সকাল থেকে শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করতেছে। রাতে ঘুম হয়নাই দেখে চোখগুলো লাল হয়ে আছে। এমন সময় ফোন আসলো রফিক ভাইয়ের। আমি ফোনের আওয়াজেই কিনা জানিনা হুরমুর করে খাট থেকে পড়ে গেলাম। আজকে রফিক ভাইয়ের সাথে সকালে আমার দেখা করতে যাওয়ার কথা। আমি মিনমিন করে বলি, “রফিক ভাই আস সালাম। সকাল থেকে রুমমেট বন্ধু খুব অসুস্থ।এখনও তার পাশেই বসে আছি”।
রফিক ভাই পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “হারামজাদা মিছিলের জন্য পোলাপাইন কেডায় জোগাড় করবো? বাইপাইল মোড়ে আয় এখুনি। আমি হোটেলের ভিতরে বইস্যা আছি”।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গায়ে লাল রঙের শার্টটা জড়িয়ে নেই। সকাল সকাল এরকম একটা গালি খাওয়া মানে সারা দিন খারাপ যাবে। কালকে থেকে আমার পেটটাও খারাপ। আজকাল বাহিরের হোটেলের খাবার খেতে খেতে পেটটা পুরাই নষ্ট হয়ে গেছে। সকাল খাবো বলে একটা টিপস বিস্কুটের প্যাকেট রেখে দিছিলাম।ওটাই খেয়ে নিচ্ছি।
পাঠককে আমার পরিচয়টা একটু দেই। আমি সরকারী দলের ছাত্র শাখার একজন কর্মী আসফাক। জাবিতে ভর্তির পর থেকে আমি ছাত্রলীগ করি, মনে প্রাণে করি।আমার অনার্স এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।আর কিছুদিন পর পাশ করে বের হয়ে যাবো। তবে লীগ আমি ছাড়বোনা।একবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে যদি একটা সুযোগ পেয়ে যাই আর কিছুই লাগবেনা জীবনে। আমার শৈশব খুব অসাধারণ কেটেছে। মা মারা যান প্রায় ১১ বছর আগে। তখন আমি মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ি কালকিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুল থেকে যখন ফিরছি তখন পথে মামার সাথে দেখা। মামার সাথে তখন একটা বিশাল বাঁশ। আমি ভয়ে ভয়ে মামার কাছে যেয়ে বলি, “মামা কাউরে মাইরবেন আজকে”।
আমার পাগল মামা নাকে ঘোৎঘোৎ করে বলতে থাকলেন, “এক কুত্তার বাচ্চা ছিলোনা লালন নামে। হারাদিন গোর খুদে। ওরে আজকে পিটায়া তামা বানামু।চল আমার লগে”।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করি, “ও কি করছে মামা?”
মামা হঠাৎ করে কেদে দিয়ে বলেন, “ওরে গোর খোদার লাইগ্যা খুজতেছিলাম।আমার বইনটা কতক্ষণ ধরে শুয়ে আছে।নিজের ঘরে তারে পাঠাইতে হইবো না?কাইল রাতে ওরে খবর পাঠাইছি, এহনো আইতাছে না ক্যান হারামীর পুতে?”
আমি চোখ মুছতে মুছতে মামার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে দৌড় দেই। আমার বাবা আমার জন্মের কিছুদিন পর মারা যাওয়ার পর থেকে মা আমাকে নিয়ে নানুবাড়ি থাকতেন। কাল রাত থেকে মা একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা আগে থেকেই বেশ অসুস্থ ছিলেন। কাল রাতে কেমন যেন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আমি সারারাত মার পাশে শুয়ে মার কপালে জলপট্টি দিচ্ছিলাম, মা কোন সাড়াশব্দ করেন নাই একবারো। আমার এই পাগল মামা কাল রাত থেকে চিৎকার করছিলেন লালনের জন্য। আমার নানী তাকে অনেক বোঝায় যে মার কিছু হয়নাই। কবর খোড়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু আমার মামা বুঝতেই চান না। সকালে আজকে নানী পরীক্ষার জন্য জোর করে স্কুল পাঠান আমাকে।বলেন মা ঠিক হয়ে যাবে আমি বাসায় আসতে আসতে।
বাসায় যখন ফিরি তখন নানী চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। আশেপাশের অনেক লোক জমা হয়েছে আঙ্গিনায়। নানী চিৎকার করে বলতে, “মারে আমার পয়সার অভাবে তোরে হসপিটালে নিতে পারলাম না। তুই আমার মাফ করি দে। আমি মার কাছে যেয়ে দেখি মার চোখে মুখে কেমন একটা প্রশান্তি।উনি যেন চোখ বুঁজে নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন।আমি মার মুখে আমার ছোট্ট হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদি। আমার মা, আমার আদরের মা টা আর আমাকে আদর করে ডাকবেনা। এটা ভাবতে, অনুভব করতে আমার ছোট্ট মনে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। আমি আম্মুর বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম, “আমি এমনেই থাকবো। আমার মারে কেউ নিয়া যাইয়েন না”।
