[[এই লেখাটা এমন একটা লেখা, যেটা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে এমন একটা কিছু আমিও তো লিখতে পারতাম! কিন্তু আমার লেখা হয়নি। আমি সবসময়েই শুধু মনে হওয়াতেই আটকে ছিলাম এবং আছি। কিন্তু কিশোর ভাই তো আর শুধু "মনে হওয়াতে" আটকে থাকতে পারেন না! আর তাছাড়া একজন কার্টুনিস্টের জন্য এমন একটা লেখা আরেকজন কার্টুনিস্টই লিখবেন, এর চেয়ে শুদ্ধ বিচার আর কি হতে পারতো? সামুতে লেখার উপায় নেই বলে কিশোর ভাই আমার মাধ্যমে লেখাটা ব্লগে পাবলিশ করতে চাইলেন। এই সুযোগে, আমার লেখা না হলেও এই লেখার দায় আমি এড়াতে চাইলাম না।]]
“They have exiled me now from their society and I am pleased, because humanity does not exile except the one whose noble spirit rebels against despotism and oppression. He who does not prefer exile to slavery is not free by any measure of freedom, truth and duty.”
তোমাদের সমাজ আমাকে তাড়িয়েছে বলে
ভেবেছো যে মানবতাকেও তোমরা বিতাড়িত করেছো?
আমার বিদ্রোহী চিত্ত মানবতার মতো নি:শঙ্ক জেনো
আমি তাই যাবো অন্য কোথাও,বাঁচবো মাথা উঁচু করে
যেভাবে বেঁচে থাকে স্বাধীনতা, সত্য, কর্তব্য।
কহলিল জিবরান
লেবানিজ কবি-চিত্রশিল্পী-লেখক, ১৮৮৩-১৯৩১
দেশ ছাড়ার কষ্ট কেমন? বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কি আরো তীব্র?
প্রিয় মাতৃভূমি, ঘরে বাবা(?) পরিত্যক্ত মা, একমাত্র ছোট বোন, বোনের ছোট্ট আদুরে মেয়েটা, শাহজাদপুর সুমী আইসক্রীম ফ্যাক্টরীর পাশের ধুলো উড়ানো রাস্তা, সেটা ছুঁয়ে যাওয়া ধান ক্ষেত, অগ্রহায়ণে বাতাসে ভেসে বেড়ানো আমন ধানের গন্ধ, অপরাহ্নের মিষ্টি রোদ, মামার বাসার টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, গলুইতে বাসা বানানো চড়ুই পাখিদের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নেচে বেড়ানো, ভোর সকালে তেজপাতা জ্বালে ধোঁয়া ওঠা লাল চা সাথে লালচে ছোট মুড়ি দিয়ে নাস্তা করে বাজারে যাওয়া, বৌমা(বড় মামী)র কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘুনে ধরা জানালা গলিয়ে আসা আলোতে পড়তে বসা, দুপুরে গোয়ালের গরুগুলোকে বিচালী খাওয়াতে যেয়ে তাদের অদ্ভুত ডাগর চোখে বধির ভালোবাসার প্রকাশে আপ্লুত হওয়া, কেইস্তা পাতা দিয়ে সবুজ রঙ, সন্ধা মালতীর লালচে গোলাপী দিয়ে লাল রঙে কাঠিতে কাপড় পেচিয়ে ছবি আঁকা, পঁচিশে বৈশাখের জন্য অপেক্ষা, রবীন্দ্রনাথের জন্ম জয়ন্তীতে শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে তিন দিনের সেই মেলায়, পলিথিন কাগজে মুড়ে, কাঠ দিয়ে আটকে আরিফ তার শিল্পসম্ভার নিয়ে হাজির হতো, সেখানে, তার আশেপাশে ছোট ছোট ভাইবোনেরা ঘিরে থাকতো তাকে...
