পুরো ঘটনাকাল ১৯৬৭-৬৮ সালের। এর মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিলো মাও সেতুং থট রিসার্চ সেন্টার বা মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র। সে বছরই মালিবাগে এটি প্রতিষ্ঠা করেন সিরাজ শিকদার। পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রকাশনা স্ফুলিংঙ্গের বিশেষ সংখ্যায় (১৯৮১) এই সময়কালের কথাই বলা হয়েছে। একই সময় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সিরাজ শিকদার পুর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ব্যানারে সর্বদলীয় এক বিপ্লবী ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। আর মাও থট সেন্টার ছিলো তার একটি ওপেন ফ্রন্ট। অন্যদিকে কমরেড রোকন তার স্মৃতিকথায় ব্যাপারটা উল্লেখ করেছেন অন্যভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এডভেঞ্চার শেষে ঢাকায় ফেরার পর খানিকটা হতাশ ছিলেন সিরাজ শিকদার। তার মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার মতো কোনো ক্যাডার তখন ছিলো না। আর রেডগার্ডের সেই অংশ অর্থাৎ মাহফুজ, মাহবুব, নুরুল ইসলামসহ বাকিরা পূর্ব বাংলা বিপ্লবী কম্যুনিস্ট আন্দোলন নামে আলাদা সংগঠন গড়ে তোলেন। আর সেই ঘাটতি পূরণ করতেই মাও থট সেন্টারের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করার দায়িত্ব পান রোকন। সেই অর্থে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ব্যানারেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সুরঙ্গ খোড়ার সেই বিখ্যাত এডভেঞ্চারটি ঘটিয়েছিলেন সিরাজ শিকদার। ফজলুল আমিনের সঙ্গে সাক্ষাতকারের উল্লেখ করে তার বয়ানে রোকন জানান- সিরাজ শিকদারের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয় কারণ তিনি হঠকারী (এডভেঞ্চারিস্ট)। এই বিষয়ে আরো ইঙ্গিত রয়েছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে পাঠকদের।
বিতর্ক এই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গঠনের স্থান নিয়েও। ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি একটি সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। রোকন জানাচ্ছেন লিয়াকত হলে সিরাজ সিকদারকে সেক্রেটারি করে জন্ম নেয় ইবিডাব্লুএম। অন্যসূত্রের বয়ানে ঢাকা জুটমিলের একজন শ্রমিকের বাসায় আয়োজিত হয় সম্মেলনটি যাতে অংশ নেন মাও থট রিসার্চ সেন্টারের প্রায় ৫০জন অনুসারী। এই সম্মেলনেই সিরাজ তার বিখ্যাত থিসিসটি পরিবেশন করেন যাতে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই থিসিসেই সিরাজ প্রধান ও মূল সংঘাতগুলো (কনট্রাডিকশনস) উল্লেখ করার পাশাপাশি একটি সফল বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায় ও তা সম্পন্নের রূপরেখা দেন। সম্মেলনে উপস্থিত সবার অনুমোদন পায় তা। থিসিস অনুযায়ী জাপানের বিরুদ্ধে চীনের যুদ্ধের আদলে বিপ্লবের সিদ্ধান্ত হয়। সুবাদেই গঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও ইস্ট বেঙ্গল রেভুলেশনারী আর্মি (পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সেনাবাহিনী)।
এখানে চমকপ্রদ ব্যাপার আছে আরো। রোকন জানাচ্ছেন থিসিস অনুযায়ী ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তান সামরিক-সামন্তবাদী উপনিবেশবাদ চালাচ্ছে পূর্ব বাংলার উপরে। তার আগ পর্যন্ত শোষণের ধরণটা ছিলো জাতীয়তাবাদী। তাই স্বাধীনতার একমাত্র উপায় সশস্ত্র সংঘাত। মাও সেতুংয়ের পদ্ধতির এই লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা জাপানের। শেখ মুজিবর রহমান চিয়াং কাইশেক। পূর্ব বাংলা যেহেতু পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী সেনাবাহিনীর অধিকৃত অঞ্চল, দখলমুক্তি ও স্বাধীনতার এই লড়াইয়ে তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুচর শেখ মুজিবকে মিত্র মানা যেতে পারে।
এরপর মাঠে নামলো ইবিডাব্লুএম। মাওর বিখ্যাত উক্তি নিয়ে চিকা পড়ে : “Power comes from the barrel of a gun” (বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”।পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা এরপরই ঘটেছে, কারণ এর পর কর্ণেল আবু তাহেরের মাধ্যমে সামরিক ট্রেনিং নেয় পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সেনাবাহিনী। ‘৬৮ সালের মাঝামাঝি প্রথমবার গেরিলা অপারেশনে নামে ইবিডাব্লুএম। দিলখুশার এক অফিস থেকে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিনতাই করে তারা। উদ্দেশ্য পার্টির ইশতেহার ছাপানো। এর আগ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররমের ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকেই এসব কাজ সারতেন সিরাজ শিকদার। শুরু হয় দলের মুখপত্র লাল ঝাণ্ডার প্রকাশনা। পাশাপাশি সদস্য সংগ্রহের কাজও চলতে থাকে পুরোদমে। এর মাঝে জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের তোপের মুখে পড়ে মাও থট সেন্টার। যদিও হামলাটি শেষ পর্যন্ত সামাল দেয় সেখানে থাকা কর্মীরা।
