তৈরির রিফাইনারির সংখ্যা ছিলো একশ থেকে দুশোটি। (৪)
আশির দশকেই পাকিস্তানের উত্থান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেরোইন প্রস্ততকারী দেশ হিসেবে। ইউরোপ বা অন্যান্য বাজার ধরার আগে ঘরেই শুরু হয়ে যায় এর বিপনন। ৮৫ সালে পাকিস্তানে হেরোইন আসক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখেরও বেশী। (৫) বাংলাদেশেও ওই একইসময় হেরোইন আঘাত হানে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই জানি সে সময় প্রতিটি গাজার আখড়ায় ফ্রিতে হেরোইন বিলি করা হতো এবং শিখিয়ে দেওয়া হতো সেবন প্রণালী। মাসখানেকের এই বিনিয়োগ যথেষ্ট ছিলো ঢাকার বুকে কয়েক হাজার হেরোইন আসক্ত তৈরি করতে।
আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ানদের পশ্চাদপসারণ এবং খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থও ফুরোয়। কিন্তু হেরোইন ব্যবসা থামেনি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে আফগানিস্তান বিশ্বের ৭৫ভাগ হেরোইনের যোগানদাতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। ‘৯৯তে তাদের কাঁচা আফিম উৎপাদন ছিলো ৪ হাজার ৬০০ টন! (৬) এই হেরোইনের টাকাই বিনিয়োগ হতে থাকে জঙ্গীবাদে। নিজেদের গৃহযুদ্ধ তো আছেই। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বলকান রাজ্যগুলোতেও কাঁচা আফিমের পয়সায় ভিত্তি পায় ইসলামী বিপ্লবের নামে সন্ত্রাস। কাশ্মীর, কসোভো, চেচনিয়াতে ধর্মের আফিমে বুঁদ জঙ্গীরা নব উদ্যোমে ঝাপায়, আর সেটাকা জোগান দিতে হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে ঝিমাতে থাকে উপমহাদেশের কয়েক প্রজন্মের কিশোর, তরুণ, যুবারা। অতিষ্ঠ ইরান ১৯৯৮ সালে বন্ধ করে দেয় সীমান্ত। এর আগে সাত বছরে তারা আটক করে ১৯৭ মেট্রিক টন হেরোইন। (৭)
আসক্তিতেই থেমে থাকে না বিপদ। সঙ্গে আসে এইডসও। বাংলাদেশে আক্রান্ত এইডস রুগীদের একটা বড় অংশই ইনজেকশনের মাধ্যমে হেরোইন নেয়ার কারণে তালিকাভুক্ত। বাকিদেশগুলোতেও একই অবস্থা। ২০০১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে প্রথম ইনজেকশনে নেশা নিয়ে অভ্যস্তদের মাধ্যমে মহামারী আকারে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার শংকা জানানো হয়। মধ্য এশিয়ায় সংখ্যাটা দশ লাখেরও বেশী বলে জানানো হয়। (৮)
এদিকে হেরোইনের টাকায় রমরমা অবস্থায় চলে যায় আইএসআই। আশির দশকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ৩০ থেকে ৫০ ভাগ জোগান আসতে থাকে হেরোইন বিক্রির খাত থেকে। সুবাদেই ধ্বসে যায় তাদের গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ যার ফলে পতন হয় বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফের সরকারের। আইএসআই আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, সামরিক বাহিনীতে বাড়ে তাদের প্রভাব। আর কাশ্মীর ও আফগানিস্তানে চালাতে থাকে ইসলামী জঙ্গীদের সহযোগিতা। ভাগের টাকায় বাদ পড়ে না বাংলাদেশের জামাতে ইসলামীও। (৯)
(চলবে)
ছবি : হাসান বিপুল
তথ্যসূত্র :
১. John F. Burns, “Afghans: Now They Blame America,” New York Times Sunday Magazine, February 4, 1990, 37; Lawrence Lifschultz, “Dangerous Liaison: The CIAISI
Connection,” Newsline (Karachi), November 1989, 52–53.
২/৫.Pakistan Narcotics Control Board, National Survey on Drug Abuse in Pakistan (Islamabad: Narcotics Control Board, 1986), iii, ix, 23, 308.
৩.U.S. Central Intelligence Agency, “Memorandum, Subject: Iran — An Opium Cornucopia,”
September 27, 1979; U.S. Department of State, Bureau of International Narcotics Matters, International Narcotics Control Strategy Report (Washington, D.C.: U.S. State Department, February 1984), 4; U.S. Department of State, Bureau for International Narcotics and Law Enforcement Affairs, International Narcotics Control Strategy Report, March 1998 (Washington, D.C.: U.S. State Department, 1998), 23; Geopolitical Drug Dispatch, “Afghanistan: Aiming to be the Leading Opium Producer,”
no. 3 (January 1992), 1, 3.
৪.Kathy Evans, “The Tribal Trail,” Newsline (Karachi), December 1989, 26.
৬.U.S. Department of State, International Narcotics Control Strategy Report, March 2000, 56; United Nations, United Nations International Drug Control Programme,
Afghanistan: Annual Survey 2000 (Islamabad: UNDCP, 2000), 15.
৭. Rashid, Taliban, 122, 124; United Nations, United Nations Office for Drug Control and Crime Prevention, Pakistan Regional Office, Strategic Study #2: The Dynamics of the Farmgate Opium Trade and the Coping Strategies of Opium Traders
৮. New York Times, November 29, 2001.
৯. Miriam Abou Zahab, “Pakistan: d’un narco-Etat a une ‘success story’ dans la guerre contre la drogue?” Cahiers d’études sur la Méditerranée orientale et le monde turcoiranien 32 (July-December 2001):147–53; Rashid, Taliban, 121–22; M. Emdad-ul Haq, Drugs in South Asia: From the Opium Trade to the Present Day (New York: St.Martin’s Press, 2000), 213.
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ৮:১৫