ফের শুন্য দিয়ে শুরু
ফুটো পকেটে বছর শুরু করাটা আমার অনেকদিনের। আগে অদ্ভুত এক বোনফায়ার ছিল আমার বর্ষশেষে। ডায়েরি লিখতাম। সে ডায়েরি পোড়াতাম ৩১ ডিসেম্বর রাতে। আমার সারাবছরের সুখ-দুখ জ্বলে যেত কাগজ হয়ে। সে ছাই থেকে নতুন শুরু, নতুন বছর। ২০০৬ সালে আমার কোনো ডায়েরি ছিল না। রোজনামচা লেখার জন্য সামহোয়ারকেই বেছে নিয়েছিলাম। বোনফায়ার হয়নি। তবে গড়ের মাঠ পকেটে ভরে শুরু করেছিলাম ২০০৭।
আগের বছর রোজার ঈদের বন্ধ শেষে আমরা জানলাম যায়যায়দিন কর্তৃপক্ষ ভারমুক্ত হয়েছেন দেড়শর বেশি সাংবাদিককে কর্মচ্যুত করে। এদের বেশিরভাগ নামকরা হাউজ ছেড়ে এসেছিলেন। তাই প্রাথমিক ধাক্কার পর তাদের বেশিরভাগের গতি হতে দেরি হয়নি। আমি তখনও শাহবাগের চিপায় রাজাউজির মারি বেকার সহকর্মীদের সঙ্গে। খবর পাই যায়যায়দিনে চেয়ার টেবিল খালি দেখে কোনার রুমের কন্ট্রিবিউটাররা সব একেকটা দখল করে বসে গেছে। রাতারাতি প্রমোশন পেয়ে নাকি বিভাগীয় সম্পাদকও হয়ে গেছে কেউ কেউ। হাসি।
মামুন খবর দেয় ব্যবস্থা হচ্ছে, হয়ে যাবে কিছু একটা। সমকালে একটা সিটিং হলো। কিন্তু ইন্টারনাল ক্যাচালের কথা শুনে আমরা পিছু হটলাম। এরপর একদিন ডাক পড়ল বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে। অনলাইন নিউজ পেপার কাম নিউজ এজেন্সি। তৌফিক ইমরোজ খালিদির সঙ্গে ইন্টারভিউতে দেখালাম আমার ব্লগ, আমার ওয়েবসাইট। সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগপত্র। আইটিফ্রেন্ডলি লোকজন খুবই পছন্দ আমাদের এডিটরের। মনটা খুশী হয়ে উঠল। ব্লগিংয়ে সময়ের বিনিয়োগটা একদম বিফলে যায়নি।
নাগরিক সন্নাসীর গৃহী লেবাস
নয়া চাকুরিতে ঢোকার পরই একটা বড় প্রভাব পড়ল আমার সামাজিক জীবনে। যায়যায়দিনে দুবছর বসে বেতন নিয়েছি। সময়টায় অবসর ছিল প্রচুর। বন্ধু এবং বান্ধবীও। সাংবাদিকতার ট্রাজেডি এই যে নিজের সময় বলে কিছু থাকে না। সারাদিন কামলা দিয়ে শরীরে আড্ডা সয় না। বড় কোনো উৎসব ছাড়া ছুটিছাটা নেই। অফডে মানে সপ্তাহের শ্রান্তি ঘুমের ঘোরে ঝেড়ে ফেলা। শুধু টেলিফোনে কাহাতক বন্ধুবাজি হয়! ছুটতে থাকল হাতে গোনা ক’জন বাদে। রয়ে গেলো শুধু ম্যাসেঞ্জারের স্বজনরা। প্রভাব পড়লো একদম হৃদয়ের মোড়কে মুড়িয়ে রাখা মানুষটির ওপর। দেখা সাক্ষাত নেই। দিনে ফোন করলে ব্যস্ত অফিসে। রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমে ঢুলছি। নিজেকে অবহেলিত ভাবতেই পারে যে কেউ। মুক্তাও তাই ভাবলো। ফোনে সংক্ষেপে কথা সারছি, ভার্সিটি পালিয়ে অফডেতে বাসায় এসে দেখে আমি চ্যাটে ব্যস্ত। বোনকে কথা দিয়ে ফেলল ডিসেম্বরে তার পছন্দের পাত্রের গলাতেই মালা