somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিঠি এবং...

০২ রা আগস্ট, ২০০৮ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কতোদি-ইন হয়ে গেল, চিঠি লিখা হয়না! সেই আবেগ মাখা ভাষার, নানান রঙ্গের, নানান ঢঙ্গের, নানান ভাষার চিঠি- কতইনা লিখেছি একসময়।

এখন বুঝি ভুলে যেতে বসেছি চিঠি লিখার ভাষা।

প্রথম চিঠি কবে লিখেছিলাম? মনে পড়ে চার বছর বয়সে মা-বাবার সাথে যখন পাড়ি জমিয়েছিলাম , সেই দূর অজানার দেশে, তখন থেকেই আমার চিঠি লিখার শুরু। "আলিফ বা" আর এবিসিডি তখন শেখা হয়ে গেলেও বাংলা মায়ের বর্ণমালার সাথে তখনও কেবল পরিচয় হবে, হচ্ছে। সখ্যতা হয় আরো পরে- বাবা যখন পার্মানেন্ট ইঙ্কে একটা ঝুলন্ত বোর্ডের গায়ে বর্ণমালা লিখে ঝুলিয়ে দিলেন চোখের সামনে- আর মা যখন দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বাল্য শিক্ষা ধরিয়ে দিলেন হাতে-তারপর থেকে।

দেখতাম, কিছুদিন পরপর ঘটা করে চিঠি লিখার ধুম পড়ে যেত। বাসার মেইল বক্সে যেদিন দেশ থেকে দাদি, ফুপি, কিংবা চাচা-চাচিদের চিঠি জমা পড়ত, সেদিন হতো আমাদের ঈদের দিন। একটি খামে থাকত কমপক্ষে চার পাচেক চিঠি, বাড়ির সব্বাআর খবর একটু হলেও থাকত সেখানে।
তার পরদিন থেকে শুরু হতো উত্তর লিখার পালা। সবাই মিলে খাতা কলম নিয়ে বসে পড়তাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে বাংলায় একটা বাক্য লিখতেই মা-কে শতবার বিরক্ত করতে হতো।
মনে আছে- মুরব্বি হোক আর সই ( তখনো আমার ছোট্ট কেউ ছিলনা, যাকে চিঠি লিখা যায়)-সবাইকে সম্বোধন করতাম "স্নেহের"- কারন, তালব্য শ'এ র'ফলা আর দ এর সাথে ধ যোগ করে "শ্রদ্ধেয়" লিখতে আমার বড্ড বেগ পেতে হতো!

সবচে' মজার অংশ ছিল, চিঠির পছনে মা আমাদের ভাই বোনদের হাত বসিয়ে হাতের চারপাশে বর্ডার একে দিতেন- কারন, ফুফুরা জানতে চায়- উনাদের আদরের ভাতিজি ভাতিজারা কত্ত বড় হয়েছে! হাতের ছাপ দেখে নাকি উনারা হাত ভেবে কাছে টেনে নিয়ে আদর করবেন!

কত্ত আবেগ মাখা ছিল সেই চিঠিগুলো!! এখন ভাবতেই মনে হয় রূপকথা!
আর সবচে' মজার ছিল আমার আর আমার প্রিয়তমা সইয়ের চিঠি গুলো। ও লিখত কোন ক্লাসে উঠেছে, কবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো- কততম হয়েছে (নিশ্চয় প্রথম বা দ্বিতীয়) । তারপর লিখত "আর যদি পত্রের কোথাও ভূল হয়ে থাকে তো ভূল আর শুদ্ধটা লিখে দিবে" (তখনো আমরা জানের জান পরানের পরান দোস্ত হলেও অতি ভদ্রতার কারনে তুই তোকারি বলতে জানতাম না)। বলাই বাহুল্য - আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় লেখা পত্রের ভুল আর ভুলের পাশে শুদ্ধ শব্দের বেশ লম্বা লিস্টি ওর পত্রের নিচে ছকাকারে দেয়া আছে।

আমার অল্প স্বল্প বাংলা জ্ঞান দিয়ে তখনো ওর মতো এমন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের ভুল ধরার মতো দুঃসাহস হয়ে উঠেনি, তাই স্বরণাপন্ন হলাম গুরুজী আম্মাজানের। আম্মু বললেন, ওর পত্রে নাকি কেবল একটাই ভুল, আর সেই ভুল হচ্ছে স্বয়ং "ভূল" শব্দটিই!!

খুব সম্ভবতঃ তারপর থেকে, অবধারিতভাবেই ওর পত্রের নিচে থাকত-"ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে"- এই ভুলে কি হ্রস্ব উকার, নাকি দীর্ঘ ঊকার থাকতা এখন আর মনে পড়ে না।

সইয়ের সাথে আবেগ মাখা ভাষায় চিঠি লিখার পর্ব তখনো শুরু হয়নি- এখনকার পিচ্চিদের মতো আমরা অত কিছু জানতাম না তো! এই পর্বটা শুরু হলো আরো পরে, যখন আমরা দেশে চলে এলাম, আর তার পরপরি সই ওর পরিবারের সাথে আরেক অজানার দেশে পাড়ি জমাল।
আমাদের নিয়তিটাই এমন, খুব বেশিদিন আমাদের একি দেশে, একি শহরে থাকা হয়নি কখনো- আর কখনো হবেওনা হয়তো! তাই চিঠিই ছিল বন্ধুত্বের ভেলাটাকে ভাসিয়ে রাখার একমাত্র ভরসা।
ও যাওয়ার আগে আমরা এক গোপন কোড ভাষা রপ্ত করে নিলাম, আমাদের দুই সখির চিঠির যদি আর কোনো পাঠক হয় তো (হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল তখন) আমাদের গোপন কথা গুলি যেন অন্তরালে থেকে যায়, তাই!

