আমার বন্ধু ইদ্রিসের গল্পটা তো আপনাদের বলেইছিলাম। দুই পর্বে লিখেছিলাম। আপনারাও পড়ে বলেছিলেন 'মজা পাইলাম' ,'অসাধারণ হইছে ভাই'। কেউ কেউ বলেছিলেন 'ক্যাম্নে পারেন'। তবে আমি নিশ্চিত আপনাদের সেটা মনে নেই। থাকলেও আবছা আবছা।
তাহলে একটু মনে করিয়ে দেই। ইদ্রিস একজন অদম্য মানুষ। কিন্তু ইদ্রিসের বাপ ছিল একটা ঝামেলাপূর্ণ লোক। বিরাট ঝামেলাপূর্ণ লোক। ইদ্রিসের যখন হাই স্কুলে পড়ার কথা তখন সে মানুষের ক্ষেতে খোলায় পাঁইট খাটে। জমিতে কাজ করে। এর জন্য মূলত তার বাপ দায়ী।
খুলেই বলি।
ইদ্রিসের বাপের নামটা কি বলেছিলাম মনে নেই। ধরে নিলাম তার নাম কফিলউদ্দিন। কফিলউদ্দিন উপজেলা সদরে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কেরানির চাকরি করত। আর যেটা করত সেটা হল- নিয়মিত ব্যাবধানে মামলা করত। কারণে অকারনে মামলা। এর ওর নামে মামলা। মাঝে মাঝে সে যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করত সেখান থেকে টাকা সরাত। মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিত কিন্তু শোধ করতনা। এভাবে তো বেশিদিন চলেনা। ফলে কফিল উদ্দিনকে মাঝে মাঝেই বিপদে পড়তে হত। সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ত ইদ্রিসের উপর। এই ঘটনা ছিল নিয়মিত। একটা একটা করে বললে গল্প লম্বা হয়ে যাবে।
ইদ্রিস এভাবেই হাইস্কুল পাশ করল। কলেজে যখন উঠল ইদ্রিসের বাপ বলল, “বহুত হইছে এইবার অফ যাও”।
ইদ্রিস বলল, “আমি কলেজে পড়ব। আইএ, বিএ পাশ করব”।
ইদ্রিসের বাপ বলল, “আমার বিশ হাজার টাকা লাগবেই একমাসের মধ্যে। না হলে জেলে যাওয়া লাগবে।”
ইদ্রিস বিশ হাজার টাকা ধার করল এক প্রেস মালিকের কাছ থেকে। বিনিময়ে সে প্রেসে কাজ করে শোধ করে দেবে। এই হল চুক্তি।
ইদ্রিস প্রেসে কাজ করে করে বাপের দেনা শোধ ও আইএ পাশ করল। এর মধ্যে শিখে ফেলল কম্পিউটারের কাজ, প্রেসের কাজ। কমপিউটার নষ্ট হলে কিভাবে ঠিক করতে হয় সেই কাজও সে কিভাবে কিভাবে যেন শিখে ফেলল। আশপাশের দুই চারটা উপজেলায় তার ডাক পড়ে।
এভাবে একদিন ইদ্রিসের মোটামুটি একটা পুঁজি হয়ে গেল। ইদ্রিস নিজে ব্যবসা শুরু করল। সেই ব্যবসা শনৈ শনৈ উন্নতি করল। ইদ্রিস এখন মফস্বল শহরের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ইদ্রিসের কাজ বেড়েছে। একা সামলাতে পারেনা।
এবার শুরু হল নতুন বিপদ। ইদ্রিসের বাপ বলল মাইনষের দোকানত বহুত কামলা খাটিছি। এলা নিজের ব্যাটার দোকানত বসিম। নিজের ব্যাটাক যদি মুই না দেখিম তা কাঁয় দেখপে?
ইদ্রিসের বাপ কফিলুদ্দিন ছেলের দোকানে বসে আর পয়সা সরায়।ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে এডভান্স টাকা নেয়, তারপর মেরে দেয়।নতুন পয়সার গরমে তার মামলার সংখ্যাও বেড়েছে।
ইদ্রিসের হলো আরেক বিপদ। বাপকে সে বলল "আব্বা আপনে দোকানত আসবেন, বসবেন, চা খাবেন, চলে যাবেন। মাস গেইলে হাত খরচ নিবেন কিন্তুক ক্যাশে হাত দেওয়া পারবেন না। "
কফিলউদ্দিন এই বিশেষ পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে কারণ উপায় নেই। তবে গ্রামের বটগাছ তলায় যে চায়ের দোকান সেখানে বসে ছেলের বদনাম করে। .........ছোল পোলক মানুষ করে এলা নিজের পায়েই কুড়াল মাননু বাহে। মোর ব্যাটা এলা মোক দাম দেয়না। রক্ত পানি করে ব্যাটাক এই জায়গাত নিয়ে আনু। আর মোর ব্যাটায়.....
এই হল গল্পের সারাংশ। ইদ্রিসের সাথে বছরে একবার দেখা হয়। ওর দোকানে বসে একবেলা চা না খেলে মন ভরেনা। মনে মনে ওকে স্যালুট দেই। ইদ্রিসকে বলি “বন্ধু, তুমি একটা রিয়্যল ফাইটার। নিজের চেষ্টায় এতদুর আগাইছ, ছোট খাট ব্যাপার না।”
ইদ্রিস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে “ আমার কপাল খারাপ বন্ধু। আরো অনেক কিছু করতে পারতাম। খালি আমার বাপটা যদি একটু ঠিক হইত। মানুষ বাপের জোরে অনেক কিছু করে। আমার সেই কপাল নাই। সারাজীবন বাপের কাছ থেকে কোন সাপোর্ট পাই নাই। সেটার দরকারও ছিলনা। খালি আমাক দুদিন পর পর ঝামেলায় না ফেললেই হত। পিছে টানে না ধরলেই হত। “
আমি ইদ্রিসকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম “মন খারাপ কইরনা বন্ধু। আমরাও আসলে তোমার মতই। আস্ত বাংলাদেশে, আমরা সমস্ত আম পাবলিক হইলাম ’ইদ্রিস’। আর সরকার এবং রাষ্ট্র যন্ত্র হইল ‘ইদ্রিসের বাপ’। আমাদের উন্নতির পথ সুগম করতে না পারুক অসুবিধা নাই খালি পিছে টাইনা না ধরলেই হয়। তবু আমরা চেষ্টা কইরা যাইতেছি। ঠিক তোমারই মত..... ইন আওয়ার ওউন ওয়ে”।
দুদিন পর পর যখন রাষ্টীয় ব্যাংকের লুটপাটের কথা শুনি, শেয়ার কেলেংকারির এবং ইত্যাদি আরো সব কফিলউদ্দিনীয় কাজ কারবারের কথা ভাবি তখন ইদ্রিসের কথা মনে পড়ে।
পড়ারই কথা। আমরা সবা্ই যে এক একটা ‘ইদ্রিস’।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৪২