দুপুরে মায়ের হাতে কেবল লাল শাকে মাখানো অমৃত গরম ভাত আর সন্ধ্যায় শাহজাদপুর বাজারে জীবনের কোলাহল দেখে বাসায় ফিরে একটি বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে মামাতো ভাই বোনদের সাথে নিয়ে পড়তে বসা তারপর বিছানার ছেড়া চাদরে গা এলিয়ে ছাড়পোকার কামড়ে আগামীর ভোরের জন্য অপেক্ষা! আহা, আরিফের একটা কার্টুনের বিনিময়ে এসবকিছু কেড়ে নিলে তুমি, হে সমাজ? হে দেশ?
আঁকতে পারার সহজাত গুণের জন্য আরিফের বাড়তি একটা কদর ছিল। মামার বাড়িতে আশ্রিত আরিফ সেই আঁকিবুকির জন্য ছোট ছোট ভাই বোনদের কাছে জনপ্রিয়ও ছিলো অনেক আর যখন ২০০৪ সালে তার আঁকা কার্টুন দেশের নামকরা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হলো তখনতো স্কুলের মাস্টার তাকে দেখতে বাড়ি চলে এলো! সেটা একটা দিন! অন্য রকম এক বিজয়ের দিন! তারপর একে একে কতো কি! টি আই বি এর মতো দেশখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বিরোধী কার্টুন আঁকা প্রতিযোগীতায় হাজার হাজার আঁকিয়েকে পেছনে ফেলে মফস্বলের কিশোর আরিফ জিতে নিলো হাজার টাকা দামের পুরস্কার। চিত্রকলায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়াই কার্টুন এঁকে খ্যাতি ছিনিয়ে নিলো সুমী আইসক্রীম ফ্যাক্টরীর আরিফুর রহমান। এই তালিকায় আছে ২০০৬ ও ২০০৮ এ টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) আয়োজিত দুর্নীতি বিরোধী কার্টুন প্রতিযোগীতায় গ্রুপ বি তে তৃতীয়, ২০০৭ এ জাতীয় ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টার আয়োজিত দুর্নীতি বিরোধী কার্টুন প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অর্জন। এমন সব প্রাপ্তি আরিফকে স্বপ্ন দেখালো নতুন এক জীবনের, ২০০৬ এ সে ঢাকায় চলে এলো, উত্তরায় এক আত্মীয়ের মুদি দোকানে কাজ শুরু করলো আর তার পাশে চলতো থাকলো জাতীয় দৈনিকে কার্টুন প্রকাশ, বাড়ি থেকে মমতাময়ী নিরক্ষর মা ফোন করে অনুপ্রেরণা জাগাতো-বাপ,কার্টুন আঁকা ছেড়োনা!
না, আরিফ কার্টুন আঁকা ছাড়েনি। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ধর্ম অবমাননার দায়ে ছয় মাস জেল খেটেও সে তা ছাড়েনি, সে ছাড়বেনা। ২০০৭ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের বিদ্রুপ সাপ্তাহিকীতে ছাপা হওয়া তার একটি গ্যাগ কার্টুন নিয়ে দেশব্যাপী কাঠ মোল্লারা গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে, ইন্ধন দেয় একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা। গ্রাম দেশে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় কৌতুককে বক্তব্য করে আঁকা কার্টুন নিয়ে মসজিদে মসজিদে প্রচারণা শুরু হয়, চলে জ্বালাও পোড়াও। প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের ততোধিক প্রভাবশালী সম্পাদককে হাটু গেড়ে ক্ষমা চাইতে হয় মৌলবাদী ধর্মীয় নেতার কাছে। মফস্বলের সদ্য কৈশোর পেরোনো আরিফ অসহায় হয়ে দেখে-এই দেশ, দেশের কিছু মৌলবাদী মানুষ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের কুৎসিত কুটিলতা। সে ভেবে পায়না কি দোষে, কি কারনে তাকে জেলে যেতে হবে,তার ছাপা হওয়া কার্টুনটিতো দৈনিকের ওই সাপ্তাহিকীর বিভাগীয় সম্পাদক, ফিচার সম্পাদক আর সম্পাদক সবার অনুমোদন পাবার পরই ছাপা হয়েছে আর কেন সব দোষ তাকেই বইতে হবে, সে তো সামান্য প্রদায়ক কার্টুনিষ্ট, তার আঁকা কার্টুন ছাপা হলে তার বিনিময়ে সে কিছু টাকা পায়, কিন্তু কেন তাকে দেশদ্রোহী কিংবা ধর্ম অবমাননার জন্য জেলে যেতে হবে, কেন তাকে ডিটেনশন দেয়া হবে, কেন তাকে জেল খানায় জে এম বি সদস্যেরা লাঠি দিয়ে পেটাবে, মুখে ঢুকিয়ে দেবে মানুষের মল... কেন তার একার বিরুদ্ধে অভিযোগ...কেন?