দেবে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এলো পয়লা বোশেখে। আমাকে উপেক্ষা করে বন্ধুর সঙ্গে চলে গেল আশুলিয়া। ফোনে শুভ নববর্ষ জানিয়ে নিসর্গের মুগ্ধ ধারাভাষ্য। পাশাপাশি মনে করিয়ে দেয়া আমি তাকে কোথাও বেড়াতে নিই না। আমার অবস্থা রাপু খাপাং। ফোন করলে ফোন ধরে না, নয়তো ওয়েটিং। চাকুরির বারোটা বাজে প্রায়। একদিন ডেকে আনলাম চারুকলায়। আমার সমস্যা গুলো জানতে চাইলাম। জানলাম- আম নট কেয়ারিং ইনাফ। আমার জীবনে কান্নাকাটির ঘটনা বেশি নেই। সেদিন দুকুল ভাসালাম। সুযোগ চাইলাম আরেকবার নিজেকে শুধরানোর। প্রতিশ্রুতি অনবহেলার। এর মধ্যে মাশীদ এলো দেশে। ওকে দিয়ে আরেকটু প্রলেপ দিলাম ভালোবাসার ক্ষতে।
কয়েকদিন পর এক সকালে জামাল ভাস্করকে ফোন- বস বিয়া করুম আপনার বাসায়। ইন্তেজাম করেন। জেবতিক আরিফ উকিল বাপ, নজমুল আলবাব মুহূর্তের নোটিশে এক কাপড়ে সিলেট থেকে ঢাকা। মৌসুম, কৌশিক, অন্যমনস্ক শরৎ, সারিয়া, নজমুল আলবাব, আনিকা- সব ব্লগার! শরৎ লাইভ বিয়ের ছবিসহ পোস্ট করলো ব্লগে। বিয়ে হচ্ছে সামহোয়ারে! বিদেশ থেকে ফোনের পর ফোন- অভিনন্দন। সব ব্লগার! বাংলা ব্লগস্ফিয়ারে আর কেউ সরাসরি বিয়ে করেছে কিনা আমার জানা নেই, আমিই প্রথম কিনা সেই কৃতিত্ব দাবি করারও ইচ্ছে নেই। তবে জীবনের এই মোড় ঘুরানো ঘটনা ও তার বাস্তবায়নে সামহোয়ার ইন ব্লগই হয়ে গেল আমার বিয়ে বাড়ি। কুটুমরাও সেখানকারই বাসিন্দা। আমার নিত্যকার জগতের কেউ নয়, ভার্চুয়াল আত্মীয়রা। বড্ড জীবন্ত। বড্ড মানবিক।
রাখাল হতে গিয়ে লেখকটা যে মরে গেলো
সামহোয়ারে জামাত-শিবিরের ট্রেনিং পাওয়া ছাগলের উপদ্রব একদম প্রথম থেকেই। গত বছর তা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে কিছু উন্মাদ ধর্মের লেবাসে যা-তা শুরু করে দিল। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিব, জাহানারা ইমাম নিয়ে নানা কটুক্তি এবং ব্যাঙ্গ রচনা। কর্তৃপক্ষ নিরব। শুরু হলো গালাগালি। অতিষ্ঠ হয়েই সামহোয়ারের সেরা ব্লগাররা ব্লগ ছাড়লেন। নতুন রাইটার্স ফোরাম হলো সচলায়তন। সেখানে সুযোগ না পাওয়া নিজকে রাতা মোরগ (মেডিকেলে আমাদের প্রিয় একটা ডায়লগ ছিল- হাম রাতা হ্যায়) মনে করা কিছু ব্লগারের ইগো এতই হার্ট হলো যে তারা কাছা খুলে নামলেন সচলায়তনের সমালোচনায়। তাতে সচলের কিছুই এলো গেলো না, মাঝে সামহোয়ারে কায়েম হলো ছাগুরাজ্য। সচলের জন্মপ্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন হয়েও আমি থেকে গেলাম পুরানো বাড়িতেই।