আজকে সকাল থেকে হঠাৎ করে মাকে খুব মনে পড়ছে। কেন জানিনা।মুখ ধুয়ে গামছায় যখন মুখ মুছছিলাম তখন বারবার মায়ের চোখ ভেসে উঠছিলো।একটা মাদ্রাসায় আজকে কোরআন খতম দিবো বলে ঠিক করি। দুটো বিস্কিট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে যখন রাস্তায় নামি তখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন কালবৈশাখী ঝড় নামবে। রফিক ভাইয়ের হাতে আরো কিছু গালি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যখন হোটেলে পৌছালাম তখন হালকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রফিক ভাই আমাকে দেখে হাত ইশারা করে ডাকলেন। আমার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বললেন, “তোরে যে ৫০টা ছেলে রেডি করার জন্য বলছিলাম কি অবস্থা”।
আমি মাথা নেড়ে হাঁ সূচক একটা ভাব দেখাই। মুখে কিছু বলিনা। রফিক ভাই হাসিমুখে বললেন, “গুড।তুই সব পোলাপাইন জোগাড় করে রানা প্লাজার সামনে নিয়া আসবি কালকে সকাল ৭টার মধ্যে”।
আমি মাথা নেড়ে মনে মনে বলি, আপনেও জানেন আমিও জানি সাতটায় কোনদিন কেউ আসবোনা।ফাপরবাজি তো বহুত নেন, নিজে তো নয়টা দশটার আগে আসেননা।
রফিক ভাইয়ের পরিচয় দেই একটু। উনি হলেন সাভার ছাত্রলীগের সভাপতি। উনি জাবিতেই কোন একটা বিষয়ে মাস্টার্স করছেন বছর পাঁচেক ধরে। উনি বাম ঘৃণা করেন আর টাকা/ক্ষমতা ভালোবাসেন। আমার মত জুনিয়র ছাত্রলীগকে প্যাদায় প্যাদায় মিছিল মিটিং ম্যানেজ করানো উনার পবিত্র দায়িত্ব। আমরা সব ম্যানেজ করলে উনি মঞ্চে উঠে গলা খাকারি দিয়ে বক্তৃতা দেন, “মুজিবের আদর্শবাদী ভাইসব, শেখ হাসিনার পবিত্র সত্তা ও আদর্শ বহনকারী বোনেরা আজ আমাদের দেশের এই উন্নতি সমৃদ্ধির ডিজিটাল রুপান্তরে যারা কাজ করছেন, যারা কাজ করবেন তাদের সবাইকে আমার লাল সেলাম। আজকে জাতির এই উন্নতির দ্বারপ্রান্তে আমাদের...”
আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনা রফিক ভাই লাল সেলাম কথাটা এতো পছন্দ করেন কেন। আমি প্রায়ই তাকে বলি, “ভাই এইটাতো বামদের মুখে ঘোরে। আপনি না এদের অনেক অপছন্দ করেন”।
রফিক ভাই লাল চোখে তাকায় বলেন, “ছাগল সেলামের আবার বাম-ডান কি। তবে অতি শীঘ্রই আমি নীল সেলাম চালু করবো দেখিস”।
বিকেলবেলা এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে হাটছিলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম, না চাইলেও দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। অনিলাকে কতদিন দেখিনা, অনেক অনেক দিন। আমি জাবিতে ভর্তি হওয়ার পর একদিন এনাম মেডিকেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম বন্ধুবর সাব্বিরের সাথে। সাব্বিরের এক বন্ধু এই মেডিকেলের ছাত্র। আমি তখনও রাজনীতি করা শুরু করিনাই। সাব্বির যখন ওর বন্ধুর সাথে আলাপ করছিলো তখন ওই বন্ধুর সাথে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর বন্ধু হাসান একটু পর মেয়েটার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো। এভাবেই অনিলার সাথে আমার পরিচয়। আমি এরপর থেকে প্রতিদিন অনিলার মেডিকেলের পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।সাদা এপ্রোন পড়ে পরীর মত একটা মেয়ে আস্তে আস্তে নীরবে হাটতে হাটতে আমার পাশ দিয়ে চলে যেত। আমাকে কখনও চিনতে পারেনি, আমিও চেনানোর চেষ্টা করিনি। ভয় লাগতো, যদি খারাপ কিছু বলে। মনটা ভেঙ্গে যাবে, আর কখনো তাহলে দেখা করতে পারবোনা। আমি ও আসলেই চোখ নিচু করে পাশের মামার দোকানে ঢুকে যেতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। এভাবে লুকিয়ে দেখার যে মজাটা কাউকে বোঝানো যাবেনা।
আমি অনিলার ব্যাপারে একটা জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম, ওর তেমন একটা বন্ধু বান্ধব নেই। আমার মনে হয় মেয়েটা কারও সাথে কথা বলেনা তেমন। ওর চোখগুলো সবসময় মনে হয় কাউকে খুঁজে। ওর প্রিয় রঙ ফিরোজা, কারণ ও বেশির ভাগ দিন ফিরোজা রঙের কোন একটা কিছু পড়ে আসে। কোনদিন হয়তো কানের দুল, কোনদিন হাতের চুড়ি। ১৪১৮ বঙ্গাব্দের প্রথম বৈশাখের দিনটাতে ও একটা ফিরোজা রঙের নূপুর পরে এসেছিলো ওদের কলেজের অনুষ্ঠানে। আমার সেদিনও ওর সাথে খুব একটু দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছিলো। একটাও নাহয় কথা বলবোনা, একটাও নাহয় শব্দ করবোনা, নাহয় তাকে একটাবারও চোখ বড় বড় করে দেখবোনা। শুধু একটু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো।এটাও আমার জন্য অনেক বেশি ছিলো।
