বছর ঘুরে প্রতিবারের মত আবারো রমজান এলো। শুধু এলোই না- আসছি আসলাম করে এক তৃতীয়াংশ পারও করে দিল।
রমজান আসলেই চার দিকে একটি পরিবর্তন ঘটে যায়- লক্ষ্য করতে না চাইলেও চোখে যেন আপনা আপনিই ধরা দেয়- তাই এড়িয়ে যাওয়া যায় না-
অফিস আদালতের পরিবর্তিত সময়টা চোখে ঠিক সেভাবে না পড়লেও ধরা পড়ে রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের পরিবর্তিত এবং সুনির্ধারিত সময়।
মানুষের রোজা রাখা ক্লান্তভাব তেমন ভাবে চোখে না পড়লেও চোখে পড়তে বাধ্য হোটেল রেস্তোরাগুলোর অকস্মাত "হিজাব" অবলম্বন আর হিন্দু হোটেলের আধিক্য।
টিভির সংবাদ পাঠিকাদের মাথায় অতি কষ্টে উঠে যাওয়া আঁচলখানির কথা আর নাই বা বললাম।
আর রোজা আসার সাথে সাথে এর "আল্টিমেট কন্সিকুয়েন্স" হিসেবে চলে আসে দ্রব্যমূল্যের রকেট গতিতে ঊর্দ্ধাকাশে ছুটে চলা।দ্রব্যমূল্য নামক এই বহুল আলোচিত-সমালোচিত, বহুল "চিল্লায়িত"(যাহাকে নিয়ে চিল্লাচিল্লি করা হয়), বহুল "মিটিঙ্গিত"(যাহাকে এজেন্ডা ধরিয়ে মিটিং করা হয়), কিন্তু বরারবরই অদৃশ্য ভিভিআইপি মহাশয়টির হাইস্পিডে ঊর্দ্ধগতিতে ছুটে চলার বিষয়টি ঠিক চোখে না পড়লেও চোখে ঠিকই ধরা পড়ে শীর্ণ হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের বাজারের থলে আর পাংশু মুখ।সেই সাথে চোখে ধরা পড়তে বাধ্য এ নিয়ে খবরের পাতা আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল জুড়ে বিস্তারিত রিপোর্ট আর কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর সরকার -জনগণের উর্দ্ধৃতি দেয়ার প্রতিযোগিতা।
কিন্তু তারপরও, রোজার সবচেয়ে কমন দৃশ্য কিন্তু এইটা না-বরং, বিকেল হতে না হতেই, ফুটপাতে কিংবা রাস্তা জুড়ে সারিতে সারিতে সাজানো নানা বর্ণের নানা স্বাদের ইফতারির আইটেম। সেই সাথে এসবের দাম, স্বাস্থ্যগুন কিংবা পুষ্টিগুনের তোয়াক্কা না করা ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন।
অবস্থা দেখে বুঝার উপায় নেই, এই একই দেশের জনগণকেই আজ খবরে দেখলাম বাজারের ক্রেতাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করছে, রোজা রেখেও (?) গালিগালাজ কিংবা নাজেহাল করতেও ছাড়ছেনা।
ব্যাপারটা যেন এমন, ইফতারিতে টেবিল ভর্তি আইটেম না থাকলে রোজাই কবুল হবেনা।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, বাংগালীর কোনো পূর্বপুরুষের মাথায় বুঝি কেউ ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, ছোলা, মুড়ি, পিয়াঁজু, বেগুনি, জিলাপী ছাড়া ইফতারী মহাপাপ! শুধু তাই নয়, সাথে দিনভেদে থাকতে হবে হালিম, ক্ষীর, ফিরনি অথবা অন্য কিছু। মোটকথা সারাদিন যে না খেয়ে থেকেছে, পাড়ার মসজিদের সাইরেন শুনার সাথে সাথেই কড়ায় গন্ডায় তা উসুল করে না নিলে প্রমাণ হয় কি করে?