তারপর একদিন বিশেষ ভাবে আমার নামে চিঠি আসল! আমার যে কি আনন্দ! ওর কি অবস্থা, বিদেশে ওর কেমন লাগছে, পড়াশোনার কি অবস্থা সব জানিয়ে শেষে কোড ভাষায়ও দু-এক বাক্য লিখতে ভুললনা।
এখনো সযত্নে রাখা আছে সেই বিখ্যাত চিঠি!
তারপর থেকে আমাদের চিঠি আদান প্রদান শুরু হলো পুরোদমে- যার পৃষ্ঠা সংখ্যা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ্য- কোনো কিছুরি ইয়ত্তা নেই। হেন কোনো বিষয় ছিলনা, যা বাদ পরত! বড় আপুরা আমাদের চিঠির সাইজ দেখে ক্ষেপাতেন- "এটা কি রচনা, নাকি থিসিস?!"

৩/৪ বছর কেটে গেল এভাবে- কারো বার্থডেতেই কেউ কার্ড পাঠাতে ভুল করতাম না- তাও সে কী রোমান্টিক কবিতা দিয়ে ঠাসা!
মাঝে মাঝে এখানকার পোস্ট অফিসে আমার চিঠিগুলো খোয়া যেত! ও একবার দেশে এসে জানাল, আমাকে নাকি ২২ পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখেছিল- আর আমি তা পাইনি!!!

তারপর একদিন, ২০০২ সালে, বাসায় চলে এলো নেট কানেকশন। ইমেইল আর মেসেঞ্জারও এল অবধারিতভাবে।
দিনে যে কয়বার, কয় ঘন্টা ধরে চ্যাট করতাম, তার কি আর হিসেব আছে?! তারপরও মেইল করা হত প্রায়শঃই! সেই সুইট সিক্সটিনে সইয়ের সাথে কত কথারই না ফুলঝুরি উড়াতাম কীবোর্ডে দুহাত রেখে!


আস্তে আস্তে মেসেঞ্জারের কারণে ইমেইলর সংখ্যাও কমে গেল। তেমন একটা আর মেইল করা হয়ে উঠত না। বার্থডে গুলোতেও কেবল একটা ঈ-কার্ড- যার মেয়াদ ৩০ দিনের বেশি না!
তার উপর প্রযুক্তি যখন আরো দয়া পরবশ হয়ে হাতে মুঠোফোন ধরিয়ে দিল, তখন তো প্রতিটা দিন অন্ততঃ কয়েকবার এসএমএস করতে করতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম চিঠি নামক মান্ধাতার আমলের ধীরগতির যোগাযোগ মাধ্যমটাকে।

আর তারপর, কর্ণফূলীর গা বেয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে...।
সেই প্রিয়তমা সই, তার প্রিয়তম এর হাত ধরে এক অজানার দেশ থেকে আরেক অজানার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সংসারের ব্যস্ততায় আগের মত এসএমএস করা হয়না, ইমেইল তো দূরে থাক। ৬ ঘন্টার ব্যবধানে মেসেঞ্জারেও দেখা হয় কদাচিত। তবে খবরাখবর রাখা হয়, কখন কোন দেশে কি করছে, তা জানা যায়। যেমন জানা আছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সে আরেক অজানার দেশে উড়াল দেবে।

আমি পড়ে রইলাম আগের ঠিকানায়। মাতৃভূমির শিকড় আকড়ে ধরে আছি বলেই হয়তো- বারবার মনে পড়ে যায় সেই ছোট্টবেলার কথা- সেই আবেগঘন ভাষার চিঠিগুলোর কথা, হাজারটা ইমেইল এসে ইনবক্স ভর্তি হয়ে এলেও সেই আবেদন কি আর আছে এতে?

কোথায় জানি পড়েছিলাম, মানবদেহে স্নায়ু আর হরমোনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইমেইল আর চিঠির মতো। স্নায়ুর মাধ্যমে বার্তা যেমন খুব দ্রুতগতিতে পৌছে যায়, কিন্তু এর প্রয়োগ হয় ক্ষণস্থায়ী,ইমেইলের মাধ্যেমে পাঠানো বার্তা খুব দ্রুতগতিতে পৌছে গেলেও কিন্তু এর আবেদন ঠিকই ক্ষণস্থায়ী। আর হরমোন যেমন কাজ করে খুব ধীরগতিতে, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, চিঠির ব্যাপারটিও তাই।

আজ অনেকদিন পর সেই আবেগঘন চিঠির কথা মনে পড়ে- একটি চিঠি লিখে উত্তরের জন্য সেই প্রতীক্ষার কথা মনে পড়ে- আর মনে পড়ে হাতে চিঠি পেয়ে সেই কী যে আনন্দে দুলে উঠত আমার কিশোরী মন!

এখন-প্রতিদিনই চ্যাট হয়, খোজ খবর রাখা হয়, ভাল মন্দ আলাপ হয় ঠিক, কিন্তু আগের সেই প্রতীক্ষা, সেই আনন্দ, সেই আবেগ- সব বুঝি হাওয়ায় উবে গেল!

প্রশ্ন জাগে, প্রযুক্তি কি দুপ্রান্তের দুই বন্ধুকে কাছে এনেছে, নাকি বরং সেই আজন্মকাল থেকে চলে আসা হৃদয়ের বন্ধনটাকে ছিন্নই করে ফেলেছে?
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×