বাংলাদেশের আইনে 'কাফকা কেইস' বলে যে কিছু আছে তা জানা ছিলো না। কিন্তু '৭৪ সালের শেষে সিরাজ শিকদার ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত এই মামলাতেই হয়রানি হয়েছেন তার বেশ ক'জন পার্টি কর্মী। মামলার ব্যাখ্যাটি সরল- সিডুসিং আ হাউজ ওয়াইফ। আরেকজনের বউকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মামলা। আর সিরাজ শিকদারের বিপ্লবী জীবনে একটি মোটা দাগের অধ্যায় এটি, যা খুব সহজে কারো মুখে শোনা যায় না।
সেই গল্পে আসার আগে আরেকটু বলে নেয়া যাক। বড় মেয়ে শিখার জন্মের পর স্ত্রীকে নিয়ে খিলগাওয়ে বাবার বাড়িতে উঠলেন তিনি। সঙ্গে ছোট তিন ভাইবোন- নাজমুল, শামীম ও শিবলী। আর বড় ভাইর স্ত্রী। ডাক্তার বড় ভাই দিনাজপুরে পোস্টিং। সিরাজ তখন তেজগাঁ টেকনিকাল কলেজে সাড়ে চারশো রুপিতে প্রভাষকের চাকুরি করছেন। পার্টিতে ছদ্মনাম রুহুল আলম। ছেলে সঞ্জীবের জন্মের পর শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ফার্মে ১৪০০ রুপি বেতনে চাকুরি নিলেন সিরাজ। স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠলেন রামপুরার এক পাকা বাড়িতে।
১৯৬৯ সালে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছেন সিরাজ। ন্যাপ ভাসানীর ছাত্র ফ্রন্টের বেশীরভাগ কর্মীই যোগ দিয়েছেন তার সাথে। এদেরই একজন রোকনউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ছাত্র। তার কাজিন জাহানারা। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার হাকিমের স্ত্রী। মহিলাদের পত্রিকা মাসিক বেগমে লেখালেখি করতেন। স্ত্রীর নারীবাদী চিন্তাভাবনা পছন্দ ছিলো না হাকিমের। তার চলাফেরার উপর তাই নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। দুই সন্তানের জননী জাহানারা রোকনউদ্দিনের সহয়তায় বাড়ি থেকে পালালেন। রোকন শরণ নিলেন নেতা সিরাজ শিকদারের। খালেদা ছদ্মনামে দয়াগঞ্জে এক শেলটারে রাখার ব্যবস্থা হলো তাকে। এনএসআইর একঝাক গোয়েন্দা নেমে পড়লো জাহানারার খোঁজে।
এদিকে বাংলার মাও সিরাজ তার অর্ধশিক্ষিত স্ত্রী হাসিনার মাঝে যা পাননি, তা পেলেন জাহানারার মাঝে। জিয়াং কুইং জাহানারার আরেকটি ছদ্মনাম নিলেন রাহেলা। কারণ এনএসআই তার খালেদা নামের খোজ পেয়ে গেছে। আর অনেকটা মজা করেই সিরাজ নাম নিলেন হাকিম ভাই। সবুজবাগে একটা ভাড়া বাসায় দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। রাতে বেরোতেন একসঙ্গেই। পার্টি সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে কানাকানি এবং একসময় অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। চরমপন্থাতেই এই বিদ্রোহ দমন করলেন সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর এবং পেয়ারা বাগানে দুর্দান্ত যুদ্ধ করা সেলিম শাহনেওয়াজ খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হুমায়ুন কবিরকে মরতে হলো জাহানারা-সিরাজের সম্পর্কের বিরুদ্ধাচরণ করায়। তবে এসব স্বাধীনতার অনেক পরের ঘটনা। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সিরাজের সঙ্গেই গ্রেপ্তার হন জাহানারা ওরফে খালেদা ওরফে রাহেলা। তাকে কুমিল্লায় ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর দুজনের সন্তান অরুণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিরাজ শিকদারের পিতাকে। (চলবে)
পাদটীকা : সূত্র সূত্র করে পাগল বানিয়ে ফেলেছেন অনেকে। কিছু ঘটনাকালসহ কিছু সূত্র দিয়ে দিলাম।
১৯৬৭ : নক্সালবাড়ী, রেডগার্ড ও মাও থট সেন্টার গঠন
১৯৬৮ : পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সুরঙ্গ কাটা অভিযান, পুরানো কমরেডদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ও লাল ঝাণ্ডার প্রকাশনা
১৯৬৯ : জাহানারার সঙ্গে পরিচয় এবং লিভ টুগেদার
রোকনের অসমাপ্ত সেই পান্ডুলিপি
রুহুল ও রাহেলার গল্প
লেখাটি এর আগে আমার ব্লগে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৩:১৪