ফিরে যাই সেই দ্রব্যমুল্যের কাছে। দ্রব্যমূল্য মহাশয়ের রকেটটাতে কে জ্বালানী ভরে দিয়ে উপরের দিকে ঠেলে দিয়েছে তা নিয়ে চলে নানা মুনির নানা মত। চোর টাকে কেউ নাম দিয়েছে সিন্ডিকেট, কেউ বা বলছে আন্তর্জাতিক বাজার- আর চোর কে হাতেনাতে ধরতে বাজারে অভিযান চালাতে বাদ রাখেনি এফবিসিসিআই প্রধান থেকে শুরু করে সরকারও।
এ ওকে দোষ দেয়, আর সে তাকে- খেলা জমে ভালই।
আর আমরা, দর্শকের সারিতে বসে গোগ্রাসে ইফতার গিলতে গিলতে, তাতে হাততালি দেই।
ওদিকে দ্রব্যমূল্য মহাশয় সপ্তাকাশের আরামদায়ক আসন থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। যত যাই হোক- উনার আসনে উনি সমাসীন- এদের এসব কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে উনার কি আসে যায়?
আমিও উনাকে, অর্থাত সেই দ্রব্যমূল্য মহাশয়কে ঠিক দোষ দেইনা। বেটা চালাক- ঠিকই ধরে ফেলেছে রমজান আসলেই মানুষের চাহিদাও বেড়ে যায়। যত যাই হোক, সারাদিন যে না খেয়ে থাকে- বাকি যে কয়েকঘন্টা ঘন্টা সে খেতে পারে, তাতেই তা উসুল করে না নিলে ভোজনরসিক বাংগালীর কি চলে? তাও আবার প্রায়শঃই এখানে ওখানে ইফতার মাহফিল এর আয়োজন হবে- নানান স্বাদের নানা বর্ণের আইটেম যাতে থাকতে বাধ্য। আবার ঘরে ঘরে গৃহিনীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তো আছেই- এই রমজানেই পাড়ায় পাড়ায় হয়ে যাবে সবার মধ্যে কার গিন্নী সবচেয়ে মজাদার ইফতারী বানাতে পারে তার একটি নীরব জরিপ।
সব মিলিয়ে এ যেন ফাস্টিং এর নয়, ফীস্টিং এর মাস!
এত শত ফীস্টিং এর আয়োজন থাকলে চাহিদা তো বাড়বেই, আর এ কথা তো বাচ্চা ছেলেও জানে, চাহিদা বাড়লে দ্রব্যমূল্য মশাইয়ের রকেটে জ্বালানী ভরবে- আর তিনিও সপ্তাকাশে চড়ে বসবেন।
দ্রব্যমূল্য মহাশয় সপ্তাকাশ থেকে আমাদের ইফতারীর পসরা দেখে না জানি কতটা শান্তি পান।
কিন্তু তিনি হয়তো অত উপর থেকে দেখেন না -
এই আমাদের একই সীমানার ভেতরেই- ২ লাখেরো বেশি মানুষ আজ বন্যায় উদ্বাস্তু- অনেকেই ভিটে বাড়ি সহ যতটুকু সম্বল ছিল, সবই হারিয়েছে চিরতরে।
বুট পিয়াঁজুর ইফতার তো দূরের কথা, একটু বিশুদ্ধ পানিও যেন এদের কাছে কেবলই স্বপ্ন।
হুজুরে আকরাম দ্রব্যমূল্য মহাশয় হয়তো সপ্তাকাশে উঠেছেন বলে দেখেননা, কিন্তু আমরা-
যারা নামকরা রেস্তোঁরার "মাত্র (??) ৬৫০" টাকার বুফে ইফতারির জন্য ছুটে যাই অফিস ফেলেই,
যারা দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়েও এলাকার বিখ্যাত হালিমটি মিস হয়ে গেল বলে হা-হুতাশ করি,
যারা রোজা রাখা কাজের মেয়েটিকে পুডিংএ চিনি কম দিয়েছে বলে ঝাড়ি দেই,
যারা টেবিল ভর্তি ইফতারি দেখেও মা'র কাছে প্রিয় আইটেম না থাকায় অভিযোগ করি,
...............
আর এভাবে ফীস্টিং এর আড়ালে "ফাস্টিং" যে করছিলাম, তাই ভুলে যাই-
এই আমরা - এই আমরাও কি দেখিনা ওদেরকে?
..........
নাহ, চোখে আজকাল একটু কমই দেখি- কি জানি, হয়তোবা রোজায় ধরেছে।
এতো ইফতার খেয়েও আমাদের যদি রোজায় ধরে, দ্রব্যমূল্য মহাশয় কে আর কি দোষ দিব? হয়তো তেনাকেও রোজায় ধরেছে- সপ্তাকাশে উঠে উনি কুম্বকর্ণের ঘুম দিচ্ছেন...।।