কিন্তু আমার অতটুকু সাহস ছিলোনা।আমি সেসময় রাজনীতি করতাম, প্রায়ই জুনিয়র ছেলেমেয়েদের লাইন ধরে দাঁড়া করিয়ে ভাষণ দিতাম আওয়ামীলীগ এই দেশের জন্য যা যা অবদান রাখছে সেগুলো নিয়ে। দলটা মাথায় থাকতো, মনে থাকতো অনিলা। আমার এই গোপন ব্যাপারটা কাউকেই কখনো বলিনাই মা কে ছাড়া। মাকে আমি সব বলতাম। আমার পরীক্ষার কথা, ভালোবাসার কথা। আমি বিশ্বাস করতাম মা ওইপার থেকে আমার সব কথা শুনতে পেতেন। একদিন মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ভালো আছিস বাবা? আগে নিজেকে ভালোবাসিস।
আমি ভবিষ্যৎ ছাত্রলীগের সভাপতি রাত জেগে কেঁদেছিলাম। শুধু সেদিন নয় প্রায় দিন মাকে মনে করে কাদি। মনে মনে মাকে বলি, দুনিয়ার সবকিছুকে যতটা ভালোবাসি তাকে যদি একটা পাল্লায় রাখি আর তোমার প্রতি আমার একদিনের ভালোবাসাকে আরেকটা পাল্লায় রাখি তাহলে সেইটা আরো বিশাল হবে মা।
রানা প্লাজায় পরদিন সকাল সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিটে হাজির হয়ে গেলাম। আজকে সোহেল ভাই নিজেই সব তদারকি করছেন। সোহেল ভাই স্থানীয় এমপির একরকম দেহরক্ষী। যেকোন ধরনের বড় হরতাল অবরোধ হলে উনি সেই হরতালের বিপক্ষে মিছিলের তদারকি করেন। আজকে সোহেল ভাইয়ের গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবী। উনি মুখে গালির ফোয়ারা ছুঁটিয়ে রফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলেন, “শালা গার্মেন্টগুলা আজকে বন্ধু কইর্যা দিতে চায়। কত বড় সাহস। এগুলা বন্ধ করলে আমি মানুষ পামু কইত্থিকা। সকালে আইসা এক মালিক আমারে বলে, আজকে গার্মেন্ট ছুটি দিয়া দিবো।আরে শালা তোগো ব্যবসার নাহয় মাইর ধইর নাই। আমারটা কে দেখবো। পার পিস নাস্তা ১৫ টাকা কইর্যা ৩১০০ কর্মীর প্রায় ৪৬ হাজার টাকার আজকে বুকিং দেয়া আছে। এই টাকা কি ওর পাছার চামড়া বিক্রি কইর্যা আসবো? রফিক বিল্ডিঙ্গের পিছনে যায়া দেখ, একটা ছোট্ট ফাটল ধরছে। এইটার লেইগ্যা বলে বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়বো। ছাগলের দল সব। আজকে গার্মেন্টের ৩০০ লোক আমারে দিয়া দিতা বলবা। ১১ টায় মিছিল শুরু করবো। আরো কিছু কথা আছে, চলো ভিতরে চলো”।
আমি বুঝি সোহেল ভাই এখন টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলবেন।এই মিছিলে আমার ইনকাম দশ থেকে বারো হাজার টাকা। আমার সাথে যেই ৫০ জন আছে এরা প্রত্যেকে অবশ্য মাত্র ১০০-১৫০ টাকা পাবে। সোহেল ভাইকে স্থানীয় এমপি সাহেব অবশ্য আরো বেশি টাকা দিয়েছেন। কিন্তু কিছু টাকা উনি সবসময়ই মেরে দেন, ভাগ পায় রফিক ভাইয়েরা।আমাদের এই সাভার এরিয়াতেই মনে হয় ছাত্রলীগ যুবলীগের এত মিল মোহাব্বত আছে।
আমি আরেকবার আকাশের দিকে তাকাই। আজকের দিনটা কেমন যেন নীরস মনে হচ্ছে। চারপাশে মানুষজন সব দিনের মতই রাস্তা পার হচ্ছে। ইপিজেড এ বিভিন্ন কোম্পানীর আসিয়ান বাস, দশ সিটের গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে। আমি ঘোষের দোকানে যেয়ে ভাবছিলাম একটু নাস্তা করে আসবো।কিন্তু রফিক ভাই ডাকাডাকি করলে বিপদে পড়ে যাবো তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রানা প্লাজার সুবিশাল ইমারতের দিকে তাকিয়ে থাকি। সোহেল ভাই সামান্য তেলের ঘানি ঠেলে এত টাকা কেমনে যে কামাইছে তা আমরা সবাই বুঝি, আমারও ইচ্ছা করে এরকম একটা প্লাজা দেয়ার। নাম দিবো আসফাক প্যালেস। সেখানে শুধু পারফিউমের দোকান থাকবে। অনিলা পারফিউম খুব পছন্দ করে, আমি প্রায়ই তাকে পারফিউমের দোকানে ঘুরতে দেখি।