জেল খানায় তার স্থান হয়েছিলো যে ভবনে(ছয় সেলে) সেখানে সে সময়কার তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র অন্দোলনে ইন্ধন দেবার অভিযোগে অন্তরীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চার শিক্ষক সহ এখনকার বিরোধীদলের নেত্রীর ছেলে কোকো, আরিফকে যিনি বলেছিলেন এসব ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে দূরে থাকতে! জেএমবি সদস্যেরা কোকোর গা হাত পা টিপে দেবার সময় তিনি আরিফকে হাদিস পড়ে শোনাতেন আর বলতেন-খবরদার এসব কুফরি কাজ করোনা! ঢাবি এর শিক্ষক ড. মো. আনোয়ার হোসেনই একমাত্র ব্যক্তি যিনি জলের ভেতরে আরিফকে কার্টুন আঁকার জন্য খাতার ব্যবস্থা করেছেন, কলম দিয়েছেন। আরিফ এর ভাষায়- খাঁচায় বন্দি পাখিকে মানুষ যেভাবে সেবা দিতে পারে স্যার আমাকে সেইভাবে ভালোবেসেছেন। তিনি একজন তুলনাহীন হৃদয়ের মানুষ।
২০০৭ এর সেইসময়কার তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেন পদত্যাগ করলে যাবতীয় অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি দিয়ে আরিফকে মুক্তি দেয়া হয়। সদ্য মুক্তি পাওয়া আরিফ অদ্ভুত এক ঘটনায় বিমুঢ় হয়ে যায় যখন সে দেখে তার কার্টুন ছাপানো প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক এর সাপ্তাহিকীর চাকরিচ্যুত বিভাগীয় সম্পাদক, মইনুলের হোসেন এর পত্রিকায় যোগ দেন! আরিফ বুঝতে পারেনা কিছু, কেবল মাঝে মাঝে মনের মধ্যে হারানো ছয়টা মাস গুমড়ে ওঠে। ২০ শে মার্চ মুক্তি পাওয়ার পর সে আরো জানতে পারে শাহজাদপুরে প্রচলিত যে কৌতুকটিকে বিষয়বস্তু করে সে কার্টুন এঁকেছিলো তা ঔ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব কারী ছাত্র শিবির এর একটি মাসিক পত্রিকা কিশোরকন্ঠ এর ১৯৯৮ এর নভেম্বর সংখ্যায় ফেনীর এক মাদ্রাসা ছাত্রের বরাতে প্রকাশিত হয়েছিলো। আরিফ ভেবে পায়না কেন এটা জেনেও এইসব পত্রিকা তা জানায়নি দেশের মানুষকে, কেন, কেন ঔ মাদ্রাসা ছাত্রের বিচার হবেনা, উল্টো মুক্তি পাবার পর জেলা শহরগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে দু’এক ধর্মান্ধ মৌলবাদীর দায়ের করা মামলার শুনানিতে পথে বসার উপক্রম হয় তার। যশোর স্থানীয় আদালতে দায়ের করা মামলায় আসামী হিসেবে আরেক প্রভাবশালী সম্পাদক পার পেয়ে যান কিন্তু আরিফের মুক্তি মেলেনা...
