দিনটি ছিল আমার শেষদিন। হ্যা আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার ১৭ বছরের জীবনের শ্রেষ্ট ১২ বছরের মেয়াদ আজ শেষ হচ্ছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে আমার শেষ দিন। সেদিন ছিল আমার কলেজের ফেয়ারওয়েল। এর পর আমার নারি কেটে দেয়া হবে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে রূঢ় পৃথিবীর বুকে। আমি আর এই সুন্দর ক্যাম্পাসে আমার আকাশি নীল জামাটা পরতে পারব না, নরম ঘাসগুলোকে প্রচন্ড অত্যাচার করে আমি জুনিয়ার থেকে সিনিয়ারে ভোওওওওওও দৌড় দিতে পারব না। কোন সুভাষ স্যার আমার কানটা মলে বলবে না, "এই তুই এত লাফালাফি করছিস কেন? তোর ক্লাস নাই? ও আচ্ছা তুই চ্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন) নাকি?"
সেদিন আমার গায়ে সেদিন আকাশি জামাটা ছিল না। আমার মেয়াদ শেষ, আমি একটা আকাশি সাদা মিশেল শাড়ী পরেছিলাম। বন্ধুরা সবাই আমার মত আবেগে বিভ্রান্ত। কেউ হাসছে আবার কেউ অকারণের কাঁদছে। অডিটোরিয়ামের শব্দসীমা নির্ধারন করা আছে এর বেশি কথা বললে ফ্যান অফ করে শাস্তি দেয়া হয়, এই নিয়মের ধারও কেউ ধারছে না। অনুষ্ঠান শুরু হবার পরও মেয়েদের বকবক কান্নাকাটি চলছে, টিচাররা এর মাঝেই কথা শুরু করলেন। একজন টিচার উঠে খুব অদ্ভুত একটা কথা বললেন, "মেয়েরা তোমাদের বেশি কথা বলতে চাই না, শুধু দোয়া করি তোমরা যেন পাতিহাঁসের মত হও"
এমন অদ্ভুত আশির্বাদ পেয়ে নড়েচড়ে বসল প্রতিটা মেয়ে, অডিটোরিয়ামে নেমে এলো পিন পতন নিরবতা। সবাই জানতে চায়, এই আপা কেন আমাদের এমন অদ্ভুত দোয়া করছেন?
আপা কথা শুরু করলেন. আমরা বরং কথাগুলো আপার জবানীতে শুনি।
গত বছর আমি একটা ট্রেনিং এ গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মত আরও অনেক টিচার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। এর মাধ্যে দেখলাম একটা লোক খুব গায়ে পরে কথা বলতে আসে। একটু পরপরই আপা আপা করে ছুটে আসে। খাতিরের অতিশয়তায় আমি একটু বিরক্ত। এর মাঝে সে আমাকে জানিয়ে গেল আপা আপনার কলেজের তো রেজাল্ট সবচে ভাল কিন্তু আমাদের কলেজের রেজাল্ট আপনাদের চেয়েও ভাল। এবার আমি একটু ভাল করে লক্ষ্য করলাম লোকটাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল এবং জিজ্ঞেস করলাম, "কিভাবে?" তিনি জবাব দিলেন, "আপা গতবছর আমার কলেজে পাশের হার ১০০% আপনাদের কিন্তু ১০০% পাশ করে নাই। কথাটায় আমি খানিকটা দমে গেলাম, কারণ কথাটা আংশিক সত্য।"
গতবার একটা মেয়ে পরীক্ষা চলাকালে অসুস্থ হয়ে পরে তাই পরীক্ষা দিতে পারে নাই আরেকজনের সম্ভবত বাবা মারা গিয়েছিলেন বা এমন কিছু। অনেক মেয়ের মধ্যে প্রতিবারই কেউ না কেউ পরীক্ষা না দিতে পারার কারণে টোটাল রেজাল্টের শতকরা ১০০% হয় না। অনেক মেয়ের মধ্যে ব্যাপারটা হতেই পারে কিন্তু এই কথাটা ভদ্রলোককে বুঝানো বেশ দায়। তাই আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম, "আমার মেয়েরা পাতিহাঁসের মত।"
এর পর ভদ্রলোক বেশ পিছেই পরে গেলেন পাতিহাঁসের মত কথার মানে কি জানারা জন্য। বারবারই শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করে আর আমি এড়িয়ে যাই। একদম শেষের দিন চলে আসব এমন সময় লোকটা বলল, "আপা বললেন না কিন্তু পাতিহাঁসের মত মানে কি!!"
আমি বললাম, "শুনুন, পাতিহাঁসত তো দেখেছেন, কি সুন্দর তা গড়ন, তার গায়ে আলো পরলে দ্যুতি ঠিকরে বের হয়, পাতিহাঁস পানিতে সামুক গুগলির মত নোংরা জিনিশ খায় তবু তার গায়ে কোনদিন ময়লা লেগে থাকে না। পানিতে তার চলন কেমন রানীর মত। পানিকে খুব না নাড়িয়ে কি সুন্দর সে পানি কেটে বের হয়?"
লোকটা খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল "হ্যা" আমি বলেই গেলাম, "আপনি তো জানেনই খাদ্য হিসাবেও পাতিহাঁস অনেক সুস্বাদু কিন্তু এটা কি জানেন পাতিহাঁস দুধে মুখ দেয়া মাত্র সেটা ছানা হয়ে যায় আর সে সেই ছানাটা খেয়ে সে চলে আসে? পানিটুকু পরে থাকে? আমার মেয়েরা হচ্ছে পাতিহাঁসের মত। তারা অনেক কিছুই পায় অনেক কিছুই পায় না কিন্তু তারা চালনে বলনে কাজে কর্মে অনেকের চেয়ে অনেক দক্ষ। তারা সবকিছু থেকে সারটুকু নিতে জানে আর সব কিছুর পরও তারা শ্রেষ্ট।"
সেদিন লোকটা আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে, সবাই বলত আপনাদের মেয়েরা অনেক জানে এখন জানলাম তাদের মায়েরাও অনেক জানে। এই কথাটা আমাকে অনেক গর্বিত করেছিল।
মেয়েরা আমি তোমাদের দোয়া করছি তোমারা পাতিহাঁসের মত হও।
এই শিক্ষিকার নাম মঞ্জুআরা আপা। উনি ক্লাস টেনে আমাদের ইতিহাস পরাতেন। সাইন্সের মেয়েদের জন্য ইতিহাস খুব বিরক্তিকর সাবজেক্ট কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত আপার ইতিহাস শুনতে। আপা শুধু বইয়ে লেখা ইতিহাস বলতেন না। আমাদের বইয়ে ৬ দফা দাবীর কথা বলা ছিল বলা ছিল না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তারিত বিবরণ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা বলা ছিল বলা ছিল না আলীবর্দিখানের বাকি ২ কন্যার বিদ্রোহের কারণ। ভাষা আন্দোলনের কথা বলা ছিল বলা ছিল না বাঙ্গালীর আরও কিছু প্রাণের দাবীর কথা। বলা ছিল না বঙ্গোবন্ধুকে প্রতিটি পদে পদে কি পরিমান সংগ্রামের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। বলা ছিল না বঙ্গোবন্ধু বাস্তবিক অর্থে একজন "মানুষ" ছিলেন তখনকার রাজনীতিবীদের মত তথাকথিত "এলিট" ছিলেন না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের জন্য বহিস্কৃত হয়েছিলেন তবু কোনদিন তুচ্ছ কোন অন্যায়কে মেনে নেননি।
আপা আজকে আপনার দিন। ৩ মাসের জন্য সেই কন্টকের সিংহাসনে আজকে আপনাকে বসানো হয়েছে। আপা, বলুন আপনি পারবেন পাতিহাঁসদের মা হতে। আপনি আপনার গায়ে কোন কাদা লাগতে দিবেন না। আপনার দেহ থেকে দ্যুতি ঠিকরে পরবে, আপনার চলনও হবে রানীর মত। পরিসীম মিথ্যাচার সত্ত্বেও মানুষ আপনার মেয়েদের প্রশংসায় মুখর। বলুন আপা আপনি আমাদের মা এটি আপনি দেখিয়ে দিবেন।
আমরা আশায় বুক বেধেছি আপা। আবার আকাশি সাদা রঙের বলাকারা সাফল্যের তুঙ্গে অবস্থান নিবে আবার সবাই বলবে "হ্যা ওরা দেখিয়ে দিয়েছে ওরা শ্রেষ্ঠা" আমরাও আপনার গর্বিত সন্তান হতে চাই।