সমস্যা হলো অনিলার সাথে এখন একজনের সম্পর্ক আছে। আমি এক বছর থেকে ওর পাশে একটা ছেলেকে দেখতাম, পরে ওর সাথে ওই ছেলেটাকে প্রায়ই এখানে সেখানেও যেতে দেখতাম। একদিন আমার চোখের সামনেই দেখলাম ও সেই ছেলেটার হাত ধরে মাথা নিচু করে হাসছে। আমার ভালোবাসার মেয়েটা খুব লাজুক ছিলো, আমি নিশ্চিত জানি ছেলেটা ওকে বারংবার অনুরোধ করায় ও হাতটা ধরতে পেরেছে। এবং সেসময় ওর চোখে মুখে যে ভালোবাসার লজ্জাটা ছিলো আমি তা দেখে আবার ওর প্রেমে পড়ে যাই। আমার চোখ খুব আদ্র হয়ে যাচ্ছিলো, এই আদ্রতা ও আরেকজনকে ভালোবাসে তার জন্য না। আমার ভিতরে তখন খুব হাহাকার হচ্ছিলো এটা ভেবে যে আমার হয়তো কখনো ওর ঠিক এমন যত্ন করে হাতটা ধরা হবেনা। ওর হাতের আঙ্গুলগুলো খুব ছোট্ট, আমার এই জীবনের একটাই ইচ্ছা ছিলো ওর সেই ছোট্ট আঙ্গুলগুলো ধরে একটু নাড়াচাড়া করবো, একদিন সাহস করে হয়তো তা আমার বুকের সাথে লাগিয়ে রাখবো। কিন্তু আমরা তো রাজনীতি করি, আমাদের এমন নরম হতে নেই। আমাদের শুধু দলকে ভালোবাসতে হবে, আর কাউকে না। আমি এমন করেই আমাকে বুঝাতাম।মনটা কতটুকু মানতো তা আজ পাঠককে নাহয় নাই বললাম।
আমি চুপ করে নীল আকাশটা যখন দেখছিলাম তখন ২৪শে এপ্রিল সকাল ৯টা বাজে। সেদিনটা খুব ভয়ংকর খারাপ একটা দিন ছিলো, সেইদিনটা কিছু লোভী সত্তার কাছে মানবতার পরাজয়ের কালো দিবস ছিলো।আমার ঠিক চোখের সামনেই হঠাৎ করে রানা প্লাজা ভয়ংকরভাবে কেপে উঠলো, সবাই নিথর হয়ে তাকিয়ে রইলো। কাঁপতে কাঁপতে একসময় একটা ভয়ংকর আওয়াজ, চারদিক সব নিশ্চুপ করে দেওয়া কিছু ভয়ংকর আহাজারি আর তার মাঝে আশেপাশের মানুষের হুড়োহুড়ি। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি একটা হঠাৎ করে আবিষ্কার হওয়া ধ্বংসযজ্জের মাঝে। আমার কানে তখন কোন শব্দ আর যাচ্ছিলো না। কে যেন আমাকে টান মেরে সরিয়ে নিলো। রাস্তায় মানুষজন যে যেভাবে পারছে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে তখন ঘোরাঘুরি করছে কিছু সংখ্যা - ৩১০০ কর্মী ১৫ টাকার টিফিন ৪৬০০০ টাকা। আমি সামনে তাকাই, দেখি রফিক ভাই সোহেল ভাইকে হাতে ধরে বের হয়ে আসছে। সোহেল ভাই হা করে তাকিয়ে তার ইমারত দেখছেন। চিৎকার করে বলছেন, “শালার পুরাই তো বরবাদ হয়ে গেলাম রে। আমার কত টাকার মাল সামান সব গেলো গা। আমার বিল্ডিংটা কেউ বাঁচাও”।
রফিক ভাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, “ভাই ভাই শান্ত হোন।আবার বিল্ডিং দাড়া করানো যাইবো। আপনে শান্ত হোন”।
হঠাৎ করে একটা কালো গাড়ি এসে সোহেল ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালো। কালো গাড়ী থেকে একটা লোক নেমে সোহেল ভাইকে বললো, “পরিস্থিতি খারাপ। এইহান থিকা আগে চলো। ভাইয়ের কাছে চলো, উনি ডাকছে। তোমার ফ্যামিলীর সবাইরে কও পলাইতে।সময় নাই, গাড়ীতে উঠো”।
সোহেল ভাই কাকে যেন গালি দিতে দিতে গাড়িতে উঠলো, রফিক ভাইও উনার সাথে গাড়িতে উঠে বসলো।আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ডান হাতের একপাশে প্রচন্ড ব্যথা। হাত দিয়ে দেখি রক্ত।খুব একটা হয়তো কাটেনি, কিন্তু ব্যাথা করছে বেশ। আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে আগাতে থাকি আমার হলের পথে। একটা গাড়ি ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই। গাড়ির ড্রাইভারকে বলি, আব্দুল জব্বার হল।
এরপর আর মনে করতে পারিনা কিছু। গাড়ি যখন হলে এসে থামলো তখন আমার কিছু জুনিয়র আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হলে রুমে পৌছিয়ে দেয়। আমি বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরে পাই। আমার গায়ে তখন জ্বর। আমার সামনে তখন আবার সেই ধ্বংসযজ্জের ছবি ভেসে উঠে। আমি চিৎকার করে বিছানা থেকে পড়ে যাই। আমার কাছে সাব্বির আর মিশু এগিয়ে আসে। আমাকে আবার ধরে বিছানায় উঠায় দেয়। সাব্বির আমার কাধ ঝাকিয়ে বলে, “এখন বেটা হলে আছোস, আমরা আছি। কিছু হবেনা”।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলি, “আমার সামনে হুরমুর করে ভেঙ্গে পড়লো বিল্ডিংটা, বিশ্বাস কর আমি মাত্র কয়েকটা হাত সামনে ছিলাম”।
সাব্বির আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললো, “লজ্জা লাগেনা তোর এখন আবার এইসব নিয়া কথা বলতে। কতগুলা মানুষ মরছে তুই জানিস কুত্তার বাচ্চা। তোর বালের দলের নেতার বিল্ডিং না ওইটা, তোদের ওপর পইড়া ভাঙ্গা উচিত ছিলো। যতগুলা মানুষ মারা যাবে সবগুলোর জন্য তোরা সবকয়টা দায়ী। এক একটা মানুষের হাহাকারের অভিশাপ তোর ভিতরে সারাজীবন জ্বালায় পুড়ায় দিবো মনে রাখিস”।
আমি আস্তে আস্তে গায়ে জামা জড়িয়ে বাইরে যাই। সাব্বির আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “কোথায় যাও এখন? কয়টা লাশ হইছে দেখার জন্য?”
আমি যখন রানা প্লাজার সামনে পৌছালাম তখন অগুনিত মানুষ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকগুলোর চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, তারা অনেক কষ্টে নিজেদের চোখের পানি আটকিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ হাতে ছবি নিয়ে ভাসা ভাসা চোখে বলছেন, এইটা আমার ছেলে বা এইটা আমার মেয়ে। এক বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, উনি চোখ মুছতে মুছতে ভীড়ের মধ্যে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখে অপ্রকৃতস্থের মত বললেন, “ছেলেটা রাগ কইর্যা কিছু খায়নাই আইজকা সকালে। হাতে ওর একটা ছবিও নাই, বুকের মধ্যে আছে খালি। কখন থেকে খুজতেছি। কেউ তো তেমন বাহির হইতেছেনা ধসের থিকা। ছেলেটা সারাদিন কিছু খায়নাই।ওরে একটু খুইজ্যা দেন, কোলে নিয়া খাওয়ামু ভাই। একটু বাহির কইর্যা দেন”।
আমি মানুষের থেকে সরে যাই, বিল্ডিঙ্গের কাছে চলে আসলে হঠাৎ করে রফিক ভাইয়ের গলা শুনতে পাই। রফিক ভাই মুখে একটা রুমাল পেঁচিয়ে আছে। আমাকে হাত ধরে একটা খোলামেলা জায়গায় নিয়ে বললেন, “সোহেল ভাইরে মুরাদ ভাইরে এখন প্রটেক্ট করতে হবে বুঝছিস। উনারা এখন একসাথে আছে এক জায়গায়। পলায় থাকবো কয়েকদিন পরিস্থিতি ভালো না হইলে। আমাদের এখন লীগের জন্য কাজ করতে হবে। মানুষজনের যেন লীগের প্রতি বিদ্বেষ না হয় সেভাবে প্ল্যান করে কাজ করতে হবে। বুঝছো আসফাক?”
আমি একবার রফিক ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই, আর একবার ধ্বংশস্তুপের থেকে বের হওয়া লাশের দিকে তাকাই। রফিক ভাই আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে বলে, “আসফাক আমার কথা শুনছিস?”
আমি রফিক ভাইয়ের রুমালটা তার মুখ থেকে খুলে নেই। আস্তে আস্তে বলি, “শোন শুওরের বাচ্চা তোর এইখানে দাঁড়ায় থাকার কোন অধিকার নাই। তোর বালের দলের রাজনীতি যায়া তোর ভাইদের পশ্চাতদেশে ঢুকা।আমি তোর বালের রাজনীতির উপর এক্ষণ থেকে মুতি। আর যদি তোরে এক সেকেন্ড দেখি এইহানে, খোদার কসম তোরে এই জায়গায় না, রানা প্লাজার একেবারে নিচে নিয়া পুতমু”।
আমি রফিককে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে রানা প্লাজার সামনে আরো এগিয়ে যাই। মাইকে বারবার তখন ঘোষনা আসছে, “কেউ দয়া করে সামনে আসবেন না। ভীড় করবেন না”। আমি মনে মনে বলি, ভীড়ের গুষ্টি কিলাই। আমি যখন ধসের একদম কাছে তখন দেখি বেশ কয়েকজন লোক বিল্ডিঙ্গের ভিতরে আস্তে আস্তে ক্রলিং করে ঢুকার চেষ্টা করছে। আমি একজনের হাত ধরে বললাম, “ভাই আমাকে আপনার মত একটা দড়ি দেন, আমিও ভিতরে ঢুকবো”। যার হাত ধরলাম তার নাম বাঁধন।
একজন খুব পবিত্র মানুষের হাত হয়তো ধরেছিলাম, সেই মানুষটা আমাকে একজনকে দেখিয়ে বলেন, “ভাই উনার থেকে দড়ি নেন। আমাকে তাড়াতাড়ি একটু ভিতরে যায়া দেখতে হবে কোন মানুষ জীবিত আছে নাকি”।
আমি খুব কাছ থেকে দেখলাম আমার মত সাধারণ মানুষজন সবার আগে দৌড়িয়ে আসছে। প্রায় চার থেকে পাঁচজন মানুষ নিজের গায়ে দড়ি বেধে হাতে ছোট্ট ছোট্ট ছেনি হাতুড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকছে।বাবু নামে একটা লোক কালো গেঞ্জী গায়ে দিয়ে বলছেন, “ত্রিশজনরে বাহির করছি ভাই। কেউ একটা স্যালাইন দেন। দমটা বাইর হইয়্যা যায় গো”।
আমি কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে আস্তে আস্তে একটা ফাটলের ভেতর ঢুকে যাই। আশেপাশে ভয়ংকর সব আহাজারির শব্দ। আমি বেশ কিছু লোকের হাত পা নাড়ার শব্দ শুনতে পাই। এটা অনুমান করি এরা সপ্তম তালায় বেঁচে থাকা মানুষেরা। একটু ভিতরে ঢুকে দেখি একজন লোক কি ভয়ংকর আহাজারি করছেন, ভাই আমার হাতটা কাইট্যা পারলে একটু বাহির করেন। আমি আর পারতাছিনা। ও ভাই আমারে বাঁচান। ও ভাই, কেউ বাঁচান।
প্রায় অনেক রাত তখন, বেশ অনেক মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। লাশের সংখ্যাটাও কম না। আমি এক আপাকে বের করে খোলা বাতাসে মুখ দিয়ে সাথে সাথে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। সারাদিন পানি বা কোন খাবার না খেয়ে থাকার ফলেই হয়তো আর সজ্ঞান থাকতে পারিনি। মনে পড়ে কিছু মানুষ আমাকে তখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো।এক সাদা এপ্রোন পরা আপু আমাকে বলছিলো, “কিছু হয়নাই। শারীরিক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু না”। ঘন্টা দুই পরে আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠলে আবার ছুটে যাই। যেই মানুষগুলো সেখানে আটকা পড়ে আছে তাদের নিকট আমি দায়বদ্ধ। তাদের প্রত্যেকটা হারিয়ে যাওয়া নিঃশ্বাসের দাম আমাকে পরিশোধ করে যেতেই হবে।
পরের দিন হল থেকে এগারোটায় বের হয়ে যাই। রাতে কাজ শেষ করে ফিরছিলাম যখন, তখন ঠিক ছয়টা বাজে। বিছানায় পড়ে গিয়ে আর কিছু মনে ছিলোনা। রাস্তায় যেতে যেতে একটুকরো কলা রুটি খেয়ে নিয়েছিলাম। আজকে আবার মানুষের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। রানা প্লাজায় যেয়ে দেখি অনেক ডাক্তার বা ছাত্র ছাত্রী পাগলের মত ছুটাছুটি করছে। সবাই এনাম মেডিকেলের, খুব কৃতজ্ঞতা বোধ হয় এদের জন্য। হঠাৎ করে দেখলাম অনিলা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাদছে। আমি এগিয়ে এসে জীবনে প্রথমবারের মত তার সাথে কথা বললাম, “কাঁদবেন না”।
সে আমার দিকে না তাকিয়ে বললো, “পারছিনা। নিজ হাতে একটু আগে একটা লোকের পা কেটে দিছি। এখন আবার দৌড়াইতে হবে, যারা স্বেচ্ছাসেবী তাদেরকে বুঝাতে হবে কিভাবে হাত পা কেটে মানুষগুলোকে বের করতে হবে”।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি এখন ভেতরে যাবো, আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন? এখন তো মানুষগুলোকে বাচাতে হবে। যাদের হাত পা আটকা তাদের না কেটে তো বাঁচানো যাবেনা। আমাদের আর উপায় নাই, বুঝেছেন?”
অনিলা আমার দিকে নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আমি ওর দিকে তাকাইনা আর। আমার ভেতরে তখন কোন মানবিক অনুভূত কাজ করছিলোনা, আমি তখন শুধু একজন অপরাধী। আমাকে আমার পাপটা ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে।জানি পারবোনা, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।
এভাবে তিন দিন আমার মত আরো অনেক সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় অনেকগুলো মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। হ্যা অনেকগুলো লাশ বহন করে নিতে হয়েছে নিজ কাঁধে।প্রতিবার একটা করে লাশ দেখেছি, চোখ খুলে রাখতে পারিনি অনেকক্ষণ।একটা মাকে দেখলাম হাত দোয়ার ভঙ্গিতে তোলা। শরীরে প্রাণ নেই, চোখ দুটো খোলা। আমি নিশ্চিত তিনি ঠিক মারা যাওয়ার আগেও তার সন্তানের জন্য দোয়া করছিলেন।
পঞ্চম তলার দিকে হঠাৎ একটা ছোট্ট ফাটল দেখতে পেয়ে আমি যখন এগিয়ে যাই তখন দেখি একজন খুব দুর্বল হয়ে হাতটা নাড়ছে। আমি আস্তে আস্তে খুব সতর্কতার সাথে সিমেন্টের গুড়াগুলো তুলে ফেলার চেষ্টা করি। একটু জায়গা হলে যখন হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিলাম তখন ধীরে ধীরে আমার যাওয়ার রাস্তাটা খুব সরু হয়ে উঠছিলো। আমার পিঠের সাথে উপরের ভেঙ্গে পড়া ছাদটার দূরত্ব চার আঙ্গুল থেকে একটুও বেশি ছিলোনা। আমি যখন মানুষটার কাছে পৌঁছিয়ে যাই তখন দেখি তার হাতে রুপার চুরি ঠিক ছোটবেলায় মাকে যেমন একটা চুড়ি পড়ে থাকতে দেখতাম সেরকমটাই। আমি উনার কাছে এগিয়ে গেলে বয়স্ক মহিলাটা বলেন, “আমি কি বাঁচি আছি এখনও?”
আমি আস্তে আস্তে বলি, “আছেন। এবং আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি আপনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আমি খেয়াল করলাম মহিলার একটা পা অনেকটা প্রায় থেঁতলিয়ে গেছে। মহিলার উপরে একটা বীম মাত্র এক মিটার দূরে। যেকোন সময় সেটা ভেঙ্গে পড়তে পারে। ওদিকে আমার চলার রাস্তাটাও খুব সরু। একবার যদি মহিলার হাতটা ধরে টেনে আনা যায় তাহলে পিছনে ক্রল করে হয়তো উনাকে বাহিরে টেনে আনা সম্ভব।এসব যখন ভাবছিলাম তখন উনি বললেন, “আমার ছোট্ট দুইটা বাচ্চা আছে। ওগো নাম বিন্দু আর টুকুন। আমি কলোনীর সাথে বস্তিতে থাকতাম। আমার নাম আসিফা। বাবা তুমি যদি আমারে বাঁচাইতে নাও পারো আমার লাশটা আমার বাড়িত পৌছায় দিও। আমার বাচ্চাগুলারে একটু দেইখো, কাউকে যে কমু সেই উপায়ও নাই। ওগো আমি না দেখলে না খায়া মরবো”।
আমি উনার হাত ধরে বলি, “আপনি কোন কথা বলবেন না। আপনি ইনশাল্লাহ অবশ্যই বেচে ফিরবেন”।
মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার বাচ্চাগুলোরে কেউ খাওন দেওয়ারও নাই। আপনে বাবা এইখান থেকে একটু বলি দেবেন যেন আমার বাচ্চাগুলারে কেউ একটু খাইতে দেয়।আমারে পরে ইহান থি উঠায়েন”।
আমি কিছু না বলে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেই উনার হাত ধরে জোরে টান দিতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। যেই বিমটা উনার একটু উপরে সেটা হয়তো পড়ে যেতে পারে। তারপরো চেষ্টা করতে হবে। আমি আস্তে আস্তে উনাকে বলি, “আপনি এখন হয়তো একটু ব্যাথা পাবেন, ধৈর্য ধরে রাখবেন”।
আমি চোখ বন্ধ করে দোয়া ইউনুস পড়ে আস্তে আস্তে উনার হাত ধরি। আমার পিঠে এখন প্রচন্ড চাপ পড়ছে। যদি একবার উপরের ছাদটা একটু নড়ে উঠে আমিও বেঁচে ফিরতে পারবোনা। অনেক কষ্টে উনার হাতটা শক্ত করে ধরে আমি ভয়ংকর জোরে একটা টান দেই। টান দেয়ার পর আমি বুঝতে পারি আমার পিঠে বিশাল ক্ষত হয়েছে। আমি তবুও সে অবস্থায় আরো জোরে টানতে থাকি। এই মানুষটাকে আমার বাঁচাতে হবে। মহিলা কোন শব্দ করছেনা। আমি ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি আমি একটা নিথর শরীর ধরে আছি। উনার উপরের বিমটা কাপছে, আমি সে অবস্থাতেই উনাকে টেনে আমার খুব কাছে নিয়ে আসি। উনি একসময় হঠাৎ একটু শব্দ করে উঠে বলেন, “বাজান তোমার মায়ে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। নিজের যত্ন নিও”।
আমি ভাঙ্গা ধ্বংসস্তুপের লাল রক্তের আহাজারিতে মায়ের কথা শুনতে পেয়ে সহ্য করতে পারছিলাম না। সারা পিঠ জুড়ে অসহ্য ব্যাথা। আমি জানি আমাকে মা আসিফাকে বাচাতে হবে। আমি জানিনা উনি কেমন করে আমার মায়ের কথা বললেন, আমি জানি একজনা মা আসিফা কে বাঁচালে আমার মায়ের আত্নাটাও অনেক শান্তি পাবেন। প্রায় এক ঘন্টা যুদ্ধ করে যখন বের হলাম তখন আমার সারা দেহ তখন রক্তাক্ত, কিন্তু মুখে অনেক প্রশান্তি। আমি কোন একজনের হাত ধরে বললাম, “দেখেনতো এই মা টা বেচে আছেন কিনা”।
কেউ আমার কথার উত্তর দিলোনা, আমি শুধু চিৎকার শুনলাম। কয়েকজন মিলে আমাকে স্ট্রেচারে তুলে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিলেন। কোন এক সাংবাদিক বোধহয় আমার কাছে এসে জানতে চাচ্ছিলেন, “আপনার অনুভূতি কেমন এভাবে একজনকে বাঁচানোর পর”। পিছন থেকে কেউ একজন ওই সাংবাদিকের মাইক কেড়ে নিয়ে বললেন, “আপনারে ওইহানে পাঠায় তারপর অনুভূতি ঢুকায় দিয়া বুঝাইতেছি দাড়ান”।
আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছালাম তখন আবছাভাবে চারপাশ দেখছিলাম। অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম অনিলা আমার হাত ধরে আছে, আমিও অনিলার হাত ধরে আছে। আমি ওর হাত শক্ত করে ধরলে ও আমার দিকে তাকায় খুব মমতা নিয়ে। আমার সেসময় আর চাওয়ার কিছু ছিলোনা।
এর বহুদিনপর আমি আমার সবুজ গ্রামের ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছিলাম। আমার সাথে আমার নানু। নানুর মুখে অনেক হাসি, কারণ চারপাশে সোনালী ধানের আলো সবার মুখে আলো ভরিয়ে দিয়েছে। আমি নানুকে বলি, “নানু আমি কিন্তু আর শহরে ফিরে যাবোনা”।
নানু হেসে বলে, “এই অজ পাড়াগায়ে থেকে কি করবিরে বাবা”?
আমি হেসে বলি, “এইখানে আমার মায়ের গন্ধ পাই, তার কথা শুনতে পাই। আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা”।
নানু কিছু বলেন না।ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আশেপাশে। উনি হয়তো উনার আদরের মেয়েকে খুঁজছিলেন। নানু কি উনার মেয়েকে অনুভব করতে পারেন আশেপাশে, আমি জানিনা। আমি খুব অদ্ভুত একটা সময়ে মাকে অনুভব করেছি সাভারের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অন্য কোন এক মায়ের হৃদয়ে। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে মা আমার পাশেই সবসময় আছেন। যখনই আমি কোন ভালো কাজ করবো তখন আমার মা পাশ থেকে, কাছ থেকে দেখতে পান।
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে সেই বৃদ্ধ চাচার সাথে দেখা করতে, যিনি দুইবেলা ঠিকমত খেতে না পারলেও দূর থেকে ছুটে আসছিলেন একটা স্যালাইনের প্যাকেট হাতে নিয়ে যদি কারও কাজে লাগে। আমার সেই সব মানুষগুলোকে খুব জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছা করে যাদের কোন দলীয়, সাংগঠনিক পরিচয় ছিলোনা সেই দিনগুলোতে। আমি একটা কথা খুব মন থেকে অনুভব করি, সবার আগে মানুষ সত্য। এই সব সাধারণ মানুষগুলো বা তাদের চিন্তাভাবনাগুলোও ভিন্ন না। তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন শুধু ব্যবহার করেছে এই সেই মতবাদ দিয়ে, দলীয় পরিচয় দিয়ে। এদের বাহিরের আবরণে হয়তো হেফাজত, জাগরণ, শিবির, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ এমন পরিচয়গুলোকে লেপ্টে দিয়েছে। কিন্তু ভেতরে একটা মানুষ ঠিক লুকিয়ে আছে। এই মানুষটাই সেদিনগুলোতে বের হয়ে এসেছিলো, এই মানুষগুলাই সেদিন না খেয়ে, বিশ্রামের ধার না ধেরে রক্ত দিয়ে, অমানবিক পরিশ্রম করে একজন একজন করে আড়াই হাজার মানুষকে উদ্ধার করেছে। আর যারা এমন একটা সময়েও বিল্ডিং নড়াচড়া থিওরী,পাউডার থিওরী দেয় বা তা নিয়ে স্যাটায়ার করে, একে ওকে না চেনার ভান করে অথবা লাখ টাকা দেয়ার লোভ দেখাতে চায় রক্তাক্ত পরিবারগুলোকে তারা এখন যে ঠিক আর মানুষ নেই তাও হয়তো বুঝতে পারি।তবে আমার আর কাউকেই ঘৃণা করতে ইচ্ছা করেনা।কাউকে না। কারণ আমি এখন অনেক ক্লান্ত। চার বছর রাজনীতি নামের যে ভয়ংকর বিষাক্ত সাপটা আমাকে ছোবল দিয়ে গেছে, আমি এখন সেই বিষ থেকে মুক্ত হতে চাই। একটু সবুজ একটা দেশে বাস করতে চাই যেখানে জ্ঞানী গুণী পন্ডিতরা আমাকে এই সেই থিওরী দিয়ে মানুষকে অবিশ্বাস করতে শেখাবেনা, জ্ঞাতে অজ্ঞাতে মানুষে মানুষে বিভাজন করা শেখাবেনা। আমি আমার সেই পুরনো ভালোবাসার দেশটাকে দেখতে চাই, বোকাসোকা হয়ে মানুষকে ভালোবেসে বাঁচতে চাই।
