আলম সাহেব কাজ তেমন পারেননা বলা যায়। শুধু সয়েল টেস্টের কোম্পানীটা চালান বলেই সেটার ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি। নইলে আর কোথাও তিনি কাজই পেতেন কিনা, সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। মানুষ হিসেবে প্রথাগত মতে সৎ বলেই বোধহয় তার কোম্পানী কাজ পায়। কিন্তু প্রথাগত সততা আমাকে টানে না। একটা চোর নিজেকে চোর বলে স্বীকার করলেও আমি তাকে সৎ বলি। চোর বলে অসৎ বলি না। নিজেকে চেনানোর বিরল এই সাহস সবার থাকে না। সেই সাহসও আলম সাহেবের আছে বলে মনে হয় না। তিনি নিজেকে জিওটেক স্পেশালিস্ট দাবি করেন বলেই জানি। আর এও জানি, তিনি তা নন! সাধারণত এধরনের মানুষ আমার মনে ঘৃণারই উদ্রেক করে। কিন্তু আলম সাহেবের ক্ষেত্রে তেমনটা হচ্ছে না।
কেন?
বয়েসটা যে তার সত্তুরের দশকে রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। পুরাতাত্ত্বীক নিদর্শনের মত ভেঙে পড়া শরীরটার দিকে তাকালে এখনও বোঝা যায়, তারও একটা সময় ছিল। চওড়া দু'টো কাঁধের একটা একটু বেশিই ঝুলে পড়েছে, হয়তো অনেক বেশি ভার বইতে হয়েছে ওটাকে! তবুও কেন যেন মনে হয় আমাকে একটা ঘুসিতে কাত করে দেবার ক্ষমতা রয়েছে তার বাঁ হাতেরও! চশমা লাগেনা, কিন্তু তবুও তার দূর্বলতা তার চোখেই। দীর্ঘ-একঘেয়ে-অসফল জীবনের ক্লান্তি, বিষণ্ণতা হয়ে বেরিয়ে আসে তার ঘোলা চোখের দৃষ্টি বেয়ে। অন্যের কাছে অস্তিত্বের আর্জি রয়েছে, কিন্তু লড়াইয়ের হুমকি নেই ওতে। আর মাত্র ক'টাদিন টিকে থাকার জন্য মাথাপেতে নিতে পারেন রাজ্যের অভিযোগ শুধু অনুল্লেখযোগ্য অর্থের যোগানের বিনিময়ে।
ভুল-ভাল সয়েল রিপোর্টের জন্য কখনও কখনও মনে হয় দু'চারটা কথা শুনিয়ে দেই। আমার সহকর্মীরা হর-হামেশাই শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি লড়াইয়ে নামার আগেই কুপোকাত এই মানুষটার সাথে লাগতে পারি না। আমার সমস্ত ক্ষোভ জমা থাকে অন্য কোন সময়ে অন্যকারও কাছে গল্পের মত করে অনুযোগ করার জন্য; এখন যেমন করছি।
হয়তো একটা সময়ে তিনিও আমার মতকরেই বা তারও বেশি ঔদ্ধত্যে হারিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে! হয়তো তার ভয়ে থরো থরো কেঁপেছে অনেকে! হয়তো একসময় তার পরিধীর ভেতর তারই ছিল একাধিপত্য! কিন্তু আজ সবই অতীত! তার শাসনের পরিধীরেখা সময়ের জলে ধুয়ে হারিয়ে গেছে। রেখে গেছে তার ব্যর্থ মূর্তিকে।
তার বিবর্ণ ব্যর্থতার রং আমাকে স্থির করে দেয়। আমি রাগতে চাই, রাগতে পারি না। ঝাড়তে চাই, কিন্তু মুখে কোন কড়া কথা আসে না। তার কালো চামড়ায় লেগে থাকা অগনিত ঘামের ফোঁটা আমার দৃষ্টির আগুনকে নিভিয়ে দেয়। আমি কেন যেন নিরুপায় বোধ করতে থাকি! অনেক কষ্টে বলি, "আলম সাহেব! কাইন্ডলী রিপোর্টটা রি-চেক করে দিন না!"
--"হ্যাঁ! হ্যাঁ! দেব! সব ঠিক করে দেব স্যার! আপনি কোন চিন্তা করবেন না!....................."
ভারাক্লান্ত ভারি দেহটা যখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে থাকে, আমি চওড়া পিঠটার দিকে তাকিয়ে ভাবি, তবে ব্যর্থতারও কি কোন শক্তি রয়েছে?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪৮