আমার বাড়ির পাশে ইছামতি নদী।ছোটকালে দেখতাম আশেপাশের হিন্দু ঘরগুলো নদীতে তাদের প্রতিমা বিসর্জন করতো বেশ খুশি খুশি মনে। আমি কষ্ট পেতাম, আমার মনে হতো এত আহলাদ করে বানানো প্রতিমাটা কেন এমন করে ডুবিয়ে দিলো। আচ্ছা প্রিয় জিনিসটা এভাবে বিসর্জন দেয়া এতো সহজ কেমন করে হয়? মাকে জিজ্ঞেস করতাম “মা তুমি কি আমাকে কখনো নদীতে এমন করে ফেলে দিবে”?
মা আমার চোখে চুমু খেয়ে বলতো, “তুই তো আমার সোনা বাচ্চা। তোকে রাখবো আজীবন সযতনে এই বুকে”।
বাবার সাথে আমার খুব একটা কথা হতোনা। একদিন সাহস করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা আমাকে একটা মূর্তি কিনে দিবা?”
বাবা আমার দিকে করা চোখে তাকিয়ে বললো, “দেবো। কি করবি?”
আমি ঢোক গিলে বললাম, “নদীতে ভাসায় দিয়ে দেখবো কেমন লাগে! অপূর্ব বললো সেদিন ও নিজ হাতে ওদের বাড়ির প্রতিমাটা ভাসায় দিছে। ওরে নাকি সবাই কোলে তুলে নাচছে।পরের দশমীতে আমিও একটা ভাসাতে চাই”।
বাবা আমাকে একটা আলতো করে থাপড় দিয়ে বললো, “আর এসব বলবানা। তুমি মুসলমান, এইসব আমাদের ধর্মে হারাম”।
সেই শুরু আমার ধর্ম নিয়ে সমাজ নিয়ে জাতি বর্ণ গোত্র সব কিছুর বৈষম্যবাদ গুলিয়ে খাওয়ার। আমি বড় হয়েছি খুব শক্ত ধর্মীয় পরিবেশে।দাদা চাইতো আমি যেন হেফজ পাশ করি। বাবার ইচ্ছায় আমি অবশ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হই।১৯৯৪ সালে বাবা যখন ঢাকায় চাকরীতে বদলী হয়ে আসেন তখন আমি সেন্ট গ্রেগরীতে ভর্তি হই। ওই সময় স্কুলের বাহিরে রহিম মামা নামে একজন ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। আমাকে খুব আদর করে বলতেন, “মামা ঝাল বেশি কইর্যা দেই আজকে? ভিটামিন সি পাইবা”।
আমি ঝাল খেতে পারতাম না। মামাকে বলতাম, “মামা আমি সিভিট কিনে খাবো। ঝাল দিয়েননা প্লিজ”।
মামার একটা প্রতিবন্ধী ছেলে ছিল। নড়াচড়া করতে পারতোনা। মাঝে মাঝে ওকে এক টাকার কয়েন দিলে লজ্জা পেয়ে হেসে দিতো।তারপর মাথা নিচু করে হাত তুলে ওর বাবাকে কয়েনটা দিয়ে দিতো। মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, “আমার ছেলেটা একটু লাজুক হইছে। টাকা পয়সা সে পছন্দ করেনা। শুধু একটু পড়বার চায়। তোমাগো স্কুলে তো ভর্তি নিবোনা, তাই একটা ছাত্র রাখছি কলজে পড়ালিখা করে। মাসে তিনশো টাকা দেই”।
আমার অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে রহিম মামার এক্সিডেন্টটা নিজের চোখে দেখি। হঠাৎ করে একটা বড় বাস কোত্থেকে যেন ফুটপাথের উপর গাড়ি উঠায় দেয়। গাড়ির চাকার সাথে মামার গড়াগড়ি খাবার দৃশ্যটা দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার মনে আছে পাশে তার ছেলেটা যখন হাম হাম আওয়াজ করে চিৎকার করছিলো। আমি সাতদিন স্কুলে যেতে পারিনাই। একটু পরপর বমি করতাম। মা আমাকে নামাজ পড়ে বুকে ফু দিয়ে দিতো। বাবা দুইদিন অফিস বাদ দিয়ে আমার পাশে বসে ইংরেজী বই পড়াতো। একদিন গভীর রাতে উঠে আমি অনেকদিন পর একটা কথা বলি বাবাকে, “ঘুম হয়না বাবা। ভয় লাগে”।
আমার গম্ভীর বাবা আমাকে বুকে নিয়ে বলে, “আমি আর তোর মা আছি না। কিচ্ছু হবেনা”।
আমি এরপর অনেকদিন অস্বাভাবিক ছিলাম। গাড়ি দেখলে খুব ভয় পেতাম। মনে হতো এই বুঝি একে বেঁকে আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে যাবে।সেই জটিল সময়ে আমার সাথে পরিচয় হয় পাশের পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের বাড়িওয়ালার মেয়ে লুবনার সাথে। লুবনা স্কলাস্টিকায় পড়তো।ওটা অনেক ভালো স্কুল ছিলো। আমার মত গরীব ছেলেদের শুনছি ওই স্কুলের আশেপাশে দেখলেও দারোয়ান ধরে মাইর দিতো।লুবনা ছিলো আমার জীবনের প্রথম ক্রাশ।আমি ১০ বছর বয়সে কেমন করে যেন ওর হাসির প্রেমে পড়ে যাই। মাঝে মাঝে পড়াশোনা বাদ দিয়ে গালে হাত দিয়ে ওর কথা ভাবতাম। ঘুমানোর সময় চিন্তা করতাম আজকে যেন ওকে স্বপ্নে দেখি। মাঝে মাঝে খুব ভয় হতো যদি আম্মু আব্বু যেনে যায়। তাইলে একটা মাইরও নিচে পড়বেনা, সব পিঠে যাবে।
আমাদের বাসার নিচে মাঝে মাঝে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। ওখানে লুবনা খেলতো। ক্লাস ফাইভে পরা আমি বৃত্তি পেয়ে ওই টাকা দিয়ে তাই প্রথম একটা র্যাকেট কিনি। সাহস করে একদিন ওরা এলিট ছেলেপেলে যেখানে খেলতো আমি সেখানে যেয়ে বলি, “আমাকে খেলায় নিবে? আমার র্যাকেট আছে। দুইটা কর্ক ও আছে”।
আমাকে ওরা খেলায় নেয়নি।তবুও প্রায় দিন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখতাম। একদিন কি মনে করে যেন লুবনা আমাকে নিজেই খেলার জন্য ডাক দিলো। ওইটা আমার জীবনের খুব ভালো একটা দিন ছিলো।এরপর থেকে নিয়মিত ওর সাথে খেলতাম। দুইবছর পর একদিন সাহস করে লুবনাকে বললাম, “তোমার দাঁত খুব সুন্দর”।
লুবনা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ হা করে বললো, “তুমি অনেক দুষ্ট হয়ে গেছো। মেয়েদের এইভাবে বলতে হয়না”।
আমি ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে চলে গেলাম। এর এক সপ্তাহ পরে বললাম, “লুবনা তোমার চুলগুলো খুব সুন্দর”।
লুবনা এইবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার সাথে আমি খেলবোনা। তুমি নাটক সিনেমার মত কথা বলো”।
আমার যখন ১৪ বছর বয়স, তখন একদিন খুব মন খারাপ করে আমাদের দোতলা বাসার নিচে বসে ছিলাম। মা আজকে আমাকে বকা দিয়েছে অনেক।আমি মার কাছে দুইশো টাকা চেয়েছিলাম লুবনার জন্য একটা গিফট কিনবো তাই। মা দেয়নি। আমার নিজের নিজের অনেক লজ্জা লেগেছে। লুবনা আমার জন্মদিনে আমাকে ৮০০ টাকা দিয়ে একটা টিশার্ট কিনে দিয়েছে। আমি এতো গরীব যে ওর জন্য একটা কার্ড কিনতে পারবোনা। লুবনার দিকে সেদিন তাকাতে পারছিলাম না লজ্জায়। সন্ধ্যা যখন প্রায় হয় হয়, লুবনা নিজে থেকে আমার কাছে এসে বললো, “তুমি প্রতিদিন আমার দিকে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়িবিড় করো। আজকে কি হয়েছে। আমাকে দেখতেই পাচ্ছোনা”।
আমি ওর কথা শুনে উলটো ঘুরে কোনরকমে কান্না থামালাম। ও আমার কাঁধে হাত দিলে মনে হলো কত আপন একটা মানুষ আছে আমার পৃথিবীতে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি বের হচ্ছিলো। ও দেখে আমার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো, “কি হয়েছে জাহিদ? কাঁদছো কেন?”
এরপর আশেপাশে তাকিয়ে যখন দেখলো কেউ নেই তখন ও আমাকে খপ করে জড়িয়ে ধরে I love you বলে ভৌ দৌড় দিলো। আমি কাঁদবো না কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রায় বিশ মিনিট আমি হা করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার জীবনটা খুব বদলে গেলো আরো একবার।পড়াশোনা মাথায় উঠলো, সারাদিন ভাবতাম শুধু ওর কথা। আমি হাসতে হাসতে নিচে যেতাম। লুবনা আমাকে দেখে এতো সুন্দর একটা হাসি দিতো, আমি সারাক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখতাম। আমার এই বাচ্চাকালের এতো রোমান্স সব হঠাৎ করে একদিন শেষ হয়ে গেলো।
২০০৪ সালের নভেম্বরের ১৯ তারিখ। রাত এগারোটা বাজতে না বাজতেই আব্বা প্রতিদিনের মত চেঁচামেচি শুরু করলেন ঘুমানোর জন্য। আমার ছোট ভাই নিলয় আমার কাছে এসে বললো, “ভাইয়া কালকে আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে কি দিবা?”
আমি ওকে থাবড় দিয়ে বলি, “ঘুমাইতে যা। তোর আবার কিসের জন্মদিন। ৮ বছর বয়স হয়ে গেছে। বুইড়া হাবড়া”।
নিলয় আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে বলে, “ভাইয়া তোমার কমিকস গুলা দিবা? বিল্লুর দুইটা আর পিঙ্কীর একটা দিলেই হবে। তুমি না বড় হয়ে গেছো, ওগুলা পড়োনা”।
রাত্রি ঠিক দুইটার দিকে দরজায় ধড়াম ধড়াম আওয়াজ শুনে আমি উঠে পড়ি। এতো জোরে কে আওয়াজ করছে। একটু পর আব্বা ড্রইংরুমে যেতেই দরজা ভেঙ্গে অনেকগুলো লোক একসাথে ঢুকে পড়ে। আমি নিলয়কে নিয়ে ভয়ে খাটের তলে ঢুকে পড়ি। আব্বা চিৎকার করে বলে, “কে তোমরা? কি চাও?”
আমার মনে হলো আব্বাকে কেউ যেন আঘাত করলো। আম্মু তখন চিৎকার করে উঠলো। আমি আর নিলয় অনেক ভয় হলেও সেখানে দাঁড়িয়ে বলি, “আপনারা কে? আমার আব্বাকে ছেড়ে দেন”।
হাড় জিরজিরে একটা লোক আমাকে খুব জোরে একটা ঘুষি দিয়ে বললো, “একটা কথা বলবিনা। আমরা কিচ্ছু করবোনা। শুধু কিছু টাকা পয়সা পাইলেই চইলা যামু”।
পরবর্তী আধা ঘন্টা ওরা আমাদের পুরো বাড়ি তছনছ করলো। মাত্র ৭০০০ টাকা বাসায় ছিলো তখন। ডাকাতগুলো তখন চিৎকার করতে থাকলো।আমার বাবাকে চোখের সামনে এলোপাথারী মারতে লাগলো। একটা সময় খেয়াল করলাম নিলয়কে একজন গলা চেপে ধরে রেখে বাবাকে বলছে, “টাকা কই বল! নাইলে তোর পোলারে আজকে জবা দিমু”।
আব্বাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি। আব্বা হাত নেড়ে আলমারী দেখিয়ে বললো, “ওইখানে আরো ৪/৫ হাজার টাকা আছে। আর কিচ্ছু নাই ভাই। বিশ্বাস করেন। আমার ছেলেটারে ছেড়ে দেন আল্লাহর দোহাই”।
আমার মা তখন প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এক ডাকাত মায়ের দিকে দেখিয়ে বললো, “উনারে ওই রুমে নিয়ে যাও। কিছু যখন দিতাছেনা তখন অন্য ভাবে উশুল কইরা লামু”।
আমার বাবা দৌঁড়িয়ে যেয়ে এক ডাকাতের পায়ের উপর পড়লো। চিৎকার করে বললো, “ভাই তোমরা আমার ভাই লাগো। এই মহিলা তোমাদের বোন। আমাদের মাফ করে দাও। তোমরা আমার বাপ লাগো। টাকা আমি তোমাদের যা লাগে দিবো। আমাকে দুইটা দিন সময় দাও”।
বাবা বা আমি কেউ খেয়াল করিনি কখন মা দৌড়িয়ে বারান্দার দিকে চলে গেছে। এক ডাকাত মা কে ধাওয়া করতে গেলে আমি শুধু ধুপ করে একটা আওয়াজ পাই। আমার ভয় হচ্ছিলো, মা কি বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছে? বাবার চিৎকারে তখন আমি নিজেও ভয় পেয়ে যাই। পেছনে তাকিয়ে দেখি নিলয়ের প্রাণহীন শরীরটা কেমন যেন বিশ্রীভাবে মাটিতে পড়ে আছে। বাবাকে একটা কোপ দিয়ে ওরা কোথায় যেন পালিয়ে গেলো। ডাকাতদের নেতা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোরে রাইখ্যা গেলাম। আজকে আমার খুনের কোটা পূরণ।যা বাইচা গেলি”।
তখন চারদিকে অন্ধকার। হালকা চাঁদের আলোতে আমি আমার অন্ধকার রুমে পশুটাকে খুব ভালো ভাবে দেখলাম। চোখ লাল হয়ে আছে যেন এইমাত্র নেশা করে এসেছে। মুখ দিয়ে কেমন বাজে সিরাপের গন্ধ। কথা বললেই ধক করে নাকে লাগে। আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। আশেপাশের বাড়িঘরগুলোতে কেউ কেউ তখন ভয়ে আমাদের বাসায় উঁকি দিচ্ছে।
আমি জানিনা আমি কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।একা অন্ধকারে বিপর্যস্ত। একটা সময় হাত বাড়িয়ে লাইট জ্বালালাম। তাকিয়ে দেখি চারপাশে লাল রক্ত। এক পাশে আমার সৎ রাগী বাবার ছোপ ছোপ রক্ত। আরেক পাশে নিলয়ের প্রাণহীন চোখ যাতে কোন ভয় নাই, শুধু বিস্ময়। বাচ্চাটা বুঝতে পারেনি কেন কিছু মানুষ তাকে এমনভাবে হত্যা করবে। আমি কোনরকমে নিচে নামলাম বাড়ির। দেখি দুই একজন খুব কৌতুহলী মানুষ একটা কিছুকে ঘিরে আছে। আমি কাছে এগিয়ে যেতে থাকলে পাশের বাড়ির দারোয়ান আমাকে আটকিয়ে রাখে। আমাকে বলে, “যাইওনা বাবা। যাইওনা”।
আমি তবুও এগিয়ে যাই। আস্তে আস্তে মাটিতে নিচু হয়ে বসে মায়ের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মাথাটা ঘুরে গেছে। চোখ ভরা দুঃখ। ঠোটটা একটু ফাক করে আছে, যেন আমাকে বলছে “বাজান তোর সাথে আর দেখা হবে তো?”
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। অনন্ত কালের এই কান্না আমাকে পৃথিবীর কোন প্রান্তে নিয়ে যায় কেউ জানেনা, কেউ বোঝেনা। আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না। আমি আশেপাশে লোকের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উচু করে আমার বাসা দেখিয়ে বলতে চেষ্টা করি, “আমার নিলয়টা ওখানে, আমার বাপটা ওখানে। কেউ দেখবা ভাই? কেউ একটু ওদেরকে আমার পাশে এনে দিবা?”
সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছেনা। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটা এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে বুকে নিয়ে ধরে রাখি। কেউ আমার থেকে তাকে নিয়ে যেতে পারবেনা। এই পৃথিবীতে কেউ পারবেনা।
সেইদিনটা আমার মৃত্যু হয়। আমি অপূর্ব হাসনাত জাহিদ সেদিন মৃত্যুবরণ করি। আমার মাঝে এরপর যেই মানুষটা বাস করতো তাকে আমি চিনিনা। একেবারেই না।
২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারী।রাত তখন প্রায় ৮টা। আজ অনেকদিন পর আমার বাড়ির এই রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম। প্রায় ১২ বছর হয়ে গেলো বোধ করি। এইখানে একসময় আমরা থাকতাম। আর দুইটা গলি পেরিয়েই আমার বাসা। তবে আজকে আমি আমার বাসার দিকে যাবোনা। আমি যাবো ১০ নম্বর রোডের ৪/এ বাড়িতে। এই বাড়িতে রফিক মেম্বার থাকেন। উনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি।বাবার সাথে উনার খুব ভালো খাতির ছিলো। আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিনটাতে উনি নিজে সবার দাফন কাফন করিয়েছে। আমার মামা দেশে আসার আগ পর্যন্ত উনি আমাকে তার বাসাতেও থাকতে দিয়েছিলেন।রফিক সাহেব এখন অবশ্য আর মেম্বার নেই। উনি অবসর নিয়েছেন। উনার পরিবার বলতে স্ত্রী এবং দুই ছেলে। এক ছেলের নাম রনি আরেকজন জুনায়েদ। একসময় আমরা একসাথে খেলতাম।
আমি দরজায় কলিংবেল দিলে রফিক সাহেবের স্ত্রী দরজা খুলে দেয়। উনি কেন যেন আমাকে সবসময় খুব অপছন্দ করতেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলি, “খালাম্মা ভালো আছেন?”
উনি আমার দিকে অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমাকে বলেন, “তোমাকে ঠিক চিনতাছিনা”।
আমি মাথা নেড়ে বলি, “আমি জাহিদ। আমার বাবা মরহুম রহমান সাহেব দুই গলি পড়ে থাকতেন।আপনাদের বাসায় আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন একসময়”।
উনি মাথা নেড়ে বললেন, “ও আচ্ছা।আসো ভেতরে আসো। তোমার আঙ্কেল গেছে একটু বাজার করতে। এক্ষুণি আইসা পড়বে। বসো। তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম। তাই চিনতে পারিনাই। কিছু মনে নিওনা”।
আমি হেসে বললাম, “সমস্যা নাই। রনি আর জুনায়েদ কেমন আছে?”
উনি বললো, “রনি থাকে এখন মালয়শিয়া। ওইখানে একটা ভার্সিটিতে পড়ে। জুনায়েদ গেছে ওর মামার বাড়ি বরিশালে বিয়ে খেতে। আমিও যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু শরীরে বাতের ব্যাথা অনেক। তাই যাইতে পারিনাই”।
একটু পর কলিংবেলের আওয়াজে আমি নিজে যেয়েই দরজা খুললাম। রফিক আঙ্কেল আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন মনে হলো।আমি উনার হাত নিজ থেকে ধরে ঝাকিয়ে সালাম দিলাম এবং বললাম, “কতদিন পর আপনাকে দেখলাম চাচা। ভালো আছেন?”
উনি আমার দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো। তোমার মামা তোমারে আমেরিকা নিয়ে গেছিলো না? কবে আসছো দেশে?”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “এইতো এক সপ্তাহ হলো। অনেক কাজ দেশে। আজকে আসছি প্রথম কাজটা করতে”।
রফিক আঙ্কেল মাথা নেড়ে বললো, “তোমাদের বাড়িটা খালি পইড়া আছে। নতুন যে কাউন্সিলর আসছে হেয় আমারে অনেকবার ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাইছে তোমার বাড়িটা দখল করবার চায়। আমি বলছি, তুমি একদিন ঠিকই আসবা। যা বলার যেন তোমার কাছেই বলে”।
আমি হেসে বললাম, “চাচা আমি তো জানি আপনি ওইখানে আপনার শালা আর তার পরিবারকে দিছেন থাকতে। আমি অবশ্য এতে কিছু মনে করিনাই”।
রফিক আঙ্কেল একটু মনে হয় ভড়কিয়ে গেলেন। লজ্জা নিয়ে বললেন, “আসলে বাবা বাড়ি খালি পইড়া ছিলো তাই আমি ওদের থাকতে দিছি। তুমি বললে ওরা এখন যাইবোও গা। কিছু খরচ হইছে অবশ্য বাড়ি মেরামত করতে। ওইটা দাবী করবোনা কেউ। তোমার বাবা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। ভাবীর হাতের মুরগীর ঝোলের স্বাদ এখনো আমি ভুলিনাই”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ওগুলো পুরনো ব্যাপার বাদ দেন। চাচা আমি আসলে দুইটা কাজে আসছিলাম। আমার বাবা তো সরকারী চাকরী করতেন ওয়াসাতে জানেন। উনি যেদিন মারা যান ওইদিন বাসায় দুই লাখ টাকা নিয়ে রাখছিলেন। ঐটা বাবা পেনশন ফান্ড থেকে লোন নিয়েছেন নিজের চিকিৎসা করাবেন বলে। বাবার দুইটা ব্লক ধরা পড়েছিলো জানেন নাকি জানিনা। টাকাটা উনি লুকিয়ে আলমারীর নিচে রেখে দিয়েছিলেন। আমি যতদূর জানি টাকাটা আপনি পরে নিয়ে খরচ করেছিলেন। আপনার ছেলে জুনায়েদ যে বরিশালে আছে এখন ও আমাকে বলছে”।
রফিক চাচা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন। আমি উনাকে আরো বলি, “জুনায়েদ তো আমাকে প্রথমে বলতেই চায়নাই। ওর দুইটা আঙ্গুল আমার কাটতে হয়েছে, আমি পকেটে করে নিয়ে আসছি। আমার প্রথম কাজ হলো আপনাকে ওর আঙ্গুলগুলো বুঝিয়ে দেয়া”।
আমি টিস্যু পেপারে মোড়ানো আঙ্গুলগুলো উনাকে দেই। জুনায়েদ খুব চিৎকার করছিলো আঙ্গুল কাটার সময়। শেষে আমার ওকে অজ্ঞান করে আঙ্গুল কাটতে হয়েছিলো। তবে এই ব্যাপারটা আমি খুব পছন্দ করি। জুনায়েদের মা আমাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। জুনায়েদ ঢাকা থেকে আসলে পালিয়ে গিয়েছিলো বরিশালে। নেশার টাকা না পেয়ে ও আমাদের এলাকারই এক রিকশাওয়ালাকে পিটিয়ে মেরেছিলো। পুলিশের ভয়ে পরে পালিয়ে যায়।
রফিক আঙ্কেল আমার দিকে তাকাতে পারেনা। সৃষ্টির শুরু থেকে যে আদিম ভয় মানুষের গহীনে বসবাস করে তার স্বরুপটা যেন আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি উনাকে বলি, “আমার দ্বিতীয় কাজটা শুনেন। আমার সন্দেহ হয়েছে যারা সেদিন আমার বাসায় ডাকাতি করতে গিয়েছিলো আপনি তাদেরকে চেনেন। না চিনলেও কারা এটা জানেন?”
রফিক আঙ্কেল হঠাৎ আমার পায়ের উপর পড়ে গেলেন। আমাকে হিচকিয়ে হিচকিয়ে বলেন, “বাবা আমারে ছাইড়া দাও। আমি কিচ্ছু জানিনা। ওই টাকাটা আমি নিছিলাম কথা সত্য, আমারে এক সপ্তাহ সময় দাও আমি তোমারে টাকাটা ফেরত দিয়া দিমু”।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “চাচা আপনি টাকা এখন দিতে পারবেন না। আপনার বড়ছেলে রনি বাসা থেকে ভেগে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে আপনার জমানো সব টাকা নিয়ে গেছে। আর আরেক নেশাখোর জুনায়েদ আপনার বাড়িটাও প্রায় বন্ধক দিয়ে টাকা মেরে দিয়েছে। আপনারা এখন মানুষের থেকে ভিক্ষা করে চলেন। আমি জানি তো। আমি এখন যেটা করবো, দুইলাখ টাকার বিনিময়ে আমি আপনার দুই হাতের দুইটা করে চারটা আঙ্গুল কাটবো। তবে আপনি যদি ওইদিন কারা ডাকাতি করছে এটা বলেন তাহলে শুধু দুইটা আঙ্গুল কাটবো। ঠিক আছে?”
চাচা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, “আমি সত্যিই চিনিনা ওগুলা কারা।ওই সময় থানার ওসি সিদ্দিক সাহেব বলছিলো এইটা নাকি শ্যামলীতে একটা দল আছে ডাকাতি কইরা বেড়ায় ওদের কাজ। আমি আর কিচ্ছু জানিনা। আল্লাহর ওয়াস্তে আমারে মাফ দাও”।
রফিক চাচার স্ত্রী এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। উনি যখন মাথা ঘুরায় পরে গেলো আমি চাচার দিকে তাকায় বললাম, “চাচা আপনার বউরে এখন ছাদ থেকে নিয়ে ফালায় দিবো। কেমন হবে?”
চাচা আমার পায়ে ধরে বলতে লাগলেন, “আমাগোরে মাফ কইর্যা দাও”।
আমি চুক চুক করে আওয়াজ করে বলি, “সব পাপ হবে বিনাশ। আপনার চার আঙ্গুল কেটে আজকে গলির সাদা কুত্তারে খাওয়াবো। ওইটা কুত্তাটা মনে হয় শংকর হয়েছে তাই না? দেখেন আমি হাত কাটি সুপারী কাটার জাতী দিয়ে। চুপ করে থাকবেন। আওয়াজ কম, আরাম বেশি হবে। আমার পছন্দ বুড়া আর মধ্যমা অঙ্গুলী, দুই হাতেরই। আমি যেখানে চাকরী করি সেখানে ওরা আমাকে বলে, Bone cutter। কিন্তু আমি হলাম আসলে আঙ্গুল কাটার। হাহাহা”।
রফিক চাচা আমার দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমার খুব শান্তি লাগে এমন নিস্পৃহ নয়ন দেখলে, মনে হয় যেন প্রেমিক পুরুষ তার প্রেমিকাকে ছলনা করছে। এই শান্তি আমি উনার আঙ্গুল কাটার সময়ও পাইনি। আজ অনেকদিন পর একটু ভালো লাগছিলো। এখনো পর্যন্ত যেভাবে চেয়েছি ঠিক সেভাবেই কাজ করতে পেরেছি। তবে আমার আশা ছিলো, ডাকাতদের ব্যাপারে আমি চাচার থেকে আরো বেশি তথ্য জানবো যেটা হলোনা। যাক আরো অনেক কাজ বাকি এবং জানার আরো উপায় তো অবশ্যই আছে। Bon Jovi এর এই আমার জীবন গাইতে গাইতে আমি আমার মত হারিয়ে গেলাম।
ধানমন্ডি থানার বর্তমান ওসি সিদ্দিক সাহেব প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে গরম পানিতে মধু মিশিয়ে খান। এরপর উনি উনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ফোন দিয়ে খোজখবর নেন। উনার স্ত্রী থাকেন সিলেট শহরের হাউজিং স্টেট। ওখানে ওসি সাহেব নিজে উনার প্রেয়সীর জন্য দুটো ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন।ঢাকায় উনার প্রথম স্ত্রী সব জানেন। কিন্তু উনি স্বামীকে খুব ভয় পান, তাই কখনো চোখ তুলে কোন কথা বলতে পারেননি।স্বামী অবশ্য একদিন ডেকে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলো, “দেখো আমার বয়স মাত্র ৫১। এই বয়সে অনেক কিছুর মনে স্বাদ জাগে। তুমি এইগুলা বুঝবানা। আমার ব্যাপারে কিছু শুনলে কিছু মনে নিবানা। ছেলে মেয়ের সাথেও এগুলা নিয়া কথা বলবানা। বুঝা গেছে না?”
স্ত্রী আকলিমা খাতুন মাথা নেড়ে সায় দেন।উনি জানে উলটাপালটা কিছু করলে উনার স্বামী উনাকে ছেড়ে দেবেনা।
আজ ভোর ৪টায় ওসি সাহেবের বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে যাওয়ার সময় আমার খুব ট্রাবল নিতে হয়েছিলো। সিকিউরিটি গার্ড প্রথমে গেট খুলতে চাচ্ছিলোনা। আমি একটু মিথ্যা করে বললাম থানা থেকে এসেছি। তখন সে হালকা করে গেটটা খুললো। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, “ওসি সাহেবের বাসায় যাবেন?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যা। উনার ফ্ল্যাট নাম্বার কত? কয় তালায়?”
দারোয়ান আমার দিকে তাকিয়ে পান চিবোতে চিবোতে বললো, “দাড়ান আমি উনারে আগে ফোন দেই। আপনে তো আগে আসেন নাই”।
আমি যেটা চাচ্ছিলামনা তাই করতে হলো। দারোয়ানের হাতটা ভাংতে মায়া লাগছিলো। ষাট বছর বয়স্ক একটা লোকের হাত এতো নরম হতে পারে জানা ছিলোনা। ওর মুখ যখন চেপে ধরে ছিলাম তখন আমার আঙ্গুলে ইয়া জোরসে একটা কামড় দিলো। আমি বোধহয় এই রাগেই ওর চাপাটা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। ওকে টেনে ওর রুমে রাখতে রাখতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। ওসি সাহেবের বাসায় ঢুকতে একটু সমস্যা হয়েছিলো। উনার দরজার নবটা আমার লেজার কাটার দিয়ে কাটতে হয়েছিলো। ইচ্ছা করলে আমি দরজা নক করেই ভিতরে আসতে পারতাম। ইচ্ছা করছিলোনা। আমার মনে হলো হঠাৎ করে ওসি সাহেবকে চমকে দিলে ব্যাপারটা আরো চমৎকার হবে।
ওসি সাহেব যখন গরম পানি দিয়ে মধু খাচ্ছিলো আমি পেছন থেকে উনাকে বললাম, “আস সালাম সিদ্দিক ভাইয়া। কেমন আছেন?”
ওসি সাহেবের হাত থেকে গ্লাসটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো। উনি গলা ফ্যাসফ্যাস করে জিজ্ঞাসা করলেন “কে আপনি?”
আমি বললাম, “আমি অপূর্ব হাসনাত জাহিদ। পল্লবীতে একই পরিবারে তিনজন খুন, একজন শুধু জীবিত - মামলার বেঁচে থাকা জাহিদ। চিনতে পারেন নাকি?”
ওসি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে বললেন, “এখানে আসছো কেন?”
আমি এবার উনার সামনে যেয়ে আমার চেহারাটা দেখিয়ে বললাম, “কয়েকদিন ধরে ঘুমাতে পারতেছিনা ভাইয়া। ঠিকমত বাথরুম ক্লিয়ার হচ্ছেনা। নাকে হয়েছে আবার সর্দি। এই গরম কালে কারো এমন হয় বলেন তো? আপনার কাছে আসছি চিকিৎসা নিতে”।
ওসি সাহেব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেলেন। উনি বুঝতে পারছেন না আমাকে ভয় পাবেন নাকি ঝাড়ি দেবেন। আমি উনার কাধে হাতে দিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলাম। উনাকে জোর করে সোফায় বসিয়ে বললাম, “যতক্ষন পর্যন্ত আপনার শরীরের মোলায়েম কয়েকটা অংশ না কাটবো ততক্ষণ শান্তি হবেনা। ঘুম বাথরুম, ঠান্ডা সর্দি সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমি ঠিক করছি আজ আপনার চোখের মণি একটা গেলে দিবো। আরেকটা কিচ্ছু করবোনা। তবে একটা কানও কেটে নিয়ে যাবো। পুরো্টা না অর্ধেকটা।আপনার নাম হবে এরপর থেকে কান কাটা সিদ্দিক। লোকে আপনারে কানা সিদ্দিকও বলতে পারে”।
সিদ্দিক সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন, “কুত্তার বাচ্চা, আমার চিনোস।এখুনি তোরে মাইরা লাশ গুম করে দিতে পারি”।
আমি বললাম, “জানবোনা কেন। আপনি আপনার সিলেটের দ্বিতীয় বউয়ের প্রথম স্বামীকে মেরে তো এভাবেই গুম করে রেখেছিলেন। আপনার স্ত্রী অবশ্য আপনার খুব বিশ্বস্ত। সে প্রথমে আমাকে কিছুই বলতে চায়নাই। আমি উনাকে একটু ট্রিটমেন্ট দেয়ার পর কিছু না জিজ্ঞেস করতেই সব বলে দিছে। কিছু মনে নিয়েন না আবার। আমরা আমরাই তো”।
সিদ্দিক সাহেব দৌড় দিয়ে উনার রিভলবারটা আনার জন্য ছুটলেন। আমি চুপ করে বসে বললাম, “আপনার ১৯৯৮ সালে আমেরিকা থেকে অর্ধেক দামে কেনা 178 colt আমার কাছে। আমার থেকে নেন।আসেন”।
আমি হেটে হেটে উনার রুমে যেয়ে দেখি উনি পাগলের মত হাতড়িয়ে উনার পিস্তল খুজছে। মনে হয় আমার কথা শুনতে পান নাই।
আমি উনার হাতে উনার গুলিবিহীন পিস্তলটা দিয়ে বললাম, “সময় নষ্ট করবেন না ভাইয়া। আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। আপনি সঠিকভাবে উত্তর দিলে আপনাকে আমি ছেড়ে দিবো। রাজি?”
সিদ্দিক সাহেবের মনে হয় প্রেশারের সমস্যা ছিলো। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বললো, “তোরে আমি হাত দিয়াই মারবো শূয়োরের বাচ্চা”।
আমার দিকে যখন এগিয়ে আসতে চাইলেন আমি উনার গলাটা আস্তে করে ধরে হাতের চাকুটা নিয়ে একটা চোখের উপর রেখে বললাম, “আমি ভাইয়া ট্রেইন্ড চোখ তুলে ফেলতে। আমার আপনার আইবলটা খুলতে মাত্র তিন সেকেন্ড লাগবে। আপনার এই মেদওয়ালা কুত্তার শরীর নিয়ে আমার সাথে পারবেন না। তার থেকে চলেন ঠান্ডা মাথায় কথা বলি”।
ওসি সাহেবের স্ত্রী আমার দিকে তাকাতেও সাহস পাচ্ছেনা তখন। তার দুই ছেলে এক মেয়ে মায়ের পাশে যেয়ে লুকাইছে। আমি ওদেরকে বললাম, “ভয় পাবেন না। এখুনি থানায় একটা ফোন দেন। বলেন, ধানমন্ডী ৯ নম্বর লেকের পারের এপার্টমেন্ট ২৮ নম্বর এর নিচতলায় একজন ৬০ বছরের সিকিউরিটি গার্ড অত্যন্ত আশংকাজনক অবস্থায় তার রুমে পড়ে আছে। জলদি যেন মেডিকেল সাপোর্ট পাঠায়”।
আমি ওসি সাহেবের চুল ধরে উনাকে খাটে বসিয়ে বলি, “আমার হাতে সময় কম। প্রশ্ন করবো, তুমি নেড়ি কুত্তার মত ভক ভক করে কথা বলবা। মিউ মিউ করবানা। ১২ বছর আগে মিরপুরে যে ডাকাতি হয় ওইখানে কে ডাকাতি করিয়েছিলো? আমি জানি, ১৪,৭০০ টাকা বেতন পায় এমন সামান্য একটা সরকারী কর্মকর্তার বাসায় কেউ ডাকাতি করতে যায়না। তুমি যা জানো তাই বলবা?”
সিদ্দিক সাহেব হাত জোড় করে বললো, “কিচ্ছু জানিনা আমি। বিশ্বাস করেন”।
আমি আমার পকেট থেকে সালফিউরিক এসিডের একটা ছোট্ট বোতল বের করে ওসি সাহেবের ডান পায়ে ঢেলে দিলাম দুই ফোটা। এরপর খুব জোরসে একটা থাপড় দিয়ে বললাম, “এসিডের মাত্রা কম। আরেকটা মিথ্যা বললে মুখে ঢেলে দিবো। মাত্রা কম হলেও এরপর যখন মদ খাবি তখন ওইটা ডাইরেক্ট তোর ভূড়ির উপর পড়বে। কুত্তার বাচ্চা আমাকে শিখাস। ভাবছিস আমি কিছু জেনে আসি নাই।ওই সময় তোর থানায় যে সেকেন্ড অফিসার ছিলো তার একটা চোখ আমার পকেটে নিয়া ঘুরতাছি তিন ঘন্টা ধরে। ওইটা তোরে এখন খাওয়াবো। তুই প্রত্যেকটা ডাকাতির থেকে ভাগ নেস আমি জানিনা ভাবছোস। সব ঠিক কইরা বল”।
ওসি সাহেব তখন তার এসিড পড়া পায়ের ওপর হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমাকে বললেন, “ভাই আপনার বাবার হাতে মোহাম্মদপুর আবাসিকের কয়েকটা হাউজিং এর পানির কানেকশনের ফাইল ছিলো। রাজউক থেকে উনাদের বানানো ৩৬টা ফ্ল্যাট রিজেক্ট করে দিছিলো। পরে ঘুষ খাওয়ায় রাজউকরে মানায় নিছিলো।কিন্তু আপনার বাবার হাতে তখন রাজউকের ফাইলটা ছিলো। উনি এইজন্য ঝামেলা করতেছিলো। উনারে বহুত টাকা সাধছিলো।রাজি হয়নাই পানির কানেকশন দিতে। ২৪ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বেচতে পারতাছিলোনা উনার জন্য। উনারে খুন করার পর আমি ওই মালিকপক্ষরে একদিন থানায় ডাইকা আনছিলাম।উনাদের কঠিন ওয়ার্নিং দিছি। ভাই আমারে ৫ লাখ টাকা দিছিলো। আপনে চাইলে আপনারে আমি এখন ৫০ লাখ টাকা দিতাছি। আমারে ছাইড়া দেন”।
আমি বললাম, “যারা আমার বাসায় গেছিলো তাদের কোথায় পাবো?”
ওসি সাহেব বললেন, “ওরা কামালের লোক। কামাল নিজে আপনার বাসায় ওইদিন গেছিলো। ও এখন হাজারীবাগ থাকে। ওইখান থেকে পরের বছর নির্বাচনে দাঁড়াবে। আমারে একসময় স্যার বলতো, এখন আমি স্যার বলি।জুতা চাটতে বললে ওইটাও করি”।
আমি হেসে বললাম, “ভাইয়া এইটাই জগতের নিয়ম। কিছু মনে নিয়েননা। আপনি আপনার ডান হাতটা নিয়ে একটু বাম চোখ ঢেকে রাখেন। আমি আপনার ডান চোখটা তুলবো”।
ওসি সাহেব কাঁদতে কাঁদতে আমার পায়ের পড়ে গেলো।আমার তখন ঘ্যান ঘ্যান লাগছিলো। পায়ের উপর কুত্তার নাকের পানি কার ভালো লাগে? আমি উনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “থানায় ফোন দিছিলেন? বেচারা দারোয়ান আর কিছুক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকলে মরেই যাবে। তাড়াতারী ফোন দেন এখুনি”।
এরপর আমি সিদ্দিক সাহাবের বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বললাম, “ফোন লাগা শূয়োরের সন্তান। নম্বর না জানলে তোর বাপের থেকে নে”।
আমি সিদ্দিক সাহেবের চোখটা তুলে উনাকে বললাম, “এত্ত ছোট কেন আইবল। ফসফরাসের পরিমাণ কম”।
ওসি সাহেবের তখন জ্ঞান নেই। আমি পাড়া দিয়ে আইবলটা ফুটিয়ে উনার স্ত্রীকে সালাম দিয়ে চলে আসলাম।আজকে একটা ভালো ঘুম হবে। কাল যেতে হবে হাজারীবাগ। কামাল সাহেব আমি আসছি।
“কামাল সাহেবের বাড়িটা ডুপ্লেক্স। বাড়িতে অনেক মানুষ ঘুরাফেরা করে। উনার চার ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তিন বছর আগে। স্বামী নিয়ে কুয়েতে থাকে। চার ছেলের বড় দুইটা মাস্তানী করে। বাকি দুইটাকে একটা এলাকার ইংলিশ মিডিয়ামে স্কুলে পড়ানো হচ্ছে এই আশায় যে এরা মানুষ হবে। আমি যখন কামালের বাড়ির সামনে গেলাম তখন রাত প্রায় দুইটা। আজকে দেয়াল টপকিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পরলাম। কেচি গেটের তালাটা ভাংতে আমার অবশ্য দারোয়ানের সহযোগিতা লেগেছিলো। নিজে ভাংলে আওয়াজ হতো, মানুষের ঘুম ভাংতো। কি দরকার। এই দারোয়ানকে অবশ্য মারতে হয়নি প্রথমে, ও নিজে থেকেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অবশ্য বাসায় ঢুকার আগে ও যেন ঝামেলা না করে এজন্য ওকে ছোট্ট একটু আঘাত করতে হয়েছে। যখন নিশ্চিত হলাম ও অজ্ঞান হয়ে গেছে আমি আস্তে করে কামাল সাহেবের বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। সবাই তখন বেঘোর ঘুমে। আমি কামালের রুমে ঢুকে দেখি ও বিশাল ভূড়ি উঁচিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর পাছায় একটা লাথি দিয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গালাম। অন্ধকার ঘরে এভাবে লাথি খেয়ে শুকরটা চিৎকার করে উঠলো ওরে বাবারে বলে। আমি টর্চ লাইট মারলাম ওর চোখে। এই সেই রক্তবর্না চোখ আমি দেখেছিলাম ঠিক ১২ বছর আগে।আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “ভাইরে কতদিন অপেক্ষা করছি আজকের দিনের জন্য। তুই কেমন আছিস ভাই? আমারে সেদিন জানে না মেরে ঠিক করিসনাইরে ভাই”।
কামাল চিৎকার করে বললো, “ওই হারামীর বাচ্চা...”
আমি কামালকে আর কিছু বলার সুযোগ দেই না। ওর গলায় পাড়া দিয়ে একটানে ওর জিহবাটা ছুরি দিয়ে ফেড়ে ফেলি।ও যখন তড়পাতে তড়পাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ওকে কাঁধে করে রাস্তায় নিয়ে যাই। দুই একজন এলাকার লোক আমার দিকে এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু ভয়ে কাছে আসছেনা। একজন বলে, “কি হইছে?”
আমি হাসিমুখে বলি, “সকল পাপ হবে বিনাশ। ১২ বছর আগে ভাই আমার বাপ মারে মারছিলো। আজকে হিসাব নিচ্ছি। দুইদিন পর লাশ এনে রেখে দিয়ে যাবো। ঠিকমত জানাজা পড়ায়েন”।
লোকগুলো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা ভয় পেলো। আমি মাঝে মাঝে নিজেও আয়নাতে আমাকে দেখে ভয় পাই। আমার চোখে মনে হয় যেন মানুষরূপী নেকড়ে বাস করে। আমি রক্তাক্ত নগরীর রক্তচোষা হায়েনা, আঁধারে বাস করা মানব মানবীর লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে বড় ভয়। আমাকে কেউ চেনেনা, জানেনা। কেউ কাছে থাকার সাহস করেনা। আমাকে কেউ ঘৃণা করেনা, কারণ আমাকে কেউ ভাবতেই চায়না। শয়তান আমাকে ভয় পায়, আমার পাশে দাঁড়াতে তার বড়ই আপত্তি।
কামালকে আমি মোহাম্মদপূর শেরশাহ শূরী রোডের একটা পুরনো বাড়িতে নিয়ে আসি। ওর জ্ঞান ফিরলে ওকে বলি, “১২ বছরের আগে ওয়াসার সরকারী কর্মকর্তার বাসায় গিয়েছিলে। তার একটা ছেলেরে জানে মারোনাই, মনে আছে নাকি ভাই? সেইদিন তোমার সাথে আরো তিনজন ছিলো। ওরা কই?”
কামালের সারা শরীর কাপছিলো। কাটা জিহবা নিয়ে আওয়াজও বের করতে পারছিলোনা। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, “ভাই জিহবা পরে সেলাই করে দেয়া যাবে। ওদেরকে এখন ফোন করে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে আসতে বলো। তাড়াতাড়ি করো। কাল সকাল নয়টায় আমার আরেক কাজ আছে।পরশু সকালে আবার আমেরিকা যাবার ফ্লাইট। এয়ার এমিরেটস। ফাস্টোক্লাস সার্ভিস। এই নাও তোমার ফোন। সুন্দর করে ফোন করো। আস্তে আস্তে কথা বলবা যেন ঠিকমত বোঝে। দুষ্টুমি করবানা। ওদের বলবা তোমার ভাতিজা ওদেরকে গাড়ি নিয়ে এসে পিক করবে। বাস স্ট্যান্ডে যেন ঠিক সকাল আটটায় থাকে”।
কামাল ভয়ে ভয়ে আমার থেকে ওর ফোনটা নিয়ে তিনজনকে ফোন দেয়। কোনরকমে বুঝিয়ে বলে মোহাম্মদপুর আসতে।
ফোন শেষ হলে আমি কামালের দিকে তাকিয়ে বলি, “অস্ট্রেলিয়া হলো সবচেয়ে বেজম্না জাতির দেশ। ওরা ওদের আদিবাসীদেরকে তড়পায় তড়পায় মারতো। পুনাবা বলে একটা আদিবাসী জাতিকে ওরা ঘরে যেয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিলো। যারা পালিয়ে বেঁচেছিলো তারা প্রায় দিন ভাবতো কিভাবে সাদা চামরার রেপিস্টগুলারে শাস্তি দেয়া যায়।মাঝে মাঝে ওরা ওদের শহরে আক্রমণ করে দুই একটা সাদা চামড়া ধরে নিয়ে আসতো। ওদেরকে কিভাবে শাস্তি দেয়া হতো জানো?
কামাল কিছু না বলে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে, “আমারে ছাইড়া দাও। তোমারে পাচ কোটি টাকা দিমু। কালকে কন্ট্রাক্টের টাকা ঘরে আনছি।তোমার বাপ মারে আমি মারিনাই। একটু পর যে বজলু আসবে ও তোমার বাপরে কোপ দিছিলো। আমার খুব ভালো মনে আছে। আমি না করছিলাম এমনে মারতে।তুমি আমার বাপ লাগো, আমারে ছাইড়া দাও”।
আমি হাসতে হাসতে বলি, “পুনাবা আদিবাসীরা মনে করতো দুষ্ট মানুষ সবসময় তার চেহারা একটা মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখে। তারা এইজন্য সাদা মানুষের মুখের চামড়া টেনে ছিঁড়ে ফেলতো। এরপর চোখে খেজুর গাছের কাঁটা ফুটিয়ে আগুনে পুড়াতো মুখ। এরপর ছেড়ে দিতো। তারা মানুষ হত্যা পছন্দ করতোনা। শুধু মুখোশটা পুড়িয়ে দিতো। আজকে তোমাদের সবার সাথে এই কাজটা করবো। শুরু করবো ভাই তোমারে দিয়া”।
সকাল আটটায় আমি বজলু, রশীদ আর আজগরকে পিক করি। নিজে গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে বলি, “আঙ্কেল, কামাল চাচা তার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলছিলো আপনাদের। কিন্তু উনি আবার মোহাম্মদপুর গেছে ওইখানের কাউন্সিলরের সাথে একটা মিটিং আছে বলে। আপনাদের ওখানে নিয়ে যেতে পারি?”
তারা সম্মতি দিলে আমি তাদেরকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের পুরনো বাড়িতে নিয়ে আসি। ওরা গাড়ি থেকে নেমে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি আমার গানটা বের করে সবাইকে বলি, “কুত্তার দল আমি তোমাদের প্রভু। আজকে তোরা আমাকে ডাকবি গড মার্সিফুল। একটা আওয়াজ হবে, একটা করে গুলি বের হবে। আস্তে করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকো”।
রশীদ আমাকে গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “ভাই আমাদের এইখানে আনছেন কেন?”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “তোমাদের মুখোশ খুলবো ভাইয়া”।
কামালকে যেখানে রেখেছিলাম সেখানে ওদেরকে নিয়ে আসার পর বজলু প্রথমেই অজ্ঞান হয়ে যায়। কামালের চামড়াহীন মুখটা আমি তখন আগুন দিয়ে প্রায় গ্রীল করে দিয়েছি। আমি রশীদ আর আজগরের দিকে তাকিয়ে বলি, “ও তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। সমস্যা নাই। ওর ট্রিটমেন্ট পরে দেবো। আমারে তোমরা ভাই চিনোনাই, এইটাতে সমস্যাও নাই। আমি তোমাদের গ্রীল করার সময় আস্তে আস্তে আমার গল্প বলবো। তোমরা আমার কাছের মানুষ। প্রতিদিন রাত্রে তোমাদের ভেবে ভেবে আমি একদিনো ঘুমাতে পারিনাই। আজকের পর থেকে আমি শুধু ঘুমাবো আর ঘুমাবো”।
বজলু যখন জেগে ওঠে তখন সকাল দশটা। ওর পাশে তিনটা চেয়ার, যাতে পা উপরে আর মাথা নিচে দিয়ে তিনটা লাশ পরে ছিলো। সবগুলোর মুখে চামড়া তোলা। মাথাগুলো পোড়া কয়লার উপর পড়ে আছে। চোখে কি যেন চোখা একটা জিনিস লাগানো।
আমি বজলুর দিকে তাকিয়ে বলি, “ভাই কেমন আছো? নাস্তা খাবা? ওদের মুখ থেকে পোড়া কিছু ফ্রাই করা মাংশ তোমারে দেই খাবা? আমি কুত্তার মাংশ খাইনা তাই নিজে টেস্ট করিনাই। কিন্তু একটু টমেটো সস দিয়ে খাইলে ভালোই লাগবে। সস এনে দিবো?”
বজলু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে ভাষা নেই।আমি আবার ওকে বলি, “বুঝলা আমি থাকতাম মিরপুরের পল্লবী আবাসিক এলাকায়। তোমরা ওইখানে ১২ বছর আগে যখন আমার বাপরে মারতে গিয়েছিলা তখন আমিও এমন করেই তাকায় ছিলাম। আমার ছোট ভাইটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমি গলা টিইপা মাইরা ফেলছিলা। মনে আছেনা ভাইয়া?আমার মায়ের দিকে নজর দিলে, উনি ভয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিলো। আমি তখন একেবারে তোমার মত তাকিয়ে ছিলাম। তোমার হারামী চোখগুলা যে আমি কতদিন নিজ হাতে ফুটাইতে চাইছি। যাই হোক তোমার বন্ধুদের থেকে তোমারে একটু অন্যরকম শাস্তি দিবো”।
বজলু আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে ওর গালের মাংশ কাটি। ও ব্যাথায় জেগে ওঠে চিৎকার করে আমি হাসতে হাসতে ওকে মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলি। ওর চোখে যখন খেজুর কাঁটা ঢুকাই ওর তখন হয়তো বেঁচে থাকার কথা না। আমার নিজের ওপর বিরক্ত লাগে। আমি একজনকেও মারতে চাইনি। আমার ইচ্ছা হয়েছিলো বাঁচিয়ে রাখতে। যতবার ওদের শরীরে ব্যাথা হবে ততবার ওরা ভাববে ওদের পাপের কথা। মুখ দিয়ে ছ্যাত ছ্যাত করতে আমি বাড়িটা থেকে বের হয়ে যাই। বজলুর মুখটা পোড়াইনি। ওর মুখের গোশত কেটে নিয়েছিলাম শুধু। ব্যাটা হেব্বি মোটা। মুখ দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ভাড়া করা Toyota HIACE গাড়িতে উঠি। আশেপাশে কতগুলো টোকাই ছেলে খেলছিলো। আমি ওদেরকে বলি, “এই বাড়ির উপরে যায়া দেখ, চারটা আস্তা মুরগীর কাবাব আছে”।
ওরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, যেন আমি মজা করলাম। আমি হাসতে হাসতে চলে যাই। এখন ব্লু মুন রেস্টুরেন্টে যাবো। একটা ফ্রেশ গোসল আর ঘুম দিয়ে লুবনার সাথে বিকেলে দেখা করবো। প্রিয় লুবনা আমি আসছি।
মিষ্টি দুপুরে লুবনাকে আমি দূর থেকে দেখছিলাম।ও প্রায় দিন বিকেলে রবীন্দ্র সরোবরের পাশ দিয়ে হাটে। ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার আগে ও চুপ করে একটা বিশেষ জায়গায় বসে গুনগুন করে গান গায়। যতবার ওকে দেখি মনে হয় সৃষ্টিকর্তা কখনো কাউকে এতো যত্ন করে বানায়নি। ও যখন গালে হাত দিয়ে পড়ন্ত বিকেল দেখে আমি তখন ভাবি, আবার কি মানুষ হয়ে যাচ্ছি। কাল সকালে আমি চলে যাবো হযবরল দেশে। আজকে ওর সাথে দেখা করার জন্যই আমি লেকের পাড়ে এসেছি। আমি আস্তে আস্তে ওর পাশে গিয়ে দাড়াই। ওকে বলি, “আমাকে চেনা যায় নাকি দেখো তো?”
লুবনা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “জাহিদ তাই না? কতদিন পর দেখা হলো? ভালো আছো?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিছু বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা। আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে আমি চিনিনা। অথচ কত ছোট্টকালে আমি যখন এই দুনিয়ার কিছুই চিনতাম না, মানুষে মানুষে ভালোবাসা হতে পারে তা বুঝতামনা তখন থেকে ওকে একদম আত্নার ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি লুবনাকে বলি, “তোমাকে আমি রাজকুমারী বলতাম মনে আছে?”
লুবনা হেসে বলে, “তা তো বলতা। কিন্তু তুমি তো অনেক হ্যাংলা পাতলা ছিলা। এখন তো মাশাল্লাহ অনেক স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। একটু পর আমার গোয়িং টু বি জামাই আসবে লেকে। ভালো হয়েছে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেলো। ওর সাথে দেখা করিয়ে দেবো। আমাদের এনগেজমেন্ট হলো এই সপ্তাহখানেক আগে। এর পর থেকে আমরা প্রতিদিন এক সাথে হাটি”।
আমি হেসে বলি, “জানি তো। তোমাদের দুজনকে এক সাথে বেশ লাগে।রাজকুমারী আমি খুব দুঃখিত। তোমার সাথে মাঝে অনেকগুলো বছর একবারো যোগাযোগ করিতে পারিনি”।
রাজকুমারী অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা কোন ব্যাপার না। আমরা ছোটকালে অনেক কিছুই ভাবি, বড় হলে সব হাস্যকর লাগে। তোমার জীবনে এত বড় একটা অঘটন হয়ে গেলো, আমি তোমার জন্য সবসময় দোয়া করতাম। তুমি কি তোমার মামার সাথে আমেরিকাতেই ছিলে এতোদিন?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমি ওখানেই ছিলাম। প্রথম ১/২ বছর আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। অনেকদিন মানসিক রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিলো। সুস্থ হওয়ার পর মামার চেষ্টায় ওখানেই পড়াশোনা করি। পড়াশোনা এখনও চলছে। পি.এইচ.ডি করছি Human Anatomy নিয়ে। সাথে ছোটখাটো একটা চাকরী করি আমেরিকান সরকারের সাথে”।
লুবনা মাথা নেড়ে বললো, “খুব ভালো লাগলো জাহিদ। কতদিন আছো দেশে? আর এসেছিলে কেন?”
আমি মুচকি হাসি। ওর দিকে তাকিয়ে বলি, “হিসাবের খাতা বন্ধ করতে আসছি। আর চলে যাচ্ছি কাল সকালেই। রাতে একটা কাজ শেষ করে একেবারে চলে যাবো”।
লুবনা চুপ করে থাকে কিছু বলেনা। ওর ব্যাগ থেকে একটা মোবাইল বের করে বলে, “তোমার একটা ছবি আছে আমার কাছে। মোবাইলে থাকে। আমি স্ক্যান করে রেখে দিয়েছি। তোমার চোখ দেখলে মনে হতো বাচ্চা একটা ছেলে কি যেন হারিয়ে ফেলেছে। এখন তোমার চোখ দেখলে অন্যরকম লাগছে। ওই ছেলেটা মনে হয় নেই”।
আমি মাথা এপাশ ওপাশ করে বলি, “আলবৎ। আমার চোখে কি লেখা আছে বলো তো?”
ও আমার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে বলে, “জানিনা জাহিদ। মনে হয় প্রাণ নেই। স্যরি কিছু মনে করোনা, যা মনে আসলো বলে দিলাম”।
আমি আস্তে আস্তে হাসি। ওকে বলি, “আমি যাই রাজকুমারী। ভালো থাকবে তো?”
