আমাদের জাতীয় সংগীতটি কি অসাধারণ! তাই না? পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকের অন্তরের যে গহীন বানী "আমি তোমায় ভালবাসি "সেই কথাটাই সোজা সাপ্টা ঢুকে গেছে আমাদের জাতীয় সংগীতের বানীতে। কি অদ্ভুত! আর দেখুন সন্তানকে ভালবেসে যেরকম সোনা যাদু বলি,প্রেমিকাকে সোনামনি, মাকে সোনা মা......... তেমন করেই বলা আছে আমার সোনার বাংলা। একদম অকৃত্রিম অভিব্যক্তি।
অনলাইনে বেশ কয়েকটি দেশের জাতীয় সংগীতের লিরিক পড়লাম। খুব অবাক হলাম, প্রায় সব দেশের জাতীয় সংগীতের মূল ভাব প্রায় একই রকম। একধরনের জাতীয়তাবাদী সংগীত। কারো কারো বানীতে আছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উস্কানি। একটি প্রতিবেশি দেশের জাতীয় সংগীত শুনলে আমার অবাক লাগে। শুনলেই মনে হয় একজন ঔপনিবেশিক শাসক বা রাজকীয় অতিথিকে স্তব কীর্তন করে লেখা গান। আমি নিশ্চিত, যিনি সেটি লিখেছিলেন তিনি জাতীয় সংগীত ভেবে লিখেন নি। হয়ত ঐতিহাসিক কোন প্রয়োজনে লিখেছিলেন।
আমি যতদুর জানি এত সুন্দর প্রকৃতি প্রেম আর কোন জাতীয় সংগীতে ফুটে উঠেনি। "ফাগুনের আমের বনের ঘ্রান " আর কেউ এমন করে অনুভব করেন নি। "কি শোভা কি ছায়া গো, কি স্নেহ কি মায়া গো "........এই অকৃত্রিম মায়ায় নিজের মায়ের মুখটিই চোখে ভাসে। কোথায় পাবেন আর? দেশকে ভাগ্য বিধাতা, হলি ল্যান্ড, পবিত্র ভুমি বলা হয়েছে,মান ইজ্জতের চিহ্ন বলা হয়েছে কিন্তু মায়ের সাথে তুলনা করা হয়নি। অস্তিত্বের এমন সর্বব্যাপী টান আর কোন গানের বানীতে নেই।
"মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন, ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি ".........কি চিরন্তন এক মর্মবেদনা। কমা দিয়ে দ্বিতীয় বার যখন গেয়ে উঠি " ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি " তখন নাড়ির বিপুল টানটাই ফুটে ওঠে মায়ের জন্য আটপৌরে ভালবাসায়। এটা স্রেফ ছন্দ মেলানোর খাতিরে লেখা নয়। "মা ' ডাকের পর অকারনেই 'ও মা ' ডেকে ওঠার শিশু সুলভ সরল আনন্দ আছে এখানে।
সবচেয়ে অন্যরকম লাগে যেটা, এই গানের উত্তম পুরুষ আমি নিজে আর মধ্যম পুরুষ দেশ মা। মাকে উদ্দেশ্য করে গাইছি। ধন্য কবি গুরু।
আর সুর? ফাগুনের উদাস হাওয়ার টান আছে এর সুরে,আহা। খাটি বংগীয় মেঠো সুর। বাউল সুর, তবে হহক্কারি টান নেই। মৃদু, প্রেম জাগানিয়া। শুদ্ধ স্বরের সরলতার সাথে কড়ি ও কোমলের স্বার্থক মেল বন্ধন। মীড় আর স্পর্শ সুরের মাধুর্যও আছে। অন্তরায় গিয়ে গলাটাকে পুরো ছেড়ে দেওয়া যায়। একটা সুন্দর সঞ্চারীও আছে। প্রিয় গগন হরকরা, তুমি সত্যি অসাধারণ।
আমরা লাখো কন্ঠে গাইতে পারি, এটাই আমাদের বিশেষত্ব না। ওটা অন্যকেউও হয়তো গেয়ে ফেলতে পারবে। আমাদের জাতীয় সংগীতটাই আমাদের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব। এটা একান্তই আমাদের।
নিজের দেশকে, দেশের প্রতি ভালবাসাকে এমন করে গানের ভেতর দিয়ে আর কেউ প্রকাশ করতে পারবেনা..........আমি নিশ্চিত।
সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় রেকর্ড, সব চেয়ে বড় গৌরব।