সত্যি বলতে এখনো আমি সচলে অনেক সচ্ছন্দ। কিন্তু সামহোয়ার যে নাড়ির টান। অমি রহমান পিয়ালকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখার জন্য রেখে অঃরঃপিঃ নিকে ছাগল তাড়ানোর রাখাল হয়েছিলাম। তুমুল গালাগালি। মজা করতে গিয়ে অমনিবাস নামে আরেকটি নিক নিলাম। অঃরঃপিঃতে আমার অনেক ভালো লেখা ছিল যা পরে অরিজিনাল নিকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমি আমার সৃজনশীলতা একদমই হারালাম। আমি আর কবিতা লিখতে পারি না, ন্যাচারাল ব্লগিং আর আসে না। ছাগুদের প্রপোগান্ডার জবাব দিতে অমি রহমান পিয়াল নিকে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য সব দলিল পোস্ট করি। কিন্তু ছাগলরা তাতে ঠেকে! জহির রায়হানের মৃত্যু রহস্য নিয়ে প্রামান্য পোস্টের পরও এখনো তারা শিবিরের গাইড বই থেকে হুবহু কপিপেস্ট মেরে যাচ্ছে। এর মাঝে অমনিবাস প্রোফাইলে মহানবীর একটি ডেনিশ কার্টুন কিছুক্ষণের জন্য লাগিয়েছিলাম। একজন ব্লগার ধরিয়ে দেওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে বদলেছি। কিন্তু ততক্ষণে হাতিয়ার পেয়ে গেছে ছাগুসর্দার ও তার সাঙ্গরা। আমার প্রোফাইলের স্ক্রিনশট নিয়ে, তাতে নবিজীর কার্টুন রঙ্গিন বানিয়ে তারা পোস্টের পর পোস্ট দিতে লাগল। কর্তৃপক্ষ তড়িৎ সাড়া দিলেন। আমি ব্যান! আর ব্লগে নাজাত দিবস পালিত হচ্ছে।
সে সময়টায় আমি টের পেয়েছি সক্রিয় ব্লগারদের একটা বড় অংশ আমাকে একদম অপছন্দ করেন না। পোস্টের পর পোস্ট পড়েছে আমার পক্ষে সাফাই গেয়ে। মডারেটরদের গালিগালাজ করে। তখনও সচলে যাননি এমন অনেকেই সেই ঘটনাকে সামহোয়ারের জামাতিকরণ মানলেন। তারাও ব্লগ ছাড়লেন। এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি লড়াই লড়েছে দ্য এ-টিম। দুর্দান্ত সব জিনিয়াসের একটি বিপ্লবী সংগঠন। যে কোনো একজনই যথেষ্ট ছাগুদের বিদিক বানিয়ে দিতে। এ-টিমের সর্বাত্মক সহযোগিতা আমার আজীবন মনে থাকবে। যারা ডা. আইজুদ্দিন, শমসের, সূফী, হোসেইন, নিধিরাম সর্দার, কুদরত আলী, গন্ডার, অলৌকিক হাসান, হাসিব, লাল মিয়া, অমিত, আরণ্যক যাযাবর, মনিটরদের স্রেফ গালিবাজ হিসেবে জানেন, তাদের চুপিচুপি জানাই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অর্জন, বংশ পরিচয়- সব বিচারেই তাদের কাছেপিঠে খুব কম ব্লগার আছে এই সামহোয়ারে। লেখক হিসেবেও সব কয়জন দুর্দান্ত। কিন্তু এই অবস্থানে তারা যেতে বাধ্য হয়েছেন সামহোয়ারকে ভালোবেসেই। রাজাকারি চেতনা মুক্ত সামহোয়ার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঝাণ্ডাটা একটুও যাতে না নোয়ায়- সেজন্য জানকবুল প্রত্যেকে। আজকে যদি সামহোয়ার সত্যি রাজাকার মুক্ত হয়, তাহলে এই নিকগুলোই কি-বোর্ডে আগুন ঝরাবে বিনির্মাণের।