কিন্তু ভালো আর মন্দের দন্দ্বে চিরকালীন ধ্রুব সত্যের মতো যেমন সত্য জয়ী হয় তেমনি অসহায় এক নিরপরাধ কার্টুনিস্ট এর পাশে সত্যান্বেষী মানুষেরা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকেন। একবিশ্ব ধারনায় অন্তর্জালের যোগাযোগে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের মানুষ জেনে যান আরিফুরের কষ্টের কথা। যে যেমনভাবে পারেন সাহায্য করবার জন্য লড়াই শুরু করেন। মানুষের স্বাধীনতা, সত্যের প্রকাশ আর ভালো কাজের জয় হিসেবে আরিফ বিজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন। নিউজপ্রিন্টের শ্যামলা কাগজে সাদা হয়ে প্রকাশিত হয় সত্য, ব্লগে ব্লগে শ্লোগান ওঠে তার মুক্তির, কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান ড.রবার্ট রাসেল বিশ্বের স্বাধীন সাংবাদিকতায় নিবেদিত জনপ্রিয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান রিপোটার্স স্যান ফ্রন্টিয়ার্সের মাধ্যমে গড়ে তোলেন জনমত। আরিফের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অনেকেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি পরিবার আরিফকে এমনকি নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে। নরওয়ের এমনই একটি পরিবার আরিফের ভবিষ্যতের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তার জন্য সেদেশের সরকারের কাছে আবেদন করে। আরিফের আইনগত যাবতীয় বিধিনিষেধ এর সঠিক মূল্যায়ন শেষে আইনজীবির ছাড়পত্রে আরিফ গত ৩০ শে নভেম্বর সকাল সাতটায় নরওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তার জন্য আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার দেশীয় প্রতিনিধিরা একনিষ্ঠ পরিশ্রমে বহির্গমণ সংক্রান্ত যাবতীয় দ্বায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে কৃতজ্ঞতার এক মহান দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন।
যাবার সময় আরিফ কাঁদেনি। তাকে কেবল একবারই কিডনী রোগে অসুস্থ মায়ের পাশে কাঁদতে দেখেছিলাম। কিন্তু আমি তাকে কাঁদাতে চেয়েছিলাম, আমি চাইছিলাম সে চিৎকার করে কেঁদে উঠুক এই দেশ মায়ের জন্য। সে পোপ সপ্তমের মতো বলে উঠুক- I have loved justice and hated iniquity: therefore I die in exile কিন্তু আরিফ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেছে-ভাইয়া আমি ফিরে আসবো, এই মা, মাটি আমাকে বড় করেছে, তার ঋণ শুধতে আমি ফিরবোই, আমাকে ফিরতে হবে, দেশ দেশ করে যারা কি হবে বলে বিজ্ঞাপন দেয়, তাদের জন্য সত্যিকারের মায়ের ভালোবাসার উদাহরণ হয়ে আমি ফিরবো।
আরিফ ফিরবেই। কিন্তু বদলে যাবার কথা বলে যারা বদলায়না,তারা বদলাবে কবে,তা কি কেউ জানেন?
কিশোর
কার্টুনিস্ট রাইটস্ নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ
এই লেখাটি তৈরী করতে সাহায্য করেছেন যারা তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি, বিশেষ করে অমি রহমান পিয়াল, সালীম সামাদ, মাসুদা ভাট্টি, ডা.আবুল হাসনাত মিল্টন,আসিফ এন্তাজ রবি, ইশতিয়াক আহমেদ, রাব্বী, মাহমুদুল হাসান রুবেল, সুজন চৌধুরী, সন্দীপন বসু মুন্না, রনক ইকরাম, মাহবুব মুন্না, ফাতেমা আবেদীন নাজলা, শিমন, কার্টুনিস্ট রকি আর প্রিয় রেজাউল করিম। আপনাদের কাছে আমার আজন্ম ঋণ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:৩৩