অনিলার সাথে আর কখনো আমার যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনা।প্রায় সময় মনে হয় ও এখনও হয়তো প্রতিটা পহেলা বৈশাখে ফিরোজা রঙ্গে আঁকা নূপুর পরে প্রিয় মানুষের হাতটা ধরে ঘুরে বেড়ায়।আমি আসফাক যখন আমার গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার তীরে বসে থাকি তখন প্রায়ই অনিলার হাসিখুশি পবিত্র মুখটা দেখতে পাই। আমি ভাবতে পারি সে খুব ভালো আছে, ঠিক সেই ভয়ংকর দিনগুলোর মতই এখনো মানুষের জন্য কাঁদে, আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের সুস্থ দেখার জন্য।
মা স্বপ্নে এসে আমাকে প্রায় জিজ্ঞাসা করে, “একা একা এভাবে ভালো আছিস বাবা”। আমি খুব শক্ত করে মায়ের হাত ধরে বলি, “ভালো আছি মা।অনেক ভালো আছি। খুব সাধারণ কিছু মানুষের সাথে সবুজ পৃথিবীতে বেশ ভালো আছি মা। যখন প্রায় সন্ধ্যে হতে চলা বিকেলে সবুজ ঘাসে শুয়ে মাটির ঘ্রাণ নেই আমার মনে হয় আমি তোমার কোলেই আছি। খুব ভালো লাগে মা তখন। মনে হয় এরা সবাই যেন আমাকে অনেক ভালোবাসে”।
আমি আজন্ম এই দ্বিধাহীন, বিভক্তিহীন সবুজ দেশটাকে ভালোবাসতে চাই। রক্তলোভী কুকুরদের মাঝে থেকেও যারা এখনো ভিতরের মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের ভালোবেসে বাঁচতে চাই। বিশ্বাস করুন এই ভালোবাসাটা কখনও শেষ হবেনা।
*****************************************************************
অনেকদিন পর কিছু একটা লিখতে পারলাম বা লিখার চেষ্টা করলাম। যা মনে হয়েছে ঠিক তাই লিখতে পেরেছি বলে মনে করি। এত বড় একটা দুর্ঘটনার জন্য নিজেকেও কেন যেন খুব দোষী মনে হয়। মনে আছে ২৪শে এপ্রিল অফিস থেকে বের হয়ে বারবার সাভার বাজার যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সারা রাস্তায় তখন একটা থমথমে পরিবেশ। যখন অফিস থেকে বের হলাম সামনে পিছনে সব রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর আতংক।
আমি খুব শ্রদ্ধা করি সেই সব বাঁধনদের, বাবুদের যারা এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এতগুলো মানুষকে উদ্ধার করেছেন। সবার এত বড় হৃদয় থাকেনা ভাই। এই গল্পটা তাদের জন্য একটা শ্রদ্ধা। এই গল্পটা তাদের জন্য একটা ভালোবাসা যারা নিজের বাহিরের পরিচয়টাকে ফেলে দিয়ে সাভারে নাওয়া খাওয়া ফেলে ছুটে গিয়েছেন। পরম করুণাময়ের কাছে তাদের সর্বপ্রকার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি।
এই গল্পটা আরেকটা মানুষকে উৎসর্গ করি। আমার মা কে। “ভালবাসার গল্প” নামে একটি ফেসবুক পরিবারের উদ্যোগে ২০১২ সালে একটা বই প্রকাশ পায় যেখানে আমার একটা গল্পকে অনাকাংখিত সম্মান দিয়ে জায়গা দেয়া হয়েছিলো।আমি বইটার একটা কপি খুব লজ্জা নিয়ে কিনি। আমার মা সেই বইটায় আমার লেখা গল্পটা পড়ে বলেন, “আমার ছেলেটা কত ভালো গল্প লেখে”। এরপর সেই বই আমাকে আর ধরতে দেয়া হয়নি, মা সিন্দুকে আগলে রাখেন।যেই বাসায় আসে তাকেই আমার গল্পটা পড়তে দেয়। বলে, “দেখ আমার ছেলে লিখছে”। চোখে মুখে কি গর্ব, আমি লজ্জা পেতাম, দু একদিন মাকে বকাও দিয়েছি। ভালবাসার গল্প দ্বিতীয়বার আমাকে সম্মান দেয় এই বছর আবারো অনাকাংখিত ভাবে। মাকে আমি বইটা দেখাতে পারিনি। কিন্তু আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমার মা এখনও আকাশের ওপার থেকে আমার এই লেখাগুলো পড়েন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পড়েন।হয়তো বলেন, “এইটা আমার ছেলের লেখা”। আমার মার মত করে কেউ আমার লেখাকে ভালোবাসেনি, তাই আমার জীবনের সব গল্প মাকে উৎসর্গ করছি।আম্মু যেখানেই থাকো অনেক ভালো থাকো। আল্লাহ তোমাকে অনেক ভালো রাখুক।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৫৪