যাহোক, যেভাবেই হোক। অঃরঃপিঃ এবং অমনিবাসের বিনিময়ে অমি রহমান পিয়াল ফিরে এলো সামহোয়ারে। এই ব্যানমুক্তির পর আরো জিহাদী জোশে নামলাম ছাগল তাড়াতে। সাফল্য এসেছে। ছাগুদের মাথাগুলো কাটা পড়েছে। তারা আছে ভিন্ন লিবাসে, ম্যাতকার আগের ভ্যাঃই। সেই তাড়ানো এখনো চলছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে লড়াই। কদিন আগে আবারো গালাগালি দিতে বাধ্য হলাম আমি রাজাকার নিকের সদম্ভ হঠকারিতায়। কর্তৃপক্ষের শেষ মুহূর্তে ঘুম ভাঙায় বছর শেষটা বিজয়েই শেষ করেছি।
বাবা তুমি খুব না হলেও, একটু হাসো
সামহোয়ারে আমার রাজাকার, জামাত এবং ইত্যাদি... লেখাটা খুব আবেগী। সেখানেই বাবার ডায়েরি ও পান্ডুলিপির প্রথম উল্লেখ। রাজাকার ব্লগাররা যখন টিটকিরি ঝাড়ছে, সমমনা ব্লগাররা দিয়েছেন তুমুল উৎসাহ। বাবার নিজের হাতে লেখা মুক্তিযুদ্ধের পান্ডুলিপি, বই হিসেবে দেখে যাওয়ার সাধ ছিলো মৃত্যুর আগে। কুলাঙ্গার আমি সে স্বপ্ন পুরো করতে পারিনি। তবে যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ ধারাবাহিকভাবেই ছাপা হয়েছে ব্লগে। মুখচেনারা বাদে আর কারো পায়ের ধুলো পড়েনি সেসব লেখায়। সর্বোচ্চ ৫টি কমেন্ট। গৎবাঁধা- পড়ছি কিংবা চলুক। হতাশ হয়েই শেষ করিনি। সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম বাবার লেখা বই হাজারো বাজারি মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের ভিড়ে পথ হারাবে। পরিকল্পনা নিলাম ই-বুক করবো। এবং ভুলে গেলাম।
মনে করিয়ে দিলেন হুমায়রা। ডিসেম্বরের শুরুতে হঠাৎ তার মেইল। ফ্লোরিডা থেকে তারা একটি ই-ম্যাগাজিন বের করেন। সামহোয়ারে ঘুরতে ঘুরতে আমার লেখা চোখে পড়েছে তাদের। বিজয় দিবস সংখ্যায় তারা আমার কিছু পোস্ট ব্যবহার করতে চান। কপিরাইটেড ব্লগার আমি না, সানন্দে সায় দিয়েছি। তখনও জানতাম না তারা কোন পোস্টগুলি নিয়েছেন। বিজয় দিবসে যখন লিংকসহ মেইল পেলাম বেশ কিছু পোস্ট পেলাম আমার। আনন্দ এলো কান্না হয়ে। চোখদুটো ভিজল বাবার নাম দেখে। যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ ধারাবাহিক ছাপা হচ্ছে সেখানে। বেঁচে থাকলে হয়তো অন্তর্জালিক প্রকাশনার ভক্ত বনতেন না, কিন্তু খুশী হতেন একাত্তরের এই কলম যোদ্ধা। অখুশী নন বলেই আমার বিশ্বাস। তার রেখে যাওয়া ব্যাটনটা ধরে তো আছি। ২০০৭ সালের অর্জনটা এখানেই। সে ব্যাটনে আমার একার হাত নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী শতশত ব্লগার হাত রেখেছেন। তীব্র আনন্দে আমি দেখি মুক্তিযুদ্ধ কথা কয় জন্মযুদ্ধের মোড়কে। এবং আমি একা নই, তোমার অনেক ছেলে ও মেয়ে আছে সঙ্গী হয়ে। ২০০৮ হোক তাদের চেতনার বিজয়ে রাঙা। স্বর্গ থেকে এটুকু প্রার্থনা করবে না বাবা?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:১৩