ও আমাকে হাসি ফিরিয়ে দেয়। ভরসা দেয়। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি, আমাকে চলে যেতে হবে। যেই মানুষটা আমার দেহ নিয়ে বেঁচে আছে সে এখন রাজকুমারীর থেকে চলে যেতে চায়।কিন্তু যেই মানুষটা তার রাজকুমারীকে ভালোবাসতো সে যেতে চায়না। আমি আবার বসে পড়ি ওর পাশে। ওর হাত ধরে বলি, “রাজকুমারী বলো তো আমার মাঝে আগের মানুষটা আর নেই তাই না? আমাকে তুমি রাজকুমার বলে ডাকতে মনে আছে? আমার সাথে কি হলো বলো তো? আমি যে মরে গেছি তা নিজেও বুঝিনি জানো। আজকে দেখো আমার চোখ ভরা জল। তোমাকে দেখে মনে হয় আমার মাঝের সেই ১৬ বছরের ছেলেটা লুকিয়ে ছিলো এতোদিন।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম জানো। তোমার কোন কোন রঙের জামা আছে, কয়টা কানের দুল সব এখনো মনে আছো। তোমার নূপুরের আওয়াজ এখনো আমার কানে বাজে, এর থেকে মধুর শব্দ আমি আর শুনিনি”।
রাজকুমারী ওর হাতটা আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে বলে, “হাত ছাড়ো প্লীজ। হাত ছাড়ো”।
ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও খুব কাঁদছে। ও আমার হাত একবার ছাড়ে, আবার শক্ত করে ধরে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আবার কেন আসছো? আমি খুব বেঁচে ছিলাম এতোদিন। আরেকজনকে ভালোবাসতে পেরেছিলাম। আমার ভেতরটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো তোমার জন্য অপেক্ষা করে। তুমি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলে মনে আছে? সেটায় লিখেছিলে, “আমরা সারাটাজীবন এক সাথে থাকবো। তুমি কথা রাখোনাই, তুমি আমাকে রেখে চলে গিয়েছিলে”।
আমি ওর কান্নাটা সহ্য করতে পারছিলাম না। চলে যেতে চাই, রাজকুমারীর তার রাজকুমারকে ছেড়ে দেয়না। অনন্ত কাল এমন করে ও যদি আমার হাত ধরে রাখতো, জগতের কি ক্ষতি হতো জানিনা।আমি ওকে বলি, “রাজকুমারী একটা কথা বলি। কখনো ভুলবেনা। আমাদের বয়সটা কম ছিলো, ভালোবাসাটা কম ছিলোনা। আমি যেই মুহূর্তে আবার চলে যাবো, তুমি আর কখনো আমাকে ভাববেনা।আমি এখন আর সেই মানুষটা নেই। আমি মরে পচে নষ্ট হয়ে গেছি। আগে তোমার হাত ধরলে যেমনটা লাগতো, সেই অনুভূতিটা এখন হারিয়ে গেছে।আমি শেষ হয়ে গেছি। একদম শেষ।“
রাজকুমারীকে আমি কিছু বলতে দেইনা। উঠে চলে যাই। কি আশ্চর্য্য আমার চোখে পানি। কতদিন পর ভেতরের মানুষটা কাঁদলো।একবার যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। কিন্তু মন সায় দেয়না আর। খুব ক্লান্ত লাগছে।
হোটেলে ফিরে আমি হেরল্ডকে ফোন দিলাম। হেরল্ড আমার রিপোর্টিং বস। ও ফোন ধরে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কাল আসছো?”
আমি শুধু সম্মতিসূচক একটা আওয়াজ করি।
হেরল্ড কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে বলে, “তুমি যেই কাজে তোমার দেশে গিয়েছিলে সেটা হয়েছে?”
আমি বললাম, “হয়েছে। কয়েকটা খুন করতে হয়েছে।উপায় ছিলোনা”।
হেরল্ড চিন্তিত হয়ে বললো, “জাহিদ আমি কেয়ার করিনা তুমি আমেরিকান সয়েলের বাহিরে যেয়ে কি করেছো। কিন্তু কোনভাবে তোমাকে ট্র্যাক করা গেলে বিপদ হবে। আমেরিকা সরকার তোমাকে চিনবেনা”।
আমি শান্তকন্ঠে বললাম, “আমি তোমাদের সরকারের একজন ট্রেইন্ড স্পাই। কিভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে হয় জানা আছে বস। পরশু দেখা হবে। গুড উইশ”।
আশফাক সাহেব রাতের বেলা ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়ে গাড়িতে ধূমপান করেন। ড্রাইভার হারুন এটা পছন্দ করেনা। একটু পর আশফাক সাহেব গাড়ির মধ্যেই বমি করবে এটাও সে জানে। ৫০ বছরের বুইড়া ভাম তাও আজকে মহিলা নিয়ে গাড়িতে উঠায়নাই। নাহলে কত রকম রঙ ঢং দেখতে হইতো। গাড়ি বাসায় চলে এলে হারুনকে নিজে টেনে টেনে মালিককে বাসায় উঠায় দিতে হয়। কাজ শেষ করে সে যখন নিচে নেমে আসে তখন একটু জোরেই গালি দেয়, “এতো খারাপ লোক মরে, এইটা মরেনা ক্যান?”
আমি তখন আশফাক সাহেবের বেডরুমে বসে আছে। মেক্সিকান টোবাকো আমার বেজায় পছন্দ। সাথে রাশিয়ান ভদকা Imperia। আহ! এই জীবনে আর কি চেয়েছিলাম।আশফাক সাহেব তার বেড রুমে ঢুকেই আমাকে দেখে ফেলেন। ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তুই কোন হারামী?”
আমি সালাম দিয়ে বলি, “স্যার আমি একজন অতি সাধারণ আম জনতা। আপনার কাছে একটা গল্প করতে আসছি”।
আশফাক সাহেব নেশার টানে হেসে বলে, “গল্প করবি, কর। আমার পা টা একটু টিপে দিবি বাপ?”
আমি বলি, “অবশ্যই দেবো। স্যার আপনি ২০০৪ এর দিকে কিছু ফ্ল্যাট বানায়ছিলেন মোহাম্মদপুরে সেগুলার কি অবস্থা? শুনছিলাম ওখানে পানির কানেকশন ছিলোনা”।
আশাফাক সাহেব উঠে বসে বলেন, “সব চালু আছে। এইসব কে বলছে তোরে? তুই কে হারামীর বাচ্চা?”
আমি আশফাক সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করি। তাকে বলি, “স্যার আমার বাপের রক্তে ওখানে এতো কিছু হয়েছে, আমি তো সব এমনিতেই জানি। এখন স্যার কাজের কথা শোনেন। আমি আজকে জ্যান্ত আপনার অর্ধেক শরীরের চামড়া ছিলবো। আপনার মুখমন্ডল দিয়ে শুরু করবো। তবে তার আগে চোখ বের করে নিবো। নাহলে চামড়া টেনে খুলার সময় আটকায় থাকে। আমি আবার খুব যত্ন নিয়ে কাজ করি। স্পট ফেলিনা চামড়ায়”।
আশাফাক আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায়। আমি খুক করে হাসতে হাসতে বলি, “স্যার আপনারে কথা দিছিলাম গল্প বলবো। এখন শুনেন বেজন্মা অস্ট্রেলিয়ানদের কিভাবে আদিবাসী পুনাবারা শাস্তি দিতো।মন দিয়ে শুনেন, জীবনের শেষ গল্প”।
আমি মেক্সিকান টোবাকোতে টান দিতে দিতে চামড়া ছিলতে থাকি। আশফালের হাত তখন ভেঙ্গে বেঁকে দুদিকে ঝোলানো। আমি গুনগুন করে বলি, সব পাপ হবে বিনাশ।
কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। কাল সকালে ফ্লাইট। প্লেনে একটা যে জোরসে ঘুম দেবো না, আহ!
**********************************************************************************
গল্পটা লিখতে যেয়ে আমি প্রায় মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় জাহিদের মত একজন মানুষকে আশ্রয় দেয়াটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার। কোন কিছু অস্বাভাবিক লাগলে আমি দায়বদ্ধ নই।কারণ পুরোটা শুধুই একটা কল্পনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৭