জেনারেল দলবীর সিংয়ের সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কেননা, প্রধান স্টাফ অফিসার, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী কমান্ডারদের নিয়ে ইতিমধ্যেই রওয়ানা হয়েছেন, এখনও এসে পৌঁছাননি। সময় অতি মন্থরগতিতে চলতে লাগল। এক-একটি মুহূর্ত যেন এক-একটি ঘণ্টা। মিত্র বাহিনীর ৯ নং ডিভিশনের স্টাফ অফিসার কর্ণেল দেশপান্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ‘বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ও তার সাথের সাতজন লে. কর্ণেল এসে পৌঁছে গেছেন।’
উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গম্ভীর স্বরে হুকুম দিলেন, ‘ওদের এখানে নিয়ে আসুন।’ আমরা হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের ছাদে ছিলাম। নিচে তাকাতেই দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ফটোগ্রাফাররা এতদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল যাদের ছবি তোলার জন্য তাদের সামনে পেয়ে সমানে ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বালিয়ে ছবি তুলছে।
যাহোক, পাকিস্তানী কমান্ডারদের নিয়ে আসা হলো। আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলাম- ওদের ভেতর আমার চেনাশোনা কেউ আছে কিনা। হ্যা, ওদের ভেতর আমার চেনা দুজন ছিল। একজনের নাম লে. কর্ণেল ইমতিয়াজ ভয়ায়েচ। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। অপরজন লে. কর্ণেল শামস। তার সাথে আমার জানাশোনা ছিল। বিগ্রেডিয়ার হায়াতকেও একবার কি দুবার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন তাদের মনে হতো খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তারাই অভদ্র, অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। বসতে তাদের চেয়ার দেয়া হলো। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন ওদের সাথে। বিজয়ী ও বিজিতের কোনো সামঞ্জস্য রাখলেন না। চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। জেনারেল দলবীর সিংয়ের মার্জিত রুচিবোধ ও ব্যবহার দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি বিগ্রেডিয়ার হায়াতের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে ইনি হচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার, আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন।’ আত্মসমর্পণের খুটিনাটি বিষয় শেষ হলো। ব্রিগেডিয়ার হায়াত তার ব্রিগেড মেজরকে ডেকে বললেন, ‘মেজর ফিরোজ, তুমি এখনই চলে যাও এবং সৈন্যদের হুকুম শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সংবরণ করতে। ওদের বলে দাও আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ইতালিয়ান সৈন্যদের মতো হানাদারেরা দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগল। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা শহরের ভেতর ঢুকলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের হেডকোয়ার্টারে গেলাম। চারদিক শান্ত, নিরব। মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে এলো। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গন, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মতো এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেওয়ার মতো আমার আর কিছুই নেই।’
‘মৃত পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ বলবেন কি?’ আমি এ কথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসহায়ের মতো আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ন্তর না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তার ভুল সংশোধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই খুলনা সার্কিট হাউজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা সার্কিট হাউজের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দুপাশের লোকজন গগনবিদারী শ্লোগান দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো।
‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। আজ মনে হলো জয় বাংলা বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চূড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মুখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউজে পৌঁছলাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এদিকে আসতে লাগল। সার্কিট হাউজের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। বুকটা ফুলে উঠল। সমুন্নত পতাকার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউজ ঘিরে রয়েছে এবং সবাই সামনে আসার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছে।
যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের উপর এতদিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের একনজর দেখার জন্য জনতা বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ছুটে আসতে চাইল। জনতার অসম্ভব ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু জনতার চাপ এত বেশি যে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই সামলাতে পারছে না। সার্কিট হাউজের দরজায় নামতেই এত ভিড়ের মধ্যে পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করতে লাগল। কেউ আনন্দে হাততালি দেয়, কেউ গলা ফাটিয়ে চিতকার করে, কেউবা পাগলের মতো ছুটে এসে চুমু খায়। কি অপূর্ব দৃশ্য। মানবতার কি মহান বহিঃপ্রকাশ! সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভুলে গিয়ে নতুন দিনের সূর্য্যকে কত আপন করে নিতে চায়। মহামানবের তীর্থ সলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যে নতুন প্রাণের সন্ধান পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি জিনিস আজ ওদের নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দলবীর সিংকে নিয়ে সার্কিট হাউজের মাঠে অবতরন করল। লম্বা, উন্নত চেহারার অধিকারী দলবীর সার্কিট হাউজ পর্যন্ত হেটে আসলেন এবং আত্মসমর্পণ পর্বের খুটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানো। তার উপর একটি টেবিল ও একটি চেয়ার।
ঐতিহাসিক মুহূর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের কমান্ডারদের আত্মসমর্পণ। যে দাম্ভিক পাকিস্তানী সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতো তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মতো আত্মসমর্পণ করলো। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান তার সাথের আটজন কর্ণেল নিয়ে মার্চ করে তার সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানী কমান্ডাররা যখন সার্কিট হাউজ থেকে বেরিয়ে মার্চ করে যাচ্ছিল, তখন বাইরে অপেক্ষমান হাজার হাজার লোক আনন্দে ফেটে পড়ল। কেউ হাততালি দেয়, কেউ বা শিস দেয়। গ্লানিকর পরাজয়! কত বড় শাস্তিমূলক অনুষ্ঠান! জেনারেল দলবীর সিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম আত্মসমর্পণকারী সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিধা। জেনারেল দলবীর সিং আত্মসমর্পণের দলিল পাঠ করলেন এবং পাকবাহিনীর পরাজিত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিলে সাক্ষর দিলেন। এরপর ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তার সঙ্গী অফিসাররা সামরিক নিয়মে কোমরের বেল্ট খুলে মিত্র বাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। এ সময় সমস্ত ফটোগ্রাফার ফটো নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলেন। দেখে মনে হলো যেন একটা বিয়ের পর্ব। উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এ রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পণ আমি আর কখনো দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়!
পাদটীকা : ৯ নং সেক্টরের সদরদপ্তরের স্টাফ অফিসার, জলিলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী (বিজয়ের পর একত্রে গ্রেপ্তার) বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট ওবায়দুর রহমান মোস্তফা (যুদ্ধকালীন ক্যাপ্টেন পদবীধারী) তার ‘মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা’ বইতে তার সেক্টরের যুদ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন। আমার আগ্রহ ছিল জলিলের গ্রেপ্তারের কারণ জানতে যা নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা বেশ প্রচারণা চালিয়ে থাকে। এ নিয়ে শিগগিরই চমকপ্রদ পোষ্ট আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:৩৮